গত ২৫ আগস্ট থেকে প্রায় দুই সপ্তাহ হতে চলল এবারের পর্যায়ে, রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঢল বেড়েই চলেছে। জাতিসঙ্ঘের হিসাবে, শুধু এই ক’দিনে তা দুই লাখ ছাড়িয়ে গেছে। কয়েক বছর ধরে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের নির্মূল করতে অত্যাচার নির্যাতন হত্যা আরো নৃশংস হয়ে উঠেছে। জাতিসঙ্ঘের ভাষায়, দুনিয়ার সবচেয়ে নির্যাতিত ও নির্মূল হয়ে যাওয়া সহ্য করা জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গারা। একালে এমন অভিযান বেড়ে যাওয়ার পেছনে একটা বড় কারণ, মিয়ানমারে চীনা বিনিয়োগে সেখানে চীনের প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় ভারতের অস্বস্তি। তা কাটাতে ভারত নীতি নিয়েছে, মিয়ানমার সরকারকে উৎসাহ ও সমর্থন দিয়ে এই হত্যাযজ্ঞকে বাড়িয়ে দেয়া। অজুহাত রোহিঙ্গা ‘মুসলমান মাত্রই এরা সন্ত্রাসী’। এমন পরিস্থিতিতে গত সপ্তাহে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি মিয়ানমার সফরে এসে সু চির পাশে দাঁড়িয়ে জানিয়েছেন, তিনি সু চির সাথে আছেন। বিবিসির সাবেক সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক ব্যাখ্যা করে বলছেন, ‘ভারতের মূল উদ্দেশ্য মিয়ানমারে চীনের প্রভাব বলয়ে ফাটল ধরানো’। ‘সম্ভাব্য উদ্দেশ্য- ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ভাবাবেগ ব্যবহার করে বার্মিজ জাতীয়তাবাদীদের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা।’ অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া অথবা হারানোর জন্য কেউ গণহত্যা ও নির্মূলকরণে সমর্থক হতে পারে মিয়ানমারে এর উদাহরণ সৃষ্টি করেছে ভারত।
মিয়ানমারে চীনের বিনিয়োগের শুরু ২০০৩ সাল থেকে। কিন্তু একালে চীনের বিনিয়োগ সুনির্দিষ্ট করে ঘটেছে রাখাইন রাজ্যে। মিয়ানমারের পড়শি হলো চীনের ল্যান্ডলকড প্রদেশ ইউনান যার রাজধানী কুনমিং। সমুদ্র উপকূলের রাখাইন রাজ্য কুনমিংকে ল্যান্ডলকড দশা থেকে মুক্ত করবে- এ জন্য রাখাইন রাজ্যে চীনের এই বড় বিনিয়োগ। এ রাজ্যে বৌদ্ধ রাখাইন আর মুসলিম রোহিঙ্গাদের বসবাস। এখানে চীনের বড় বিনিয়োগ প্রজেক্ট উল্লেখযোগ্য হলো- কিয়াওপিউতে এক গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা বা শিল্পপার্ক স্থাপন যেখানে কম্পোজিট টেক্সটাইল ও তেল শোধনাগারের মতো ভারী শিল্প স্থাপন করা যায়। ওই বন্দর থেকে চীনের কুনমিংয়ে শোধনাগার পর্যন্ত তেল ও গ্যাসের পাইপলাইন ইতোমধ্যেই চালু হয়ে গেছে।
চীনের কাছে এই প্রজেক্ট আরো গুরুত্বপূর্ণ এ জন্য যে, এই পাইপলাইন হবে মধ্যপ্রাচ্যের তেল চীনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে, জাহাজে মালাক্কা প্রণালী ও সিঙ্গাপুর ঘুরে পূর্ব চীন সাগরের বন্দরে যাওয়ার বদলে বিকল্প ও শর্টকাট পথ। এতে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরত্ব কমে যাওয়ায় এই তেলের ল্যান্ডিং কস্ট অনেক কম হবে। এ ছাড়া এতে তেলবাহী জাহাজকে আর ব্যস্ত ও সঙ্কীর্ণ মালাক্কা প্রণালী পার হতে হবে না বলে পাইপলাইনে নেয়া তেলের নিরাপত্তা বেশি হবে। এপ্রিল মাসে মিয়ানমারের নতুন প্রেসিডেন্টের চীন সফরকালে ১০ বছর ধরে ঝুলে থাকা মিয়ানমারকে প্রদেয় রাজস্ব বিতর্কের অবসান করে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তেল পাইপলাইন এই বছর চালু হলেও মিয়ানমারের নিজস্ব গ্যাস ২০০৯ সাল থেকেই ওই পাইপলাইনের প্যারালাল করে পাতা আলাদা পাইপলাইনের মাধ্যমে কুনমিংয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের ওই সফরেই কিয়াওপিউ গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে ৭.৩ বিলিয়ন ডলারের আর বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার ২.৩ বিলিয়ন- এভাবে মোট ১০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ চুক্তি হয়।
নির্মিত বন্দরের ৮৫ ভাগ মালিকানা চীনা কোম্পানিকে দিতে মিয়ানমার রাজি হয়েছে। চীনের বড় প্রজেক্ট বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ; এতে সংশ্লিষ্ট প্রায় ৬৫টি দেশজুড়ে তা বয়ে যাবে, ওই নৌ-সড়ক মেগা-অবকাঠামোর সাথে কিয়াওপিউ বন্দরও যুক্ত হওয়ার কথা।
মে মাসে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের প্রথম সম্মেলন হয়ে যাওয়ার পর থেকে ভারত সরাসরি এশিয়ায় চীনের বিনিয়োগ প্রভাব বেড়ে যাওয়ার বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ভারতের যুক্তি, এশিয়ায় তার ‘পড়শি প্রভাব বলয়’ অঞ্চলেও চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ও প্রবেশ সে মানবে না। একে ভারতের অমান্য করা সম্ভব যদি পাল্টা অন্তত চীনকে ছাড়িয়ে যাওয়া না হলেও সমান্তরাল অর্থনৈতিক সক্ষমতায় ভারত পৌঁছাতে পারে।
ভারতের প্রো-আমেরিকা প্রভাবশালী থিংকট্যাংক ব্যক্তিত্ব ও স্ট্র্যাটেজিক থিংকার সি রাজামোহন, বিষয়টিকে মানেন। তিনি এ বিষয়ে তার লেখা সাপ্তাহিক কলামে ব্যাখ্যা করে ভারতের রাজনীতিবিদদের সাবধান করেছেন। তিনি ১০ বিলিয়ন ডলারের এই বন্দর প্রজেক্ট সম্পর্কে সরাসরিই বলেছেন, ‘দিল্লির আসলে কিয়াওপিউ প্রজেক্টে চীনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাওয়ার মুরোদ নেই। এমনকি অন্য কোনো আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়ও চীনের বিকল্প হয়ে হাজির হতে পারবে না।... যদি চীন যেভাবে কথা দিয়েছে, তা মেনে কিয়াওপিউ বন্দরকে সিঙ্গাপুর বা হংকংয়ের মতো বাণিজ্যিক ‘হাব’ হিসাবে গড়ে তুলতে থাকে, ভারতের নীতিনির্ধারকদের এ নিয়ে চিন্তা করে সময় নষ্টই করতে হবে। এখানকার বাণিজ্যিক স্বার্থ নিশ্চিত ও বিনিয়োগ নিরাপদ করতে ভবিষ্যতে চীনকে প্রয়োজনীয় সমতুল্য মেরিন ও সামরিক শক্তি সমাবেশ ঘটাতেও হবে।’
চীনের সাথে ভারতের সামর্থ্যরে ফারাকের কথা খেয়াল রেখে পথচলার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। কিন্তু সে কথায় কান দেয়ার অবস্থা মোদি সরকার অথবা ভারতের হামবড়া আমলা-গোয়েন্দাদের নেই। এ অবস্থায় বিনিয়োগ সক্ষমতা না থাকা ভারতের হয়তো অন্তর্ঘাতমূলক কাজ আর দাঙ্গায় উসকানি দিয়ে পরিস্থিতি অশান্ত করে তোলা ছাড়া হাতে কিছু নেই। এবারে আবার লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে শরণার্থী বানানো কার পরিকল্পনার ফল, কে জানে।
সু চির সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেছেন, রোহিঙ্গারা নিজেরা নিজেদের বসতঘর ও পাড়ায় আগুন দিয়ে স্বেচ্ছায় রিফিউজি হতে বাংলাদেশ সীমান্তে গেছে। সব দোষের দোষী, ‘জাত খারাপ’ রোহিঙ্গা মুসলমানদের সম্পর্কে আর কত হাস্যকর আজব অভিযোগ শুনতে হবে, কে জানে। কিন্তু রাখাইন রাজ্যের হিন্দুদেরও কেন উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরা উৎখাত করল? তারাও যে বাংলাদেশে রিফিউজি হয়ে এসেছে এ সম্পর্কে বাংলাদেশের হিন্দু খ্রিষ্টান বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদের নেতা রানা দাসগুপ্তের সাক্ষ্য ও অভিযোগের ভিডিও মিডিয়ায় আমরা দেখেছি। ভারতের মোদির চোখে এরাও সন্ত্রাসবাদী!
