মঙ্গলবার, ২৯ আগস্ট, ২০১৭

বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের জন্য কি করতে পারে?

রাখাইনে জাতিগত নিপীড়ন আমাদের সংবিধান কি বলে?  সংবিধান ২৫ নং অনুচ্ছেদে আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নতির কথা বলা হয়েছে; দফাঃ (ক) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তিপ্রয়োগ পরিহার এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য চেষ্টা করিবেন; (খ) প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায় অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যেমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করিবেন; এবং (গ) সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতবাদ বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সংগত সংগ্রামকে সমর্থন করিবেন। আমারা যদি আর্ন্তজাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদেকে অনুসরণ করি তাহলে রোহিঙ্গাদের পাশে দাড়ানো কেবল ব্যাক্তিগত দায়িত্ব নয় রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। রোহিঙ্গাদের বার্মিজ জান্তা সরকার বাঙালি বলে সম্বোধন করে। পৃথিবীতে বাঙালি জাতি রাষ্ট্র একমাত্র বাংলাদেশ। সেই হিসেবে বিশ্বের যেকোন প্রান্তে বাঙালিদের দুঃখে সুখে পাশে দাড়ানো বাঙালি জাতি রাষ্ট্র বাংলাদেশের নৈতিক দায়িত্ব।

সাংবিধানিকভাবেই বাংলাদেশ একটি মুসলিম রাষ্ট্র। তাই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও রাষ্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে। বিশ্ব শক্তি এখন বাংলাদেশের আচরণের উপর গভীর দৃষ্টি রাখবে। রাখাইনদে জাতিগত নিধনের ব্যাপারে প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও ভারতের অবস্থান বিবেচনা করে বিশ্ব মোড়ল কথা বলবে। ভারত ইতিমধ্যে রোহিঙ্গাদের জঙ্গি সাব্যস্ত করে বিবৃতি দিয়ে নিন্দা জানিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার যদি চুপ থাকে তাহলে বিশ্ব মোড়ল এই জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে তেমন কোন পদক্ষেপ নিবে না এটা বলাই যায়। বার্মার রোহিঙ্গা সমস্যা বার্মার অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে চুপ করে থাকারও কোন সুযোগ নেই। এই সমস্যা আমাদের অভ্যান্তরের সমস্যা সৃষ্টি করছে। এমতাবস্থায় সরকার চুপ করে না থেকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিবে বলে আশা রাখি।

বার্মার চলমান রোহিঙ্গা হত্যাকান্ডের তেমন কোন নিউজ বাংলাদেশের প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে পাবেন না। দু’একটা যা-ও বা পাবেন সেখানকার ভাষাগুলিও হাস্যকর, সস্তা আবার চমকপ্রদও। যেমন, সংবাদগুলিতে বলা হচ্ছে ‘চলমান নৃশংসতায় গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী সুচী নিরবতা পালন করছেন’। বিষয়টা লক্ষ্য করুন। আমি মানলাম আপনারা ‘মেয়ে মানুষ’ দেখলে ঠিক থাকতে পারেন না; একটু তোষামদী করে হলেও তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। আপনারা হিলারী ক্লিনটনকেও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বানিয়ে দিয়েছিলেন। নিজেদের নারীবাদীও প্রমাণের চেষ্টা মহাব্যস্ত, চেতনাবাজী প্রদর্শনের পাশাপাশি।

আমি ঠিক-ঠাক জানি না, ‘আপনাদের জ্ঞান বা শিক্ষার অভাব রয়েছে’ না কি ‘ইচ্ছেকৃতভাবে টাওটগীরি করে আনন্দ পান’! অং সাং সুচী বর্তমানে মায়ানমার এর পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সূচীর দল মায়ানমারের ক্ষমতাসীন দল- আপনারই কিছুকাল আগেও লিখেতেন তার দল ‘ভূমিধস বিজয়’ পেয়েছে। এখনই তা ভুলে গেলেন। সুচী যে গলা বাড়িয়ে বলতেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট হতে পারবো না ঠিকই- কিন্তু আমি প্রেসিডেন্ট এর চেয়েও উপরে থাকবো’- সেটাও ভুলে গেলেন?

