বাঙালি ও অন্যদের শান্তিচুক্তির বিরোধীতাঃ বিএনপি শান্তিচুক্তির বিরোধীতা করে লংমার্চ শুরু করে এবং সেখানে ঘোষণা দেয় যে, তাঁরা ক্ষমতায় আসলে শান্তি চুক্তি বাতিল করবে। প্রেক্ষাপট ও বিশালতা বিবেচনায় সেটি ছিল এযাবৎ কালের সবচেয়ে বড় লংমার্চ।
শান্তিচুক্তি বিরোধী লংমার্চ
কিন্তু বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় গিয়ে সেই চুক্তি বাতিল তো দুরে থাক বাস্তবায়নে জোরালো ভূমিকা পালন করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করে সাবেক শান্তি বাহিনীর মেজর রাজেশ তথা মণি স্বপন দেওয়ানকে
নমিনেশন দিয়ে এমপি ও মন্ত্রী বানায়। এর পরের নির্বাচনে গোটা তিন পার্বত্য জেলায় কোন বাঙালিকে নমিনেশনও দেয়নি দলটি। ধারনা করা হয়, বিএনপির এহেন আচরণের পেছনে পশ্চিমা চাপ রয়েছে। এ দিকে সাবেক শান্তি বাহিনী হতে প্রসীত খীশার নেতৃত্বে একাংশ চুক্তির বিরোধীতা করে বের হয়ে নতুন সংগঠন ইউপিডিএফ গঠন করে। ইউপিডিএফ পাহাড়ে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন দাবী করে।
শান্তি চুক্তিতে আপাত স্থিতিশীলতা আসলেও, এর অসারতা এখন বোঝা যাচ্ছে। এখনও পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি শোনা যায়। প্রায় প্রতি সপ্তাহে জনসংহতি ও চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ এর মধ্যে চাঁদাবাজি সংক্রান্ত ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন স্থানে বন্দুক যুদ্ধ ঘটে। সেখানকার পাহাড়ি-বাঙালি উভয় সম্প্রদায়ই রয়েছে আতংকে। প্রায়ই বাঙালি-পাহাড়ি দাঙ্গায় হতাহতের খবর পাওয়া যায়। চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণ, সন্ত্রাস আগের চেয়ে তো কমেইনি, বরং তিনগুণ বেড়েছে। কারণ জেএসএস(জনসংহতি), ইউপিডিএফ ছাড়াও জেএসএস থেকে ‘সংস্কারপন্থী’ বলে পরিচিত নতুন আরেক সংগঠনের আবির্ভাব ঘটেছে। এবার সমপরিমাণ চাঁদা তিন দলকেই দিতে হয় পাহাড়ি-বাঙালি সবাইকে।
এ ছাড়া চুক্তি বাস্তবায়নের পরপরই বিএনপির আগেই সেখানকার বাঙালিরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিজেদের আপত্তির কথা তীব্রভাবে তুলে ধরে। ১৯৯৮ এর ৩ জুন ‘সাপ্তাহিক পূর্ণিমা’তে শান্তি চুক্তির ফলে কোথায় কোথায় অন্যায় ভাবে বাঙালিদের স্বার্থ লঙ্ঘিত হয়েছে এ নিয়ে ওয়াদুদ ভূইয়া (পরবর্তীতে খাগড়াছড়ি আসনের নির্বাচিত সংসদ সদস্য) তা সুনির্দিষ্ট তুলে ধরেন। সে গুলোর উপর নিম্নে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচিত হল-
- চুক্তির খ-খণ্ডের ৩০-এর ঘ- ধারা মোতাবেক বাঙালিদের নাগরিকত্ব সনদ দিবেন উপজাতীয় রাজা এমনকি নির্বাচনে প্রার্থী হতে হলেও, যা সংবিধানসম্মত নয়।
