ভূমিই হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল
সমস্যা। ভূমির মালিকানা নির্ধারণ করতে পারলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে।
কিন্তু দেশের এক-দশমাংশ এলাকার ভূমির ক্যাডেস্টাল সার্ভেই (সিএস) কখনও
হয়নি। ব্রিটিশ শাসন থেকে শুরু করে পাকিস্তান-পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ কোন
সময়ই পার্বত্য ভূমির সার্ভে হয়নি। বর্তমান সরকার ভূমি কমিশন আইনের সংশোধনী
এনেছে। এই কমিশনের মাধ্যমে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কিন্তু এই সংশোধনী নিয়েই পাহাড় উত্তাল হয়ে উঠেছে। ঘুরে গেছে পাহাড়ে
রাজনীতির মোড়।
উপজাতি জনগোষ্ঠীগুলো নতুন কমিশন আইনকে
স্বাগত জানিয়েছে। বাঙালী জনগোষ্ঠী ভূমি কমিশন আইনের সংশোধনীর বিরুদ্ধে
আন্দোলনে নেমেছে। এতে করে পাহাড়ী ও বাঙালীদের মধ্যে বিরোধ চরম আকার ধারণ
করেছে। যে কোন সময় যে কোন স্থানে বড় ধরনের সংঘর্ষ ঘটে যেতে পারে।
পাহাড়ের খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান
জেলায় বর্তমানে ৫১ ভাগ পাহাড়ী বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠী আর ৪৯ ভাগ বাঙালী
জনগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করে। দেশের একদশমাংশ এলাকায় মাত্র ১৬ লাখ লোকের
বসবাস। প্রাকৃতিক সম্পদ সমৃদ্ধ এই এলাকা গত চার দশকের বেশি সময় ধরে
অস্থিতিশীল করে রেখেছে জেএসএস (জনসংহতি সমিতি) নামের একটি সশস্ত্র সংগঠন।
তাদের দাবি এই অঞ্চলকে স্বায়ত্তশাসন দিতে
হবে। কিন্তু দেশের ভেতরে আরেকটি দেশ গঠন হলে দেশের কোন সার্বভৌমত্ব থাকে
না। তাই তাদের এই অন্যায় দাবি কোনভাবেই মানার মতো না বলেই ১৯৯৭ সালের ২
ডিসেম্বর পাহাড়ীদের সঙ্গে একটি চুক্তি করে সরকার। এই চুক্তির ৭২টি দফার
মধ্যে ৪৮টি দফার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বাকি দফাগুলো বাস্তবায়নের
কাজ চলছে। ধরতে গেলে উপজাতিদের দেয়া দফাগুলোর সবই বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
খাগড়াছড়ির ডিসি মুহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামন
বলেন, উপজাতিদের দাবি অনুযায়ী সব দফা বাস্তবায়ন করা হলে পার্বত্য অঞ্চল আর
বাংলাদেশের অংশ থাকবে না। কারণ তখন তাদের হাতে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন
ও বন বিভাগ চলে যাবে। এখান থেকে সব নিরাপত্তা সংস্থার লোকজনকে চলে যেতে
হবে। এসিল্যান্ড চলে যাবে। এসব যদি চলে যায় দেশের একদশমাংশের সার্বভৌমত্ব
থাকবে না। সরকার ভূমি কমিশন করেছে। ভূমি কমিশন কাজও শুরু করেছে। ভূমি বিরোধ
মিটে গেলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
উপজাতি নেতৃবৃন্দ নানাভাবে চাপ সৃষ্টি
করছে যাতে তারা এই অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসন পান। কিন্তু ১৯৯৭ সালের চুক্তিতে
কোথাও বলা হয়নি যে তাদের স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। ওই চুক্তির কোথাও ‘শান্তি
চুক্তি’ কথাটিও লেখা নেই। ফলে উপজাতিদের দাবি অযৌক্তিক। এখানকার ভূমি ৩
ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। সমতল, উঁচু টিলা ও পাহাড়। এখানে সমতলে এক একর
ভূমির রাজস্ব মাত্র ৩ টাকা, উঁচু টিলার রাজস্ব ২ টাকা আর পাহাড়ের ১ টাকা।
এই রাজস্ব আদায় করেন হেডম্যান ও
কারবারিরা। আমরা জমির রাজস্ব আদায়ের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব করেছি জমির
