স্পেন, ইউরোপিয় ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। একদিকে যেমন ইউরোপের প্রথম সভ্যতার উৎকর্ষ সাধিত হয় এখানে অপরদিকে ইনকুইজেশনের মত বর্বরতাও সংগঠিত হয় এখানে। কিন্ত এসব কিছুর মাঝেই স্পেনের সবচেয়ে বেশি উৎকর্ষ সাধিত হয় মুসলিম শাসনামলে। মুসলমানদের স্পেন বিজয়, শাসন, এবং মুসলিম শাসনের বিলুপ্তি নিয়েই এই লেখা।স্পেনের অতীত ইতিহাস থেকে জানা যায় এটি কেল্ট এবং আইবেরিয়দের বাসভুমি ছিল। তখন স্পেন আইবেরিয় উপদ্বীপ নামে পরিচিত ছিল। এক দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের ফলে এই ভুখন্ডটি রোমান সম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। মধ্যযুগে এটা জার্মানিয় ভিসিগোথদের দ্বারা শাসিত হত। ভিসিগোথরা ছিল যাযাবর এবং অত্যন্ত যুদ্ধ প্রিয় জাতি। এরা প্রথম দিকে আরিয়ান খ্রীস্টান ছিল। ৫৮৯ খ্রীস্টাব্দে ভিসিগোথ সম্রাট ক্যথলিক ধর্মমত গ্রহন করলে সম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। পরবর্তিতে এই বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে পার্শবর্তি সামন্ত রাজা রডারিক, কোনেন সিস গোত্রের সাহায্যে তৎকালিন ভিসিগোথ সম্রাট উইটিযাকে সিংহাসনচুত্য করে নিজে সিংহাসনে বসেন। রডারিক, উইটিযাকে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করেন।
আন্দালুসিয়ায় (স্পেইনে) মুসলিম সম্রাজ্যের পরিধি |
রডারিক ছিলেন সম্রাজ্যবাদি এবং উচ্চাভিলাষি। তাই সিংহাসনে বসেই সে তার সম্রজ্যের পরিধি বাড়াতে পার্শবর্তি স্বাধিন ছোট রাজ্যগুলোর দিকে দৃষ্টিনিবদ্ধ করেন। এরি ধারাবাহিকতায় সে সিউটা রাজ্যে আক্রমন করে সিউটা দখল করে নেয়। তখন সিউটার রাজা ছিলেন কাউন্ট জুলিয়ন। কাউন্ট জুলিয়ন প্রথম পালিয়ে গেলেও পরবর্তিতে রডারিকের আনুগত্য স্বীকার করে নেয়। উল্লেখ্য, তখন আনুগত্য স্বীকারের মাধ্যম ছিল নিজের পুত্র অথবা কন্যা কে কেন্দ্রিয় রাজার দরবারে পাঠিয়ে দেয়া। ঐতিহাসিকগন এর দুটি ব্যখ্যা দিয়ে থাকেন। একটি, ভবিস্যতে আনুগত্য স্বীকারকারি যেন বিদ্রহ করতে না পারে অপরটি, কেন্দ্রিয় শাসন ব্যবস্থার সাথে অঙ্গরাজ্যগুলোর সামঞ্জস্য বজায় রাখার জন্য কেন্দ্রের নিয়ম কানুন শিখানো। কাউন্ট জুলিয়নো তার একমাত্র কন্যা ফ্লোরিন্ডাকে তলেডোতে (তৎকালিন স্পেনের রাজধানি) পাঠিয়ে দেন। পরিবর্তে রডারিক তাকে সিউটা ও আলজি সিরাস এর গভর্নর নিযুক্ত করেন। জুলিয়নের কন্যা ফ্লোরিন্ডা অত্যন্ত সুন্দরি ছিল। রডারিক ফ্লোরিন্ডাকে ধর্ষন করে। ফ্লোরিন্ডা গোপনে তার বাবাকে চিঠি লিখে সমস্ত ঘটনার বর্ননা দিলে জুলিয়ন রডারিকের কাছ থেকে কিছু দিনের ছুটির কথা বলে ফ্লোরিন্ডাকে তলেডো থেকে নিয়ে যায়।
রডারিকের ছবি |
উইটিযা ছিল কাউন্ট জুলিয়নের শশুর। রডারিক উইটিযাকে হত্যা করার পরও জুলিয়ন তা সহ্য করে নেয়। কিন্তু এবার মেয়ের অপমানে জুলিয়ন আর মুখবুজে থাকেনি। সে তৎকালিন মুসলিম খেলাফতের আওতাধিন উত্তর আফ্রিকার মুসলিম গভর্নর মুসা ইবনে নুসাইকে হিসপানিয়া (স্পেন) আক্রমনের আমন্ত্রন জানান।
মুসা, খলিফা প্রথম ওয়ালিদের কাছে এব্যপারে চিঠি লিখলে খলিফা তাকে প্রথমে পরিক্ষা মুলক অভিজান প্রেরনের আদেশ দেন এবং অভিজানের ফলাফলের উপর নির্ভর করে পরবর্তি অভিজান প্রেরনের নির্দেশ দেন। মুসা ইবনে নুসাই প্রথমে তারিফ বিন মালেকের নেতৃত্বে ৪০০জন পদাতিক ও ১০০জন অশ্বারোহি সহ প্রথম অভিজান প্রেরন করেন। প্রথম অভিজান সফল হলে মুসা তার প্রধান সিপাহ সালার তারেক বিন জিয়াদকে ৭০০০ পদাতিক বাহীনি নিয়ে পরের অভিজানের নির্দেশ দেন।
সৈন্যসামন্ত নিয়ে তারেক বিন জিয়াদ |
তারেক বিন জিয়াদ তার সৈন্য বাহীনি নিয়ে ভূমধ্য সাগর ও কর্ডবার সাগর সংযোগ প্রনালী পার হয়ে হিসপানিয়ার উপকুলের একটি পাহাড়ের কাছে অবতরন করেন। পরবর্তিতে তার নামানুসারে এই পাহাড়টির নাম রাখা হয় জাবাল আত তারেক (বর্তমান জিব্রাল্টার।
তারেক কর্ডবায় পৌছলে মুসা তাদের সাহাজ্যের জন্য আরো ৫০০০ সৈন্য প্রেরন করেন। মোট ১২০০ সৈন্য হওয়া সত্বেও শত্রু পক্ষের লক্ষাধিক সৈন্য মুসলিম সৈন্যদের মনে কিছুটা ভিতি সৃষ্টি করে ফেলে। তারেক ব্যপারটা বুঝতে পেরে এক ঐতিহাসিক সিদ্ধন্ত নেন। তারেক তার সকল সৈন্যদের একত্রিত করে তারা যে জাহাজ গুলোতে চড়ে হিসপানিয়ায় এসেছিল সে জাহাজ গুলো জ্বালিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। সৈন্যরা তার এরূপ সিদ্ধন্তে হতভম্ব হয়ে যায়। কিন্তু নেতার আদেশ হওয়ায় তাদের এ নির্দেশ নির্দিধায় মেনে নিতে হয়। অতঃপর তারেক তার ঐতিহাসিক ভাষন দেন। ভাষনটির নিম্নরূপঃ
ভিসিগোথ শাসনামলের প্রচলিত মুদ্রা |
কর্ডবা উপকুলে মুসলিম বাহীনির জাহাজ জ্বালিয়ে দেয়ার চিত্র |
