রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালানোর অভিযোগ উঠেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। বার্মিজ সেনারা রোহিঙ্গাদের দেখলেই কোনো বাছবিচার ছাড়াই গুলি করছে। শিশুদেরও রেহাই দিচ্ছে না তারা। বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ, শিশু যেকেউ-ই সেনাদের সামনে পড়লে বুলেটের শিকার হচ্ছে। অতর্কিতে অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ঘরবাড়ি। মিয়ানমার দাবি করেছে, রাখাইনে শুক্রবার সহিংসতা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ১০০ জন নিহত হয়েছেন। বিদ্রোহী রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (এআরএসএ) ওই দিন ভোরে মিয়ানমার পুলিশের আউট-পোস্টে হামলা চালালে এ সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে বলে দাবি করেছে মিয়ানমার। আলজাজিরা বলেছে, শুক্রবার থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৮০০ জন নিহত হয়েছেন। তবে নিহতের এ সংখ্যা নিরপেক্ষ সূত্র থেকে যাচাই করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছে সংবাদ সংস্থাটি। বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা জানাচ্ছেন, রাখাইন প্রদেশে দুইদিনে সাত শতাধিক রোহিঙ্গাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে সেদেশের সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি।
বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা আরো জানায়,‘নিথর দেহ পড়ে আছে বাড়ির উঠানে, ধানক্ষেতে। কারো লাশ পড়ে আছে বাড়ির পাশের খাল কিংবা পাহাড়ের পাদদেশে। শতশত মৃতদেহ পড়ে আছে রাস্তায়। বাড়ি পুড়ে ছাই হয়েছে। কেউ কেউ জঙ্গলে যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে। সীমান্তে কড়াকড়ি থাকায় এপারেও আসা যাচ্ছেনা। যারা বেঁচে আছে তারা নিহতদের লাশ দাফন করছে। কিন্তু ভাগ্যে জুটছেনা কাফনের কাপড়।’ গত দুইদিন ধরে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের উত্তরাঞ্চলের গ্রামগুলোতে এই চিত্র বিরাজ করছে বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা। গত শুক্রবার রাতে সেখানকার বেশকিছু পুলিশ ফাঁড়িতে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) হামলার পর থেকে রবিবারপর্যন্ত মংডুর উত্তরাঞ্চলের গ্রাম রাথিডং, হাতিপা, খোয়ারিপাড়াসহ বেশকিছু গ্রামে এই হত্যাযজ্ঞ চালায় সেনাবাহিনী ও বিজিপি।
মংডু, বুথিডায়ুং ও রাথেডায়ুং শহর ঘিরে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান শুরু করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এ তিন অঞ্চলে প্রায় ৮০ হাজার লোকের বসবাস। সেখানে সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি রাখা হয়। মংডুর বাসিন্দা আজিজ খান বলেন, শুক্রবার সকালে সেনাবাহিনী তাদের গ্রামে হানা দেয় এবং বাড়ি ও গাড়িতে নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে। তিনি আরো বলেন, সরকারি বাহিনী ও সেনাবাহিনী তাদের গ্রামের ১১ জনকে হত্যা করে। যা কিছু নড়াচড়া করছিল, এমন সব কিছুতেই তারা গুলি চালায়। এরপর কিছু সেনা ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। আজিজ খান বলেন, সেদিন নিহতদের মধ্যে নারী ও বৃদ্ধ রয়েছে। এমন কি ছোট্ট শিশুকেও তারা রেহাই দেয়নি। ইউরোপভিত্তিক রোহিঙ্গা অ্যাক্টিভিস্ট ও ব্লগার রো নাই স্যান লুইন আলজাজিরাকে জানিয়েছে, সর্বশেষ সহিংসতায় ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়েছে। মসজিদ ও মাদ্রাসা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাজার হাজার মুসলিম রোহিঙ্গা খাদ্য ও আশ্রয়ের সংকটে রয়েছে।
রো নাই স্যান লুইন আলজাজিরাকে আরো বলেন, সরকারি বাহিনী আমার নিজের চাচাদের পালাতে বাধ্য করেছে। বাড়িঘর ধ্বংস ও লুটপাট করলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সাহায্য করা হচ্ছে না। খাদ্য নেই, আশ্রয় নেই। এমন অবস্থায় তারা আতঙ্কে আছে, তখন তাদের জীবন নিয়ে নেওয়া হবে। বুথিডায়ুংয়ের এক বাসিন্দা মিন্ট লুইন (ছদ্মনাম) আলজাজিরাকে বলেছেন, সব বাড়িতেই প্রাণ সংহারের আতঙ্ক। হোয়াটসঅ্যাপে লোকজন হত্যার ভিডিও শেয়ার করছে। হত্যার শিকার নারী ও শিশুদের ভিডিও শেয়ার হচ্ছে।
নিরপরাধ ব্যক্তিদেরও গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। বাইরের কেউ হয়তো চিন্তাই করতে পারবেন না, আমরা কতটা ভয়ের মধ্যে আছি। ঘরবাড়ি ছেড়ে ধান খেত, গম খেতে গিয়ে লুকাচ্ছে লোকজন। অনেকে বাংলাদেশের সীমানায় নো ম্যানস ল্যান্ডে এসে জড়ো হচ্ছে, তারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। গত বছর অক্টোবর মাসে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনী দমন-পীড়ন, নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ শুরু করলে প্রায় ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। কক্সবাজারে অস্থায়ী ক্যাম্পে তাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। নতুন করে আরো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করায় পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়ছে।