ব্যবহারের ভিত্তিতে খাজনা বা রাজস্ব নির্ধারণের। ১৯১৭ সালের সিএস রেকর্ডের
একটি কাগজের ভিত্তিতে জমির কাজকর্ম পরিচালনা করে আসছি। আমি মনে করি ভূমি
সমস্যার সমাধান হলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
গত কয়েকদিন পাহাড়ে ঘুরে জানা গেছে, ভূমি
কমিশন আইনের সংশোধন করায় বেঁকে বসেছে পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালীরা।
পাহাড়ী-বাঙালীদের এ বিরোধকে কেন্দ্র করে আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পাহাড়ের
রাজনীতি। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর চুক্তির শর্তানুসারে গঠন
করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন।
দুই যুগের অধিক সময় ধরে পাহাড়ী এলাকায় চলে
আসছে সংঘাত। এ সময় প্রতিবেশী দেশ ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয় অনেক
পাহাড়ী। নিজ বাড়ি ছেড়ে দুর্গম পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়া পাহাড়ীদের নিজ ভূমিতে
পুনর্বাসনের সুযোগ করে দেয়াই ছিল এই কমিশনের প্রধান কাজ।
নানা কারণে ওই কমিশন পাহাড়ে ভূমি বিরোধের
সমাধান করতে পারেনি। সরকার আবার নতুন করে ভূমি কমিশন গঠন করে দিয়েছে। এই
কমিটি কাজ করে যাচ্ছে। ২০০৯ সালে পার্বত্য জেলার ভূমি ব্যবস্থাপনা, জেলা
প্রশাসক ও স্থানীয় প্রশাসনে কমিশনের উপস্থাপিত বা দাখিলকৃত তথ্য উপাত্ত
প্রচলিত আইন বিবেচনায় পার্বত্য জেলাধীন পাহাড় এবং জলেভাসা জমিসহ সমূদয় ভূমি
(প্রযোজ্য আইনের অধীন অধিগ্রহণকৃত এবং সংরক্ষিত বনাঞ্চল, কাপ্তাই
জলবিদ্যুত প্রকল্প এলাকা, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্প কারখানা ও সরকার বা
স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নামে রেকর্ডকৃত ভূমি ব্যতীত) মৌজা ওয়ারী স্থানীয় জরিপ
কার্য পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
ওই সময় সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ
জানিয়ে সার্কেল চীফ ও আঞ্চলিক পরিষদ প্রতিনিধি কমিশন সভা বর্জন করার
পাশাপাশি পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ থেকে প্রথমে ২৩ দফা পরে ১৩ দফা সংশোধনী
প্রস্তাব পাঠানো হয়। পাহাড়ীদের দাবির প্রেক্ষিতে সম্প্রতি সরকার কমিশন
আইনের কিছু ধারা সংশোধন করে নতুন কমিশন গঠন করেছে।
পাহাড়ে ভূমি কমিশনের সংশোধনী সম্পর্কে
বাঙালী সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, সংসদে উত্থাপিত বিলে আইনের ৬(গ) ধারায়
ভূমির পরিবর্তে ‘যে কোন ভূমি শব্দগুলো জুড়ে দেয়ায় তিন পার্বত্য অঞ্চলের যে
কোন ভূমি/জমি পাহাড়ীরা নিজের দাবি করে ভূমি কমিশনে আবেদন করতে পারবেন। এরপর
কমিশন বৈঠকে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে দাবি করা ভূমি উপ-জাতিদের নামে নাম জারি
করতে পারবে।
এতে একদিকে সরকারের এখতিয়ার যেমন খর্ব হবে
তেমনি তিন পার্বত্য জেলায় বসবাসরত বাঙালীরাও ভূমিহীন হতে বাধ্য হবে।
পার্বত্য ভূমি কমিশন আইনের ‘ঘ’ অনুচ্ছেদের ৪-এ বলা হয়েছে ‘গঠিত ভূমি কমিশন
পুনর্বাসিত শরণার্থীদের জায়গা-জমির বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি করাসহ এ যাবত যে
সকল ভূমি ও পাহাড় অবৈধভাবে বন্দোবস্ত ও বেদখল হয়েছে, সেসব জমি ও পাহাড়ের
মালিকানার স্বত্ব বাতিলে পূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে। এখানে ১২ হাজার
২২২ ভারত প্রত্যাগত পরিবারকে পুনর্বাসনের কথা বলা হয়েছে।
ভূমি কমিশন ত্রিপুরা থেকে ফিরে আসা
