বর্মী হানাদার বাহিনীর রোহিঙ্গা বিরোধী কিলিং অপারেশনে মৃতের সংখ্য ২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ঘটনাস্থল থেকে প্রাপ্ত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ তথ্য বিশ্লেষণ এবং গোপনীয়তার সাথে সরেজমিন পরিদর্শন পরবর্তী এমনটি জানিয়েছেন আরাকান টিভি’র সংবাদদাতারা। এ সংখ্যা ক্রমশই বেড়ে চলছে। জানাগেছে, রাথিদং জেলার খিয়ান্দং ও চৌপ্রাং এলাকার রোহিঙ্গাদের প্রায় একমাস যাবত অবরোধ করে রাখে সামরিক ও উগ্রপন্থি রাখাইন সদস্যরা। রোহিঙ্গা স্বাধিকার আন্দোলনের কর্মীরা অবরোধ প্রত্যাহারের জন্য ভিডিও বার্তা দেয়। এরপর অবরোধ প্রত্যাহার না করে উল্টো আরো বেশি চাপ প্রয়োগ করে রোহিঙ্গাদের। ২৩ আগস্ট ওই এলাকা থেকে দুই শতাধিক রোহিঙ্গাদের ধরে নিয়ে যায় সেনা বিজিপি ও লুন্টিং এর সম্মিলিত বাহিনী। রোহিঙ্গা নারীদের শ্লীলতাহানী ও মারধর করে। তৎমধ্য থেকে ৬ জনের লাশ পাওয়া গেলেও বাকিদের হদীস মিলেনি। রোহিঙ্গা পল্লীতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে বর্মী সৈন্য একই দিন আরাকান রাজ্য বিষয়ক সরকারের উপদেষ্ঠা কমিশন তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন সরকারের হাতে তোলে দেয়।
এ প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের নাগরিকতা দেয়ার ব্যাপারে সরকারকে সুপারিশ করা হয়। অন্যথায় আরাকানে জঙ্গিবাদ বাড়তে পারে বলেও সতর্ক করা হয় সরকারকে। আনান কমিশনের এ রিপোর্টে সন্তোষ্ট হতে পারেনি ম্যালিটেরী কর্তৃপক্ষ। একদিন পর ২৪ আগস্ট দিবাগত রাতে খিয়ান্দং ও চৌপ্রাং এলাকার অবরুদ্ধ রোহিঙ্গাদের নাস্তানাবুদ করে দেয়ার প্রস্তুতি নেয় সেনাবাহিনী। সোর্সের মাধ্যমে এ খবর রোহিঙ্গা স্বাধিকার আন্দোলনের কর্মীদের কাছে পৌঁছলে তারা রাতেই সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এতে আরো বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে ওই রাত থেকে কিলিং অপারেশন শুরু করে সৈন্যরা যা এখনো চলমান রয়েছে ।পদদলিত করে এক রোহিঙ্গা শিশুর নাড়িভূঁড়ি বের করে ফেলেছে সৈন্যরা। পাশে আহাজারি করছে মা।
অপারেশনের প্রথম রাতের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ শুক্রবার সকালে জানা যায়। ওই রাতে প্রায় ১২০ জন প্রাণ হারান। তৎমধ্য থেকে ৬ জন সেনা সদস্য এবং ৯৯ জন রোহিঙ্গার মৃতদেহ পাওয়া যায়। পরের দিন থেকে আরো নৃশংসতা শুরু করে সামরিক বাহিনী। আকিয়াব থেকে সেনা, নৌ ও্ বিমান বাহিনীর হাজার হাজার সদস্য উত্তর আরাকানে আননয়ন করা হয়। কামান, মর্টার, গোলা-বারুদ ও ভারি অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে হামলা শুরু করে গ্রামের সাধারণ নিরস্ত্র রোহিঙ্গাদের উপর। নির্লিপ্ত তান্ডব ও হত্যাকান্ড চালিয়ে আরাকানের ভূমি রক্তে রঞ্জিত করে তোলে। নারী-শিশু, বৃদ্ধ ও যুবক কাউকে ছাড় দেয়নি। যাকে যেখানে পেয়েছে তাকে সেখানে গুলি করেছে। ২৫ আগস্ট প্রায় ৩’শ রোহিঙ্গা হত্যার শিকার হয়। ২৫ আগস্ট মধ্যরাত থেকে রোহিঙ্গাদের হত্যা করার পাশাপাশি তাদের বাড়িঘরে আগুনে জ্বালিয়ে দেয়। ওই দিন মংডু, বুথিদং ও রাথিদং –এর অন্তত ৩০টি রোহিঙ্গা গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে। এতে পুড়ে মরেছে অনেক নারী ও বৃদ্ধ। রক্ষা পায়নি রোহিঙ্গাদের গবাদি পশুও। ২৬ আগস্ট সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ে হত্যার শিকার রোহিঙ্গার সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যায়। এছাড়া প্রায় ১০ হাজার মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। পাঁচ হাজারের মতো বাংলাদেশ সীমান্তে চলে যায়। গুলিবিদ্ধ ও অগ্নিদগ্ধ হয়ে আহত হয় হাজার দুয়েক।