- খ- খণ্ডের ২৬ ধারা অনুযায়ী আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদের অনুমতি ব্যাতীত জমি-ভূমি ক্রয়বিক্রয়য়, হস্তান্তর এমনকি ইজারা পর্যন্ত দিতে পারবে না কেউ, স্বয়ং সরকারও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে ভূমি অধিগ্রহণ করতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে নাগরিক হিসেবে বঞ্চিত করা হয়েছে বাঙালিদের।
- পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ, সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যপদ সহ গুরুত্বপূর্ণ জনপ্রতিনিধিত্ব উপজাতিদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে, অথচ সেখানে বাঙালিদের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক।
- চুক্তির খ-খন্ডের ১৬ ধারায়, যে শান্তি বাহিনী দীর্ঘ এত ২৪ বছর ধরে দেশপ্রেমিক বাঙালি ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করে আসছে, তাদেরকে ৫০,০০০ টাকা পুরস্কার সহ পুনর্বাসনের ব্যাবস্থা করা হয়েছে। অথচ দেশমাতৃকার জন্য শান্তি বাহিনীর হাতে যারা নির্মমভাবে আহত/নিহত হয়েছে, তাঁদেরকে কোন প্রকার ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসনের ব্যাবস্থা করা হয়নি।
- চুক্তির গ-খন্ডের ৭ নং ধারা মোতাবেক পরিষদ সমূহের তিনটি উপসচিব ও একটি যুগ্ন-সচিব সহ চারটি পদে বাঙালি হওয়ার অপরাধে বাঙালি কর্মকর্তাদের বদলে পাহড়িদের নিয়োগ দেয়া হবে, এর ফলে বাঙালিদের ন্যায্য প্রাপ্তির জন্য আর কোনও প্রশাসনিক স্তর রইলো না।
- চুক্তির খ-খণ্ডের ৩২ ধারায় পরিষদসমূহের ধারায় মহান জাতীয় সংসদে পাশকৃত আইনের বিরুদ্ধে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা আঞলিক পরিষদকে দেওয়া হয়েছে, যা সংবিধানসম্মত হতে পারে না। এ যেন গণতান্ত্রিক শাসন ব্যাবস্থার ভেতর আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র।
- চুক্তির খ- খণ্ডের ২৪ ধারায় সিপাই থেকে সাব-ইন্সপেক্টর পর্যন্ত পদে শান্তি বাহিনী প্রত্যাগতদের নিয়োগের ক্ষমতা পরিষদকে দেওয়া হয়েছে। যারা কিছুদিন আগেও আনসার, বিডিআর, পুলিশ, সেনাবাহিনী সহ সাধারণ বাঙালিদের দেখা মাত্র গুলি করতো, তাঁরা এবার বৈধ অস্ত্র দিয়ে তা করতে যে দ্বিধা করবে না, তাঁর নিশ্চয়তা কি?
- চুক্তির খ-খন্ডের ১৪ ধারা অনুযায়ী পরিষদকে সরকারী কর্মচারী উপজাতীয় থেকে নিয়োগ, বদলি ও শাস্তি প্রদান ইত্যাদি ক্ষমতা পরিষদকে দেওয়া হয়েছে।
- চুক্তির খ খণ্ডের ২৬ ধারায় (গ) অনুযায়ী চেইনম্যান, আমিন, সারভেয়ার, কানুনগো, সহকারী কমিশনার (ভূমি) সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা শন্তু লারমা কতৃক নিয়ন্ত্রিত (এখন পর্যন্ত শন্তু লারমাই সেটার চেয়ারম্যান, অজ্ঞাত কারণে নির্বাচন হয়নি একবারও) আঞ্চলিক পরিষদকেই দেয়া হয়েছে। এর কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিরা নিজেদের ভূমির উপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন।
- চুক্তির গ-খন্ডের ৮ ধারায় পৌরসভা, স্থানীয় বিভিন্ন পরিষদ, তিন পার্বত্য জেলার প্রশাসনের সার্বিক দায়িত্ব পরিষদকে দেওয়া হয়েছে, যা প্রজাতন্ত্রের ভেতর আরেকটি প্রজাতন্ত্র ও ইউনিটারি বাংলাদেশ কনসেপ্টের সাথে সাংঘর্ষিক।
- চুক্তির ৭ ধারা ও ১৬ ধারার (ঘ) অনুযায়ী শান্তি বাহিনী ও উপজাতিরা এ যাবতকাল যত ব্যাংক ঋণ নিয়েছে, তা সুদ সমেত মওকুফ করা হয়েছে। অথচ, যে সকল বাঙালি শান্তি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের কারণে ঋণ নিয়েও তা কাজে লাগাতে পারেনি, পারলেও শান্তি বাহিনী তা ধ্বংস করে দিয়েছে, তাঁদের ঋণ মওকুফ করা হয়নি, বরং সার্টিফিকেট মামলায় তাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
- বাংলাদেশ সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদের এবং ২৮ (১, ২, ৩) অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করে ও পশ্চাৎপদ জনগণের (পাহাড়ি) ধুঁয়া তুলে চুক্তির বৈধতার সাফাই দেওয়া হচ্ছে। যদি ঐ ধারার প্রয়োগ করতেই হয়, তাহলে সেটির সুযোগ তো চাকমারা পেতে পারে না। কেননা, চাকমাদের মধ্যে ৭০% শিক্ষিত, বাঙালিরা ১০%, অন্যান্য উপজাতিরা ১০%-১২% এর বেশি নয়। চাকরি, ব্যাবসা-বাণিজ্যসহ আর্থ-সামাজিকভাবে চাকমারা এগিয়ে। সে ক্ষেত্রে ‘পশ্চাৎপদ অংশ’ তো বাঙালি ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপজাতিরা। তাছাড়া একই পাহাড়ে, একই আবহাওয়ায়, একই প্রতিকূল অবস্থায় বাঙালিরাও তো বাস করছে। সুতরাং, পশ্চাৎপদ অংশের উন্নয়নের নামে চাকমাদের উন্নয়ন নয়, বরং পার্বত্য বাঙালি ও ক্ষুদে উপজাতিদের উন্নয়নে সংবিধানে উল্লেখিত ধারা প্রয়োগ ও চুক্তি করা উচিত ছিল।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিরা শান্তি চুক্তিকে নিজেদের প্রতিকূলে নিয়েছে। সেই বিষয়টি ও বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্তে আসা কি যৌক্তিক নয় যে, শান্তি চুক্তি নতুন এক অশান্তির বীজ বপন করেছে? আহমদ ছফা শান্তি চুক্তি নিয়ে আশংকা প্রকাশ করেছিলেন, ‘পার্বত্য শান্তি চুক্তিতে এমন কিছু বিস্ফোরক উপাদান আছে, যা উপজাতি-অউপজাতি জনগোষ্ঠীর মধ্যে অশান্তির পরিমাণ বাড়াবে, দেশের অন্যান্য অঞ্চলে এবং নানা অংশে ছড়িয়ে দেবে অশান্তির আগুন’। আজ আমরা তাঁর কথার আক্ষরিক ফলে যাওয়া দেখতে পাই। তিনি এই চুক্তিকে একটি গণতান্ত্রিক রেফারেন্ডামের মধ্যে দেখতে চেয়েছিলেন। যখন রেফারেন্ডাম ছাড়াই এই চুক্তি পাশ হয়, তখন চুক্তির বিরোধীতা করার কারণ হিসেবে নিম্নের যুক্তিগুলো তুলে ধরেন-
- শান্তিচুক্তি বিভেদ বাড়িয়েছে।
- গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করে এই চুক্তি হয়নি।
- এই ক্ষেত্রে ভারত জুজু নয়, মূর্তিমান প্রবল উপস্থিতি।
- পার্বত্য অঞ্চলে তেল-গ্যাস উত্তোলনের জন্য আমেরিকান কোম্পানির সাথে চুক্তি।
- মার্কিন কোম্পানি কতৃক ভারতেও তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের চুক্তি ইত্যাদি বিষয়।