আমার কাছ থেকে শুনুন। ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসী নামের ক্ষমতাসীন দলটির প্রধান সূচি। তার ‘হাবি’ (হাজবেন্ড) ছিলেন একজন বৃটিশ হোয়াইট ভদ্রলোক। তার দু’সন্তানেরও বৃটিশ পাসপোর্ট। মায়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী কেউ কোন বিদেশী নাগরিক-কে বিয়ে করলে অথবা বিদেশী পাসপোর্টধারী সন্তান থাকলে সে দেশের শীর্ষ পদ এ বসতে পারবে না বা প্রেসিডেন্ট হতে পারবে না।

আর এজন্য সূচী বলেছিলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট এরও উপরে থাকবো’। হ্যা, তিনি মায়ানমারের বর্তমান প্রেসিডেন্ট’কেও নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেও মায়ানমারের মুল কর্তৃত্ব অং সান সুচীর হাতেই। এবং এই অং সান সুচী’র নির্দেশেই চলছে রোহিঙ্গাদের উপর বর্তমান ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকান্ড। তিনি নিরবতা পালন করছেন না, তিনি অপারেশনের নির্দেশদাতা।

বাংলাদেশের সাংবাদিকগুলিকে আমি মোটেও দেখতে পারি না। বরং অন্তর থেকে প্রচন্ড ঘৃণা করি। সেলিম ওসমান যেদিন এদের ‘খানকি ছেলে’ বলে গালি দিয়েছিল- সেই গালিটা সত্যিই আমার খুব মনে ধরেছিল। সেলিম ওসমানের প্রতি আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ, তিনি দীর্ঘদিন ধরে এই ‘অমিমাংসিত বিষয়টা’র একটা সঠিক, সহজ ও বাস্তব সমাধান দিয়েছেন।

এবার বাস্তবতায় ফিরি। আমি কখনও ফেসবুকে কোন নিহত ব্যক্তির লাশের ছবি দেয়াটা যুক্তিযুক্ত মনে করি না, কখনও লাইক দিই না বা কমেন্টও করি না। আমার ভাল লাগে না। কিন্তু ইদানিং ফেসবুকে অনেকেই মনের ক্ষোভ থেকে প্রচুর ছবি আপলোড করে থাকেন। ওগুলি চোখে পরে, আমি দেখি, আমার দু’চোখে জলও চলে আসে। কষ্ট পাই। ওদের জন্য কিছুই না করতে পারার কষ্ট।

বাংলাদেশে অল-মোষ্ট ৩ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস। রোহিঙ্গারা মুলত কক্সেসবাজার এর টেকনাফের দিকে জাতিসংঘের ক্যাম্পে বসবাস করে। তার বাইরেও বেশীকিছু রোহিঙ্গা অনৈতক ও অবৈধভাবে ‘বাংলাদেশী পাসপোর্ট’ সংগ্রহ করে বিদেশে বসবাস করছে এবং কিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশী বিয়ে করে অথবা অন্য কোনও ভাবে মুল স্রোতে মিশে গিয়েছে।

বাংলাদেশ খুবই ছোট একটা দেশ। এদেশে গাদাগাদি করে প্রায় ১৬ কোটি মানুষ বসবাস করে। নিজেদের ‘চাপ’ই আমরা সামলাতে পারি না। তার উপর রয়েছে রোহিঙ্গা, বিহারী, পাকিস্তানীরা এবং অবৈধ ভারতীয়রা তো রয়েছেই।ওদিকে মিয়ানমারের নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের কষ্টও সহ্য করতে পারছি না আমরা। কিন্তু কিছু তো একটা করা দরকার ওদের জন্য।

