বৃহস্পতিবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৭

বোমাং রাজা

বান্দরবান পার্বত্য জেলার বোমাং সার্কেলের ১৬তম বোমাং রাজা ক্য সাইন প্রু চৌধুরী (কে এস প্রু)। রাজা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ১৩৭তম রাজ পূণ্যাহ উপলক্ষ তিনি এই প্রথম পাহাড়ের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনায় বাংলানিউজের মুখোমুখি হয়েছেন। বান্দরবান পার্বত্য জেলার বোমাং সার্কেলের ১৬তম বোমাং রাজা ক্য সাইন প্রু চৌধুরী (কে এস প্রু)। রাজা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ১৩৭তম রাজ পূণ্যাহ উপলক্ষ তিনি এই প্রথম পাহাড়ের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনায় বাংলানিউজের মুখোমুখি হয়েছেন।
তার মন্তব্য, সরকার ও জনসংহতি সমিতির (জেএসএসের) মধ্যে যে চুক্তি সই হয়েছে, তার মাধ্যমে পাহাড়ের উন্নতি যে হয়নি, তা নয়, কিন্তু আরও উন্নতি হওয়া প্রয়োজন। পার্বত্য চু্ক্তি বাস্তবায়নের মূল অন্তরায় ভূমি সমস্যা। চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে পাহাড়ে শান্তি আসবে বলে মনে করেন তিনি। এজন্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি। একান্ত সাক্ষাৎকারে বোমাং রাজা ক্য সাইন প্রু চৌধুরী (কে এস প্রু) প্রথমবারের মতো বাংলানিউজকে এ কথা বলেন।


বাংলানিউজের বান্দরবান প্রতিনিধি এস বাসু দাশের নেওয়া সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

বাংলানিউজ: পার্বত্য চুক্তিতে পার্বত্য জেলায় কতটুকু শান্তি এসেছে? 

ক্য সাইন প্রু চৌধুরী: সরকার ও জেএসএসের মধ্যে যে সমঝোতা (পার্বত্য চুক্তি ) হয়েছে, তার মাধ্যমে উন্নতি হয়নি আমরা বলনো না, উন্নতি হয়েছে। তবে আরও বেশি উন্নতি হওয়া প্রয়োজন। পার্বত্য জেলার একজন নাগরিক হিসেবে সরকারের কাছে আমার আবেদন, কালক্ষেপণ না করে সরকার যেন পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করে।

বাংলানিউজ: পার্বত্য জেলার সবচেয়ে বড় সমস্যা কী? এ সমস্যা দূর করতে সরকারের কী কী উদ্যোগ নেওয়া দরকার?

ক্য সাইন প্রু চৌধুরী: সবচেয়ে বড় সমস্যা ভূমি, এই ভূমিই আমাদের প্রাণ। ভূমির সমস্যার যদি সমাধান না হয়, তাহলে আমাদের জন্য অনেক বড় ক্ষতি হবে। এমনিতেই ক্ষতিতে ভুগছি আমরা। এক্ষেত্রে সময় অপচয় না করে ভূমি সমস্যা সমাধানে সরকারের উচিত সর্বোচ্চ চেষ্টা করা।

বাংলানিউজ: পাহাড়ে শত শত উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) পাহাড়ের উন্নয়নে কাজ করছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে স্থানীয় আদিবাসীদের জীবনমান উন্নয়নে তাদের অনুদান পাওয়া অর্থ যথাযথভাবে ব্যয় হচ্ছে কি?

ক্য সাইন প্রু চৌধুরী: এখানে যা কিছু আমরা পাচ্ছি, তা আমাদের সরকার, স্থানীয় লোকজন এবং বিদেশিদের কাছ থেকে পাওয়া। আমাদের উন্নয়ন যে হচ্ছে না, তা আমি বলবো না; উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু যে পরিকল্পনা তাদের আছে, তা ঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। তহবিলের অপব্যবহার করা হচ্ছে। যতটুকু সম্ভব নিয়মানুবর্তিতা, সৎ, উৎসর্গপরায়ণের মাধ্যমে আমাদের চরিত্র গঠন করলে এখন আমরা যা কিছু পাচ্ছি, এর দ্বিগুণ সফলতা পাবো।

বাংলানিউজ: পার্বত্য জেলার বর্তমান অশান্তির মূলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফের সংঘাতকে দায়ী করা হয়, এটি নিরসনে সংগঠনগুলোর জন্য আপনার পরামর্শ কী?

ক্য সাইন প্রু চৌধুরী: জেএসএস অনেক বছর পরে সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় এসেছে। অপরদিকে, সরকারের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছিল, তা ইউপিডিএফ মানতে চায় না। সমস্যা-সংকট নিরসনের জন্য সবাইকে একমতে আসতে হবে। পার্বত্য জেলা শুধু ইউপিডিএফ এবং জন সংহতি সমিতির (জেএসএস) নয়, এটা সবার। সরকার এবং জেএসএসের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে, তার মাধ্যমে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে, আরও উন্নতির জন্য সবার একযোগে কাজ করে যাওয়া প্রয়োজন।

বাংলানিউজ: তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে বান্দরবান পার্বত্য জেলা একটি শান্ত, সম্প্রীতি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধ এলাকা। এর কারণ কী বলে মনে করেন?

ক্য সাইন প্রু চৌধুরী: বোমাং সার্কেলের ইতিহাসে কখনো পাবেন না যে, আদিবাসীদের মধ্যে কোনো সংঘাত হয়েছে। দেখুন, পাকিস্তান আমলেও আমরা সংঘর্ষ দেখেনি। আশা করি, হবেও না। কেননা, আমাদের এখানে ১১ আদিবাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে বাঙালিদের সু-সম্পর্ক রয়েছে। আমরা শুধু পার্বত্য জেলায় শান্তি নয়, আমাদের পুরো জন্মভূমিতে শান্তি বজায় রাখতে চাই।

বাংলানিউজ: সাবেক বোমাং রাজা অং শৈ প্রু চৌধুরী পাহাড়িদের ‘আদিবাসী’ দাবি করেননি এবং আদিবাসীরা মায়ানমার থেকে এসেছে, বলেছিলেন।, আপনিও কি এ বিষয়ে একমত? 

ক্য সাইন প্রু চৌধুরী: শত শত বছর আগে আমরা মায়ানমার থেকে এখানে এসেছি এটি অস্বীকার করছিনা। কিন্তু আমরা এখানে বাস করছি প্রায় শতাব্দি ধরে। আমরা পৃথক না, আমরা এক এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নিজেদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে দাবি করেন। সেই হিসেবে আমিও একজন ‘আদিবাসী’। আমাদের তো প্রথম থেকেই ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আগে তো আমাদের ‘আদিবাসী’-ই বলতেন সবাই।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে যে ‘আদিবাসী’ লেখা ছিল, এগুলো কি কিছুই নয়? আমাদের মুখ থেকে তো বের হয়নি, তিনিই (শেখ হাসিনা) তো উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছেন, এখন পরিবর্তন কেন?

বাংলানিউজ: রাজ পরিবারের রাজকর বাড়ানোর দাবি দীর্ঘদিনের। নতুন রাজা হিসেবে কর বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছে আপনার কোনো দাবি আছে?

ক্য সাইন প্রু চৌধুরী: ব্রিটিশ আমলে কার্যকর করা রাজকর সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন করা হয়নি। কিন্তু, এটা হতে পারে না। আগে কর ছিল ৬ টাকা, এখনও তাই। এক্ষেত্রে রাজার অংশ হলো ২.৫০ টাকা। তারপর হেডম্যানের অংশ ২.৫০ টাকা এবং অবশিষ্ট ১.৫০ টাকা আমাদের সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয়। ১৯০০ সাল থেকে একই অবস্থা চলে আসছে। আগে ১ টাকা দিয়ে অনেক জিনিস পাওয়া যেতো। কিন্তু, এখন ১ টাকা দিয়ে ১ গ্লাস পানিও পাওয়া যায় না, চাহিদার ওপর ভিত্তি করে অবশ্যই কর বাড়ানো উচিত।

বাংলানিউজ: আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

ক্য সাইন প্রু চৌধুরী: রাজ পূণ্যাহ উপলক্ষে দেশবাসীসহ বাংলানিউজের সব পাঠক ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ।

বাংলাদেশ সময়:  জানুয়ারি ০৩, ২০১৩ সম্পাদনা: শামীম হোসেন, নিউজরুম এডিটর, আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর