সুন্দরবনের কাছে রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন নিয়ে বাংলাদেশের সকল পর্যায়ের মানুষের মধ্যে এক ধরনের সচেতনতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু এই সচেতনতাই যথেষ্ঠ নয়। পরিবেশের দিকে তোয়াক্কা না করে টপ-ডাউন উন্নয়নের কি বিপর্যয় ঘটতে পারে রাঙ্গামাটির কর্নফুলী নদীর ওপর নির্মিত কাপ্তাই বাঁধ তাঁর উজ্জ্বল উদাহরণ। পাকিস্তান আমলে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে বিদেশী সাহায্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের
রাঙ্গামাটি জেলায় নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে যে কৃত্রিম লেক বানানো হয়েছে, তাঁর নিচে ডুবে গেছে হাজার হাজার মানুষের বাড়ি, সহায়-সম্পত্তি, স্মৃতি ও বেঁচে থাকার অবলম্বন। সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব শরদিন্দু শেখর চাকমা লিখেন; ''বাঁধ নির্মাণের সময় বলা হয় যে মাত্র
২৫০ বর্গমাইল এলাকা ডুবে যাবে, কিন্তু বাঁধ নির্মাণ শেষে দেখা গেল যে ৩৫০ বর্গমাইল এলাকা ডুবে গেছে এবং বর্ষাকালে লেকের পানি বেড়ে গেলে কর্ণফুলী হ্রদের আয়তন হয় ৪০০ বর্গমাইল। এই ৩৫০ অথবা ৪০০ বর্গমাইলের মধ্যে অনেকের নিজস্ব ফলের এবং সেগুন বাগান, সরকারের সংরক্ষিত বন এবং সেই সঙ্গে unclassed field state forest ডুবে যায়।
বাঁধ নির্মাণের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট ৩৬৯ মৌজার মধ্যে ১২৫ টি মৌজা পানির তলে চলে যায়। এতে ৫৪ হাজার একর কৃষি জমি অর্থাৎ জেলার মোট কৃষি জমির প্রায় ৪০% হ্রদের জলে ডুবে যায়। আর ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ১ লাখ লোক। যাদের মধ্যে অধিকাংশ ছিল চাকমা। তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট লোক সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ লাখ অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামের
৩ ভাগের ১ ভাগ লোক কর্ণফুলী বাঁধ নির্মাণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত
হয়। ১ লাখ লোকের মধ্যে পরিবারের সংখ্যা ছিল ১৮ হাজার এবং তাদের মধ্যে ১০ হাজার পরিবার ছিল কৃষি জমির মালিক। বাকীরা ছিল জুম চাষী।'' (১)
এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র যে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে তাঁর প্রভাব আজও পাহাড়িদের মনে গেঁথে আছে। এই বিপর্যয়কে 'বড় পুরং' নামে স্মরণ করে থাকে তারা। বাঙালীদের প্রতি অবিশ্বাসের সূত্রপাত বলা যায় এই বাঁধকে। অথচ, আমরা মেইনল্যান্ড
বাংলাদেশ থেকে সেখানে যাই আনন্দ, মজা ও পিকনিক করার জন্য।
যেই প্রেক্ষাপটে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র শুরু হয়েছিল, বর্তমানে তারচেয়ে বেশি বিদ্যু উৎপাদন হচ্ছে বাংলাদেশে। তাছাড়া এটিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিশাল দখল বাণিজ্য। পরিবেশ দুষণ এখন সেখানকার বাস্তবতা। (২) পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকট সমাধানের লক্ষ্যে এই প্রকল্পের উপযোগীতা বিবেচনা করার সময় এসেছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এটি বন্ধ করে দেয়া যায় কিনা সেটাও বিবেচনা করা দরকার।
নোটঃ
(১) শরদিন্দু শেখর চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রামের একাল-সেকাল, অঙ্কুর প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০২, http://www.muldharabd.com/?p=2360
(২) কালের কণ্ঠ, বিবর্ণ কাপ্তাই হ্রদ, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, http://www.kalerkantho.com/print-edition/…/2016/09/25/408936
প্রাসঙ্গিকঃ
পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকট-পর্ব ১: ১৯৪৭ সালে ভারতীয় পতাকা উত্তলন
পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকট-পর্ব ২: উন্নয়নের বিপর্যয় কাপ্তাই বাঁধ