‘মুসলমান মানেই সন্ত্রাসী’- মোদি ও সু চির সস্তা ফর্মুলার ওপর দাঁড়ানো এই বয়ান, এরা নিজেরাই মিথ্যা ও অচল বলে প্রমাণ করেছেন। মিয়ানমারের বৌদ্ধ মংদের সংগঠন মা-বা-থা গোষ্ঠী বিজেপি-আরএসএস শিবসেনার মতো চরম ইসলামবিদ্বেষী এবং উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী। সারাক্ষণ রাখাইন রাজ্যে এরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণার বিষ উগলে যাচ্ছে। সরকার ও সেনাবাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় এই গোষ্ঠী তৈরি করা হয়েছে। এরা রাখাইন রাজ্যের স্বল্প হিন্দু জনগোষ্ঠীকেও রেহাই দেয়নি। এই ছোট ঘটনা মোদি-সু চির ইসলামবিদ্বেষী অ্যালায়েন্সকে ফুটা করে দিয়েছে।
১৯৪৮ সালের কলোনি শাসকমুক্ত মিয়ানমারের জন্মের আগে থেকেই নির্মূল আর নির্বিচারে হত্যা ইত্যাদি চলে আসছে। ১৯৬২ সালের পর থেকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্নতায় আকর্ণ ডুবে থাকা মিয়ানমারের সরকারগুলো ‘উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ’ চর্চা করেছে। মিয়ানমার ‘উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী’ ভিত্তিতে গড়া এক রাষ্ট্র। এই নামের আড়ালে আসলে ইসলামবিদ্বেষ চর্চা করে এসেছে তারা। তাদের মূল সঙ্কট রোহিঙ্গা বা মুসলমান ছিল না। মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী হলো ‘বার্মান’ বা ‘বার্মিজ’; এরা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬০ ভাগ। এই বর্মি জনগোষ্ঠীর জন্ম থেকেই মূল সঙ্কট হলো অভ্যন্তরীণ অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সাথে এদের সঙ্ঘাত; অন্যভাবে বললে, অন্যান্য জনগোষ্ঠীকে বর্মিদের কর্তৃত্বের নিচে রাখাকেই একমাত্র পথ হিসেবে বেছে নেয়া- এটাই সব সঙ্ঘাতের উৎস। অথচ ফেডারেল ব্যবস্থা হতে পারত এর সহজ সমাধান।
ব্রিটিশ শাসনামলে মিয়ানমারে কোথাও কোথাও স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ ছিল। কিন্তু ১৯৪৮ সালে জন্মের পর থেকে মিয়ানমারে কোনো ফেডারেল ব্যবস্থা গড়ার চেষ্টা না করে বরং পুরনো স্বায়ত্তশাসন লুপ্ত করে সব কিছু বর্মিদের অধীনে আনার জবরদস্তি চেষ্টা করা হয়েছে। ২০১৪ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে মিয়ানমারের প্রায় ৮৮ ভাগ বৌদ্ধ, ছয় ভাগ খ্রিষ্টান ও চার ভাগ মুসলমান। এত বড় অংশ বৌদ্ধ বলে, এক উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের অবয়ব, যা ইসলামবিদ্বেষী করে সাজানো। একে নিজের রাজনীতিক ভিত্তি হিসেবে বেছে নিয়েছিল নে উইন সরকার।
অনুমান ছিল, এতে পুরনো বর্মি আধিপত্যটা উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের (ইসলামবিদ্বেষ) আড়ালে থেকে শাসনকাজ চালাতে পারবে। এটাকে অনেকে মিয়ানমারিজম বলে থাকেন। এসব কারণে ১৯৭৭ সাল থেকে নে উইনের তৈরি রোহিঙ্গা সমস্যা প্রথম প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে এবং বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী আসার জোয়ার দেখা গিয়েছিল। ১৯৭৮ সালে জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় মিয়ানমার