পার্বত্য অঞ্চলের সংকটের পটভূমি নিহিত উপনিবেশিক প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে।এর সাথে যুক্ত হয়েছে উত্তর-উপনিবেশিক (post colonial) জাতিরাষ্ট্র গঠনের পার্শপ্রতিক্রিয়া। ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগতভাবে পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন এথনিক জাতিগোষ্ঠীর অধিবাসীরা দেশ ভাগের কারণে ভারত, বার্মা এবং বাংলাদেশের সীমানা দ্বারা বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ফলে ইতিহাসের সাথে তাঁদের যেই সংযোগ ছিল, ছিল স্বাধীন সত্ত্বা, ছিল নিজস্ব কালচার ও ঐতিহ্য সেগুলোও সংখ্যাগরিষ্ট জাতিরাষ্ট্রের চাপে হারিয়ে যেতে বসেছে। ব্রিটিশ উপনিবেশ কাঠামোগতভাবে শেষ হলেও তাঁর রেশ যে এখনো রয়ে গেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম সংখ্যাগুরু পাহাড়ী এবং বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ধারণা ও প্রত্যাশা ছিল সেটা ভারতের অংশে পরবে। ব্যাপারটা এমন নয় যে, পাহাড়ীরা ভারতের সাথে যোগ দেয়ার জন্য শুরু থেকেই এক পায়ে খাঁড়া ছিল।বরং ১৯৪৭ সালের ১০ ই জানুয়ারি কংগ্রেস হাই কমান্ড জয়প্রকাশ নারায়ণ ও এ ভি থাক্কড়কে পাঠায় সেখানকার হিলমেন্স এসোসিয়েশন ও জনসমিতিকে ভারতের সাথে রাখার দাবি উঠাতে রাজি করানোর জন্য। তারা স্থানীয় নেতাদের আশ্বাস দেন যে যদি তারা দাবী তোলে তাহলে কংগ্রেস তা আদায় করবে।(১)
কিন্তু রেডক্লিফ যখন দেখলেন পুরো এলাকাটা চট্টগ্রামের ওপর নির্ভরশীল, তখন এটাকে পূর্ববাংলার সাথে রাখা যুক্তিযুক্ত মনে করলেন। তাছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য কর্ণফুলি নদীর বিশেষ গুরুত্বের কথাও তিনি বিবেচনা করে পার্বত্যচট্টগ্রামকে বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত করে দেন। কিন্তু কংগ্রেস এই সিদ্ধান্তকে মানতে পারেনি। নেহেরু, প্যাটেল বিভিন্নভাবে মাউন্টব্যাটনকে চাপ দেয়ারও চেষ্টা করেছেন। কিন্তু লিয়াকত আলী খানকে নমণীয় করতে পারেনি। এর জন্য পাঞ্জাবের ফিরোজপুর ও জিরা নামে দুটো এলাকা পাকিস্তানের হস্তচ্যুত হয়। (২)
সেময় পার্বত্য অঞ্চলের একাংশের কংগ্রেসপন্থী নেতা ছিলেন স্নেহা কুমার চাকমা।আনন্দবাজার পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি প্রকাশ করেন কিভাবে কংগ্রেস হাই কমান্ড পার্তব্য চট্টগ্রামে বিদ্রোহ করতে উস্কানি দেয়। তিনি বলেন; “আমি পেটেলের সাথে তিন মাসের মধ্যে তিনবার দেখা করি। বাংলার কংগ্রেস নেতাদের সাথেও বিষয়টা নিয়ে আমি কথা বলি। তারা আমাকে রাজ্য কমিটিতে কো-অপ্ট করে নেন। বাংলার কংগ্রেস নেতাগন ও পেটেল উভয় তরফ একমত যে বাউন্ডারি কমিশন বিরাট অন্যায় করেছে। পেটেল আমার সেক্রেটারিকে বিদ্রোহের উত্তেজনা সৃষ্টি করতে বলেন, যাতে করে পাকিস্তানিরা রক্তপাতের মাধ্যমে অবস্থা আয়ত্তে আনার পথ বেচে নিতে বাধ্য হয় এবং ভারত সামরিক হস্থক্ষেপের সুযোগ পায়।” (৩)
এর অংশ হিসেবেই ১৫ আগষ্ট অফিসিয়ালি ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে যাবার পর, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারতীয় পতাকা উত্তলন করে স্নেহা কুমার চাকমার অনুসারীরা। ২-৩ দিন পর সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সেই পতাকা নামিয়ে ফেলে।পাকিস্তান আর্মির বেলুচ রেজিমেন্ট ভারতপন্থীদের সেখান থেকে বিতারত করে।ভারতের পক্ষেও ঐ সময়ে সামরিক পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ হয়নি। ১৭ এই আগষ্টকে সেজন্য ভারতীয় চাকমাদের একটা অংশ ‘কালো দিবস’ হিসেবে আজও স্মরণ করে।(৪)
যে কোন জাতি রাষ্ট্র তার ভৌগলিক সীমানার নিরাপত্তা রক্ষায় সর্বশক্তি নিয়োগ করে। সদ্য স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাছে পাহাড়ীদের উপরোক্ত আচরণ এক দীর্ঘস্থায়ী অবিশ্বাস ও সংশয়ের সৃষ্টি করে।বাঙালী মুসলমান পাকিস্তান পর্ব অনুশীলন করে ১৯৭১ সালে নতুন জাতিরাষ্ট্র তৈরি করলেও পাহাড়ীদের সেই ঘটনা আজও উদাহরণ হিসেবে মনে রেখেছে। ঐ ঘটনার আগে ব্রিটিশ উপনিবেশ সরকার কর্তৃক তৈরিকৃত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়েল অ্যাক্ট ১৯০০' অনুসারে পার্বত্য অঞ্চল যে আংশিক স্বায়ত্তশাসন ভোগ করত সেটি রহিত হয় এবং কেন্দ্রীভূত শাসনের (Centralised rule) আওতায় চলে আসে। যা বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মূল জাতিগোষ্ঠী বাঙালীদের সেখানে প্রবেশ ও বসতি স্থাপনের সুযোগ করে দেয়।
নোটঃ
(১) Bhaumik, Subir, Insurgent Crossfire: Northeast India, New Delhi, 1996, p:73
(২) Mansergh, Nicholas et al, Transfer of Power: Constitutional Relations between Britain and India, 12 vols, London, 1970-1983
(৩) Snehakumar Chakma, Interview, Ananda Bazar Patrika, 4 July 1986
(৪) Sekhar Datta, 'Black day' for Chakmas, The Telegraph, Calcutta, August 15 , 2016, https://www.telegraphindia.com/…/jsp/north…/story_102539.jsp
[if you like our activism, please support this initiative to continue https://goo.gl/HbxXzf]