এককালে যাদের ছিল স্বাধীন রাষ্ট্র ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তি এখন তারাই সন্ত্রাসী বৌদ্ধদের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার। মিয়ানমারের মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভাগ্য বিড়ম্বনার ইতিহাস যে কাউকে তাড়িত করবে। এই উপমহাদেশ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সর্বপ্রথম যে কয়টি এলাকায় মুসলিম বসতি গড়ে ওঠে, আরাকান তার মধ্যে অন্যতম। রোহিঙ্গারা সেই আরাকানী মুসলমানের বংশধর। এক সময় আরাকানে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৪৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসন দুইশ বছরেরও অধিককাল স্থায়ী হয়। ১৬৩১ সাল থেকে ১৬৩৫ সাল পর্যন্ত আরাকানে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ হয়। এরপর মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। ১৬৬০ সালে আরাকান রাজা থান্দথুধম্মা নিজ রাজ্যে আশ্রিত মোঘল সম্রাট শাহজাদা সুজাকে সপরিবারে হত্যা করে। এরপর শুরু হয় মুসলমানের উপর তার নিষ্ঠুর অমানবিক অত্যাচার নিপীড়ন। প্রায় সাড়ে তিনশ বছর মুসলমানদের কাটাতে হয় এই দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে।
১৭৮০ সালে বর্মী রাজা বোধাপোয়া আরাকান দখল করে নেয়। সেও ছিল ঘোর মুসলিম বিদ্বেষী। বর্মী রাজা ঢালাওভাবে মুসলিম নিধন করতে থাকে। ১৮২৮ সালে বার্মা ইংরেজদের শাসনে চলে যায়। তবে ১৯৩৭ সালে বার্মা স্বায়ত্তশাসন লাভের পর বৌদ্ধদের পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ব্যাপক রূপ নেয় এবং তারা প্রায় ৩০ লাখ মুসলিম হত্যা করে। ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। তারা থেকে যায় ভাগ্য বিড়ম্বিত। স্বাধীন দেশের সরকার তাদেরকে নাগরিকত্ব দূরে থাক মানবিক অধিকারটুকুও দেয়নি।
নাসাকা বাহিনী ও বৌদ্ধদের হামলার শিকার হয়ে রোহিঙ্গা মুসলিমরা পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশসহ বিশ্বের আনাচে-কানাচে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। এরা বিশ্বের রাষ্ট্রহীন নাগরিক। ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয় এবং সরকারিভাবে তাদেরকে সেখানে ‘বসবাসকারী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তাদের ভোটাধিকার নেই। নেই কোন সাংবিধানিক ও সামাজিক অধিকার। নিজ দেশে পরবাসী তারা। তারা মিয়ানমারের অন্য প্রদেশে অনুমতি ছাড়া যেতে পারে না। এক সময় যেখানে রোহিঙ্গারা ছিল সংখ্যাগুরু আজ সেখানে তারা সংখ্যালঘু। রাখাইন বৌদ্ধদের সেখানে এনে মুসলিমদের সংখ্যালঘু বানানো হয়েছে।
নতুন করে ভয়াবহ মুসলিম নিধন অভিযান
যুগ যুগ ধরে মুসলিম নিধনের ধাবাহিকতায় গত ৩ জুন ২০১২ ইং থেকে পূর্ব পরিকল্পিত ইতিহাসের নৃশংসতম এ গণহত্যা শুরু করেছে সন্ত্রাসী রাখাইন বৌদ্ধরা। রোহিঙ্গাদের হাতে বৌদ্ধ মহিলা নির্যাতনের অজুহাতে তারা এ গণহত্যার সূচনা করে। শুরুতেই কট্টরপন্থী সন্ত্রাসী বৌদ্ধরা ১০ জন রোহিঙ্গা মুসলিমকে শহীদ করে। তারপর থেকে দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য রাখাইনের তুয়ানগোকিতে এ হামলার ঘটনা ঘটে। এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে মুসলিম রোহিঙ্গারা জুমুয়াবার বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ শুরু করলে ভয়াবহ দাঙ্গা বেঁধে যায়।
মিয়ানমারের আকিয়াব শহরের রামবী গ্রামের এক রাখাইন শিক্ষিকা কর্তৃক ছাত্র পিঠানোকে কেন্দ্র করে অভিভাবক ও শিক্ষকদের গালিগালাজ ও উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়, এতে এক শিক্ষিকা মারা যায়। এরই জের ধরে আকিয়াব শহর থেকে গাড়িযোগে একদল রোহিঙ্গা মুসলিম ইয়াঙ্গুন যাওয়ার পথে ৩ জুন ২০১২ইং টংগু নামক স্থানে পৌঁছলে রাখাইন যুবকেরা গাড়ির হেলপারসহ ১০ রোহিঙ্গা মুসলিমকে পিটিয়ে হত্যা করে। ড্রাইভার কৌশলে পালিয়ে গিয়ে টংবু ইমিগ্রেশনকে অবহিত করে।
