শুক্রবার, ১৩ মার্চ, ২০২০

খাগড়াছড়ির মুক্তিযুদ্ধ

আলহাজ্ব দোস্ত মোহাম্মদ চৌধুরী
ভাষা সংগ্রাম থেকে আমাদের স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত। চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করে ছিলেন….এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”……।  শুরু হয়ে গেল বাংলার সর্বত্র স্বাধীনতার প্রস্তুতি। একাত্তরে ২৫ শে মার্চ গভীর রাত্রিতে দখলদার হিংস্র বর্বর পাক বাহিনী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠে ছিল তারা। শুরু করল তারা গণহত্যা ট্যাংক চালিয়ে ও মেশিনাগারের গুলি বর্ষন করে। যেদিন ২৫ শে মার্চের রাতেই পাকবাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার হবার পূর্ব মুহুুুুুুুুুুুুুুুুর্তে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করলেন বাংলাদেশে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পৌঁছিয়ে দেয়া হল চট্টগ্রামসহ দেশের সর্বস্তানে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে। ঢাকা রেডিও ষ্টেশন তখন বর্বর পাক সেনার দখলে। চট্টগ্রাম বেতার কেদ্র থেকে ২৬শে মার্চ প্রচারিত হল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার বানিটি। 

বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সেদিন বেলা ১টার কয়েক মিনিট স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ করেন চট্টগ্রামের আওয়ামীলীগ নেতা মরহুম এম.এ. হান্নান। এই ঘোষণা পাঠের পর পর বেতার কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকেই তা শুনতে পারেনি। তাই এর পরদিন অর্থাৎ ২৭শে মার্চ দুপুর হতে চট্টগ্রাম বেতারে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়াউর রহমান বাংলা এবং ইংরেজীতে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধের স্বশস্ত্র স্বাধীনতার সংগ্রাম। জাতি ঝাঁপিয়ে পড়ল মুক্তির সংগ্রামে অত্যান্ত আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত পাক বাহিনী সংগে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে আমাদের দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। যুদ্ধের নয় মাসের মধ্যে নিয়মিত সেনাবাহিনী ও গণবাহিনী সমন্বয়ে গঠিত মুক্তিবাহিনী দেশের প্রতিটি অঞ্চলে প্রতিরোধ ও আক্রমন গড়ে তুলে আমাদের বিজয়কে সেদিন নিশ্চিত করেছিল।

এই সংগ্রাম ছিল তাদের বাঁচা মরার সংগ্রাম। তার উপর নির্ভর করেছিল তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, তাদের সমগ্র অস্তিত্ব। তাই সেদিন বাংলার দামাল ছেলেরা যে, যা পেয়েছে তাই নিয়ে শত্রু বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরেছিল। সে দিন বাংলার প্রতি গ্রামে গঞ্জে শহরে বন্দরে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল দেশের প্রতি অঞ্চল পরিণত হয়েছিল দুশমনের মৃত্যু ফাঁদে।

প্রত্যন্ত অঞ্চল দুর্গম পাহাড় ঘেরা অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন্ডিত বাংলাদেশের এই পার্বত্য চট্টগ্রাম। শাসন তান্ত্রিক সুবিধার জন্য ১৯২০ সালে বাঘাইছড়ি, মহালছড়ি, দীঘিনালা ও রামগড় থানা নিয়ে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার দ্বিতীয় মহকুমা রামগড়। গিরি মেঘলা পার্বত্য চট্টলার চেঙ্গীবিধৌত খাগড়াছড়িতে ১৯৭১ সনে, আমি তখন খাগড়াছড়ি মহকুমা আওয়ামীলীগের সভাপতি।

২৫শে মার্চের কালো রাত্রিতে বর্বর পাক হানাদার বাহিনী যখন ঢাকায নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তথন খাগড়াছড়ির মানুষ গভীর নিদ্রা আচ্ছন্ন। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই আমার সাংগঠনিক সম্পাদক (আওয়ামীলীগ) আনোয়ারুল আজিমের মুখে শুনতে পেলাম রামগড় আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব মরহুম সুলতান আহম্মদ তার যোগে জানাইলেন যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। প্রকাশ থাকে যে, খাগড়াছড়ি রামগড় হতে একটি মাত্র পি.সিও.দ্বারা তারবার্তা চলত। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের সেই সর্তক ইঙ্গিত ‘‘তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক।’’ এই মন্ত্রে দিক্ষীত হয়ে আমার নেতৃত্বে নূর বক্স মিঞাকে সাধারণ সম্পাদক করে একযুদ্ধ পরিচালনা কমিটি গঠন করি। উল্লেখিত কমিটিতে সক্রিয় ছিলেন, হাজী বাদশা মিঞা, জয়নাল আবেদীন আন্দোলনের দুর্গ। আমি ও নুর বক্স মিঞা প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় খাগড়াছড়ি মহকুমার রামগড়, মহালছড়ি, দীঘিনালা ও অন্যান্য থানায় প্রতিরোধ আন্দোলনের সংগ্রাম কমিটি গঠন করি। ৭ই মার্চের পর হইতে নিয়মিত মিটিং মিছিলে মুখরীত ছিল খাগড়াছড়ি মহকুমার সদর। ২রা মার্চ থেকে আওয়ামীলীগ, ছাত্র, জনতাকে একত্রিত করে সকাল ১০টায় মিছিল সহকারে মহকুমা প্রশাসকের অফিসে গিয়া, পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করি।

ইতিমধ্যে রামগড়ের সুলতান আহম্মদ সাহেব জানালেন যে, লৌগাং বা তাইন্দং এ একজন বাঙালি মেজর স্ব পরিবারে আত্মগোপন করে আছেন। আমি ২৭ শে মার্চ সকালে একটি জীপ নিয়ে লৌগাং যাই। সেখানে উক্ত মেজর’কে না পেয়ে ওয়্যারলেস যোগে তাইন্দং এ তার সাথে যোগাযোগ করি। আমি তাকে (মেজর সাহেব) অনুরোধ করি। দেশের এই ক্লান্তি লগ্নে তারমত একজন যোগ্য পরিচালকের বিশেষ প্রয়োজন। মেজর সাহেব নাম আবুল কাশেম। আমার অনুরোধে তিনি রামগড়ে যান।

