বুধবার, ২ আগস্ট, ২০১৭

পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ নিয়ে হাইকোর্টের রায় স্থগিত

পার্বত্য শান্তি চুক্তির অধীনে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন অসাংবিধানিক হিসেবে বাতিল করে দেয়া হাইকোর্টের রায় আগামী ছয় সপ্তাহ স্থগিত করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার স্থগিতাদেশ চেয়ে সরকারের দায়ের করা আবেদনের প্রেক্ষিতে আপিল বিভাগের চেম্বার জজ বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেন এই আদেশ দেন। সরকারকে এ সময়ের মধ্যে নিয়মিত আপিল আবেদন (লিভ টু আপিল) করতে হবে। গত মঙ্গলবার বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ রায় দেয়ার পরপরই সরকারের অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করতে এবং দ্রুত আপিলের জন্য সনদ চেয়ে আবেদন করলে তা নাকচ করে দেন হাইকোর্ট। একদিন পরই গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে সরকার চেম্বার জজ আদালতে স্থগিতের আবেদন করে চেম্বার জজ আদালতের নিয়মিত কার্যদিবস না থাকলেও প্রধান বিচারপতির অনুমোদনে দুপুরে চেম্বার জজ বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেন তার খাস কামরায় আবেদনটি ওপর শুনানি করেন।

পার্বত্য শান্তি চুক্তির অধীনে প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন সংবিধান অনুযাযী রাষ্ট্রের একক চরিত্র ধ্বংস করার দায়ের হাইকোর্ট তা বাতিল করেন। রায়ে আদালত বলেন, পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ আইন রাষ্ট্রের একক চরিত্রকে ধ্বংস এবং সংবিধানের পবিত্রতা নষ্ট করেছে। এছাড়া তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের স্থানীয় সরকার পরিষদ আইনে বিদ্যমান অ-উপজাতীদের (বাঙ্গালী) জন্য বৈষম্যমূলক বিধানও বাতিল করা হয়। শান্তি চুক্তির বৈধতা প্রশ্নে দায়ের করা দু'টি রিট আবেদনের রুল নিত্তি করে হাইকোর্ট এই রায় দেন। তবে পার্বত্য শান্তি চুক্তিকে রাজনৈতিক সমঝোতা হিসেবে অভিহিত করে তা আদালতের বিচার্য বিষয় নয় এবং চুক্তির জীবন শেষ হয়ে গেছে বলে শান্তি চুক্তির বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত দেননি আদালত। শুনানিতে সরকারের এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, হাইকোর্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন পুরোটা বাতিল করেছে। পাশাপাশি তিনটি জেলা পরিষদ আইনের বেশ কয়েকটি ধারা বাতিল করেছে। এটা বাতিলের আগে বিগত এক দশক পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ কাজ করছে। পাশাপাশি জেলা পরিষদ আইনের ধারাগুলোর আওতায় নিয়োগ পাওয়া উপজাতি পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের উপজাতিরা কাজ করছে। রায় স্থগিত না হলে আঞ্চলিক পরিষদ কাজ করতে পারবে না। বন্ধ হয়ে যাবে আঞ্চলিক পরিষদের কার্যক্রম। তিনি আরো বলেন, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকার নিয়মিত আপিল করবে। বিষয়টিতে সাংবিধানিক ও আইনের ব্যাখ্যার প্রশ্ন জড়িত। তাই রায়টি স্থগিত হওয়া প্রয়োজন। 

রিট আবেদনের কৌঁসুলি সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক সরকারের দায়ের করা স্থগিতের আবেদনের বিরোধিতা করে বলেন, হাইকোর্ট শান্তি চুক্তি অবৈধ ঘোষণা করেনি। জনস্বার্থে দায়ের করা রিটের প্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন বাতিল করেছে এবং তিন জেলার স্থানীয় সরকার পরিষদ আইনের কয়েকটি ধারা বাতিল করেছে। আইন অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়নি। কার্যক্রম শুরুর পর ১৯৯৯ সাল থেকে পরিষদের কোন নির্বাচন হয়নি। সরকার এখন বিকল্পভাবে আঞ্চলিক পরিষদেও কাজ চালিয়ে নিতে পারে। এজন্য হাইকোর্টের রায় স্থগিত করার প্রযোজন নেই। স্থগিত করা ঠিক হবে না। এরপর আদালত ছয় সপ্তাহ স্থগিতের আদেশ দিয়ে এ সময়ে নিয়মিত আপিল দায়ের করার নির্দেশ দেন। রিট আবেদনের কৌঁসুলি সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাককে শুনানিতে সহায়তা করেন ব্যারিস্টার ইমরান এ সিদ্দিক এবং ব্যারিস্টার বেলায়েত হোসেন। সরকার পক্ষে এটর্নি জেনারেলকে সহায়তা করেন অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা। আদেশের পর এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, শান্তিচুক্তি একটি চলমান প্রক্রিয়া। হাইকার্টের এই রায়ের বহাল থাকলে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে। সেখানে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির ও প্রশাসনিক জটিলতা সৃষ্টি হবে। প্রসঙ্গত, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির প্রেক্ষিতে ১৯৯৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন (সংশোধন) ১৯৯৮, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন (সংশোধন) ১৯৯৮, বান্দরবান পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন (সংশোধন) ১৯৯৮ নামে চারটি আইন প্রণয়ন করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। 

তিন জেলার স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন ১৯৮৯ সালে প্রণীত আইন সংশোধন করে প্রণয়ন করা হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইনে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো সৃষ্টি করা হয়। এতে প্রায় একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা এবং সুবিধাদি দেয়া হয়। আঞ্চলিক পরিষদ প্রাদেশিক সরকারের মতো কাজ করছে। এটা দেশের একক চরিত্র ধ্বংস করেছে। আইন অনুযায়ী উপজাতীয় ব্যক্তিই হবেন আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান। এর প্রধান বাংলাদেশ সরকারের প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা পেয়ে আসছেন। ১৯৯৮ সালে আঞ্চলিক পরিষদ গঠনের পর থেকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন জ্যোতিরিন্দ্র বোধি প্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)। শুধু তাই নয় আঞ্চলিক পরিষদকে আইন প্রণয়ন এবং কর নির্ধারণেরও ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। অন্য দিকে সংশোধিত পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইনেও উপজাতী ব্যক্তিকে চেয়ারম্যান করার এবং এক তৃতীয়াংশ সদস্য উপজাতীয় হবেন বলে বিধান করা হয়। এর চেয়ারম্যান হচ্ছেন জেলার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। পার্বত্য তিন জেলার সমন্বয়ে গঠিত হয় আঞ্চলিক পরিষদ। গত ২৩ মার্চ শুনানি শেষে আদালত রায়ের দিন ধার্য করেছিলেন। গত সোমবার দুপুর ১২টা ৩৫ মিনিটে রায় দেয়া শুরু হয়। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে। সরকারের পক্ষে তখন চীফ হুইপ আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতির পক্ষে জ্যোতিরিন্দ্র বোধি প্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বান্দরবান জেলার বাসিন্দা মো: বদিউজ্জামান রিট দায়ের করলে ২০০০ সালের ২৯ মে হাইকোর্ট রুল জারি করেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট তাজুল ইসলাম আরেকটি রিট দায়ের করলে ২০০৭ সালে ২৭ আগস্ট রুল জারি করেন হাইকোর্ট। গত বছর ১৪ মে হাইকোর্টের বর্তমান বেঞ্চ দু'টি রিট আবেদনে জারি করা রুলের চূড়ান্ত শুনানির জন্য ২৯ অক্টোবর দিন ধার্য করেন। ওই দিনই রুলের শুনানি শুরু হয়। গত ২৩ মার্চ শুনানি শেষে রায়ের দিন ধার্য করা হয়। মোট ২০ কার্য দিবস শুনানি গ্রহণ শেষে আদালত রায় দেয়া শুরু করেন। দু'টি রিট আবেদনে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি, শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর, সম্পাদন ও বাস্তবায়ন, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলার স্থানীয় সরকার পরিষদ সংশোধনী আইন ১৯৯৮-এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়।শুক্রবার ১৬ এপ্রিল ২০১০