হিসপাহানিয়ার নতুন নাম করন করা হয় আন্দালুসিয়া। রাজধানি স্থানান্তরিত হয় কর্ডবায়। এসময় আন্দালুসিয়া ছিল ইউরোপের সবচেয়ে সম্বৃদ্ধশালি দেশ। মুসলমানেরা আন্দালুসিয়ায় অনেক স্থাপনা তৈরি করেন। তার মধ্যে রয়েছে ৫০০এরো অধিক মিল যেখানে সমস্ত ইউরোপে ১০০এর অধিক মিল ছিলনা। মুসলমান মাত্রই শিক্ষানুরাগি। সমস্ত ইউরোপ যখন মুর্খতা, কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসে নিমজ্জিত ছিল সেখানে মুসলমানেরা আন্দালুসিয়ায় ৮০০শিক্ষা কেন্দ্র, ৭০০মসজিদ, ৭০টি লাইব্রেরী স্থাপন করে। লাইব্রেরীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় লাইব্রেরীটিতে প্রায় ৬০০০০০বই ছিল। তাছারা ৯০০পাবলিক গোসল খানা, ৬০০০০ প্রাসাদ এবং অনেক রাস্তাঘাট স্থাপিত হয় মুসলিম শাসনামলে। আর জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মুসলমানদের পদচারনা ছিল চোখে পরার মত।
মুসলিম শাসনামলে নির্মিত মাসজিদুল কুর্তুবা এর অভ্যন্তরিন দৃশ্য। |
মুসলিমদের এরূপ অগ্রগতি পার্শবর্তি ইউরোপিয় খ্রীস্টান রাষ্ট্রগুলোর চক্ষুশুল হয়ে দাড়ায়। তারা মুসলিমদের ইউরোপিয় ভূখন্ড থেকে উচ্ছেদ করার জন্য একে অন্যের সাথে জট পাকাতে থাকে। আরগুনের শাসক ফারডিনান্ড এবং কাস্তালিয়ার পুর্তগীজ রানি ইসাবেলা নিজেদের মধ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে মসলমানদের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী দল গঠন করে।
রাজা ফারদিনান্দ ও রানী ইসাবেলা |
১৪৮৩ সালে আবু আব্দুল্লাহ বেআব্দিল লুসান আক্রমন করে পরাজিত ও বন্দি হয়। পরবর্তিতে গ্রানাডার গভর্নরের সাথে তার গৃহযুদ্ধ বেধে যায় যা ছিল ফারডানিন্ডের ষড়যন্ত্র। এভাবে গৃহযুদ্ধের ফলে তাদের শক্তি কমতে থাকলে খ্রীস্টান বাহীনি গ্রানাডা অবরোধ করে। ১৪৯২সালে "ক্যাপিচুলেশন অব গ্রনাডা" নামের এক চুক্তির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্দালুসিয়ায় মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। মুসলিমদের ধর্মিয়, ভাষাগত এবং অর্থনৈতিক সুবিধাই ছিল এ চুক্তির বিষয়বস্তু। এই চুক্তির উপর ভরসা করে মুসলমান শাসকগন সেখানকার মুসলিমদের অভিবাবকহীন করে রেখে যায়।
১৪৯২সালের গ্রানাডার চুক্তি |
এর পরের ইতিহাস অত্যন্ত ভয়াবহ ও মর্মান্তিক ইতিহাস। ১৫০১ সালে এ চুক্তি ভঙ্গ করে আন্দালুসিয়ার খ্রীস্টান শাসক মুসলিম নাগরিকদের ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করতে থাকে। যারা তাদের ধর্ম গ্রহন করতে নারাজ ছিল তাদেরকেই তারা হত্যা করত। অনেক মুসলমান এ পরিস্থিতিতে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হলেও তারা অন্তরে এক আল্লাহতে বিশ্বাস করত। খ্রীস্টান শাসকেরা প্রকাশ্য মুসলিমদের হত্যা করার পর বুঝতে পারল যারা ধর্মান্তরিত হয়েছে তারাও পরিপুর্নভাবে তাদের ধর্মে বিশ্বাসি নয়। তাই তারা একটি পরিকল্পনা করে। তারা ঘোষনা দেয় যে, ৩ দিনের মধ্যে সকল মুসলিমদের আন্দালুসিয়া ছারতে হবে। তারা আরো ঘোষনা করে, যারা মুসলমান তারা যদি খ্রীস্টান জাহাজ গুলোতে ওঠে তাহলে তাদের মুসলিম দেশগুলোতে পৌছে দেয়া হবে। এর মধ্যে তারা বন্দরে জাহাজ ভিড়িয়ে দেয়। তখন স্পেনের অভিবাবকহীন মুসলমানেরা তাদের এত তোর জোর দেখে তাদের বিশ্বাস করে জাহাজে উঠে পরে। কিন্তু খ্রীস্টান রাজা তাদের মাঝ সমুদ্রে নিয়ে জাহাজগুলো ডুবিয়ে দেয়। এদিন অনেক মুসলিম নারী-পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ পানিতে ডুবে শাহাদাত বরন করেন। এদিনটি পরবর্তিতে All fools day/ April fools day হিসেবে পালিত হতে থাকে। আর এভাবেই শেষ হয় স্পেনে মুসলিম শাসনের সোনালী অধ্যয়।
স্পেনে মুসলমানদের শেষ দিনগুলো
১৪৯২ সালে কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেন। সেই বছরটি আরেকটি বিশেষ ঘটনার জন্য বিখ্যাত। গ্রানাডায় নাসিরি বংশের শেষ শাসক দ্বাদশ মুহম্মদের আত্মসমর্পণের বছর। এ বছর ইতি ঘটে স্পেনে মুসলিম শাসনের দীর্ঘ অধ্যায়ের। ৩০শে এপ্রিল, ৭১১ সালে জিব্রাল্টারে তারিক বিন জিয়াদের অবতরণের মধ্য দিয়ে যার সূচনা হয়েছিল। এই সাতশো বছরে আইবেরিয়ান উপকূল পরিণত হয় সমস্ত ইউরোপের সংস্কৃতি ও সভ্যতার কেন্দ্র হিসেবে। উঠে আসেন ইবনে রুশদ্, আব্বাস ইবনে ফিরনাস এবং ইবনে তোফায়েলের মতো মুসলিম পণ্ডিতেরা। আর এই সময়কেই গণ্য করা হয় ইহুদি সংস্কৃতির স্বর্ণযুগ হিসেবে। এ প্রসঙ্গে বিবিসির প্রতিবেদন,
বর্তমান জাবাল আত তারিক বা জিব্রাল্টার |
মুসলিম শাসনের পতনের যুগ
১০০২ সালে ইবনে আবি আমিরের মৃত্যুর পরপরই মুসলিম স্পেনে বিশৃঙ্খলা নেমে আসে। সমগ্র উপদ্বীপ কম-বেশি ৩৪টি ক্ষুদ্র স্বাধীন শাসকের হাতে চলে যায়। তারা একে অপরের সাথে নিজের স্বার্থ নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। এর থেকে মূলত লাভবান হচ্ছিল উত্তর-পশ্চিম অংশের ক্যাথলিক রাজারা।
তারা এই অন্তঃকলহকে কাজে লাগিয়ে দক্ষিণ দিকে রাজ্য বৃদ্ধিতে সফল হলেন। তবে ইউসুফ বিন তাশফিন ১০৯০ সালে মরক্কো থেকে জিব্রাল্টার প্রণালী অতিক্রম করেন এবং আল মুরাবিদ বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। মুরাবিদরা অল্প সময়ের জন্য হলেও আগের দাপট ও প্রতিপত্তির প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়।
মুরাবিদদের ক্ষমতা যখন ক্ষয়িষ্ণু, তখন ১১৪৭ সালে আল মোহাদরা ইতিহাসের পাতায় সামনে চলে আসে। তাদের সবচেয়ে বড় বিজয় ছিল ১১৯৫ সালে আলারকোসে খ্রিস্টান মিত্রবাহিনীকে পরাজিত করা। আভ্যন্তরীণ নানা কোন্দলের কারণে তারা জর্জরিত হয়ে পড়ে দ্রুত। ১২১২ সালে লে নাভাস দে তলোসার যুদ্ধে পরাজিত ও উচ্ছেদ হয়।
বহুধা বিভক্ত রাজ্যগুলোে একে একে তলিয়ে গেল |
এদিকে গ্রানাডার মুহাম্মদ ইবনে আল আহমার ক্যাস্টাইলের ফার্দিনান্দের রাজায় পরিণত হয়। এমনকি ১২৪৮ সালে তাকে অন্য মুসলিম রাজ্য সেভিল বিজয়ে সহযোগিতা করে। ততদিনে পতন ঘটে গেছে কর্ডোবা (১২৩৬ সালে) এবং ভ্যালেন্সিয়ার (১২৩৮ সালে)। আস্তে আস্তে অন্য নগরীগুলোর ভাগ্যে একই পরিণতি নেমে আসলো। শুধু বাকি থাকলো গ্রানাডা। পরবর্তী প্রায় দুশো বছর গ্রানাডা টিকে থাকতে পেরেছে নিজের যোগ্যতার কারণে নয়, কেবল স্প্যানিশ রাজাদের অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েনের জন্য।
নিঃসঙ্গ, ক্লান্ত গ্রানাডা
আস্তে আস্তে পুরো আইবেরিয়ান পেনিনসুলায় গ্রানাডার অবস্থা দাঁড়ায় নিঃসঙ্গ তপস্বীর মতো। এজন্য তা মূলত অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা সর্বহারা মানুষদের অভিবাসন কেন্দ্রে পরিণত হয়। যারা এসেছিল আলমেরিয়া, সেভিল, সারাগোসা কিংবা ভ্যালেন্সিয়ার মতো নগরী থেকে। পরিণামে গ্রানাডার লোকসংখ্যা বেড়ে গেল কয়েকগুণ। শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটলো।
জিব্রাল্টারের মানচিত্র |
গ্রানাডায় তখন শাসক আবুল হাসান (১৪৬৫-৮২)। ক্যাথলিকদের সম্মিলিত বাহিনী ১৪৮২ সালে দক্ষিণ-পশ্চিম গ্রানাডায় সিয়েরা দে আল হামাহর তীরে অবস্থিত আল হামাহ দুর্গ দখল করে নেয়। মসজিদে আগুন ধরিয়ে দেবার কারণে অনেক নারী ও শিশু মারা যায়। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় পরপর দুবার পুনঃদখলের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন আবুল হাসান।
সিংহাসনের টানাপোড়েন
আবুল হাসানের পুত্র মুহম্মদ আবু আব্দুল্লাহ মায়ের প্ররোচনায় পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে লিপ্ত হন। ১৪৮২ সালে শহর রক্ষীদের সাহায্যে আল হামারা অবরোধ করেন। গ্রানাডা তার অধিকারে আসে। স্পেনীয় ইতিহাসে তিনি বোআবদিল নামে পরিচিত। ১৪৮৩ সালে বোআবদিল ক্যাস্টিলের অধিকারে থাকা লুসেনা আক্রমণ করে পরাজিত ও বন্দী হন।
হতভাগ্য বোআবদিল |
শূন্য সিংহাসনে পুনরায় আরোহণ করেন পিতা আবুল হাসান। খুব দ্রুত ভাই মুহাম্মদ আল জাগালের কাছে ক্ষমতা ত্যাগ করেন ১৪৮৫ সালে। বন্দী বোআবদিলকে ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা ক্ষয়িষ্ণু মুসলিম রাজ্যের বিরুদ্ধে দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন। ক্যাস্টিলের সৈন্যবাহিনী নিয়ে তিনি চাচার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হন এবং ১৪৮৬ সালে রাজধানীর কিছু অংশ দখল করেন।
গ্রানাডায় দুই সুলতানের আধিপত্যের দ্বন্দ্ব সুযোগ এনে দিল ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলাকে। তারা আলোরা, কাসার, বনিলা, রোন্ডা ও অন্যান্য শহরগুলো অধিকার করেন। পরবর্তীতে লোজা, আলমেরিয়া এবং মালাগা তাদের পদানত হয়। নাগরিকদের দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হতে থাকে। প্রচণ্ড অবরোধের মুখে সহায়হীন অবস্থায় আল জাগাল ১৪৮৭ সালে আত্মসমর্পণে বাধ্য হন। প্রচণ্ড দুর্দশায় তিনি তিলিমসানে গমন করে বাকি জীবন সেখানেই কাটান। তার সম্পর্কে ঐতিহাসিক লেনপুল বলেন,
তিনি সর্বশেষ মুর শাসক। তিনি ছিলেন সাহসী যোদ্ধা, যথার্থ শাসক এবং খ্রিস্টশক্তির বিরুদ্ধে অটল প্রতিদ্বন্দ্বী। যদি ভাতিজার দ্বারা বিঘ্ন না ঘটতো, তবে গ্রানাডা তার হাতেই থাকতো গোটা জীবন। (The Moors in Spain, Page- 248)
শেষমেশ আর পেরে উঠলেন না আল জাগাল |
বোআবদিল উপাখ্যান
এবার পালা আসে আবু আবদুল্লাহ ওরফে বোআবদিলের। ১৪৯০ সালে ফার্দিনান্দ তাকে গ্রানাডা সমর্পণ করতে আদেশ দেন। এতদিন ধরে মিত্রতা ধরে রাখা আবু আবদুল্লাহ অস্বীকার করলেন। ফলশ্রুতিতে ৪০,০০০ পদাতিক এবং ১০,০০০ অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে ফার্দিনান্দ রওনা হন জবাব দিতে। ১৪৯১ সালে গ্রানাডাকে লণ্ডভণ্ড করে দেয় তার উন্মত্ত বাহিনী। প্রধান সেনাপতি মুসা বিন গাজানের নেতৃত্বে মুসলিম অশ্বারোহীরা প্রতিরোধ করার প্রবল প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু কোনো প্রকার সাহয্য না পাওয়ার কারণে ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসে মুসলিমদের মনোবল ও শক্তি। অতঃপর ২রা জুন, ১৪৯২ সালে বোআবদিল আত্মসমর্পণ করেন।