২৯ শে মার্চে মরহুম জহুর আহম্মদ চৌধুরী এম.আর. ছিদ্দিকী ও অন্যান্য জননেতাবৃন্দ রামগড়ে আসেন এবং ঐদিন সাহায্যের জন্য আগরতলা চলে যান। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে রামগড়ের ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই প্রতিরোধ আন্দোলনের যোগ্য বলিষ্ঠ্য নেতৃত্ব দেন মরহুম আহম্মদ সুলতান। আর স্বাধীনতা কামী জনগণ, আওয়ামীলীগের সংগ্রামী নেতৃবৃন্দ সাহায্যের জন্য ছুটে যান রামগড়ে।

অন্যদিকে সীমান্ত এলাকায় দায়িত্বশীল বাঙালি ই.পি.আর সদস্যরা হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যদের পরাভূত করে রামগড়ে আসতে থাকে। আমি ও নুর বক্স মিঞা তাঁদের সংগঠিত করি। আমরা চট্টগ্রাম, কাপ্তাই, চন্দ্রঘোণা ও রাঙ্গামাটি হইতে আগত মুক্তিযোদ্ধাদের মহালছড়ি হইতে খাগড়াছড়ি জড়ো হয় এবং জীপে (চাঁদের গাড়ি) যোগে রামগড় পৌঁছে দেই। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মহালছড়িতে একটি লঙ্গর খানা ও মুক্তিযোদ্ধা সংগঠিতকরণ ক্যাম্প স্থাপন করি। এই ক্যাম্প ও লঙ্গর খানার সার্বিক দায়িত্ব পালন করেন মহালছড়ির মোবারক আলী মাষ্টার। কিন্তু সেই সময় অভাব ছিল সামরিক অফিসার, গোলাবারুদ ও অস্ত্র শস্ত্রের। প্রথম দিকে অফিসার বলতে ছিল সুবেদার। উনারা হলেন সুবেদার মুফিজুর বারী ও সুবেদার জয়নাল আবেদীন। মুক্তি বাহিনীর হাতে তখন অস্ত্রের মধ্যে ছিল কয়েকটা ৩০৩ রাইফেল ও কয়েকটা চাইনিজ রাইফেল। ৭দিনের মধ্যে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তোরার জন্য গোলা বারুদ সংগ্রহ ও যথাস্থানে পৌঁছানোর দায়িত্ব পড়ে রামগড় আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মরহুম সুলতান আহম্মদ ও আমার উপর।

পূর্ব পরিচয়ের সুবাদে সাবরুমের (বর্তমানে ত্রিপুরা রাজ্যের মহকুমা) কংগ্রেস নেতারা মরহুম সুলতান সাহেবের অনুরোধে গোলা বারুদ সংগ্রহের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১লা এপ্রিল ১৯৭১ সালে ভারত সরকার রামগড়ের অনুকুলে দুই ট্রাক গোলা বারুদ ও যুদ্ধের সরঞ্জাম সাহায্য হিসাবে পাঠিয়ে দেয়। ঐ সময় আমি ও নুর বক্স মিঞা ৩২টি জীপ (তৎকালীন একমাত্র যানবাহন খোলা জীপ বা চাঁদের গাড়ী) নিয়ে রামগড়ে উপস্থিত ছিলাম। যার দরুন খুব অল্প সময়ের মধ্যে সিপাহী ও গোলা বারুদ গুলি চট্টগ্রামের সরকার হাট, হাটহাজারী, কালুর ঘাট ও পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাই ও চন্দ্র ঘোণায় পাঠাইতে সক্ষম হই।

কয়েকদিন পরেই শুরু হল গণজমায়েত। চন্দ্রঘোনা কাপ্তাই ও রাঙ্গামাটির সম্মিলিত ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক ও জনতা রাঙ্গামাটি মহালছড়ি হয়ে খাগড়াছড়ি আসে। তাঁদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা এবং প্রশিক্ষণের জন্য জীপ যোগে রামগড় হয়ে ভারতে পাঠানোর দায়িত্ব পড়ে খাগড়াছড়ি সংগ্রাম কমিটির উপর। এর জন্য প্রতিদিন খাগড়াছড়ি বাসির সাহায্য নিয়ে লঙ্গর খানা গড়ে ১৫০ হইতে ২০০ জনের খাবার ব্যবস্থা করি।

১৯৭১ এর এপ্রিলের প্রথম দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক সৈয়দ হাসান, তৌফিক ইমাম (এইচ টি ইমাম) খাগড়াছড়িতে এসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। এরই মাঝে মেজর জিয়াউর রহমান (সাবেক প্রেসিডেন্ট) কয়েকজন সামরিক অফিসার নিয়ে খাগড়াছড়ি আসেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন অলী আহম্মদ (কর্ণেল অলী আহম্মদ, বীর বিক্রম) তারা নুর বক্স মিঞা ও আমার সাথে সাক্ষাত করে ঐ দিন রাত্রে রামগড় চলে যান।

এদিকে রামগড়ে নেতাদের যুদ্ধের পরিকল্পনা করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। কারণ মাত্র দুইজন সুবেদার এই লাইনে কাজ করেন। ২রা এপ্রিল রামগড় টেলিফোন এক্সচেঞ্জের কয়েকজন অপারেটরকে বাজার করার টাকা দেয়া হলে একমাত্র লাইনম্যান সোলেমান ব্যতীত বাকী অপারেটররা পালিয়ে যায়। স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বাবু রনজিৎ দেব বর্মন, বাবু বিজয় কুমার সাহা, জীতেন্দ্র মজুমদার ও মোহাম্মদ সিরাজুল হককে দিয়ে মরহুম সুলতান আহাম্মদ রামগড় পতনের পূর্ব পর্যন্ত টেলিফোনের কাজ চালান। উল্লেখ্য যে, রামগড় পতনের সময় লাইনম্যান সোলেমান টেলিফোন এক্সচেঞ্জটি উঠিয়ে সাবরুমে নিয়ে যায়।