বেশির ভাগ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হলেও ১৯৮২ সালের নতুন ইমিগ্রেশন আইন সব কিছুকে আগের চেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় নিয়ে যায়। এরপর ২০০১ সালে আমেরিকার ওয়ার অন টেরর শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত থেমে থেমে রোহিঙ্গা নির্মূল অপারেশন বিভিন্ন সময় চলেছে। এতে আগের ‘মিয়ানমারিজম’ এবার ‘ইসলামি সন্ত্রাসের’ অভিযোগ তুলে নিজের দানবীয় উগ্রতার পক্ষে আরো সাফাই নিয়ে হাজির।
মিয়ানমার পরিস্থিতি ২০০৬-০৭ সাল থেকে এক নতুন মাত্রা পায়। তখন মিয়ানমার ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনে জাতিসঙ্ঘের নিন্দা ও অভিযোগের মধ্যে আর পশ্চিমা জগতে ভয়াবহ রকমের অবরোধের অধীনে। এমনিতেই জেনারেল নে উইনের শাসনামলে (১৯৬২-৮৮) বার্মা ছিল বাকশালী সমাজতন্ত্রের মতো এক মতাদশের অধীনে; এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল জেনোফোবিয়া বা বিদেশীবিদ্বেষ। আজ পর্যন্ত মিয়ানমার এমন হওয়ার পেছনে ওর দুটি গঠন বৈশিষ্ট্য উল্লেখযোগ্য; এর একটি হলো জেনোফেবিক যার উৎস হলো ভারতবিরোধিতা।
১৮২৪ সালে দখল নেয়ার পর থেকে ব্রিটিশরা বার্মাকে ভারতের প্রদেশ (১৮২৪-১৯৩৭) বানিয়ে কলোনি শাসন চালাত, ভারতীয় নেটিভদের মাধ্যমে শাসন করত, ফলে ভারতীয় কর্মচারী বা ব্যবসায়ীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল সেখানে ইত্যাদিÑ এখান থেকে এক ধরনের জেনোফোবিক বৈশিষ্ট্য বার্মার জনমানসে ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে গেড়ে বসেছিল। এর প্রভাবেই ১৯৬২ সালে নে উইন সামরিক ক্যুতে ক্ষমতা দখলের পর বার্মা ত্যাগ করেছিল অথবা মারা গিয়েছিল প্রায় চার লাখ ভারতীয়।
আর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, ১৯৪২ সালের আগে সেকালের জাপানি কলোনি মাস্টারের হাতে ট্রেনিং। ব্রিটিশদের হাত থেকে বার্মাকে কেড়ে নেয়ার পরিকল্পনায়, জাপানি মার্শাল তেজোর বাহিনীর হাতে, বেছে নেয়া ৩০ জন বর্মি সামরিক ট্রেনিং পেয়েছিলেন। তারা পরে দেশে ফিরে সামরিক সংগঠন বানিয়েছিলেন, আর ১৯৪২ সালে জাপানি বাহিনীর সহায়তায় ব্রিটিশদের হাত থেকে কর্তৃত্ব কেড়ে নিয়েছিলেন। সু চির বাবা অং সানের নেতৃত্বে উ নু-আর নে উইন শীর্ষ তিনজন হলেন ৩০ জনের মূল নেতা। এদের নেতৃত্বেই নতুন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ‘বার্মিজ স্বাধীন সেনাবাহিনী’ গড়া হয়েছিল।
বলা হয়, জাপানিদের নির্মমতার ট্রেনিং, নির্যাতনের টেকনিক সেই থেকে বর্মি সেনাবাহিনীর বৈশিষ্ট্য হয়ে যায়। এরাই ১৯৪৮ সালে নিগোসিয়েশন করে ব্রিটিশদের হাত থেকে বার্মাকে স্বাধীন করেছিলেন। আজো মিয়ানমারে সব রাজনৈতিক সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে, তাদের চিন্তা ও বয়ানে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের উদাহরণ বা হিরো হয়ে আছেন ওই ৩০ জন। গেড়ে বসা এই মিথ ভেঙে নতুন করে ভেবে দেখা, ফিরে দেখা আর নতুন করে মূল্যায়নের সাহস না হওয়া পর্যন্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্র ও রাজনীতি তার নির্মমতা, নির্মূলের সামরিকতা থেকে মুক্ত হতে পারবে না।