নির্মম এ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ও বিচারের দাবিতে ৫ জুন ২০১২ ইং বাদ যোহর ও আছরের নামায শেষে মুসলমানরা ইয়াঙ্গুন শহরে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। এ ঘটনায় মুসলিম অধ্যুষিত পুরো আরাকান রাজ্যে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় ইয়াঙ্গুনে শীর্ষ মুসলিম নেতারা বৈঠক করে। ৮ জুন ২০১২ ইং শুক্রবারে জুমুয়ার নামাযে মুসলমানদের জমায়েত করে শান্ত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। উক্ত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ৮ জুন ২০১২পুরো আরকানে জুমুয়ার নামাযে মুসল্লীরা সমবেত হতে থাকে। মংডু শহরের মসজিদে জুমুয়ার নামায চলাকালে মংডুয়ে বৌদ্ধদের ইউনাইটেড হোটেল থেকে মসজিদে ও মুসল্লীদের উপর পাথর নিক্ষেপ শুরু করে ।
অতঃপর রাখাইন বৌদ্ধরা সম্মিলিতভাবে মুসলিমদের উপর হামলা শুরু করে। হাজার হাজার মুসলমানদের শহীদ করা শুরু করে। মসজিদ-মাদরাসা, ঘর-বাড়ি পোড়ানো শুরু করে। সরকারি মদদে কারফিউ জারি করে সেনা, পুলিশ ও নাসাকা বাহিনীর উপস্থিতিতে রাখাইন বৌদ্ধরা মুসলমানদের গণহত্যা চালাচ্ছে। সংঘর্ষ ও অগ্নিকান্ডের ঘটনা চালাচ্ছে। সাম্প্রতিক এ দাঙ্গার যে খবরাখবর গণমাধ্যমে এসেছে তা খানিকটা একপেশে ও তথ্য গোপনের অপচেষ্টায় দুষ্ট বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা। কারণ প্রকাশিত খবরে এ দাঙ্গার মূল ঘটনা আড়ালে চলে গেছে এবং দাঙ্গার প্রকৃত উৎসকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। বৌদ্ধদের প্রাধান্য থাকায় দেশটির প্রচারমাধ্যম তাদের নিয়ন্ত্রণে। মুসলমান বা রোহিঙ্গাদের তেমন খবরদারি নেই সেখানে।
এ সম্পর্কিত প্রতিবেদনে এক বার্মিজ নাগরিক বলেছে, রোহিঙ্গা হত্যা একটি ভালো কাজ। এদিকে যাদের বিরুদ্ধে সম্ভ্রমহরণের অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের সঙ্গে সঙ্গেই গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কিন্তু প্রতিশোধ নেয়ার নেশায় উন্মাতাল হয়ে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের উপর হামলা চালায় বৌদ্ধ রাখাইনরা। ধর্ষণের ঘটনাটি দুঃখজনক হলেও এর প্রতিশোধ এত নির্মম হতে হবে? আবার একই প্রশ্নে জর্জরিত রোহিঙ্গারাও। হামলার প্রতিবাদে তারা কেন সশস্ত্র সংঘাতের পথ বেছে নিল? এ প্রশ্ন দুটোর উত্তর খুঁজতে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের আশ্রয় নেয়ার কোন বিকল্প নেই। ধর্ম ও জাতিগত বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের মধ্যে এর উত্তর পাওয়া যাবে। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক দাঙ্গার প্রকৃতি বিবেচনা করলে দেখা যায়, রোহিঙ্গারা সংখ্যালঘু হলেও তাদের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা কখনও প্রকাশ করেনি মিয়ানমার সরকার। তাদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। এর প্রমাণ পাওয়া যায় জাতিসংঘ নিযুক্ত মিয়ানমারের বর্তমান প্রতিনিধি ইয়ে মিয়িন্ট অংয়ের উদ্ধৃতি থেকে। সে মুসলমান ধর্মানুসারী রোহিঙ্গাদের ‘বন্য ও বর্বর’ বলে উল্লেখ করেছে। তাছাড়া সেই ১৯৮২ সাল থেকে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের উদ্বাস্তু বলে ঘোষণা করে আসছে। তাদের দেশটির নাগরিকত্ব দেয়া হয় না। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, এরা বাংলাদেশ থেকে আগত বাঙালি আদিগোষ্ঠী। এদের সঙ্গে মিয়ানমারের কোন সম্পর্ক নেই। সে মতামত প্রতিষ্ঠা করতে মিয়ানমার সরকার তাদের উপর এমন অমানবিক নির্যাতন চালায়, যাতে করে তারা দেশ ছেড়ে পালায় অথবা দাসত্ব স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়। এদের এ নাজুক পরিস্থিতি দেখে মেডিসিনস স্যান ফ্রন্টিয়ারস বলেছে, পৃথিবী থেকে বিলুপ্তপ্রায় আদিগোষ্ঠীর তালিকায় ভয়াবহ অবস্থানে রয়েছে রোহিঙ্গারা। এছাড়া সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার পর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীসহ মিয়ানমারের সব মিলিয়ে ১৩৫টি আদিবাসী গোষ্ঠীর উপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে চলেছে। তবে বৌদ্ধ ধর্মান্ধ সামরিক জান্তাদের চোখে রোহিঙ্গা মুসলমানরা ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীতে পরিগণিত হয়।
