সোমবার, ৩ জুলাই, ২০১৭

আমি কেনো সেটেলার?


আমি একজন সংবাদকর্মী। বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যমে প্রায় ১৬ বছর কাজ করছি। উপজেলা, জেলা হয়ে এখন ছয় বছর ক্রাইম বিটে কাজ করছি রাজধানীতে। আমার পূর্বপুরুষের বাড়ি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায়। আর জন্মস্থান পার্বত্য চট্টগ্রামে। এ লেখাটি আমার জন্ম জিকুষ্ঠি দেওয়ার জন্য নয়। কিন্তু যে প্রসঙ্গে লিখছি তার উদাহরণ দেওয়ার জন্য এটাই বেশ উপযুক্ত। এবার আসি মূল কথায়। যারা পত্রিকা পড়েন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের খবরা খবর পড়েন তারা সবাই কম বেশি তথা কথিত ‘সেটেলার’ শব্দটির সঙ্গে পরিচিত। কয়েকদিন আগে অস্ট্রেলিয়া থেকে মজিব উল্লাহ নামে এক রোহিঙ্গা শরণার্থী ভদ্রলোক আমার মোবাইলে কল দিয়েছিলেন। তিনি কয়েক বছর যাবত আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড। ভদ্রলোক আরাকানের নির্যাতিত পরিবারের সদস্য। তিনি অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এখন অস্ট্রেলিয়ায় ইসলামিক সোসাইটি অব সেন্ট্রাল কুইনসল্যান্ডের ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বসবাস করেন অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে। তিনি জানেন আমি সংবাদ কর্মী, সেই সঙ্গে আমার পূর্ব পুরুষের বাড়ি চট্টগ্রাম এবং আমার জন্মস্থান পার্বত্য চট্টগ্রাম।


সেই সূত্রধরে তিনি আমাকে বেশ ভাবিয়ে তোলার মতো কিছু কথা বলেছেন। তিনি বললেন, ‘আমি রোহিঙ্গা। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে আমার কোনো মোহ নেই, কিন্তু এ মাটির মানচিত্রকে আমি মায়ের আঁচলের মতোই শ্রদ্ধা করি। যখন দেখি কেউ এ আঁচল ধরে টানাটানি করছে তখন আমি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ মুসলিম দেশটির ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকতে পারি না। পক্ষালম্বন করি। স্বাধীনতা, স্বার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা ও সমৃদ্ধির পক্ষ। কারণ এ মাটি আশ্রয় দিয়েছে আমার মতো অগণিত অসহায় নির্যাতিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে। অবদান রেখেছে আমাকে আমিতে পৌঁছাতে। তাই এ মমতাময়ী বাংলা মায়ের প্রতি থাকি সদা কৃতজ্ঞ। একটা বিষয় আমার মোটা মাথায় আসছে না। বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিকের যদি সাংবিধানিক অধিকার থাকে বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্তে গিয়ে বসবাস করার। তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়ে বসবাসরত বাংলাদেশিরা সেখানে সেটেলার হবে কেন? তাও দেশের মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতেও এমন শব্দ ব্যবহার হচ্ছে। আবার অন্যদিকে যতদূর জানি বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশে কোনো আদিবাসীও নেই। এখন কথা হচ্ছে সমতল থেকে কেউ পাহাড়ে বসবাস করলে তাকে সেটেলার বলা হচ্ছে। অন্যদিকে পাহাড় থেকে কেউ সমতলে এসে বসবাস করলে তাকে সেটেলার বলা হচ্ছে না। কেন এই বৈষম্য?’

এরপর তিনি বলেন, ‘আমার জানা মতে বাংলাদেশে আদিবাসী বা indigenous বলে কোনো জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই। সেক্ষেত্রে ওই বিশ্লেষণ ব্যবহার করা সংবিধান লঙ্ঘন কিনা বিশেষজ্ঞরা বলতে পারেন।’
এ কথাগুলো বলে তিনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তারপর শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘পূর্বে রোহিঙ্গাদেরও বার্মায় কোনোভাবেই আলাদা হিসেবে দেখা হতো না। কিন্তু এক সময় রোহিঙ্গাদের মূলধারা থেকে আলাদা করার চেষ্টা শুরু হলো। তারপর পর্যায়ক্রমে রোহিঙ্গাদের আরাকানের বহিরাগত বলে প্রচার শুরু করল এবং যার ফলশ্রুতিতে আমাদের সেখান থেকে তাড়িয়েই দিল।’

‘অথচ আমরা সাবেক বার্মার না হলেও, আমাদের একটা স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। আমরা আরাকান রাজ্যের বাসিন্দা সেখানে আমাদের পূর্বপুরুষরা রাজা-বাদশা এবং প্রজা ছিলেন। আর এক সময় ব্রিটিশরা দখল করে নেয়। পরে ভারত উপমহাদেশে স্বাধীনতা দেওয়ার সময় আমাদের রাজ্যকে বার্মার সঙ্গে যুক্ত করে দেয়’ বলেন তিনি।
সে যাই হোক। এখন কথাহলো আমাদের যেভাবে আলাদা পরিচয় দিয়ে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো সেই পথেই কী হাটছেন আপনারা—প্রশ্ন করেন মজিব উল্লাহ।

তারপর তিনি বলেন, ‘এখন পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের বাহিরাগত হিসেবে স্টাবলিস্ট করা হচ্ছে। এ জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে সেটেলার শব্দটি। সেটেলার শব্দের মাধ্যমে প্রথমে একটা আলাদা জাতি হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে পার্বত্য বাঙালিদের। তারপর দেখবেন আপনাদেরও একদিন পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে তথাকথিত সেটেলার বলে তাড়িয়ে দেবে।’
তার কথার সঙ্গে আমি কিছু দ্বিমত করেছি। সেগুলো এখানে এখন বলছি না। পরে আরেক কিস্তিতে বলব। কিন্তু আমার মনে নতুন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আমাকে কেনো সেই ‘সেটেলার’ এর তকমা নিতে হবে?

আগেই বলেছি, আমার পূর্বপুরুষের বাড়ি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায়। আর জন্মস্থান পার্বত্য চট্টগ্রামে। এ চট্টগ্রামেই হাজার বছর ধরে আমার পূর্বমপূরুষের বসবাস। পার্বত্য চট্টগ্রামও এর বাইরে নয়। চট্টগ্রামের অংশই বটে। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় আমাদের এখানে প্রায় তিনশ বছর আগে কক্সবাজার হয়ে বর্তমান বাংলাদেশ সীমানার বাইরে থেকে চাকমা, মারমাসহ কিছু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের আগমন ঘটে। রাঙ্গুনিয়ায় অনেক দিন ছিলেন তারা। এখানেই চাকমা রাজ বাড়ি এবং চাকমাদের জন্য ক্ষুদ্র পরিসরে রাজ্য পরিচালিত হয়। বেশি দিন আগের কথা নয়। এ ব্রিটিশ আমলেই। ব্রিটিশ সরকারের মাঝামাঝি সময়ে চাকমারা চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া ছেড়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটিতে পাড়ি জমায়। তাদের সঙ্গে এবং তাদের আগেই কিছু বাঙালি পার্বত্য চট্টগ্রামে আসা-যাওয়া করতো। কেউ কেউ অস্থায়ী বসতিও গড়েছিল। পরে চট্টগ্রাম জেলা থেকে আলাদা হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার সৃষ্ঠি হয়। পরে সেটাও ভেঙে বর্তমানে তিন জেলা।

তাহলে আমার চট্টগ্রামে উড়ে এসে জুড়ে বসা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের একটি বড় অংশ যদি পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়ে ভূমিজ সন্তান হয়ে যায়। সেখানকার মালিক বনে যায়! তাইলে আমি চট্টগ্রামের ভূমিজ সন্তান হয়ে কেনো পার্বত্য চট্টগ্রামে সেটেলার হবো? আমার পরিবারের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের পাশের জেলা ফেনী, কুমিল্লার মানুষও কয়েকশ বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম বসবাস করে আসছে। বিশেষ করে খাগড়াছড়ির রামগড় মহকুমা একটি পুরাতন ও প্রসিদ্ধ স্থান। এখানে মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ অনেক ইতিহাস আছে। যার নেতৃত্বে ছিল ৯০ শতাংশ বাঙালি। যারা কয়েকশ বছর ধরে বসবাস করেন এ মহকুমার আশপাশের এলাকা, মানিকছড়ি, গাইমারা, মাটিরাঙ্গা সহ অন্যান্য এলাকায়। আজ তারাও সেখানে তথাকথিত সেটেলার হিসেবে পরিচিত।

আমার প্রশ্ন চাকমা-মারমারা যেমন বাইরের দেশ থেকে কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম বসবাস করে পরে পার্বত্য চট্টগ্রাম এসেছে। তেমনি চট্টগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী জেলা ফেনী-কুমিল্লার মানুষও এসেছে ২/৩শ’ বছর আগে। তারা কোনোভাবেই তথাকথিত সেটেলার হতে পারে না। বরং এরাও সংজ্ঞানুযায়ী পাহাড়ি। এখন মূলত রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার জন্য কতিপয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জেএসএস/ইউপিডিএফ নামধারী সংগঠন কৌশলে বাঙালিদের সেটেলার বানিয়ে রোহিঙ্গাদের মতো একটা আলাদা জাতি বানাতে চাইছে।

মূলত শান্তিচুক্তির পর ২০০০ সালের দিকে প্রথম ‘সেটেলার’ শব্দটি ব্যবহার শুরু হয়; যাদের সরকারি ভাবে ১৯৭৯-৮০ সালে পুনর্বাসন করা হয়েছে তাদের। কিন্তু পর্যায়ক্রমে এখন পাহাড়ের সব বাঙালিকেই তারা কৌশলে তথাকথিত সেটেলার বানিয়ে দিচ্ছে। পাহাড়ে বসবাসরত সব বাঙালিকেই তারা সেটেলার বলছে। আপনি (পাঠক) যদি পাহাড়ে যান এবং ঘটনাচক্রে কোনো একটা কিছুতে ফেসে যান। তখন সেই তথাকথিত জেএসএস/ইউপিডিএফ নামধারী নেতারা আপনার বিরুদ্ধে প্রচার চালাবে সেখানে আপনাকেও সেটেলার বলবে।

আমার পূর্বপুরুষ চট্টগ্রামের। চট্টগ্রাম থেকে পর্যায়ক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রাম চলে গেছে। চাকমা, মারমারাও কিন্তু আগে চট্টগ্রাম ছিল। চাকমাদের যে রাজবাড়ি এখন রাঙামাটিতে সেটার বয়স কত? দুইশ বছর? তাও কিন্তু নয়। তার আগে তাদের রাজবাড়ি কোথায় ছিল? রাঙ্গুনিয়া। এ রাঙ্গুনিয়া আমার দাদাবাড়ি। রাঙ্গুনিয়ায় তারা এসেছে বাহির থেকে। আর আমার পূর্বপুরুষ আছে হাজার বছর। তাইলে তারা রাঙ্গুনিয়া থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়ে ভূমিজ হয়ে যায়। আর আমি সেটেলার? এ কেমন কথা!
লেখক : সিনিয়র ক্রাইম রিপোর্টার, পরিবর্তন ডটকম।