সোমবার, ৩ জুলাই, ২০১৭

পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড় ধসের দায় কি বাঙালি বসতিদের?


প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ বাংলাদেশ। এদেশে অতিবর্ষণে প্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্র জনগোষ্ঠী। তবে গত ১১-১৩ জুন ২০১৭-তে ভারি বর্ষণের সময় বৃহত্তর চট্টগ্রাম, অর্থাৎ চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি এবং কক্সবাজারে দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণহানী ঘটেছে। ওই ঘটনায় ৫ জন সেনা কর্মকর্তাও মারা গেছেন। যারা সাহসের সঙ্গে দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে অকালে ঝরে যান মাটিচাপা পড়ে। বৃহত্তর চট্টগ্রামে পাহাড় ধসের করণে প্রাণহানির ঘটনা একবারে নতুন না হলেও এ বছরের পাহাড় ধসজনিত বিপর্যয় ইতোপূর্বেও সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের মধ্যে নিঃসন্দেহে রাঙামাটিতে এ বছর প্রাণহানী ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। মর্মান্তিক মানবিক বিপর্যয়ের এই বিষয়টি সামনে রেখে বর্তমানে বেসরকারি টেলিভিশনে টক-শো সমূহে বক্তাদের বক্তব্য, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্বার্থান্বেষী মহলের অযাচিত মন্তব্য এবং বিভিন্ন প্রথম শ্রেণির দৈনিক পত্রিকাগুলোর রিপোর্টগুলোতে আপাতদৃষ্টিতে সাম্প্রতিক পাহাড় ধসের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দায়ী করা হচ্ছে। গত ১৬ জুন ২০১৭ তারিখে প্রথম আলো পত্রিকায় ‘ছয় বছরে নিহতদের ৬৪ ভাগ বাঙালি’ শিরোনামের একটি কলামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, বন ও পাহাড় কেটে যত্রতত্র বাঙালি পুনর্বাসন করা হয়েছে। অধ্যাপক আখতার পার্বত্য অঞ্চলের এই বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে যথেষ্ট গবেষণা করে উপরোল্লেখিত মন্তব্য করেছেন কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগলিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিষয়টি একেবারে সরলীকরণ করে পক্ষপাতমূলকভাবে কোনো একটি জনগোষ্ঠীর উপর দোষ চাপিয়ে দেওয়া সম্পূর্ণ অবিবেচনা প্রসূত।
সাম্প্রতিক বছরগুলোর কথা যদি বিবেচনায় আনা হয়, তাহলে দেখা যায় যে, ২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামের ৭টি স্থানে পাহাড় ধসের কারণে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়, ২০০৮ সালের ১৮ চট্টগ্রামের লালখান বাজার মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড় ধসে ৪ পরিবারের ১২ জনের মৃত্য হয়, ২০১১ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রামের টাইগারপাস এলাকায় বাটালি হিলের ঢালে পাহাড় ও প্রতিরক্ষা দেওয়াল ধসে ১৭ জনের মৃত্যু হয়, ২০১২ সালের ২৬-২৭ জুন চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজার ও সিলেটে ৯৪ জন মৃত্যুবরণ করে। এছাড়া ২০১৫ সালের ২৬-২৭ জুন টানা বর্ষণ, ধস আর পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারে ১৯ জনের মৃত্যুর বিষয়ও এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোর পাহাড় ধসজনিত এই প্রাণহানির বিষয় বিশ্লেষণে অনুমান করা যায় যে, পাহাড় ধসের ভৌগোলিক বিপর্যয় শুধুমাত্র পার্বত্য জেলাগুলোতে নয়, পাহাড় পরিবেষ্টিত বৃহত্তর চট্টগ্রামের অধিকাংশ স্থানেই ঘটেছে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় ভৌগোলিক দিক দিয়ে কিছুটা ভিন্ন। এখানে সমতল ভূমির পাশাপাশি উঁচু-নিচু, ছোট-বড় অনেক পাহাড় বা টিলা রয়েছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো সাধারণত মাটি এবং বালু মিশ্রিত, এ সকল পাহাড়ের মাটি এটেল মাটির মতো আঠালো নয়। এ অঞ্চলের পাহাড়গুলো সাধারণত পৃথিবীর অন্যান্য কিছু কিছু অঞ্চলের পাহাড়গুলোর মতো পাথর পরিবেষ্টিত নয়। এই পাহাড়গুলোর মাটি কোনো নির্দিষ্ট শক্ত অবলম্বনের অনুপস্থিতিতে ভারি বর্ষণের ফলে সহজে ধসে পড়ে। এখানে সহায়ক অবলম্বন বলতে ব্যাপক বনায়নই গ্রহণযোগ্য সমাধান।