মিয়ানমারই সম্ভবত একমাত্র উদাহরণ যেখানে রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা কমান্ডার ইন চিফ ও রাজনীতিক রাষ্ট্রপতির মধ্যে ভাগ হয়ে আছে। অর্থাৎ রাষ্ট্র এক কিন্তু যার দ্বৈত-নির্বাহী। কার্যত মিয়ানমারের প্রধান এক্সিকিউটিভ সামরিক বাহিনী। মিয়ানমারের কমান্ডার ইন চিফ নিজেই প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও সীমান্তরক্ষা- এই তিন মন্ত্রী নিয়োগ দেন আর প্রেসিডেন্ট প্রধান নির্বাহী বটে; কিন্তু তিনি সেটা মেনে নিয়ে বাকি মন্ত্রীদের নিয়োগ দেন। ফলে নে উইনের হাতে আর্মির সেট করে দেয়া রাষ্ট্র বৈশিষ্ট্য- ইসলামবিদ্বেষী উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের ভেতরে থেকে সু চিকে নোবেল প্রাইজের ধ্বজাধারী হতে হয়, ‘বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ’ সেদেশ যেভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে তাকে সমর্থন না করা সু চির জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আবার একই কারণে সু চির জীবনীকার উইন্টেলের বরাতে বিবিসি লিখছে, ‘তিনি (সু চি) এখন সেনাবাহিনীর পকেটে। সু চি হাড়ে মজ্জায় বার্মিজ। কিন্তু কয়েক বছর ধরে মিয়ানমারের পশ্চিমে রাখাইনে যা ঘটছে তা চরম জাতিবিদ্বেষী। সেখানে মুসলিম রোহিঙ্গাদের প্রতি সমন্বিত বিদ্বেষ রয়েছে।’
গণবিক্ষোভের মুখে ১৯৮৮ সালে নে উইন দৃশ্যত পদত্যাগ করলেও ক্ষমতা নেন তারই শিষ্য জেনারেলরাই। ক্ষমতা ও রাজনীতি বলতে তারা একটা কাজই জানেন- দমন নির্মূল। ফলে সেই পুরনো অভিজ্ঞতায় প্রায় কয়েক হাজার লোক মেরে ১৯৯০ সালে সাধারণ নির্বাচন দেয়া হয়, কিন্তু বিরোধীরা জিতলেও ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বরং সে নির্বাচন বাতিল বলে ঘোষণা করে দেন জেনারেলরা। ১৯৯৭ সালের পর থেকে মিয়ানমার পশ্চিমের (আমেরিকা ও ইউরোপের) বাণিজ্য অবরোধ মুখে পড়ে। এই অবস্থায় বাইরের কোনো রাষ্ট্রের সাথে মিয়ানমারের বাণিজ্য বিনিয়োগ লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়।
একমাত্র ব্যতিক্রম চীন। চীনের ভেতর দিয়ে যতটুকু সম্ভব বাইরের দুনিয়ার সাথে বার্মার সংযোগ সম্পর্ক হতো। মিয়ানমারে চীনা বিনিয়োগ শুরু হয়েছে ২০০২-০৩ সালের পর থেকে। এমন অবস্থায় ২০০৬-০৭ সালের দিকে এশিয়ার দুই রাইজিং অর্থনীতি হিসেবে নিজের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চীন ও ভারত মিয়ানমারের গ্যাস কেনার জন্য প্রবল আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। এই সময়ই অবরোধের ব্যাপারটাকে নতুন দৃষ্টিতে দেখা শুরু হয়।
তত দিনে আমেরিকার পলিসিতে ভারতকে কাছে টেনে চীন ঠেকানোর চর্চা পোক্ত নির্দিষ্ট হতে শুরু করেছিল। ফলে ভারতের মাধ্যমে অবরোধ তুলে নেয়ার ফর্মুলা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছিল। এই অবস্থানের পেছনে যে মূল্যায়ন কাজ করেছিল তা হলো, মিয়ানমারে অবরোধ দেয়াতে এর ফল চীন একা খাচ্ছে। তাই ভারতের মধ্যস্থতায় অবরোধ তুলে নেয়ার নতুন ফর্মুলা।