দেশের অধিকাংশ মানুষ রোহিঙ্গাদের কষ্টে ব্যথিত। আর কথিত সেকুলাররা বা চেতনাজীবিরা ব্যস্ত রোহিঙ্গাদের প্রতি যেন আমাদের কোন মায়া জন্মাতে না পরে। ওরা সন্ত্রাসী, জংগী, অপরাধী, ইয়াবা সরবরাহকারী এসব। বেশী জ্ঞানী কেউ কেউ আবার আরও এক ডিগ্রী এগিয়ে ওদের পূর্বের ইতিহাসও দেখছি ঘাটাঘাটি করে যাচ্ছে, ‘রোহিঙ্গরা না-কি নিজেরাই বার্মার সংগে থাকতে আগ্রহী ছিল না’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমি ওসব সেকুলারদের কথা গুরুত্বই দিই না। ওরাও ওসব সাংবাদিকদেরই সৎভাই। ওরাও অং সান সুচি’র মধ্যে ‘নির্দেশদাতা’ নয়, ‘নিরবতা’ দেখতে পায়। তবে যাই হোক আমাদের উভয় সংকট; এটাই বাস্তবতা। আমাদের সক্ষমতা নেই ওদের আশ্রয় দেবার এটা যেমন সত্য, আবার আমরা ওদের কষ্ট কোনভাবেই সহ্যও করতে পারছি না।

আমাদের বিবেক আমাদের চুপ থাকতে দিচ্ছে না। জাতিসংঘের উদ্বাস্ত বিষয়ক দপ্তর ‘বাংলাদেশ কে সীমান্ত খুলে দেবার’ অনুরোধ করেই চুপচাপ থাকছে। যদিও বাংলাদেশের বর্তমান রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলির পরিচালনা কিন্তু জাতিসংঘই করে যাচ্ছে- সেটাও আমরা স্বীকার করতে চাই না।

মিয়ানমার আমেরিকাসহ বিশ্বের সংগে মুলতঃ দীর্ঘকাল অবরুদ্ধ ছিল। সম্প্রতি সুচীর দল ক্ষমতা গ্রহণের পরই ওবামা সরকার সেই নিষেধাজ্ঞাগুলি পর্যায়ক্রমে তুলে নিয়েছে। চায়না ছিল মিয়ানমারের একমাত্র দরজা। চায়না তার নিজেদের স্বার্থে মিয়ানমার বা উত্তর কোরিয়াকে ‘লালন-পালন’ করে যাচ্ছিল।

এবং এই চায়নাই অতি সম্প্রতি তার সীমান্ত উম্মুক্ত করে দিয়েছে ‘নির্যাতিত রোহিঙ্গা’দের রক্ষা করতে। আমি নিজে আজ থেকেও দশ-বারো বছর আগে কুনমিং শহরে প্রচুর সংখ্যক রোহিঙ্গাদের দেখেছি ওখানে বসবাস করতে।

এখন প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, ‘বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের জন্য কি করতে পারে?’ বাংলাদেশ ইতিমধ্যে মিয়ানমার এর সংগে সংযুক্ত টেকনাফ সীমান্ত আরও শক্তভাবে সীল করে দিয়েছে, অতিরিক্ত বিজিবির সংগে এরমধ্যেই আরও অতিরিক্ত ৩ প্লাটুন সৈন্য মোতায়েন করেছে। কোন রোহিঙ্গাবহনকারী নৌকা এপারে আসতে দিচ্ছে না।

বাংলাদেশ সরকার কোন প্রতিবাদও জানায়নি। বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের হস্তক্ষেপও চায়নি। বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে ধমকও দেয়নি। কারণ ব্যক্তি শেখ হাসিনার কোন স্বার্থ নেই মিয়ানমারে। ভারতীয় হিন্দু পরিবারের নাতনী শেখ হাসিনা’র কিছুই এসে যায় না শত শত মুসলিম মারা গেলে। শেখ হাসিনা তো নিজ দেশেই হাজার হাজার মুসলিমকে হত্যা করে যাচ্ছে- সেখানে বিদেশী মুসলিম মারা গেলে কার কি? হিন্দু যেন মারা না যায়- সে বিষয়ে শেখ হাসিনা সজাগ দৃষ্টি রাখছে- এটাই ঢের বেশী।