ফলে রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতায় মুসলমান আদিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ঠেকাতে তাদের ঘরবাড়ি পর্যন্ত পুড়িয়ে দেয়া হয়। রোহিঙ্গাদের সাধারণত স্থানীয়ভাবে ‘কালারস’ নামে অভিহিত করা হয়। সাম্প্রতিক এ দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের ‘দ্য ভয়েস’ নামক সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে। সেখানে একজন পাঠক তার মতামত দিতে গিয়ে লিখেছে, আমাদের উচিত কালারস হত্যা করা অথবা ধ্বংস করা, তা না হলে এ দেশ থেকে বৌদ্ধ ধর্মের অস্তিত্ব মুছে যাবে। এমন উদ্ধৃতি থেকে সহজেই বোঝা যায়, বার্মিজ ও রোহিঙ্গারা ধর্মগত দিক থেকে দ্বান্দ্বিক ও পৃথক সত্তার অধিকারী। সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মিজরা চায় সেখানে বৌদ্ধদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক। সে মতবাদের আলোকে রোহিঙ্গারা ক্ষুদ্র ও ভিনদেশী বলে পরিচিত। দেশটির সাম্প্রতিক অগ্রযাত্রায়ও তাদের কোন স্থান নেই বলে বিশ্বাস করে নেপিডোর সরকার।
তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে মিয়ানমার বিদ্বেষী ও বৌদ্ধদের শত্রু হিসেবে। শুধু তাই নয়, জাতীয়তার প্রশ্নে তাদের গনায় ধরা হয় না। অর্থাৎ অভিন্ন পতাকার তলে মিয়ানমারের জাতীয়তার স্বীকৃতি পায়নি তারা। ফলে যাযাবরের জীবন কাটাতে হচ্ছে তাদের।
সাম্প্রতিক এক হিসাবে জানা যায়, প্রায় তিন লাখ শরণার্থী রোহিঙ্গা বাস করছে বাংলাদেশে। কিন্তু এরা কোনভাবেই বাংলাদেশী নাগরিক নয়, তা আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত। ফলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাদের চলে যেতে জোর তাগিদ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু মিয়ানমার সীমান্তের কাঁটাতার ডিঙিয়ে তারা নিজ দেশে ফিরতে পারছে না। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের পরিচয় এসে দাঁড়িয়েছে রাষ্ট্রহীন জাতিতে। তাছাড়া আরাকান অঞ্চলে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও তা রোধ করার জন্য কৌশল প্রণয়ন করেছে সরকার। ২৫ বছরের পূর্বে মুসলমানদের বিয়ে করার অনুমতি নেই। আর অনুমতি দিলেও রোহিঙ্গাদের জন্য বিয়ের আগে নিবন্ধন করার বাধ্যবাধকতা করা হয়েছে। ফলে নিজ দেশেই ফেরারি জীবনযাপন করে তারা। আর এ নির্মম অত্যাচার তাদের প্রতিশোধপরায়ণ করে তুলেছে। বহুদিনের জমানো ক্ষোভের বিস্ফোরণে জ্বলে উঠেছে রোহিঙ্গারা।
অন্যদিকে ১৭০০ শতকের সময় এশিয়ার বিখ্যাত বাণিজ্য নগরী বলে পরিচিত আরাকানের এমরায়ুক ইউ শহরের স্বাধীন সুলতান ছিলেন একজন মুসলমান। তাহলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, রোহিঙ্গা ও দেশটির অন্য আদিবাসী মুসলমানরা মিয়ানমারে ভুঁইফোড় অথবা উড়ে আসা অধিবাসী নয়। তাদেরও সমৃদ্ধ অতীত রয়েছে। এর বিপরীতে গত কয়েক দশক ধরে লাখ লাখ চীনা শরণার্থী আস্তানা গেড়েছে দেশটিতে। শুধু বৌদ্ধ হওয়ায় তাদের সাত খুন মাফ করেছে মিয়ানমার সরকার। ধর্মের সম্প্রীতি মিশে গেছে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে। এর বিরুদ্ধে কখনও কোন বিদ্রোহ তৈরি হয়নি। কিন্তু নিজ দেশে পরবাসী জীবনযাপন করছে রোহিঙ্গা ও অন্য মুসলিম আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষ। বহির্বিশ্বে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে শুধু প্রচার করা হয়, তাদের অধিকারের কথা কখনও ভুলেও বলা হয় না। রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে কথিত নোবেল জয়ী অং সান সুচিও আলাপ তুলেনা। সুতরাং রোহিঙ্গা মুসলমান আদিবাসীরা মিয়ানমারে এখন অবাঞ্ছিত। কিন্তু নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারাও এখন মুসলিম চেতনায় বিশ্বাসী। ফলে সংঘাত অনিবার্য, তারই প্রমাণ মিলল সাম্প্রতিক দাঙ্গায়।
(আল জাজিরা)