দুই মাসের নিরুপায় ভাগ্য বিড়ম্বনার পর মুসলমানরা স্পেনে তাদের সর্বশেষ শক্তিশালী দুর্গ হস্তান্তর করে এক সন্ধির নাটকীয়তায়।
লালচে রঙের জন্যই নাম আল হামারা দুর্গ |
সন্ধি ও তার শর্তসমূহ
সেনাপতি মুসা ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলার উপর ভরসা করতে নারাজ ছিলেন। অনেকটা এ কারণেই তিনি শর্তসাপেক্ষে আত্মসমর্পণ করতে বিরোধিতা করেছেন। সন্ধির কয়েকটি শর্ত ছিল নিম্নরূপ-
১. বোআবদিল, তার অফিসার এবং নাগরিকগণ ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলার প্রতি আনুগত্যের শপথ নেবে।
২. বোআবদিল আল বুশরাতে একটা জায়গীর পাবেন।
৩. মুসলমানরা জীবন ও ধর্মের স্বাধীনতা ভোগ করবে।
৪. সমস্ত বন্দী মুসলিম মুক্তি পাবে।
৫. তাদের আচার, অনুষ্ঠান, রীতিনীতি, ভাষা ও পোশাক বহাল থাকবে।
৬. মুসলিম ও খ্রিস্টানদের মধ্যকার বিরোধ দু'পক্ষ মিলে সমাধান করবে।
৭. চাইলে সমস্ত মালামাল নিয়ে যেকোনো মুসলমান স্পেন ছেড়ে চলে যেতে পারবে। চাইলে আবার তিন বছরের মধ্যে ফিরে আসতে পারবে। এরও পরে হলে সম্পদের এক-দশমাংশ প্রত্যার্পন করতে হবে।
৮. নতুন মুসলমানদের উপর পূর্বের ধর্মে ধর্মান্তরিত করার কোনো চেষ্টা করা হবে না।
৯. মুসলিম শাসকের সময় যে কর দিতে হতো, তা-ই চালু থাকবে।
১০. চুক্তির শর্তসমূহ পালন করার জন্য পরিচালক নিয়োগ করা হবে।
প্রচণ্ড ক্ষোভ আর কষ্ট নিয়ে দুর্গ ছেড়ে বের হয়ে যায় সবাই |
দুই মাস অতিবাহিত হবার পরেও মিশর, তুরস্ক কিংবা অপরাপর মুসলিম রাজ্য থেকে কোনোপ্রকার সাহায্য এলো না। ক্যাস্টেলিয়গণ শহর অবরোধ করলে বোআবদিল আন্দ্রাক্স গমন করেন। পরে সেখান থেকে ফেজে নির্বাসিত হন। আবু আব্দুল্লাহ বিদায় নিলেন। মিনারগুলোতে অর্ধচন্দ্রের পরিবর্তে ক্রুশ শোভা পেতে থাকলো। যে পাহাড়ে দাঁড়িয়ে তিনি রাজধানীর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেঁদেছেন, তা আজও 'মুরের দীর্ঘশ্বাস' নামে পরিচিত। তার মা তাকে বলেছিলেন-
যেহেতু পুরুষের মতো দাঁড়িয়ে রক্ষা করতে পারোনি, নারীর মতোন ফুঁপিয়ে কাঁদো। (J. Read: The Moors in Spain and Portugal, p. 219)
ফেজে অত্যন্ত দুর্দশাপূর্ণ দিন যাপনের মাঝেই ১৫৩৮ সালে তার মৃত্যু হয়।
ফার্দিনান্দের পরবর্তী প্রতিক্রিয়া
সন্ধির পরবর্তী সাত বছর পর্যন্ত ক্যাথলিক শাসক ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলার সাথে মুসলিমদের সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকে। কিন্তু ক্যাস্টিলীয় এই রাজা দ্রুত তার প্রতিশ্রুতির কথা বেমালুম ভুলে যায়। জোরপূর্বক প্রজাদের ধর্মান্তরিত করতে শুরু করে। গ্রানাডায় রাশি রাশি আরবি বই আগুনে ফেলা হয়। ফ্রান্সিসকো জিমেনেজ দে সিসনেরস ১৪৯৮ সালে গ্রানাডার মুসলিমদের ধর্মান্তরিত করার উদ্দেশ্যে মিশনারী হিসেবে নিযুক্ত হন।
সাবেক মুসলমানরা পরিচিত হতো মরিস্কো নামে |
সাবেক মুসলমানরা পরিচিত হতো মরিস্কো নামে। গ্রানাডার প্রধান আর্চবিশপ হেরনান্ডো দে তালাভেরা মরিস্কোদের কর্মপরায়ণতা ও নৈতিকতার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ‘বিশ্বাসহীন কর্ম ও কর্মহীন বিশ্বাস’ এর ধারণা দেন। জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করায় পুরাতন গ্রানাডায় কিছু মরিস্কো বিদ্রোহ করে। এর প্রতিক্রিয়ায় আইন পাশ করানো হয় দুই বছরের মাথায়। হয় ধর্মান্তরিত হতে হবে, নাহলে অর্থদণ্ড দিতে হবে। প্রতি বছর মাথাপিছু দশ স্বর্ণমুদ্রা কর দিতে হতো কিংবা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে হতো। অনেকেই কর দিতে না পেরে ধর্মান্তরিত হবার পথ বেছে নেয়। ধর্মান্তরিত হলেও মিলতো তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক মর্যাদা।
সম্পূর্ণ ভিন্ন আইবেরিয়ান উপদ্বীপ
বলে রাখা ভালো, মুসলিমদের বিতাড়নের বহু আগেই ইহুদিদের সমূলে উচ্ছেদ করা হয় স্পেন থেকে। ১৪৯২ সাল থেকেই হয় ধর্মান্তর কিংবা দেশত্যাগের আইন জারি হয়।
ইহুদিদের উপর আক্রমণ আসে সবার আগে |
প্রথমদিকে ভ্যালেন্সিয়া এবং অ্যারাগনের মরিস্কোরা ধর্ম পালনের অনুমতি পেয়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে ঘোলা হয়ে উঠে পরিস্থিতি। ১৫২৫ সালে ধর্ম, ভাষা ও প্রথার বিরুদ্ধে আইন হয়। এজন্য চালু করা হয়েছিলে ফারদা নামক কর। ১৫৬৮সালে মরিস্কোরা বিদ্রোহ করলে তাদের দমন করা হয়। চূড়ান্তভাবে তাদের দমন করার জন্য ১৬০৯ সালের ৪ঠা আগস্ট আইন পাশ করা হয়। নতুন খ্রিস্টানসহ ৪,৬৭,৫০০ জন মরিস্কো দেশ ত্যাগ করে। ১৬১০-১২ সালের মধ্যে আন্দালুসিয়া ও স্পেনের বিভিন্ন এলাকা থেকে মরিস্কোরা বিতাড়িত ও নির্বাসিত হয়। ১৬১০ সালে প্রায় ১,০০০ শিশু তাদের মাতা-পিতাকে স্পেনে রেখে দেশ ত্যাগ করে।
অজস্র মরিস্কো দেশত্যাগ করে |
