রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদের মূলে রয়েছে দুই বৃহৎ দেশ ভারত ও চীনের বাণিজ্য বিস্তারের পরিকল্পনা। ভারত ইতোমধ্যে রাখাইন রাজ্য দিয়ে তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অঙ্গরাজ্য মিজোরামের সঙ্গে নৌযোগাযোগ স্থাপন করেছে। তারা সিট্যুতেও বন্দর সম্প্রসারণ করছে। অন্যদিকে রাখাইন রাজ্যের ওপর দিয়ে চীন কুনমিং পর্যন্ত সাড়ে ৭ হাজার কিলোমিটার গ্যাস ও পাইপলাইন স্থাপন করেছে। রাখাইনের পশ্চিম উপকূলে রোহিঙ্গা মুসলমান অধ্যুষিত সমতল ভূমিটি কৌশলগত কারণে দুই দেশের জন্যই অতিগুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়েছে। তাই এই দুই দেশকে অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করে দিতে রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের পুরোপুরি নির্মূলে নেমেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। অর্থনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের এমনই ধারণা।
মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক হেড অব মিশন ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, আরাকানের পশ্চিম উপকূলটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীন ও ভারতের কাছে। এখানে অবস্থান নিয়ে বঙ্গোপসাগরের ওপর নজরদারি রাখতে চায় চীন। তা ছাড়া কুনমিংয়ের সঙ্গে আরাকানের ওপর দিয়ে তারা গ্যাস ও তেলের পাইপলাইন স্থাপন করেছে। চকপিউ গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করছে চীন। ভারতও এই অঞ্চলে তাদের তৎপরতা বাড়িয়েছে। এই দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সংঘাতের শিকার হচ্ছে নিরীহ রাখাইন জনগোষ্ঠী।
১৯৯৮ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাসে কাজ করেন মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম।
রাখাইন (সাবেক আরাকান) প্রদেশটি মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিম উপকূলের পাহাড়ি অঞ্চল। এটির আয়তন ৩৬ হাজার ৭৬২ বর্গকিলোমিটার। প্রদেশটির দক্ষিণে রাজধানী সিট্যুর (আকিয়াব) অবস্থান। এটি মিয়ানমারের একটি প্রাচীন সমুদ্র বন্দরও। রাখাইন রাজ্যটি আরাকান পর্বতমালা দ্বারা মূল মিয়ানমার থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। ফলে নব্বইয়ের দশক পর্যন্তও মূল মিয়ানমার থেকে রাখাইন প্রদেশে সড়ক যোগাযোগ ছিল না। ২০০১ সালে দেশটি চীনের সহায়তায় সিট্যু থেকে রেঙ্গুন পর্যন্ত একটি মহাসড়ক নির্মাণে সক্ষম হয়। রাখাইনের বেশিরভাগ ভূমি পাহাড়ি হলেও পশ্চিমাঞ্চলের সমুদ্র তীরবর্তী একটি বড় অংশ সমতল। এটির উত্তর-পশ্চিমে নাফ নদী এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর। উপকূল গভীর। এই পুরো সমতলে গত চারশ বছরেরও বেশি সময় ধরে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বসবাস। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গারা সংখ্যালঘু হলেও এই অঞ্চলটি তাদের নিয়ন্ত্রণে। রাখাইনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মংডু সমুদ্র বন্দরের একচ্ছত্র ব্যবসায়ীও মুসলমানরাই। ভূমি এবং রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে একপ্রকার সংঘাত ও সংগ্রামে জড়িত আরাকানের রোহিঙ্গারা। তাই এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক আওতা বাড়ানো অথবা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে দেওয়াকেই শ্রেয় মনে করছে মিয়ানমার সরকারÑ এমন মত দিয়েছেন মেজর (অব.) এমদাদ।
জানা যায়, ভারত ইতোমধ্যে আকিয়াব বন্দর থেকে নৌপথে মিজোরাম রাজ্যের আইজল পর্যন্ত যোগাযোগ স্থাপন করেছে। ফলে এই অঞ্চলে দেশটির বিচরণও আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়ে গেছে। ভারত রাখাইনে আরও সক্রিয় হতে চায়। এ কারণে তাদের কৌশলগত অবস্থান মিয়ানমারের পক্ষে। গত ২৪ আগস্ট রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতন শুরুর পর ৫ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমারের প্রশাসনিক রাজধানী নেপিডো সফর করেন। তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের পক্ষে থাকার অঙ্গীকার করেন।
অন্যদিকে গত ১৩ সেপ্টেম্বর চীনও একই ইস্যুতে মিয়ানমারের পক্ষে নিজেদের অবস্থানের ঘোষণা দেয়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ রোহিঙ্গা ইস্যুতে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রাক্কালেই এ ঘোষণা দেয় চীন। আরাকান রাজ্যে চকপিউ গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করছে মিয়ানমার। এতে সহায়তা করছে চীন।
জানা যায়, মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়াতে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশও চেষ্টা চালিয়ে আসছে। দেশটির সঙ্গে সড়ক ও রেল যোগাযোগ স্থাপনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উখিয়ার ঘুমদুম সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সড়ক নির্মাণের কাজ বর্তমানে চলমান রয়েছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন সম্প্রসারণ হলে সেটি মিয়ানমার পর্যন্ত সংযুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে। ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, রোহিঙ্গা ইস্যু বারবার দুই দেশের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি করেছে। ফলে ভারতের মতো বড় অর্থনীতির দেশ এই সুযোগ নিচ্ছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের নৌপ্রটোকল চুক্তি নেই। তাই মংডু, সিট্যু ও অন্যান্য বন্দর থেকে ছোটখাটো জাহাজগুলো পণ্য নিয়ে বাংলাদেশে আসে না। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে একটি জাহাজ সিঙ্গাপুর বন্দর ছুঁয়ে ইয়াঙ্গুন যেতে গড়ে ছয়দিন লাগে। অথচ বন্দর প্রটোকল থাকলে চট্টগ্রামের সঙ্গে একদিন এবং টেকনাফ বন্দর থেকে সিট্যুতে যেতে জাহাজের সময় লাগত ৮ ঘণ্টা। টেকনাফ বন্দর থেকে মংডু যেতে লাগে মাত্র ৩০ মিনিট।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট এসএম নুরুল হক আমাদের সময়কে বলেন, ২০১২ সালের পর মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য সারা বিশ্ব এগিয়ে এসেছে। বাংলাদেশও এগিয়েছে। আগে বাংলাদেশে মিয়ানমার থেকে আমদানি বেশি ছিল। এখন প্রায় সমান সমান। এর পরিমাণ প্রায় ৪১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। রোহিঙ্গা ইস্যুতে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে আমাদের সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে।
হামিদ উল্লাহ, টেকনাফ থেকে ফিরে