মিয়ানমার এখনো কোনো রিপাবলিকই নয়। ফলে এই রাষ্ট্রের কাছে মানবাধিকার, জনগণের মৌলিক অধিকার- এসব কথা অর্থহীন। আর ‘ডেমোক্র্যাসির নেতা সু চি’ এটা তো আরো হাস্যকর।
হঠাৎ ২০১০ সালেই মিয়ানমারে বিদেশী ডাইরেক্ট বিনিয়োগ হয়েছে ২০ বিলিয়ন, আর এর অর্ধেক হলো একা চীনের। কিন্তু ভারতের অর্জন কী এতে? তেমন বৈষয়িক বিনিয়োগ ব্যবসায় না প্রভাব কোনোটাই অর্জন হয়নি ভারতের। প্রধানমন্ত্রী মোদি গত ৬ সেপ্টেম্বর তিন দিনের মিয়ানমার সফরে গিয়েছেন।
সু চি বলেছেন ‘অসত্য খবর প্রচার করে রাখাইনে উত্তেজনা ছড়ানো হচ্ছে’। সু চি হামলাকারীদের ‘টেরোরিস্ট’ বলেছেন। আর মোদি বলেছেন, ‘তিনি সু চির পাশে আছেন’। মিয়ানমার সফর থেকে মোদি কী অর্জন করতে চান এই প্রশ্নে বিবিসি কলকাতায় বিবিসির সাবেক সাংবাদিক সুবীর ভৌমিককে সাক্ষ্য মেনে অনেক কথা বলিয়ে নিয়েছে। সুবীর কথাগুলো ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর তরফ থেকে আমাদের কাছে পৌঁছাতে চেয়েছেন, এটা ধরে নিতে পারি। সুবীর বিবিসিকে বলছেন, ‘মোদির সফরের ঠিক আগে দিল্লির পক্ষ থেকে এসব বক্তব্য বিবৃতির মূল উদ্দেশ্য বৌদ্ধ অধ্যুষিত মিয়ানমারের সাথে অধিকতর ঘনিষ্ঠতা’।
মি. ভৌমিক বলছেন, ‘রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে চীনের মৌনতার সুযোগ কাজে লাগাতে চাইছে বিজেপি সরকার’। ‘মুসলিমদের প্রশ্নে বার্মিজ জাতীয়তাবাদী এবং কট্টর বৌদ্ধরা মোদি এবং তার দল বিজেপির সাথে একাত্ম বোধ করে’। ভারত যে সম্প্রতি বিশেষ অভিযানের জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা বলেছে, সেটাকেও দেখা হচ্ছে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সেনা অভিযানের প্রতি দিল্লির সমর্থন হিসেবে’।
অর্থাৎ ভারত জেনারেলদের ইসলামবিদ্বেষী উগ্র জাতীয়তাবাদকে উসকে দেয়ার জন্য কাজ করছে। এই কাজটাই ২০০৮ সাল থেকে ভারত করে জেনারেলদের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করে আসছে। এ কারণে ২০১২ সালে রোহিঙ্গা হত্যার বড় ঘটনাটা ঘটতে পেরেছে বলে মনে করা হয়। এবারের নতুন সংযোজন, মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমার মাইন পুঁতে রেখেছে। মিয়ানমার অল্প কিছু রাষ্ট্রের মধ্যে একটি, যে মাইন ব্যবহার নিষিদ্ধসংক্রান্ত জাতিসঙ্ঘের কনভেনশন স্বাক্ষর করেনি। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত এ নিয়ে জাতিসঙ্ঘে নালিশ বা সদস্যদের মধ্যে প্রচার করতে যায়নি।
পলায়নপর আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য মাইন পুঁতে রাখা হয়েছে, এরা কি বিদ্রোহী? অর্থাৎ নিরীহ সাধারণ মানুষ কোনো আশ্রয় না পাক, মিয়ানমারের হাতেই তাকে মরতে হবে। আর এই স্যাডিজম সত্ত্বেও মোদি বলেছেন, ‘তিনি সু চির পাশে আছেন’। তার মানে, যেহেতু ভারতের বিনিয়োগের সক্ষমতায় প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দাঁড়ানোর মুরোদ নেই, তাই তাকে নিজের নাক কেটে হলেও অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করতে হবে!
লেখক : গৌতম দাস, রাজনৈতিক বিশ্লেষক