৪ঠা এপ্রিল বিকালে ডিসি তৌফিক ইমাম ও মেজর জিয়াউর রহমান রামগড়ে উপস্থিত হন। রামগড়ের নেতৃবৃন্দ মনে মনে আনন্দিত হলো। এইভেবে যে যুদ্ধের পরিকল্পনা তৈরীতে একজন অভিজ্ঞ মেজর পাওয়া গেল। ডিসি সাহেবের আর্থিক সাহায্যে রামগড় লঙ্গর খানার বোঝা কিছুটা হালকা হয়। ষ্টোর পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন স্থানীয় পশু ডাক্তার বাবু বিকে দাস। রান্নার দায়িত্ব ছিলেন মৌলভী বজলুর রহমান ও জনাব এবিছিদ্দিক। তারা তাদের দায়িত্ব অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে পালন করেছিলেন। ভারতের হরিণার ইয়ুথ ক্যাম্পেও। এর মধ্যে মেজর রফিকুল ইসলাম (১নং সেক্টর কমান্ডার ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) আগরতলা হইতে রামগড়ে আসেন। এইবার দুই মেজর (মেজর জিয়াউর রহমান ও মেজর রফিকুল ইসলাম) মিলিতভাবে কাজ শুরু করেন। তাদের কার্যালয় ছিল বর্তমান রামগড় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কক্ষে। এদিকে বহু দামাল ছেলে সামরিক প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য আগ্রহী। কিন্তু প্রশিক্ষকের অভাব দেখা দেয়। তখন বাংলার এক অকুতোভয় ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের ৯ই এপ্রিল প্রশিক্ষনের দায়িত্ব নেন। ১০ই এপ্রিল থেকে পূর্ণ মাত্রায় প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। এরই মধ্যে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আসতে আরম্ভ করল রামগড়ে।

যাঁরা এই পথে এলেন তারা হলেন জনাব এম ওহাব, এম. এ. হানান, আব্দুল্লাহ আল হারুন, মির্জা আবুল মনছুর, ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেন, প্রফেসর খালেদ (সাবেক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী), মাইন শিক্ষাবিদ, ডা: এ. আর মল্লিক, ছৈয়দ আলী আহসান, চট্টগ্রামে পুলিশ সুপার, (তৎকালীন) মানিকছড়ি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডা: এস.বি বিশ্বাস, খাগড়াছড়ির ডা: সিরাজুল ইসলাম আরও অনেকেই। কয়েকজন ডাক্তার রামগড়ে আসায় আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া গেল।

মানিকছড়ির মাননীয় মং রাজা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন গরুর গাড়ীতে করে রামগড়ে পাঠাতে লাগলেন চাউল, ডাউল, তরী-তরকারী। বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অনুগত্য প্রকাশ করে দিলেন বৈদেশিক মুদ্রা। যা ঐ সময় অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য যোগ দিতে লাগল আরও অনেক যুদ্ধ বিশারদ। তাঁদের মধ্যে ছিল ক্যাপ্টেন মাহুফুজুর রহমান, ক্যাপ্টেন আলী, ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভূঞা, গ্রুপ ক্যাপ্টেন সুলতান মাহামুদ। সময়ের সাথে সাথে প্রতিরোধ আন্দোলন ধীরে ধীরে সীমিত হয়ে যেতে লাগল। যেহেতু মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে শুধু রাইফেল ও কয়েকটি ২”-৪” মটার। তাই আধুনিক পাকবাহিনীর সাথে পাল্লা দেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিদিন মুক্তি সেনারা পিছিয়ে আসায় বিকল্প প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলার কথা চিন্তা করতে হলো রামগড় নেতৃবৃন্দ ও সামরিক অফিসারদের শুরু হলো হরিণা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের কাজ।

এদিকে কালুর ঘাটের প্রতিরোধ ব্যর্থ হওয়ায় রাঙ্গামাটি, মহালছড়ি, হয়ে মেজর মীর শওকত (বর্তমানে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক মন্ত্রী) ক্যাপ্টেন মাহফুজ, ক্যাপ্টেন মারী, ক্যাপ্টেন কাদের এবং কয়েকজন সুবেদার ও বেশ কিছু সৈন্য নিয়ে ২৪শে এপ্রিল মহালছড়িতে ঘাঁটি স্থাপন করে খাগড়াছড়িতে এসে পৌঁছান।

অপরদিকে পাক বাহিনী রাঙ্গামাটি শহর দখল করার পর ২০ শে এপ্রিল বুড়িঘাট নানিয়াচর হয়ে মূল প্রতিরক্ষা কেন্দ্র মহালছড়ির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে ৮ম ইষ্ট বেঙ্গল এর সাথে তৎকালীন ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর কিছু সৈনিক পার্বত্য চট্টগ্রাম হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিল। শহীদ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ ছিলেন কোম্পানীর মেশিন গানার। ১৯৭১ এর ২০ শে এপ্রিল তারিখে শত্রু পক্ষের ২য় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের পক্ষে ১টি কোম্পানী ৬” ইঞ্চি মটার নিয়ে ৩টি লঞ্চ ও ২টি স্পীড বোর্ড বোঝাই করে প্রতিরক্ষা এলাকায় ঢুকে পড়ে।

মুক্তিবাহিনীকে দেখা মাত্রই শত্রু সৈন্যরা ৬” ইঞ্চি মর্টার ও অন্যান্য গোলা বর্ষণ শুরু করলে বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। একমাত্র ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ তার নিজের অবস্থানে থেকে নিজের মেশিন গান দিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে পাকিস্তানী বাহিনীর উপর গোলা বর্ষণ অব্যাহত রাখেন। যার ফলে শত্রুর ২টি লক্ষ্য ও ১টি স্পীড বোট পানিতে ডুবে যায় এবং ২ (দুই) প্লাটন শত্রু সৈন্য ধ্বংস হয়। অক্ষত নৌযান গুলোতে অবশিষ্ট শত্রু সৈন্যরা পশ্চাদপস্বরন করতে বাধ্য হয়। শত্রু প্রবল গোলা বর্ষনের মুখেও ল্যান্স নায়েক আব্দুর রউফ তার মেশিন গান নিয়ে নিজের অবস্থানে স্থির ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ বিপক্ষের মর্টারের গোলা তার কাঁধে আঘাত করলে তিনি মাটিতে লুটে পড়েন। তিনি শাহাদাৎ বরণ করেন। শহীদ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ এর অসীম বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগের ফলে শত্রু বাহিনী সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ঘাঁটি মহালছড়িতে আর আঘাত হানতে পারেনি। স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর শ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুুুুুুুুুুুুুুুুর রউফ ১৯৪৩ সালে মে মাসে ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী থানার সালামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মুন্সী মেহেদী হোসেন। ১৯৬৩ সালের ৮ই মে তিনি তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্ বাহিনীতে সৈনিক হিসাবে যোগদান করেন।