অনেকে ফ্রান্সে আশ্রয় গ্রহণ করতে চাইলে ফ্রান্স অপারগতা দেখায়। নির্বাসিতদের মধ্যে অধিকাংশ তিউনিশিয়া ও রাবাতে এবং সামান্য অংশ তুরস্কে আশ্রয় নেয়। মধ্যযুগের ইতিহাসে এমন মর্মান্তিক ঘটনা বিরল। গঞ্জালেস প্যালেন্সিয়া মনে করেন,
মরিস্কোদের নির্বাসনের ফলে স্পেনের কৃষিক্ষেত্র ও শিল্পকারখানাগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। জনপদ পরিণত হয় প্রেতপুরিতে। (ইনকুইজিশন, চার্লস লী, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা- ৪১০)
সত্যিকার অর্থেই একসময়ের মুসলিম খেলাফতের প্রাণকেন্দ্র থেকে নিষ্ঠুরভাবে বিতাড়িত হয় মুসলমানরা। শিল্প ও জনসমৃদ্ধ স্পেন হারিয়ে যায় ক্যাথলিক জাত্যাভিমানের তলে, এখনো যার ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান। সেই আল হামারা, সেই কর্ডোবা। মুসলিম ইতিহাসের পাতায় রক্ষিত একখণ্ড দীর্ঘশ্বাস।
ইসলামের হারানো ইতিহাস
৭১১ খ্রিস্টাব্দে আইবেরিয়া উপদ্বীপে (বর্তমান স্পেন ও পর্তুগাল) ইসলাম পৌঁছায়। সেখানকার রাজা রডারিক এর অত্যাচারী শাসনের ইতি ঘটাতে আইবেরিয়ার নির্যাতিত-নিপীড়িত খ্রিস্টানদের থেকে আমন্ত্রণ পাওয়া মুসলিম বাহিনী তারিক বিন জিয়াদের নেতৃত্বে মরক্কো ও স্পেনের মধ্যবর্তী জিব্রাল্টার প্রণালী অতিক্রম করে। এরপর সাত বছরের মধ্যেই আইবেরিয়া উপদ্বীপের বেশিরভাগ অঞ্চলই মুসলিম নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। আর এই অঞ্চলের বিভিন্ন অংশ পরবর্তী ৭০০ বছর ধরে মুসলিম নিয়ন্ত্রণেই থাকে।
রডারিকের নামে প্রচলিত মুদ্রা |
[রিকনকুইস্তা (Reconquista) হচ্ছে একটি স্পেনীয় ও পর্তুগীজ শব্দ যার ইংরেজি হচ্ছে Reconquest (অর্থঃ পুনর্দখল)। ঐতিহাসিকরা ৭১৮ বা ৭২২ থেকে ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ৭৭০ বছরের সময়কালকে “রিকনকুইস্তা” হিসেবে অভিহিত করে থাকেন, যা মূলত খ্রিস্টানদের স্পেন পুনর্বিজয়ের আন্দোলনকে বুঝানো হয়।]
গ্রানাদা আমিরাত
রিকনকুইস্তার সময় আল-আন্দালুসের উত্তরদিক থেকে আসা হানাদার খ্রিস্টান রাজ্যগুলোর হাতে একের পর এক মুসলিম রাজ্যগুলোর পতন হতে থাকে। কর্ডোবা, সেভিয়া এবং টলেডোর মতো বড় বড় শহরগুলোর পতন হয় ১১শ থেকে ১৩শ শতকের মধ্যে। যদিও উত্তর আফ্রিকার মুরাবিতুন এবং মুওয়াহিদুন আন্দোলনগুলো খ্রিস্টানদের আক্রমণের এই স্রোতকে মন্থর করতে সাহায্য করেছিল, তবে মুসলিমদের মাঝে চরম অনৈক্য শেষ পর্যন্ত তাদের রাজ্যহীন ও ভূমিহীনে পরিণত হওয়ার দিকেই ধাবিত করে।
গ্রানাদা আমিরাতের সীলমোহর, যাতে লেখা রয়েছে “আল্লাহ ছাড়া কোন বিজয়ী নেই” |
একটিমাত্র মুসলিম প্রদেশ — গ্রানাদা – ১৩শ শতকে খ্রিস্টানদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল। ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে কর্ডোবার পতনের পর গ্রানাদা আমিরাতের শাসকগণ শক্তিশালী খ্রিস্টান ক্যাস্টিলে সাম্রাজ্যের সাথে এক বিশেষ চুক্তি স্বাক্ষর করে। অর্থাৎ তারা “গ্রানাদা আমিরাত” হিসেবে স্বাধীন থাকার অনুমতি পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ক্যাস্টিলে সাম্রাজ্যের আক্রমণের মুখোমুখি হওয়ার পরিবর্তে তাদেরকে চড়া মূল্যে ক্যাস্টিলে সাম্রাজ্যের কাছে কর প্রদান করতে হয়েছিল। এই কর প্রদান করতে হতো প্রতি বছর স্বর্ণমুদ্রা হিসেবে। এটি গ্রানাদার মুসলিমদের আরো দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় ফেলে দেয় যেহেতু তারা নিজেরাই নিজেদের শত্রুদের কাছে কর প্রদানের মাধ্যমে শত্রুদের ধীরে ধীরে আরো শক্তিশালী করে তুলছিল।
এছাড়াও গ্রানাদা আমিরাতের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকার পেছনে অন্যান্য আরো কারণগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে এর ভৌগলিক অবস্থান। গ্রানাদা দক্ষিণ স্পেনের সিয়েরা নেভাদা পর্বতমালার মধ্যে অনেক উঁচু স্থানে অবস্থিত যা আক্রমণকারী বহিঃশক্তির বিরুদ্ধে একটা প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করতো। একারণে খ্রিস্টান ক্যাস্টিলে সাম্রাজ্যের চেয়ে সামরিক শক্তির দিক দিয়ে দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও এই পর্বতমালা গ্রানাদাকে দিয়েছিল আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে বিশাল এক সুবিধা।
গ্রানাদার যুদ্ধ এবং অস্তিত্বের লড়াই
প্রায় ২৫০ বছরেরও বেশী সময় ধরে গ্রানাদা টিকে ছিল শক্তিশালী খ্রিস্টান ক্যাস্টিলে সাম্রাজ্যকে কর প্রদান করে যাওয়ার মাধ্যমে। শত্রুভাবাপন্ন খ্রিস্টান রাজ্যবেষ্টিত হওয়ায় গ্রানাদা প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে ছিল। ১৫শ শতকের শুরুর দিকে আল-আন্দালুসের সর্বশেষ এই রাজ্য নিয়ে এক মুসলিম স্কলার লিখেছিলেনঃ
“গ্রানাদা কি এক উত্তাল সমুদ্র এবং ভয়ানক অস্ত্রশস্ত্র-সজ্জিত হিংস্র এক শত্রু দ্বারা বেষ্টিত নয়, যারা উভয়ই রাতদিন গ্রানাদার জনগণের উপর ভীতির সঞ্চার করে?”