শরণার্থীদের ভূমি বিরোধ সংক্রান্ত আবেদনের শুনানি করবে। কিন্তু যে কোন ভূমি
শব্দগুলো যোগ করে এ আইন কার্যকর করা হলে এ সঙ্কট সহজে কাটবে না বলে মনে
করছেন তারা।
এদিকে, আইনে যে ১৩টি সংশোধনী আনা হয়েছে
তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আইনের শিরোনাম সংশোধন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম
ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন ২০১৩ রাখা হয়েছে। ২০০১ সালের ৫৩
নং পার্বত্য ভূমি কমিশন আইনের প্রস্তাবনায় পার্বত্য জেলা সংক্রান্ত জাতীয়
কমিটি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি শব্দগুলোর পরিবর্তে সংশোধন করে
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি
সমিতি লেখা হয়েছে।
মন্ত্রিসভায় যে ৬টি সংশোধনী প্রস্তাবকে
নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়েছে সেটি সম্পর্কে পাহাড়ী-বাঙালী কারোরই ধারণা নেই।
বাঙালীভিত্তিক সংগঠনগুলো পাহাড়ীদের রীতিনীতি এবং পদ্ধতি অনুযায়ী ভূমি কমিশন
কাজ করলে ভিটে মাটি হারা হবে এমন আতংকে আছে।
বাঙালী নেতৃবৃন্দ বলেন, ভূমি কমিশন আইন
সংশোধন পার্বত্যবাসীর জন্য ভাল হয়নি। এখানে পাহাড়ী-বাঙালী দুই সম্প্রদায়ের
মধ্যে যে বিশ্বাস ও আস্থা ছিল তা অনেকাংশে নষ্ট হয়েছে। ভূমি কমিশন নিয়ে
দুটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল, দুটি জাতিগোত্র দলের মধ্যে বিভেদ রয়েছে। এ ভূমি
কমিশন আইন সংশোধনীর মাধ্যমে বিভেদটা আরও উস্কে দেয়া হয়েছে।
তারা বলছেন, ২০১০ সালের ১৩ এপ্রিল
হাইকোর্ট এক রায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদকে অবৈধ ঘোষণা করা
হয়েছে। সরকার আঞ্চলিক পরিষদের কথা মতো আইন সংশোধন করছে। ইতোমধ্যে
বন্দোবস্তকৃত এবং বর্তমানে বন্দোবস্তির জন্য আবেদনকৃত সব জায়গার মালিকানা
বাতিল করা হবে বলেও জানা গেছে। যা বাঙালীদের স্বার্থের চরমহানি ঘটবে।
উল্টো দিকে পাহাড়ী নেতৃবৃন্দ মনে করেন,
সংশোধিত আইনের কারণে বাঙালীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। বরং তারাও এই আইনে
লাভবান হবেন। প্রতিষ্ঠা হবে ন্যায়বিচার। পাহাড়ে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা
করতে হলে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করাই জরুরী। কমিশনের আইন অনুযায়ী পাহাড়ীরা
নিজেদের ভূমির অধিকার ফেরত পাবে। একইভাবে বাঙালীরাও তাদের ভূমি ভোগ করতে
পারবে।
ফিরোজ মান্না, খাগড়াছড়ি থেকে ফিরে ,সূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ, পার্বত্য নিউজ
[লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে? তাহলে দয়াকরে গবেষণামূলক ও ইতিহাস ভিত্তিক এই সাইটটি চালিয়ে যেতে সাহায্য করুন। পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার বঞ্চিত বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী সাইটটি পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার কতৃক চরমভাবে অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত, পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ঠ এনজিও সমূহের একচোখা নীতি, সন্তু লারমা ও প্রসীত খীসাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) 'এর নিপিড়িত, নির্যাতিত ও বর্বরতম সন্ত্রাসের নির্মম ও অসহায় শিকার - পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠির সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ক্ষুদ্রতম এক প্রয়াস]