২৫ শে এপ্রিল মেজর মীর শওকত সাহেব খাগড়াছড়িতে একরাত কাটিয়ে পরের দিন ২৬ শে এপ্রিল মেজর জিয়াসহ সৈন্যদের সংগঠিত করে মেজর মীর শওকত মহালছড়িতে চলে যান মেজর জিয়া রামগড়ের দিকে চলে যান, প্রতিরোধ ব্যুহ রচনা করতে ২৭ শে এপ্রিল পাকবাহিনী রাঙ্গামাটি থেকে মহালছড়ি অভিমুখে অগ্রসর হয়। ঐ দিন সম্মুখ যোদ্ধে ক্যাপ্টেন কাদের অসীম বীরত্বের সহিত যুদ্ধ করেন। এক সময় বর্তমান মহালছড়ি থানার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সামনে কবর স্থানের ডান পার্শ্বে বট বৃক্ষের নিচে তিনি গুলি বিদ্ধ হন। গুরুতর আহত অবস্থায় মেজর মীর শওকতের নির্দেশে তাঁকে রামগড় পাঠানো হয়। রামগড় নেওয়ার পথে তিনি জালিয়া পাড়া নামক স্থানে শাহাদাৎ বরন করেন। সম্পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় তাঁকে রামগড়ে দাফন করা হয়। শহীদ ক্যাপ্টেন কাদেরকে কবর দেওয়ার সময় দেখা গেল তাঁর হাতে বিয়ের মেহেদী রং জ্বল জ্বল করছে। তিনি সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে রেখে যান।

২৭ শে এপ্রিল মহালছড়ি পতনের পর পাকবাহিনী ঐ দিন খাগড়াছড়ি দখল করে এর পূর্বে ২৬ শে এপ্রিল আমি ও নুর বক্স মিঞা লঙ্গর থানার আর্থিক অবস্থা সর্ম্পকে ডিসি সাহেবের সাথে পরামর্শের জন্য রামগড় যাই। ২৯ শে এপ্রিল ফেরার পথে জালিয়া পাড়ার মেজর মীর শওকতের সঙ্গে সাক্ষাত হলে তিনি আমাকে ও নুর বক্স মিঞাকে খাগড়াছড়ি প্রতাবর্তনে নিষেধ করেন। তাই আমরা পূর্ণরায় রামগড়ে ফিরে যাই। পাক হানাদার বাহিনী ধরে নিয়েছে রামগড় সীমান্তবর্তী থানা, কাজেই তার পতন ঘটিয়ে তাদের দখলে নেওয়া প্রয়োজন। সুতরাং রামগড়কে উদ্দেশ্য করে তিন দিক থেকে আক্রমন শুরু করে মহালছড়িতে কাদের শহীদ হওয়ার পর আমাদের বাহিনী টিকতে না পেরে ২৯ তারিখে জালিয়া পাড়া ৩০ শে এপ্রিল রামগড় পিছু হঠতে বাধ্য হয়। অপর দিকে দেখা গেলো পাক হানাদারদের একটি দল করেরহাটে হেঁয়াকো রামগড়ের দিকে অগ্রসর হইতেছে। মেজর সামছু উদ্দিন, সুবেদার ফারুক উদ্দিন প্রমুখের মরণ পন চেষ্টাতেও ডিফেন্স রক্ষা করতে না পারায় রামগড়ের দিকে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। অপর দল ক্যাপ্টেন অলির নেতৃত্বে চট্টগ্রাম দিক থেকে আগত দল হিঙ্গুলী কারেনহাট তুলাতলি অবস্থান ছেড়ে হেঁয়াকোতে অবস্থান নিল। লেঃ হিজাজোত হেঁয়াকোতে ডিফেন্স নিলেন। সামরিক দিক দিয়ে হেঁয়াকো ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরবর্তী ধাপে মুক্তিযোদ্ধাদের সদর দপ্তর রামগড় আক্রমন করতে চেয়েছিল। ২৭ শে এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী ভারি অস্ত্রসস্ত্রের সাহায্যে তিন দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর আক্রমন চালায় মুক্তিযোদ্ধারা হেঁয়াকো এলাকা টিকে থাকতে ব্যর্থ হলো। ২৮শে এপ্রিল আবার পাকহানাদার বাহিনী চিকনছড়া ছেড়ে বাগানবাড়ী নামক স্থানে অবস্থান নেয়। ১লা মে চিকনছড়া ও নারায়নহাট থেকে পাক বাহিনীর আক্রমনের ফলে বাগান বাড়ী ছেড়ে মুক্তিযোদ্ধারা রামগড়ের দিকে পিছু হঠতে বাধ্য হয়।

৩০শে এপ্রিল তারিখে সর্বাধিনায়ক কর্ণেল মরহুম এম.এ.জি ওসমানী রামগড়ে আসেন। কর্ণেল ওসমানী দুই দিন রামগড়কে নিজেদের নিয়ন্ত্রনে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতে বললেন। মেজর জিয়া ও মেজর শওকত, ক্যাপ্টেন রফিক, ক্যাপ্টেন অলী, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান, ক্যাপ্টেন ভূঞা, লেঃ মাহফুজ প্রমুখ অফিসার রামগড়কে নিজেদের নিয়ন্ত্রনে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করতে লাগলেন। ১লা মে থেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বিগ্রেড তিন দিক থেকে রামগড়কে আক্রমন করে। ২রা মে’র সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলে। মুক্তিযোদ্ধারা অবশেষে ঐ তারিখ রাতেই ভারতের সাবরুমে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলো। সমস্ত চট্টগ্রাম এলাকা পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রনে চলে গেল। পতন ঘটলো রামগড়, খাগড়াছড়ি তথা চট্টগ্রামের।

৩০ শে এপ্রিল তারিখে সর্বাধিনায়ক কর্ণেল মরহুম এম.এ.জি ওসমানী আসার পর রামগড় থানায় আমি, সুলতান মিঞা, নুর বক্স মিঞা এবং আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের সাথে পরিচয় এবং আলোচনার মাধ্যমে পরামর্শ দেন যে, গেরিলা যুদ্ধ ব্যতিত আমাদের বিকল্প পথ নেই কাজেই গেরিলা যুদ্ধের জন প্রশিক্ষণ নিয়ে শত্রুর সাথে মোকাবেলা করতে হবে।