খ্রিস্টানদের গ্রানাদা বিজয়ের মূল চালিকাশক্তিটি আসে ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে, যখন অ্যারাগন রাজ্যের রাজা ফার্দিনান্দ এবং ক্যাস্টিলে রাজ্যের রাণী ইসাবেলা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। এর মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হয় আইবেরীয়া উপদ্বীপের সবচেয়ে শক্তিশালী দু’টি খ্রিস্টান রাজ্য। একজোট হয়েই তারা তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে গ্রানাদার দিকে, উপদ্বীপের সর্বশেষ এই মুসলিম রাজ্যকে সমূলে উৎপাটন করাই হয়ে পড়ে তাদের লক্ষ্য।
১৪৮২ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের এই নতুন খ্রিস্টান রাজ্যের সাথে গ্রানাদা আমিরাতের যুদ্ধ শুরু হয়। শক্তিমত্তার দিক দিয়ে অপেক্ষাকৃত অনেক দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও গ্রানাদার মুসলিমরা নির্ভীক হয়ে বীরের মতো যুদ্ধ করে। এক স্পেনীয় খ্রিস্টান গল্পকার মুসলিম সৈন্যদের বীরত্বের প্রতি সম্মান জানিয়ে বলেন, “মুসলিমরা তাদের সর্বশক্তি দিয়ে এবং হৃদয় উজাড় করে যুদ্ধ করেছে ঠিক যেমনটা একজন সাহসী ও নির্ভীক ব্যক্তি তাঁর নিজের, নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের জীবন রক্ষা করতে করে থাকে।” এই যুদ্ধে মুসলিম জনসাধারণ এবং গ্রানাদা আমিরাত সেনাবাহিনীর সৈন্যগণ অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে নিজেদের অস্তিত্বের জন্য লড়াই করেছে, আল-আন্দালুসের ইসলামকে বাঁচানোর জন্য লড়াই করেছে। অন্যদিকে মুসলিম শাসকদের ভূমিকা ছিল সম্পূর্ণ উল্টো, তারা তেমন সাহসিকতা ও বীরত্বের পরিচয় দিতে পারেননি।
যুদ্ধের গোটা সময়জুড়ে খ্রিস্টানরা ঐক্যবদ্ধ ছিল এবং নিজেদের মধ্যে কোন রকমের দ্বন্দ্ব-বিবাদ কিংবা দলাদলিতে জড়িত হয়ে পড়েনি। যদিও অতীতে এমন ঘটনা খ্রিস্টানদের মাঝে অহরহ ঘটতো। এমন ঘটনা ছিল খ্রিস্টানদের মাঝে খুবই স্বাভাভিক এক ব্যাপার। অন্যদিকে মুসলিমদের অভ্যন্তরীণ দলাদলির কারণে গ্রানাদা বড় এক রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। মুসলিম নেতা ও গভর্ণরেরা একে অপরের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়ছিল এবং একে অপরকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য বিভিন্ন ধরনের ফন্দি আঁটতে ব্যস্ত ছিল। এদের বেশিরভাগই আবার অর্থ-সম্পদ, ভূমি এবং ক্ষমতার বিনিময়ে গোপনে বিভিন্ন খ্রিস্টান রাজ্যের যোগসাজশে কাজ করে যাচ্ছিল। আর এতো খারাপ পরিস্থিতির মধ্যেও সবচেয়ে খারাপ ঘটনাটি ছিল গ্রানাদা আমিরাতের সুলতানের ছেলে মুহাম্মাদের বিদ্রোহের ঘটনা। ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রায় এক বছর পরে মুহাম্মাদ তার পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে গ্রানাদায় তুমুল এক গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে দেয়। আর একই সময়ে খ্রিস্টান স্প্যানীয় বাহিনীও বাহির থেকে গ্রানাদায় আক্রমণ করা শুরু করে।
রাজা ফার্দিনান্দ এই গৃহযুদ্ধকে নিজের সুবিধার্থে কাজে লাগায়। গ্রানাদা আমিরাতকে সামগ্রিকভাবে দুর্বল এবং মেরুদণ্ডহীন করে দেয়ার জন্য সে মুহাম্মাদকে তার পিতার বিরুদ্ধে (এবং পরবর্তীতে মুহাম্মাদের চাচাকেও) বিদ্রোহে সহায়তা করে। মুহাম্মাদকে নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে ফার্দিনান্দ অস্ত্র ও যোদ্ধা দিয়ে সহায়তা করে এবং শেষ পর্যন্ত মুহাম্মাদ সফলও হয়। গোটা বিদ্রোহের সময়জুড়ে খ্রিস্টান বাহিনী ধীরে ধীরে গ্রানাদা আমিরাতের সীমান্তে চাপ প্রয়োগ করতে করতে আমিরাতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবেশ করতে থাকে এবং দখল করতে থাকে। ফলে ১৪৯০ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মাদ যখন বিদ্রোহে জয়ী হয়ে ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করে, ততদিনে শুধুমাত্র গ্রানাদা শহরটিই তার শাসনাধীন অঞ্চল হিসেবে থাকে এবং গ্রাম অঞ্চলের সমগ্র অংশ খ্রিস্টানদের হাতে চলে যায়।
গ্রানাদার সর্বশেষ প্রতিরোধ
গ্রানাদায় মুহাম্মাদের ক্ষমতা ও শাসন পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর তার কাছে রাজা ফার্দিনান্দ একটি চিঠি পাঠায়। চিঠিতে রাজা ফার্দিনান্দ মুহাম্মাদকে চিঠি পাওয়া মাত্রই আত্মসমর্পণ করার ও গ্রানাদাকে খ্রিস্টানদের হাতে তুলে দেয়ার নির্দেশ দেয়। ফার্দিনান্দের এই দাবিতে মুহাম্মাদ খুবই বিস্মিত ও হত-বিহ্বল হয়ে পড়ে কারণ ফার্দিনান্দ ইতিপূর্বে তাকে বুঝিয়েছিল যে সে তাকে গ্রানাদা শাসন করার অনুমতি দিবে। পরিষ্কারভাবে, বহু দেরীতে হলেও মুহাম্মাদ বুঝতে পারে যে আসলে গ্রানাদা দুর্বল করার জন্য ফার্দিনান্দ তাকে দাবাখেলার এক গুটি হিসেবে ব্যবহার করেছে মাত্র।
খ্রিস্টানদেরকে সামরিকভাবে প্রতিরোধ করতে মুহাম্মাদ উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিভিন্ন মুসলিম সাম্রাজ্যের কাছে সাহায্যের আবেদন করে। কিন্তু কেউই তার এই ডাকে সাড়া দেয়নি, শুধুমাত্র ওসমানী সাম্রাজ্যের নৌবাহিনীর এক ছোট্ট অংশ স্পেনীয় উপকূলে হানা দিয়েছিল তবে তাও তেমন কোন কাজে আসেনি। ১৪৯১ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলার সেনাবাহিনী গ্রানাদা শহর চতুর্দিক দিয়ে ঘেরাও করে ফেলে। মুহাম্মাদ তার আলহাম্বরা প্রাসাদের মিনার থেকে দেখতে পায় যে খ্রিস্টান বাহিনী গ্রানাদা শহর বিজয়ের জন্য জড়ো হচ্ছে এবং আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে মুহাম্মাদ সবকিছু অন্ধকার দেখতে পায় এবং শেষমেশ কোন উপায়ান্তর না দেখে ১৪৯১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে খ্রিস্টানদের সাথে একটি চুক্তি করে যা খ্রিস্টানদেরকে গ্রানাদা শহরের নিয়ন্ত্রণ দিয়ে দেয়।