 কিন্তু যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিকতার ছোঁয়া পার্বত্য চট্টগ্রামের পড়েছে। অনেক বছর আগে সাধারণত পাহাড়ের গ্রাম অঞ্চলে ‘সনাতনী উপজাতী বন ও কৃষি সভ্যতার’ ঐতিহ্যবাহী লোকজ শিক্ষা থেকে ডধঃবৎংযবফ গধহধমবসবহঃ ও পরিবেশ সংরক্ষণের কলাকৌশল অনুসরণ করে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী তাদের ঘরবাড়ি তৈরি করত। এ বিষয় অনস্বীকার্য যে এ ধরনের লোকজ জ্ঞানকেই ১৯৯২ সালে প্রথম বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলনে ‘ঞৎধফরঃরড়হধষ ঝপরবহঃরভরপ কহড়ষিবফমব’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। অনেক আগের সেই সময়গুলোতে এই সনাতনী ধারা অবলম্বন করেই পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরা পাহাড়ের মাটি না কেটে খুঁটির ওপর ‘টং ঘর’ তুলত। এছাড়া তাদের ধর্মীয় একটি সংস্কার ছিল সেই সময়গুলোতে। প্রয়াস বিশিষ্ট উপজাতি গবেষক ও লেখক অমরেন্দ্র লাল খীসার গবেষণাপত্র থেকে জানা যায় অধিকাংশ গোত্রের উপজাতিরা ‘ধরিত্রীকে আঘাত করে মাটি কর্ষণ করাকে পাপ মনে করত’। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উপজাতিদের জীবনে আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষা, বাসস্থান ও পোশাক পরিচ্ছেদে আমূল পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকাতেও উপজাতি যুবক যুবতীদের জিন্স, টি-শার্টেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে দেখা যায়। এখানে আরও একটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে পার্বত্য এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। অনেক আগে দুর্গম পাহাড় এবং প্রত্যন্ত এলাকায় যখন কোনো রাস্তা-ঘাট ছিল না, পাহাড়িরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ভালো মূল্য পেত না। সাম্প্রতিক কয়েক দশকের ক্রম উন্নয়নের অন্যতম হচ্ছে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় রাস্তা-ঘাট তৈরি। বর্তমান সময়ে প্রত্যন্ত এলাকায় উপজাতিদের উৎপাদিত পণ্য যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়নের ফলে শহর এলাকায় পরিবহন সহজেই সম্ভব হয়।

উপজাতিগণ তাদের উৎপাদিত পণ্যের ভাল দাম পান এবং নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের ক্রমান্বয়ে আধুনিকতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে আগ্রহবোধ করেন। তার অর্থ হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন অর্থাৎ পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করা ছিল সময়ের দাবি। প্রশ্ন হচ্ছে, যারা এই রাস্তাগুলো তৈরি করেছেন তারা কি যথেষ্ট নিরাপদভাবে রাস্তা তৈরি করতে পেরেছেন কি না? এর উত্তর হ্যাঁও হতে পারে আবার নাও হতে পারে। যেকোনো উন্নয়নমূলক কর্মকা-ের সঙ্গে আর্থিক সংশ্লিøষ্টতা নির্ভরশীল। বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় রাস্তাগুলো তৈরি করতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সামর্থ্য এবং নিরাপত্তাব্যবস্থা বিবেচনায় পাহাড়ের পাদদেশসমূহ কেটে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। সাধারণ জ্ঞানে পাহাড়ি এলাকায় রাস্তার দীর্ঘস্থায়ীত্ব নিশ্চিত করতে পানি সঞ্চালনের সুব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। যতটুকু জানা যায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরির ক্ষেত্রে পানি সঞ্চালনের জন্য উপযুক্ত কার্যকরি ড্রেন ব্যবস্থা এবং অন্যান্য নিরাপত্তার বিষয়টি ভালভাবে নিশ্চিত করেছেন। এছাড়াও সময়ে সময়ে প্রতিনিয়ত রাস্তাগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা তারা ভালভাবেই করছেন। তাই, পাহাড় ধসের মূল কারণ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় আধুনিকতার অন্যতম নিয়ামক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, আধুনিক বাসস্থান তৈরি, পর্যটনের উন্নয়ন ইত্যাদি একমাত্র কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা সমীচীন নয়।

চট্টগ্রাম মহানগরীতে ২০০৭ সালের ভূমি ধসের পর গঠিত তদন্ত কমিটি পাহাড় ধসের কারণ হিসেবে যে সমস্ত সমস্যা চিহ্নিত করেছিল তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভারি বর্ষণ, পাহাড়ের মাটিতে বালির ভাগ বেশি থাকা, উপরিভাগে গাছ না থাকা, গাছ কেটে ভারসাম্য নষ্ট করা, পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস, পাহাড় থেকে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না রাখা, বনায়নের পদক্ষেপের অভাব, বর্ষণে পাহাড় থেকে নেমে আসা বালি এবং মাটি অপসারণের দুর্বলতা ইত্যাদি। এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেøখ করা যেতে পারে, অতি বৃষ্টিপাতও বালি/মাটি মিশ্রিত পাহাড়ধসের অন্যতম ‘কারণ’ হিসেবে চিহ্নিত। নাসার তথ্যমতে, গত ১২-১৪ জুন ২০১৭-তে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ৫১০ মিলি/২০ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়েছে (ডেইলি স্টার, ১৭ জুন ২০১৭)। শুধুমাত্র ১৩ জুন সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত, একদিনে রাঙামাটিতে ৫২৪ মিলি বৃষ্টিপাত হয় (ইন্ডিপেন্ডেন্ট, ১৪ জুন ২০১৭)। পূর্ববর্তী বছরগুলোতে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, রাঙামাটির জুন মাসের গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হলো, ৪৫৩.১ মিলি (২০১৬), ৩৯৭.৩ মিলি (২০১৫), ৩৩৬.৭ মিলি (২০১৪), ৩১৬.৯ মিলি (২০১৩), ৩৩৫.৪ মিলি (২০১২)। অর্থাৎ পাহাড় ধসজনিত মানবিক বিপর্যয়ের ওই দিনগুলোতে একদিনের গড় বৃষ্টিপাত অন্যান্য বছরের জুন মাসের গড় বৃষ্টিপাতের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ বৃহত্তর চট্টগ্রামের পূর্বের অভিজ্ঞতার বিবেচনায় বর্তমান বছরের পাহাড়ি ধসের কারণ হিসেবে শুধুমাত্র একটি জাতিগোষ্ঠী, অর্থাৎ বাঙালিদের দায়ী করা নিতান্তই অবিবেচনা প্রসূত অপরিপক্ক ভাবনা বলে প্রতীয়মান হয়।

গত ১১-১৩ জুন ২০১৭-তে রাঙামাটির বিভিন্ন এলাকায় সংঘটিত পাহাড় ধসের বিষয়টি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পাহাড়ের পাদদেশে অবৈধভাবে বাঙালি ও পাহাড়িদের অনিরাপদভাবে তৈরিকৃত বাসস্থান এলাকায় পাহাড় ধসের পাশাপাশি জনবসতিহীন অনেক পাহাড়েও ব্যাপক ভূমি ধস হয়েছে। তাই এ বিষয় নিশ্চিত করে বলা যায়, পাহাড়ের পাদদেশে অবৈধভাবে বাঙালি/পাহাড়িদের বসতিস্থাপনই বর্তমানে ভূমি ধসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ নয়, যদি তাই হতো যে সকল পাহাড়ে বসতি স্থাপিত হয়নি, সেই পাহাড়গুলোতে ভূমি ধস হতো না। মূলত এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং টক-শোগুলোতে লেখক এবং বক্তাগণ প্রকৃত গবেষণাপ্রসূত বক্তব্য উপস্থাপন না করে অবিবেচনাপ্রসূত ও অপরিপক্ক বক্তব্য দিচ্ছেন। এতে করে পাহাড় ধসের প্রকৃত কারণ অপ্রকাশিত থেকে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, পাহাড় ধসের কারণ হিসেবে ‘শুধুমাত্র পাহাড়ি’ অথবা ‘শুধুমাত্র বাঙালিরা’ দায়ী একথা ঢালাওভাবে বলা যাবে না। সময়ের প্রয়োজনে যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে পরিবর্তন আসা খুবই স্বাভাবিক। আধুনিকতার এ পরিবর্তন ছিল সময়ের দাবি, যা বাঙালি বা পাহাড়ি কারও পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আমাদের সকলেরই উচিত সংঘটিত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতিকে ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করে নিজস্ব স্বার্থান্বেষী আচরণ পরিহার করা। এই দেশ আমাদের সকলের। পাহাড়ি ও বাঙালি উভয় জনগোষ্ঠী এই স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের গর্বিত নাগরিক। পার্বত্য এলাকায় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের এই সন্ধিক্ষণে ব্যক্তিগত পছন্দ ও মতামতকে উর্ধ্বে রেখে সকল শ্রেণিপেশার মানুষ একসঙ্গে কাজ করবে, এটাই কাম্য।
লেখক: মিল্টন বিশ্বাস, অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়