২রা মে পাকবাহিনী রামগড় আক্রমন করে। সকাল ৯টার দিকে মেজর জিয়াউর রহমান রামগড় ছেড়ে ভারতে চলে যান। রইলেন শুধু মেজর রফিকুল ইসলাম। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষার জন্য বেশ কয়েক রাউন্ড ৪” ইঞ্জি মটারের গোলা বর্ষন করেন। বেলা ৪ ঘটিকার সময় তিনি ও ভারতের দিকে পা বাড়ান। এক সময় শত্রুর প্রবল আক্রমনে টিকতে না পেরে আমরা পা বাড়ালাম সীমান্তের দিকে। সে সময় রামগড় বাজারে বহু ঘরের চালে আগুন জলছিল।

এইভাবে বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার অনেক এলাকা পাক বাহিনীর হাতে চলে যায়। শুধুমাত্র গুটিকয়েক এলাকায় তখনও আমরা আত্মগোপন করে ট্রেনিং সেন্টার চালু করি এবং নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখি। তার মধ্যে তবলছড়ি উল্লেখযোগ্য। তবলছড়ির বিপরীতে শিলাছড়ি নামক স্থানে আমাদের একটি নিয়মিত ক্যাম্প ছিল। ঔ ক্যাম্পের কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী (পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার ও বিআরটিসির সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন)। আমি খালেকুজ্জামান সাহেবের পরামর্শ ও সহযোগিতা নিয়ে তবলছড়ি মুক্ত এলাকায় একটি মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং সেন্টার চালু করার লক্ষ্যে তবলছড়ি চলে আসি। প্রায় দুইশত মুক্তিযোদ্ধার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আমিও নুর বক্স এবং মোবারক আলী মাষ্টারকে নিয়ে ট্রেনিং সেন্টার চালু করি। ১৬ই জুন তারিখে রাতে হঠাৎ হানাদার বাহিনীর আক্রমনে আমরা ট্রেনিং সেন্টার গুছিয়ে আবার শিলাছড়িতে ফিরে যাই। অতর্কিত প্রতিরোধে আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা সামান্য আহত হয়। আমার মাথার চুল ঘেষে একটি বুলেট চলে যায়, আর এক ইঞ্চি নিচ দিয়া গেলে মাথার খুলি উড়ে যেত। পরবর্তীতে সকল মুক্তিযোদ্ধাকে ১নং সেক্টরের হরিণা ক্যাম্পে পাঠিয়া দেই। সরকারি ভাবে ট্রেনিং নেওয়া শেষে তাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা যুদ্ধে প্রেরণ করি। এরই মাঝে বেশ কিছু গেরিলা যুদ্ধ সম্পন্ন হয় যা আমার এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ে আমাদের অবস্থান সুদৃঢ় ও সুনিশ্চিত করেছিল তার মধ্যে নিম্বের অপারেশ গুলো উল্লেখযোগ্য।

মানিকছড়ি ডাইনছড়ি অপারেশন
বর্তমান খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় অন্তর্গত মানিকছড়ি একটি থানা। ৭১ এর সেপ্টেম্বর মাসে মানিকছড়ি ডানছড়ি চেম্প্রু পাড়া এলাকায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ এফ.এফ. ফোর্স নং ৯১ ও ৯৪ এর গ্রুপ কমান্ডার যথাক্রমে হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা ও আলী আশরায় যৌথভাবে এক গেরিলা আক্রমন পরিচালনা করে।

ডাইনছড়ির গহিন অরণ্যে তখন মুক্তিবাহিনীর একটি গোপন ক্যাম্প ছিল। উক্ত ক্যাম্পে বাংলাদেশ এফএফ ফোর্স নং ৯১ ও ৯৪ এর প্রায় ৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। হঠ্যাৎ একদিন দুপুর বেলা এক ইনফরমার এসে সংবাদ দিল যে, বাটনাতলী উপজাতীয় গ্রামে পাকবাহিনীর প্রবেশ করছে এবং সেখানে খাবারের আয়োজন করেছে। হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা কাল বিলম্ব না করে ১২ জনের এক দুর্ধর্ষ গেরিলা দল বাছাই করে নিলেন। আক্রমনের পরিকল্পনার করে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়লেন। সঙ্গে নিলেন একটি এসএমজি, ২টি এলএমজি ও ৯টি এসএলআর বেশ কিছু হ্যান্ড গ্রেনেড ও গুলি। ডাইনছড়ি ও বাটনাতলী পাশা পাশি এলাকা। গোপন ক্যাম্প থেকে তারা বেরিয়ে এসে জঙ্গলাকীর্ণ প্রায় ৩ কিঃ মিঃ পথ অতিক্রম করে ডাইনছড়ির চেম্প্রু এলাকায় একটি টিলাতে এসে তারা অবস্থান গড়ল। উক্ত টিলাটি বেশ বড় এবং পূর্ব পশ্চিমে লম্বালম্বি। সেখান থেকে প্রায় ১.৫ কিঃ মিঃ দুরে পাকবাহিনীর একটি উপজাতীয় মারমা গ্রামে অবস্থান নিয়ে ছিল। পাক বাহিনীর অবস্থান থেকে উক্ত টিলার পাশ দিয়ে একটি পায়ে হাঁটার জঙলী পথ মানিকছড়ি থানা ও মংরাজার রাজবাড়ী পর্যন্ত চলে গেছে। হেমদা ও আশরাফ গ্রæপের বদ্ধমূল ধারনা ছিল পাকবাহিনীরা এই জঙ্গলের পথ ধরে মানিকছড়ি রাজবাড়িতে যাইতে পারে। তখন মানিকছড়ি পাক বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। ডাইনছড়ি চেম্প্রু পাড়া এলাকার উক্ত টিলাটে ১০ জন পজিশনে রেখে হেমদা রঞ্জন ২ জন যোদ্ধা সহ পাক বাহিনীর অবস্থান রেকী করার জন্য উক্ত মারমা গ্রামে গেল। শত্রু হতে ২০০ গজ ব্যবধান থেকে চিন্তা করল যে এখানে আক্রমন করলে গ্রাম বাসিরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই সিদ্ধান্ত নিল শত্রু ফেরার পথে ডাইনছড়ির টিলাতে যেখানে সাথীদের পজিশনে রেখে এসেছে সেখানে আক্রমন করবে। রেকী শেষে হেমদা, আলী আশরাফ ও সহযোদ্ধারা দ্রুত ক্রুলিং করে ধান ক্ষেতের ভিতর দিয়ে উক্ত টিলার পাদদেশ একটি বিরাট উচুঁ গাছের আড়ালে অবস্থান নিল। টিলার উপরে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধারা লক্ষ রাখছিল হেমদা ও তার দুই সহযোগী যোদ্ধার উপর। অল্প সময় অপেক্ষা করে তারা দেখল পাকবাহিনীর ৫০/৬০ জনের একটি বড় দল তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। শত্রু সেনারা প্রায় ৫০ গজের রেঞ্জের মধ্যে আসতেই হেমদা রঞ্জন, আলী আশরাফ ও তার সাথীদের অস্ত্র একসাথে গজে উঠল হঠাৎ আক্রমনে ও অনবরত গুলি বর্ষণে পাকবাহিনী বেকায়দায় পড়ে যায়।