২ জানুয়ারী ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে আলহাম্বরা প্রাসাদে খ্রিস্টান সাম্রাজ্যসমূহের পতাকা এবং ক্রস বা ক্রুশচিহ্ন লাগিয়ে দেয়া হয় |
২ জানুয়ারী ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে এই চুক্তি কার্যকর হয় এবং স্পেনীয় বাহিনী গ্রানাদায় প্রবেশ করে আনুষ্ঠানিকভাবে আল-আন্দালুসের সর্বশেষ মুসলিম রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নেয়। খ্রিস্টান সৈন্যরা সকাল বেলা ঐতিহাসিক আলহাম্বরা প্রাসাদে প্রবেশ করে এবং তাদের বিজয়ের চিহ্ন হিসেবে প্রাসাদের দেয়ালে দেয়ালে বিভিন্ন স্পেনীয় খ্রিস্টান রাজবংশ, রাজা-রাণীদের পতাকা ও নিশান লাগাতে থাকে। প্রাসাদের সবচেয়ে উঁচু মিনারের উপরে সৈন্যরা রূপার তৈরী বিশাল এক ক্রুশ্চচিহ্ন বা ক্রস খাড়াভাবে স্থাপন করে এবং এর মাধ্যমে গ্রানাদার ভীত সন্ত্রস্ত মুসলিম অধিবাসীদের জানিয়ে দেয় যে খ্রিস্টান-বিশ্ব মুসলিমদের আল-আন্দালুসের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে। শহরের মুসলিম অধিবাসীরা ঘর থেকে বের হতে সাহস পাচ্ছিলনা এবং শহরের রাস্তাগুলো জনমানবশূন্য হয়ে পড়ে।
সুলতান মুহাম্মাদকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। গ্রানাদা ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় পথে সুলতান এক পর্বতমালার গিরিপথে থেমে গ্রানাদার দিকে ফিরে তাকায় এবং কাঁদতে আরম্ভ করে। তার এই আকস্মিক অনুশোচনা ও আক্ষেপে তার মা কোনরূপ প্রভাবিত না হয়ে বরং তাকে তিরস্কার করে বলেনঃ
“যে জিনিষ তুমি একজন পুরুষ হয়ে রক্ষা করতে পারোনি সে জিনিষের জন্য নারীদের মতো কান্নাকাটি করোনা।”
যদিও বিজয়ী খ্রিস্টানরা গ্রানাদার অধিবাসীদের ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং বেশকিছু সুবিধাজনক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তবে শীঘ্রই সকল প্রতিশ্রুতিই ভঙ্গ করা হয়। ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়, ফলে শত-সহস্র মুসলিম অধিবাসী উত্তর আফ্রিকায় হিজরত করতে কিংবা ধর্মীয় বিশ্বাস গোপন করতে বাধ্য হয়। ১৭শ শতকের শুরুর দিকে এসে গোটা স্পেনে আর একজন মুসলিমের অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যায়না।
১১শ শতকে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি থেকে ১৫শ শতকের শেষদিকে এসে শক্তিহীন এক রাজ্যে পরিণত হয়ে খ্রিস্টানদের অধীনে চলে যাওয়া— আন্দালুসিয়ার পতনের এই গল্প ইসলামের ইতিহাসে অদ্বিতীয়। মুসলিমদের নিজেদের মাঝে প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্ব-বিবাদ, অন্যান্য মুসলিম সাম্রাজ্যগুলোর সমর্থন ও সাহায্যের অভাব এবং ইসলামী ঐক্যের বদলে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও ক্ষমতাকে প্রাধান্য দেয়া এসবকিছুই আল-আন্দালুসকে পতনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আর ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে গ্রানাদা পতনের মাধ্যমে, এই গল্পেরও ইতি ঘটে।
স্পেনে মুসলিম শাসনের শেষ দিন
৭১১ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের মাটিতে পা রাখেন মুসলিম বাহিনী। মুসলিম সেনাপতি তারিক ইবনে জিয়াদের নেতৃত্বে স্পেনের অত্যাচারী রাজা রডারিককে পরাজিত করে মুসলমানরা এই ভূখণ্ডে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করে। মুসলিম আগমনের এক দশকের মধ্যে আইবেরীয় উপদ্বীপের (বর্তমান স্পেন ও পর্তুগাল) অধিকাংশ ভূখণ্ডই তাদের অধীনে চলে আসে। এরপর সাতশো বছরের বেশি সময় মুসলমান এই ভূখণ্ড শাসন করে।
খিস্টীয় নবম শতকে আন্দালুস হয়ে ওঠে ইউরোপের সবচেয়ে অগ্রসর অঞ্চল। এই ভূখণ্ডের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ লোকই ইসলাম ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। এর রাজধানী কর্ডোভা ছিলো মুসলিম বিশ্ব ও ইউরোপের জ্ঞানপিপাসুদের তীর্থস্থান।
১০৩১ খ্রিস্টাব্দে ঈসায়ীতে উমাইয়া শাসনের পতন হলে আল-আন্দালুস অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পরে। ক্ষুদ্র এই রাজ্যগুলো তাইফা নামে পরিচিত ছিলো। ক্ষুদ্র এই রাজ্যগুলো দুর্বল এবং একতাবদ্ধ না থাকার কারনে ধীরে ধীরে উত্তরের খ্রিস্টান রাজ্যগুলোর আগ্রাসনের শিকার হতে থাকে। পরবর্তী দুইশত বছরের মধ্যে খ্রিস্টান আগ্রাসনে একেএকে এই রাজ্যগুলোর পতন ঘটতে থাকে। ১২৪০ সালের মধ্যে দক্ষিণের একমাত্র গ্রানাডা ছাড়া বাকি সবগুলো রাজ্য মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যায়।
১২৩৬ সালে কর্ভোভার পতনের পর, গ্রানাডার শাসকেরা উত্তরের খ্রিস্টান রাজ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী রাজ্য ক্যাস্টাইলের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। চুক্তি অনুসারে, বার্ষিক কর প্রদানের ভিত্তিতে গ্রানাডা নিজেদের স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখার অধিকার লাভ করে। অর্থাৎ, গ্রানাডা স্বাধীনভাবে তাদের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে খ্রিস্টান ক্যাস্টাইল রাজ্যকে কর প্রদান করতে বাধ্য ছিলো।
এই চুক্তির মাধ্যমে গ্রানাডার শাসকরা তাদের স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখার পরিবর্তে বরং তাদের শত্রুদের হাতকেই অধিক শক্তিশালী করে। এছাড়াও গ্রানাডার স্বাধীনভাবে টিকে থাকার আরো একটি কারণ ছিলো তার ভৌগোলিক অবস্থান। দক্ষি্ণ স্পেনের সিয়েরা নেভদার পাহাড়ী অঞ্চলে রাজ্যটি অবস্থিত থাকার কারণে এখানে সেনা অভিযান পরিচালনা ছিলো কঠিন। সামরিক দিক হতে ক্যাস্টাইলের থেকে দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও সিয়েরা নেভদার পাহাড় গ্রানাডার প্রতিরক্ষাকে শক্তিশালী করেছিলো।
যদিও ২৫০ বছরের অধিক গ্রানাডা খ্রিস্টান ক্যাস্টাইল রাজ্যের করদ রাজ্য হিসেবে তার আবস্থান টিকিয়ে রাখে, কিন্তু চারপাশের বৈরী খ্রিস্টান রাজ্যগুলোর অবস্থানে সবসময়ই তার স্বাধীনতা হারানোর আশংকায় ছিলো। ১৪০০ শতকের একজন মুসলিম পণ্ডিত আল-আন্দালুসের এই শেষ অবস্থান সম্পর্কে লেখেন, ‘দিন-রাত গ্রানাডার অধিবাসীরা বিশাল সমুদ্র ও তাদের প্রতি বৈরী বিশাল সেনাবাহিনী দ্বারা নিষ্পেষিত হচ্ছে।’
১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে আরাগনের রাজা ফারডিন্যান্ড ক্যাস্টাইলের রানী ইসাবেলাকে বিয়ে করেন। এর মাধ্যমে আইবেরীয় উপদ্বীপের দুইটি শক্তিশালী খ্রিস্টান রাজ্য একত্রিত হয়। এই ঐক্যবদ্ধ খ্রিস্টান শক্তি আন্দালুসের মাটি থেকে সর্বশেষ মুসলিম রাজ্যটির স্বাধীন শাসনের অবসান ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
১৪৮২ খ্রিস্টাব্দে ঐক্যবদ্ধ খ্রিস্টান শক্তির সাথে গ্রানাডার সংঘর্ষ শুরু হয়। সামরিক দিক হতে পিছিয়ে থাকা স্বত্ত্বেও গ্রানাডার অধিবাসীরা অসম্ভব সাহসিকতা্র সাথে লড়াই করে। আন্দালুসের সর্বশেষ অবস্থানকে টিকিয়ে রাখতে সাধারন মুসলিম জনগন এবং সৈন্যবাহিনী চরম সাহসিকতার লড়াই করলেও তাদের শাসকেরা সেরূপ সাহসিকতার পরিচয় দিতে পারেনি।
যুদ্ধের সম্পূর্ণ সময় খ্রিস্টান সেনাবাহিনী ঐক্যবদ্ধ ছিলো। তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থের কোনো দ্বন্দ্ব ছিলো না। অন্যদিকে, গ্রানাডায় মুসলিম শাসক ও প্রশাসকরা পারস্পরিক ক্ষুদ্র স্বার্থ নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিলো। তাদের মধ্যে আবার অনেকেই অর্থের বিনিময়ে খ্রিস্টান শক্তির পক্ষে কাজ করছিলো। যুদ্ধ শুরু হওয়ার এক বছরের মাথায় গ্রানাডার আমির আবুল হাসানের পুত্র মুহাম্মদ তার পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।
রাজা ফারডিন্যান্ড এই সুযোগকে তার কাজে লাগান। তিনি মুহাম্মদকে তার পিতা এবং পরবর্তীতে তার চাচা আল জাগলের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে সাহায্য করেন। মুহাম্মদ ফারডিন্যান্ডের সাহায্যে তার পরিবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গ্রানাডার অধিকারে সক্ষম হন। এর মাধ্যমে ফারডিন্যান্ডের সেনাবাহিনী গ্রানাডার ভূমিতে পা ফেলতে সক্ষম হয়। ১৪৯০ সালে মুহাম্মদ যখন গ্রানাডা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন, তখন গ্রানাডা শহর ছাড়া আর কোনো অঞ্চলই তার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত ছিলো না।
গ্রানাডা অধিকারের পরপরই, নতুন আমির মুহাম্মদকে রাজা ফারডিন্যান্ড গ্রানাডাকে তার হাতে হস্তান্তরের নির্দেশ দিয়ে একটি চিঠি পাঠান। এই চিঠিতে মুহাম্মদ বিস্মিত হন এবং বুঝতে পারেন, তিনি এতোদিন ফারডিন্যান্ডের দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন।
মুহাম্মদ খ্রিস্টান বাহিনীকে প্রতিরোধের সিদ্বান্ত নেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম শাসকদের কাছে সাহায্য চেয়ে চিঠি পাঠান। ছোট একটি ওসমানীয় নৌবহর ছাড়া আরো কেউই তার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। ১৪৯১ সালের শেষে গ্রানাডা ফারডিন্যান্ড ও ইসাবেলার সম্মিলিত বাহিনীর অবরোধের শিকার হয়। ১৪৯১ সালের নভেম্বরে মুহাম্মদ গ্রানাডার শাসন খ্রিস্টান অধিকারে প্রদানের চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন।
১৪৯২ সালের ২রা জানুয়ারী, স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুসারে স্পেনীয় সেনাবাহিনী শহরে প্রবেশ করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলিম আন্দালুস রাষ্ট্রের পতন ঘটায়। খ্রিস্টান সৈন্যরা বিখ্যাত আলহামরা প্রাসাদ দখল করে এবং এর উপরে সম্মিলিত খ্রিস্টান শক্তির বিজয়পতাকা উড়িয়ে দেয়। আলহামরার সর্বোচ্চ প্রাসাদে রূপার তৈরি একটি বিশাল ক্রুশ স্থাপিত হয়। আমির মুহাম্মদকে নির্বাসনে পাঠানো হয়।
চুক্তি অনুসারে যদিও খ্রিস্টান বাহিনী ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম নাগরিক অধিকারের প্রতিশ্রতি প্রদান করেছিলো, কিন্তু শীঘ্রই তারা তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। ১৫০২ ঈসায়ীতে সমগ্র স্পেনে ইসলামি বিশ্বাসকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। অসংখ্য স্পেনীয় মুসলমান তখন উত্তর আফ্রিকায় হিজরত করে। যারা স্পেনে ছিলো, তারাও তাদের বিশ্বাসকে গোপন করতে বাধ্য হয়। ১৬০০ ঈসায়ীর মধ্যে স্পেন সম্পূর্ণ রূপে মুসলিম শূন্য হয়ে পরে।
সূত্র : ফিরাস আল-খতীব-এর ‘মুসলিম স্পেনের সর্বশেষ দুর্গ’ অবলম্বনে নিহার মামদুহ
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা সমূহ:
· পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা
· পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক সেনাহত্যার ইতিহাস
[লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে? তাহলে দয়াকরে গবেষণামূলক ও ইতিহাস ভিত্তিক এই সাইটটি চালিয়ে যেতে সাহায্য করুন। পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার বঞ্চিত বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী সাইটটি পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার কতৃক চরমভাবে অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত, পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ঠ এনজিও সমূহের একচোখা নীতি, সন্তু লারমা ও প্রসীত খীসাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) 'এর নিপিড়িত, নির্যাতিত ও বর্বরতম সন্ত্রাসের নির্মম ও অসহায় শিকার - পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠির সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ক্ষুদ্রতম এক প্রয়াস]