২৭ ও ২৮ আগস্ট ভিন্ন কায়দায় হত্যালীলা চালানো শুরু করে সামরিক বাহিনী। গ্রাম ঘেরাও করে রোহিঙ্গাদের আটক পরবর্তী ব্রাশ ফায়ার করার মাধ্যমে গণহত্যা চালায়। ২৭ তারিখ থেকে রোহিঙ্গা নারীদেরকে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা করে। অগ্নি সংযোগ করে জ্বালিয়ে দেয় রোহিঙ্গা পল্লী। বিশেষ করে রাথিদং-এর এর ফিরিন্দক, সোহাগপ্রাং, বুথিদং-এর চৌপ্রাং এবং মংডুর কইল্লাভাঙ্গা, পৌরসভার আশেপাশের গ্রামে এ নারকীয় বর্বরতা চলে। এ দুই দিনে প্রায় হাজার খানেক রোহিঙ্গাকে হত্যা করে হানাদার বাহিনী।
আজ ২৯ আগস্ট মঙ্গলবারও মংডু, বুথিদং ও রাথিদং-এর ১৭টি গ্রামে একযোগে সৈন্যরা সাধারণ রোহিঙ্গাদের উপর আক্রমণ করে হত্যালীলা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষকরে আন্ডাং, বচ্ছরা, কুয়াশ্চং এর পাড়াগুলোতে অগ্নিসংযোগ করছে এবং নারীদের ধর্ষণ করছে। এসব এলাকা এখন পুরুষ শুন্য।
অন্যদিকে মুসলিম প্রধান প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়ার আশায় গত পাঁচদিনে সীমান্তে পৌঁছেছে প্রায় ত্রিশ হাজার রোহিঙ্গা। বাংলাদেশ সরকারের অনড় অবস্থানের কারনে সীমান্তে রোহিঙ্গাদের আর্তনাদ চলছে। অনাহারে অর্ধহারে খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টিতে ভিজছে আর রোদে পুড়ছে। ক্ষুদার্থ শিশুদের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠেছে সেখানকার পরিবেশ। প্রাণ বাঁচাতে দলে দলে রোহিঙ্গারা সেখানে ভিড় করছে। অন্যদিকে কিছু কিছু রোহিঙ্গাকে আটক করে বার্মায় ফেরত পাঠানোর মাধ্যমে মৃত্যুর দুয়ারে আবারো টেলে দিচ্ছে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি। বাবা-মাকে হারিয়ে সদ্য এতিম হওয়া কিছু ছেলে মেয়েকে ডাল রান্না করে খাওয়াচ্ছে এক রোহিঙ্গা যুবক। ছবিটি আন্ডাং থেকে তোলা।
সামরিক বাহিনীর এবারের গণহত্যা ছাড়িয়ে গেছে পূর্বেকার সকল নির্যাতনের ঘৃন্যতম ইতিহাসকে। রোহিঙ্গাদের দেখামাত্র গুলি করে হত্যা, নারীদের ধর্ষণ, অগ্নি সংযোগ করে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়াসহ এমন কোন মানবতা বিরোধী অপরাধ নেই যা সরকারি বাহিনী করছেনা। আরাকানে গণমাধ্যম কর্মীদের প্রবেশাধিকার নেই বলে নিহতের সঠিক সংখ্যাও প্রকাশ হচ্ছেনা। ফলে অনুমাণ করে মৃতের সংখ্যা প্রকাশ করছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। আবার অনেক গণমাধ্যম সরকারের পক্ষ খেতে দেয়া বানোয়াট তথ্যের উপর ভিত্তি করে সংবাদ পরিবেশন করছে।
যে সব স্থীর ও ভিডিও চিত্র ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ছে তাতে নির্যাতনের শতকরা ৫ভাগও প্রকাশিত হচ্ছেনা। ভয়াবহ অনুকূল পরিবেশে থেকেও সাহসীকতা ও ধৈর্যের সাথে রোহিঙ্গারা যেসব সচিত্র খবর সরবরাহ করছে তাতে মূল নির্যাতনের আংশিক প্রকাশ পাচ্ছে মাত্র। তাছাড়া বর্মী প্রশাসন রোহিঙ্গাদের লাশ গোপন করার জন্য গণকবর দিচ্ছে। রোহিঙ্গারা যাতে কোন তথ্য বোহিরে প্রেরণ করতে না পারে সেকারনে আরাকানের কিছু কিছু স্থানে মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দিয়েছে।
আরাকান থেকে ইতিমধ্যে ৫ হাজার অমুসলিম (রাখাইন ও মঘ) কে সরিয়ে নিয়েছে প্রশাসন, যাতে রোহিঙ্গাদের উপর আরো বেশি বর্বরতা চালিয়ে আরাকান থেকে তাদের শিকড়ে উপড়ে ফেলানো যায়। আরাকানে বসবাসরত হিন্দু তথা সনাতন ধর্ম্বালম্বীদেরকেও রোহিঙ্গাদের সাথে হত্যা করছে হানাদার বাহিনী। বাংলাদেশ সীমান্তে চলে যাওয়া বেশ কিছু হিন্দু নারী সাংবাদিকদের বলেছেন, হিন্দুদেরকেও হত্যা করছে রাখাইন ও সরকারি বাহিনী।
হাসান হাফিজ, আরাকান টিভি