পাকসেনাদের কমান্ডার ক্যাপ্টেন ছিল একটি ঘোড়ায় চড়া। তাদের অস্ত্র ছিল মর্টার, এল.এম.জি এবং অটো চাইনিজ রাইফেল। প্রথম ব্রাশ ফ্রায়ারের সাথে ঘোড়ায় চড়া ক্যাপ্টেন গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। সেই সাথে অনেক গুলিবিদ্ধ হয়ে আত্মচিৎকার করতে লাগল। পরিষ্কার বুঝা গেল প্রথম ফায়ার ওপেনিং এ আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের দারুন কাজ হয়েছে। পাকবাহিনীরা মরিয়া হয়ে মুক্তিসেনাদের দিকে এলোপাতাড়ি গুলি বর্ষণ ও মর্টার গোলা বর্ষণ করতে লাগল। প্রায় আধা ঘন্টা যাবত পাহাড়ের পাদদেশ এবং পাহাড়ের উপর থেকে পাকবাহিনীর উপর গুলি বর্ষণ প্রায় ১২জন পাকসেনা খতম করে মুক্তিসেনাদের এমুনিশন প্রায় শেষ হওয়ার পূর্বেই সেই স্থান ত্যাগ করে মুক্তিবাহিনী নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। অত:পর পাকবাহিনী রেগে ও রোষে মুক্তিবাহিনীর উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পরক্ষণই সংলগ্ন গ্রাম খানি আগুনে জ্বালিয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে। সেখানে প্রায় ১০০টি মারমা পরিবার বসবাস করত।

যোগ্যাছলা অপারেশন
বর্তমান খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মানিকছড়ি থানার অর্ন্তগত যোগ্যাছলা এলাকাটি পাক আমলে একটি বিদেশী কোম্পানীর অধীনে তৈল প্রাপ্তির সম্ভাবনার খনন কার্য চলছিল। এই জন্য এলাকাটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসাবে বিবেচিত ছিল। অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে যোগ্যাছলা এলাকাতে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ এম.এফ.ফোর্স নং- ৯১ এর কমান্ডার হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা একটি সম্পূর্ণ যুদ্ধ পরিচালনা করে। এলাকাটি ছিল মুক্তিবাহিনীর গুপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র গুলির মধ্যে একটি। তখন এই কেন্দ্র হেমদা রঞ্জনের অধীনে প্রায় ৬০জন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। আশ্রয় কেন্দ্রটি ছিল টিলার উপর। টিলার বাম পার্শ্বে এবং সামনে ছিল বিস্তৃত ধানের ক্ষেত ও ডান পার্শ্বে পাহাড়। অদুরে গ্রাম, গাড়ী চলাচলের রাস্তা নেই। পায়ে হাঁটার পথ বিদ্যমান সেদিন সকাল বেলা তার (হেমদা রঞ্জনের) ইনফরমার এসে খবর দিল যে প্রায় ৫০/৬০ জনের একটি বিরাট পাকবাহিনীর দল তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। সংবাদ পাওয়া মাত্রই গ্রুপ কমান্ডার সঙ্গীদের নিজ নিজ অস্ত্র নিয়ে পজিশন নিতে নির্দেশ দেয়। মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ছিল লাইট মেশিনগান, এসএমজি, এসএসআর, রাইফেল এবং হ্যান্ড গ্রেনেড।

মুক্তিবাহিনীরা পজিশন নেয়ার প্রায় ১০ মিনিটের এর মধ্যেই শত্রু পক্ষ তাদের রেঞ্জের আওতায় এসে পড়ে। টিলা থেকে সবটা দেখা যাচ্ছিল। শত্রু পক্ষ লম্বা লাইন ধরে মুক্তি সেনাদের দিকে এগিয়ে আসছে। সাথে সাথে কমান্ডার হেমদা রঞ্জন ফায়ার এর নির্দেশ দেয়। মুক্তি সেনাদের সব কয়টি অস্ত্র এক সঙ্গে গর্জে উঠল। পাক বাহিনী এর পাল্টা জবাব দেয় এবং মর্টারের গোলা বর্ষণ শুরু করে। বেশ কয়েকটি গোলা বারুদ আমাদের মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের পার্শ্বে এবং টিলার পাদদেশে এসে বিস্ফোরিত হয়। প্রায় ২০ মিনিট যাবত গোলাগুলি বিনিময়ের পর শত্রু পক্ষ পিছু হঠে পালিয়ে যায়। মুক্তি সেনারা কয়েকজন যোদ্ধা গুলিবর্ষণ করতে করতে কিছুদূর অগ্রসর হয়। সেদিন মুক্তিযোদ্ধা ৯জন পাক সেনাকে ঘায়েল করে। এই অপারেশনে মুক্তিবাহিনীর কোন যোদ্ধা হতাহত হয় নাই।