কিন্তু আরও একটা অতি দৃশ্যমান বিষয় হলো, বিএনপি বা বেগম খালেদা জিয়াকেও কিন্তু কোন বিবৃতি বা প্রতিবাদ জানাতে দেখা গেল না। বেগম জিয়া এই সময় প্রধানমন্ত্রী থাকলেও যে কিছু একটা করে ফেলতেন- সেটাও আমি বিশ্বাস করি না।

আসলে যোগ্য নেতৃত্ব না থাকলে যা যা হবার- বাংলাদেশকে ঘিরে ঠিক তাই-ই হচ্ছে। বাংলাদেশের কিন্তু অনেক কিছুই করার ছিল বা রয়েছে। বাংলাদেশ ‘বিনা শর্তে’ জাতিংঘের উদ্বস্ত বিষয়ক হাই কমিশনের তত্ববধায়নে সীমানা খুলে দেবে- মিয়ানমারের নিরীহ রোহিঙ্গাদের জন্য; এতে নির্যাতিত রোহিঙ্গারা অন্তত বাঁচার নিশ্চয়তা পাবে।

কিন্তু, এসব রোহিঙ্গাদের প্রবেশের সময়ই প্রত্যেকের বায়োমেট্রিক ফিংগার প্রিন্ট এবং নাম, জন্ম তারিখ এর একটা ডাটাবেইজ তৈরী করে ফেলবে। যেন ভবিষ্যতে এরা অবৈধভাবে কোন সুবিধা নিতে না পারে। বিষয়টির মানবিক দিকগুলি জাতিসংঘ, আমেরিকাসহ ইওরোপিয়ান ইউনিয়ন, অষ্ট্রেলিয়া এবং চায়না, মানবাধিকার সংস্থাগুলিসহ ‘মুসলিম’ দেশগুলির সামনে তুলে ধরবে। সরকার প্রধান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রতিটি দেশে দেশে ছুটে যাবে এবং তাদের সর্বমোট সংখ্যা, বাংলাদেশের সার্বিক ক্ষতির হিসাব এবং অন্যান্য খরচাদি সকল দেশের নিকট প্রকাশ করে সকলের কাছে সাহায্য চাবে।

ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দিয়েছেন, ‘তার দেশ সকল বাড়ী-ঘরহীন উদ্বাস্তদের গ্রহন করবেন’। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী ম্যানিলা চলে যাবে এবং ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট কে এই সকল রোহিঙ্গা উদ্বাস্তদের গ্রহণের অনুরোধ করবে। বাংলাদেশ তার ‘অক্ষমতা’র কথা বিশ্বশক্তিসহ নিকটবর্তী চায়না, জাপান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারতসহ অন্যান্যদের নিকট বারবার তুলে ধরবে এবং বিষয়টির একটা স্থায়ী সমাধানের জন্য চাপ দেবে।

আমি বিশ্বাস করি মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশই অতি আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব ভাগ করে নিবে। এই ‘সামান্য কয়েকটি’ কাজ করলে, ক্ষমতাসীন সরকার দেশবাসী এবং আন্তর্জাতিক ভাবে অত্যন্ত জোড়ালো সমর্থন এর পাশাপাশি বিশ্বের সকল দেশের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে সাহায্য পাবে এবং একই সংগে বিভিন্ন দেশকে এসব ‘উদ্বাস্ত’দের গ্রহণ করতে অনুরোধ করবে; বাংলাদেশের সীমাবদ্ধতার কথা জোর দিয়ে তুলে ধরবে।

আমি বিশ্বাস করি ফিলিপিন্সসহ বিশ্বের প্রতিটি উন্নত দেশই বিষয়টি সিরিয়াসভাবে গ্রহণ করবে, রোহিঙ্গা সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান হবে, বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ একটা অতি উজ্জ্বল ভাবমূর্তি নিয়ে দাঁড়াতে পারবে। কিন্তু বাংলাদেশে অতটা ‘যোগ্যতাসম্পন্ন সরকার’ আপনি কোথায় পাবেন? এত কিছু করতে গলে ‘চুরি করা’র সময় পাবে কখন?

লেখক, তৌফিকুল ইসলাম পিয়াস