গুমতির কালাপানিয়া অপারেশন
বর্তমানে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মাটিরাঙ্গা থানার গুমতি ইউনিয়নের একটি গ্রাম কালা পানিয়া। অক্টোবর এর মাঝামাঝি সময়ে পাক সেনা এবং রাজাকার এর আগমন সংবাদ পেয়ে বাংলাদেশ এফএফ ফোর্স নং- ৯৪ এর গ্রুপ কমান্ডার আশরাফ দল নিয়ে বাঁধা প্রদান করতে তবলছড়ি হতে কালা পানিয়ার ছুটে যায়। তাদের সাথে পাকসেনাদের কালা পানিয়ায় সংঘর্ষ বাঁধে। সাথে সাথে নিয়মিত বাহিনীর বি.ডি.আর এর নায়েক সুবেদার খায়েরুজ্জামান কিছু সৈন্য নিয়ে আশরাফ গ্রুপকে সাহায্যের জন্য অগ্রসর হয়। পিছন থেকে বিএসএফ এর একটি আর্টিলারী গ্রুপ মর্টার দিয়ে সাহায্যা করে। ফলে পাকহানাদার বাহিনীরা পিছু হঠতে বাধ্য হয়। গুমতি ইউনিয়নে মুক্তি বাহিনীরা নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখে।

দেওয়ান বাজার অপারেশন
বর্তমান খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মাটিরাঙ্গা থানার বাংলাদেশ সীমান্তে দেওয়ান বাজার বিওপির বিপরীতে ঘোড়া কাফকায় আমাদের মিত্র বাহিনীর বিএসএফ ফাঁড়ি পাক হানাদার কর্তৃক আক্রান্ত হয়। তখন সম্ভবত ৭১ এর অক্টোবর মাস। তবলছড়ি হইতে আমি ও মোবারক আলী মাস্টারসহ নিয়মিত বাহিনীর কিছু সৈন্য নিয়ে বিএসএফ এর সাহায্যার্থে ঘোড়া কাফকায় যাই। আনুমানিক রাত ১০ টা হতে ১২ টা পর্যন্ত গুলাগুলি বিনিময় হয়। আমাদের প্রবল আক্রমনের মুখে টিকতে না পেরে পাক হানাদাররা পিছু হঠতে বাধ্য হয়। এতে বিডিআর এর একজন সৈনিক সামান্য আহত হয় এবং বিএসএফ এর একজন সৈনিক সীমান্তের ফেনী নদীতে পড়ে গেলে সাঁতার না জানায় মৃত্যু হয়।

রামগড় মহামুনি পাড়া অপারেশন
৭১ এর অক্টোবর এর মাঝামাঝি সময়ে ক্যাপ্টেন মাহফুজের নেতৃত্বে মহামুনি এলাকা এর সফল গেরিলা অপারেশনে ১ জন কর্ণেল সহ ১৭ জন পাক সেনাকে খতম করে। এই অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধারা মর্টার ব্যবহার করে। এই যুদ্ধে হেমদা রঞ্জন গ্রুপের রামগড়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা রনজিৎ ত্রিপুরা ও ব্রজেন ত্রিপুরা প্রমুখ অংশ গ্রহণ করে।

রামশিরা অপারেশন
বর্তমান খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মাটিরাঙ্গার থানার গুমতি ইউনিয়নের রামশিরা নামক স্থানে উপজাতীয় এলাকা পাক বাহিনী ও কিছু উপজাতীয় চাকমা রাজাকার অবস্থান নিয়েছিল। সংবাদ পেয়ে তবলছড়ি মুুক্তিযোদ্ধা হেডকোয়াটার হইতে নায়েক সুবেদার খায়েরুজ্জামান ও এফএফ গ্রুপ কমান্ডার আলী আশরাফের নেতৃত্বে ৪০/৪৫ জনের একটি দলের রামশিরার পৌছাইয়া উল্লেখিত এলাকা সন্ধ্যা হইতে ঘিরে রাখা হয়। শেষ রাত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের তরফ থেকে প্রথম গুলি বর্ষণ করিলে পাকহানাদার বাহিনী ও রাজাকার পাল্টা জবাব দেয়। প্রায় দুই ঘন্টা যাবত পাকবাহিনী ও রাজাকারের সাথে গুলাগুলি হয়। মুুক্তিযোদ্ধাদের গ্রাউন্ডে গুলি বষর্ণের পাক হানাদার বাহিনী টিকতে না পেরে পিছু হঠতে থাকে তারা গুমতি খেদাছড়া হইয়া পালায়ন করে। পাক বাহিনীর চলা চলের জন্য যে রাস্তাটি করা হয় খেদাছড়া হইতে গুমতি পর্যন্ত তার নাম এখন ও পাঞ্জাবী রোড হিসাবে পরিচিত।

পাতাছড়া অপারেশন
বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় থানার পাতাছড়া ইউনিয়নের কালাপানি নামক স্থান পাকবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। মংশোয়ে অং (জুলুবাবু) ও হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা এবং আলী আশরাফ, তিন গ্রুপ কমান্ডার যৌথভাবে মিলিত হইয়া ৯০/৯৫ জনের বাহিনী নিয়ে তিন দিক থেকে আক্রমন করে, প্রায় দেড় থেকে দুই ঘন্টা যাবৎ গোলাগুলির পর তাহারা পিছু হঠে ক্যাম্প ছেড়ে মানিকছড়ি দিকে পালাইয়া যায়।

ভাইবোনছড়া অপারেশন
ভাইবোনছড়া বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার সদর থানার একটি ইউনিয়ন নভেম্বর দিকে (তখন রোজা) আলী আশরাফ গ্রুপ ও নিয়মিত বাহিনীর নায়েক সুবেদার খায়েরুজ্জামান সীমানা এলাকা তবলছড়ি হতে ভাইবোনছড়া যায়। তারা বেশ কিছু মুক্তি সেনা নিয়ে প্রায় ১২ মাইল পাহাড়ী পথ অতিক্রম করে এসে চেঙ্গী নদীর পশ্চিম তীরে ওত পেতে থাকে। নদীর পূর্ব তীরে খাগড়াছড়ি হতে পানছড়ি একটি সড়ক পথ বিদ্যমান। তাদের ধারনা ছিল এই পথে পাকসেনারা খাগড়াছড়ি হতে পানছড়ি সৈন্য ও রসদ নিয়ে যাবে। পশ্চিম তীরে আমাদের মুক্তিসেনারা অপেক্ষা করতে লাগল। এক সময় দেখা গেল পাক সেনাদের একটি বড় দল এই পথ ধরে আসছে। এবার অপেক্ষা পালা শেষ। শত্রু সেনারা আমাদের মুক্তিবাহিনীর রেঞ্জের আওতায় আসা মাত্রই গ্রুপ লিডার আলী আশরাফ ও খায়েরুজ্জামানের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধারা গুলিবর্ষণ শুরু করে। সাথে সাথে পাকহানাদাররাও গুলি চালাইতে থাকে। বেশ কিছু সময় গুলি বিনিময়ে অবস্খা প্রতিকূলে দেখে পাকহানাদাররা পালিয়ে যায়, এতে কেউ হতাহত হয়নি। এই ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে ভাইবোনছড়া ও তবলছড়ির মধ্যবর্তী জায়গা কমলা বাগান নামক স্থানে দশজন রাজাকার আমাদের হাতে আত্মসমর্পন করে। তাদেরকে ১নং সেক্টরের হরিণা হয়ে আগরতলা প্রেরণ করি।

রামগড় বিজয়
৭১ এর ৬ এবং ৭ই ডিসেম্বর রামগড় পাকবাহিনীর উপর আমাদের মুক্তি বাহিনীরা স্থল ও বিমান আক্রমন করে। আমাদের আক্রমনে পাকবাহিনী রামগড় হেডকোয়ার্টার ছেড়ে পালিয়ে যায়। ৮ই ডিসেম্বর আমাদের আক্রমনে পাকবাহিনী রামগড় হেডকোয়ার্টার ছেড়ে পালিয়ে যায়। ৮ই ডিসেম্বর বিকালে পার্বত্য চট্টগ্রামের রামগড়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হয়।

তবলছড়ি ও ভাইবোনছড়া বিজয়
মুক্তিযুদ্ধের শেষে দিকে ১নং সেক্টরে গিয়ে ৭১ এর ২৪ শে নভেম্বর পর্যন্ত বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। প্রশিক্ষণ শেষে আমি এম.এফ. সাব ডিভিশন কমান্ডার ও সাব এড মিনিস্ট্রেটর হিসাবে নিয়োগ প্রাপ্ত হই। ৮ই ডিসেম্বর তারিখে সেক্টর হেড কোয়াটার আমার প্রেরিত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সকল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটি ট্রাক হরিণা হইতে তবলছড়ি চলে আসি। সেখানে ক্যাপ্টেন অশোক দাস গুপ্ত ওরফে বাবুল চৌধুরীর সাথে সাক্ষাত করি। পূর্বে নিয়মিত বাহিনীর ও আমার এফ এফ মুক্তিযোদ্ধাদের যৌথভাবে তবলছড়ি হইতে পানছড়ি হয়ে ভাইবোনছড়া পর্যন্ত মুক্ত করি।

গাছবান অপারেশন ও খাগড়াছড়ি মুক্তকরণ
৭১ এর ১৪ ডিসেম্বর। বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলা সদর থানার একটি ইউনিয়ন ভাইবোনছড়া, ক্যাপ্টেন অশোক দাস গুপ্ত ও আমি একটি প্রতিরক্ষা ঘাটি ভাইবোনছড়াতে রেখে প্রায় ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা ফাইটিং পেট্রোল পটিয়ে খাগড়াছড়ির দিকে অগ্রসর হই। কুকিছড়া পার হয়ে গাছবান (খাগড়াছড়িতে ও ভাইবোনছড়ার প্রায় মাঝামাঝি জায়গা) সেতুতে আমার প্রথম দল পা রাখার সাথে সাথেই বাম দিকে পাহাড় থেকে পাকবাহিনীর দোসর ও মিজোরা গুলি বর্ষণ করতে থাকে, আমাদের মুক্তি সেনারাও সাথে সাথে পাল্টা জবাব দেয়। শেষ পর্যন্ত আমাদের গুলির মুখে টিকতে না পেরে মিজোরা পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যায়। ১৫ই ডিসেম্বর ভাইবোনছড়া হইতে খাগড়াছড়ি পর্যন্ত মুক্ত করি। ঐ দিনেই সব ডিভিশন কমান্ডার হিসাবে আমি মহকুমা শহর খাগড়াছড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করি। সেই থেকে অদ্যাবধি ১৫ই ডিসেম্বর খাগড়াছড়ি জেলা সদরে হানাদার মুক্ত দিবস পালন করা হয়। ঐ সময় নিয়মিত সেনাবাহিনীর অধিনায়ক ক্যাপ্টেন অশোক দাস গুপ্ত (বাবুল চৌধুরী) তৎকালীন ইপিআর বর্তমান বিডিআর বাহিনীর নায়েক সুবেদার খায়েরুজ্জামান, পুলিশের হাবিলদার আহম্মদ উল্লাহ, এফএফ এর যে কয়েকজন গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন, যথাক্রমে মোঃ আলী আশরাফ, মোঃ মোবারাক আলী, মোঃ নুরুন্নবী, সুবোধ বিকাশ ত্রিপুরা, মংশোয়ে অং (জুলু বাবু) এবং আমি মহকুমা কমান্ডার হিসাবে ছিলাম।

১৫ইং ডিসেম্বর সকাল ১১টায় মহকুমা সদরে পতাকা উত্তোলনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত করে থানা হেড কোয়াটারগুলোতে পাঠিয়ে দেই। ঐ দিনেই থানা সদর গুলো শত্রু মুক্ত ৭১ এর ১৬ইং ডিসেম্বর দিঘীনালায়। (বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার একটি থানা শহর) মিজোরা হঠাৎ বিদ্রোহ করে ও জনগণের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। তখন আমি আমার সহকর্মী মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর উকিল আহম্মদকে দলের প্রধান করে বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা সেখানে প্রেরণ করি। তাদের সাথে মিজোদের তুমুল সংঘর্ষ হয়। উক্ত সংঘর্ষে প্রায় ৩০০ জন মিজো ও রাজাকার নিহত হয় এবং আমাদের মুক্তিসেনারা বিজয়ীর বেঁশে খাগড়াছড়ি ফিরে আসে। খাগড়াছড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চাঁদের গাড়ীর ভূমিকা ছিল অন্যান্য। বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার ন্যায় আমাদের খাগড়াছড়ির মুক্তিযোদ্ধাগণও অসীম সাহসী ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

লেখক: আলহাজ্ব দোস্ত মোহাম্মদ চৌধুরী, যুদ্ধকালীন মহকুমা কমান্ডার, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা।