(এটি একটি কাল্পনিক গল্প। আসুন সকলে সচেতন হই)। ইতালি থেকে দেশে ফিরলেন ইসমাইল। এয়ারপোর্ট থেকে ইসমাইলকে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বললেন এবং হাতে একটা সিল মেরে দিলেন। ইসমাইলও হাসি মুখে জানালেন,‘এর কোন ব্যতয় ঘটবে না জনাব! আমি বাড়ি গিয়েই নিজেকে ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলবো! ইসমাইল গতরাতে গ্রামের বাড়ি এসেছে। এসেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমিয়ে পড়ার আগে রাতে বাবা মাকে ডেকে ইসমাইল বললেন,‘ তোমরা আমার কাছে আসবেনা! একটু দূরে দূরে থাকবে!’ ইসমাইলের বাবা মার কপালে চিন্তার ভাজ। ইসমাইলের বাবা ছেলের এই আচরণ পছন্দ করলেন না। রাতে পান খেতে ইসমাইলের মাকে তিনি বলেই ফেললেন,‘পাঠাও, আরো পাঠাও তোমার ছেলেকে দূর দেশে! দূর দেশে থাকতে থাকতে আদব কায়দা সব ভুলে গেছে!’
ইসমাইলের মা বললেন,‘কী করলো আমার ছেলে?’
ইসমাইলের বাবা গজগজ করতে করতে বললেন,‘এতদিন পর আসলো ছেলেটা! বাবাকে একটা কদমবুসিও করলো না! বেয়াদব কোথাকার!আবার বলে কি না দূরে দূরে থাকতে!’
ইসমাইলের মা কিছু বললেন না। মনে মনে ভাবলেন, আসলেই তো। বিদেশে গেলেই কী এভাবে আদব কায়দা সব ভুলে যেতে হবে! সকালে ছেলেকে বলে ওর বাবাকে কদমবুসি করাতে হবে!
এ কেমন জাতি আমরা? আসুন সকলে সচেতন হই
|
ইসমাইলের বাবা খুশি হয়ে গেলেন। গতরাতে ছেলের বেয়াদবি তিনি ক্ষমা করে দিলেন। ছেলে যে এত বড় একটা অর্জন করেছে তা তো তিনি জানতেনই না। ইসমাইলের মাও কিছু বলেনি তাকে! অবশ্য সে বেকুব টাইপের মহিলা! এই অর্জনের সে কী বুঝবে!’
এ কেমন জাতি আমরা? আসুন সকলে সচেতন হই |
ইসমাইল ভয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। এসব কী হচ্ছে। এরা কী সব পাগল হয়ে গেছে।
ভিড় আরো বাড়ছে। ইসমাইলের বাবা নতুন পাঞ্জাবি পড়ে সেই ভিড়ের মধ্যে ছুটাছুটি করছেন। এমন সময় ইসমাইলের মা তাকে ডেকে বললেন, ‘ছেলে যে আমার এত বড় সম্মান নিয়ে এলো, এত মানুষ আসছে দেখতে। তাদের তো আপ্যায়ন করা লাগে!’
ইসমাইলের বাবা জিভ কেটে বললেন, ‘ঠিক বলেছো ইসমাইলের মা! আমি এখনি বাজারে যাচ্ছি। পরিতোষের দোকানের রসগোল্লা নিয়ে আসছি! সবাইকে আজ মিষ্টি মুখ করাবো!’
এ কেমন জাতি আমরা? আসুন সকলে সচেতন হই |
ইসমাইলের মা তার ভাইকে বোঝাচ্ছেন,‘মন খারাপ করিস না বটু! তোকে অবশ্যই জানাতাম! গতরাতেই তো ও এলো!’
ইসমাইলের মামা এবার তার দুলাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘গরু জবাই করেন দুলাভাই! শুধু রসগোল্লায় হবে না! ভাগ্নের এই অর্জন আমাদের খুব বড় করে সেলিব্রেট করা দরকার!’
ইসমাইলের বাবা তার ছোট শ্যালকের কথায় খুশি হয়ে বললেন, ‘ঠিক বলেছো তুমি! আসলে আমিও তাই ভাবছিলাম!’
এ কেমন জাতি আমরা? আসুন সকলে সচেতন হই |
গ্রামের ডেকোরেটর ব্যবসায়ী ছদরুল বিনা খরচে ইসমাইলদের উঠানে প্যান্ডেল টানায় দিয়ে গেল! পাঁচশ চেয়ারও দিয়ে গেল! ইসমাইলের বাবা টাকা নেয়ার জন্য অনেক করে বললেন,‘ টাকা নাও! এটা তোমার ব্যবসা!’
ছদরুল জিভ কেটে বললেন,‘কি বলেন চাচা! ইসমাইল ভাই আমাদের গ্রামের গর্ব! ধইরা নেন তার হোম কোয়ারেন্টাইন হওয়ার লাইগা এইটা আমার একটা ছোট্ট উপহার!’
ওদিকে সারা গ্রাম জুড়ে শুধু ইসমাইলের কথা। গ্রামের চায়ের দোকানে উচ্চ শিক্ষিত কিছু পোলাপান তর্ক জুড়ে দিয়েছে, আসলে কথাটা হবে হোম কোয়ারেন্টিন! হোম কোয়ারেন্টাইন না!
আরেক দল সাথে সাথে প্রতিবাদ করে বলছে,‘হোম কোয়ারেন্টাইনই হবে!’
তুমুল বিতর্ক শুরু হলো। এর মধ্যে একজন বললো, ‘চল ইসমাইল ভাইকে জিজ্ঞেস করে আসি। ওনিই ভালো বলতে পারবে।’
ওরাও সবাই মিলে ইসমাইলদের বাসায় চলে আসলো।
এ কেমন জাতি আমরা? আসুন সকলে সচেতন হই |
ইসমাইল এখনো ঘরের জানালা দরজা সব বন্ধ করে বসে আছেন। গ্রামের মুরুব্বিরা সব বসে আছেন। এক মুরুব্বি আর থাকতে না পেরে বলেই ফেললেন, ‘ছেলে একটু বেয়াদব আছে! আমরা এত এত মুরুব্বি কতক্ষণ ধরে বসে আছি আর সে বেরই হচ্ছে না! কই আমাদের সাথে দেখা করবো! কোলাকুলি করবে! কদমবুসি করে দোয়া নিবে তা না!’
আরেক মুরুব্বি আবার এই কথাকে সমর্থন জানালো-‘ঠিকই বলছেন! বিদেশ গেলে পোলাপাইন বদ হইয়া যায়!’
দুপুরবেলার একটু আগে ইসমাইল আর থাকতে না পেরে একটা মাস্ক পরে ঘর থেকে বের হয়ে এলো। তার টাট্টিঘরে যাওয়া দরকার! ঘটনা খুব জরুরি!
ইসমাইল বের হতেই সবাই তাকে ঘিরে ধরলো। জনতা সব হৈ হৈ করে উঠলো-এই বের হয়েছে, বের হয়েছে!’
কিন্তু ইসমাইলের মুখে মাস্ক দেখে সবাই একটু চুপসে গেল! গ্রামের স্কুল শিক্ষক ইসমাইলের বাপকে বললেন,‘ও ইদ্রিস ভাই, তোমার পোলা গরুর লাহান মুখে জোয়াল পড়ছে ক্যান?’
ইসমাইলের বাবা চিন্তিত হয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। এবার ইসমাইলেদের প্রতিবেশী, এলাকার বিবিসি সংবাদ হিসেবে পরিচিত ফরিদের মা বলে উঠলেন,‘বুঝেন নাই ভাইসাহেব! বৈদেশ গিয়া আপনার পোলার যাতে পাতে মুখ দেয়ার স্বভাব হইছে! তাই এইসব লাগায় ঘুরতেছে! আমার ফরিদ জীবনেও এইসব পরে নাই! সে ভালা পোলা! ধর্ম! কম্ম করে!’
এদিকে গ্রামের চেয়ারম্যান সাহেব ছুটে এসে ইসমাইলের গলায় বিশাল এক ফুলের মালা পড়িয়ে দিলেন। তারপর কোলাকুলি করে বললেন,‘বিকালে স্কুল মাঠে চইলা আসবা বাজান! তোমাকে সংবর্ধনা দেয়া হবে।গঞ্জে লোক পাঠাইছি, তোমার জন্য গোল্ড মেডেল আনতে!’
ইসমাইল মাথা কাত করে জানালো সে আসবে।
ইসমাইলের ছোট মামা ছুটে এসে ইসমাইলকে জড়িয়ে ধরে বললো,‘আমি জানতাম ভাগ্নে! সেই ছোটবেলায় তোকে দেখেই আমি বুঝছিলাম বড় হয়ে তুই হোম কোয়ারেন্টাইন সম্মান অর্জন করবি!’
ভিড়ের মধ্যে ইসমাইলের চোখ গেল তার ছোটবেলার প্রেমিকা পাখির উপর! এই পাখি গত দুই বছর আগে তাকে ছ্যাকা দিয়ে এক সরকারি কেরানির সাথে উড়াল দিয়েছিলো! সেই পাখিও আজ ইসমাইলের কাছে এসে মিনমিন করে বললো,‘আমি ভুল করেছি ইসমাইল! তখন যদি জানতাম তুমি এতবড় সম্মান পাবা তাহলে আমি কখনোই তোমাকে ছেড়ে যেতাম না!’
ভিড়ের মধ্যে পাখি আবার হারিয়ে গেল। এবার সামনে এলো ইসমাইলের মা। তিনি ইসমাইলের হাতে নতুন লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি ধরিয়ে দিয়ে বললেন,‘বাড়ির ছাদে চল! সেখানে তোকে গোসল দেয়ার আয়োজন করা হইছে! বালা মসিবত দূর করার জন্য সোনা-রুপার পানির এন্তেজাম করা হইছে। এত এত মানুষ আসছে কে কখন বদ নজর দেয় তার ঠিক আছে!’
ইসমাইলের গোসল দেয়া হয়েছে। গোসলে হলুদ বাটাও ছিলো। মা খালারা সবাই ডলে ডলে ইসমাইলকে গোসল দিলো। ইসমাইল কী বলবে তা বুঝতে পারছে না! আজ কী তার বিয়ে নাকি? মা বাবা কী গোপনে তার জন্য কাউকে ঠিক করে রেখেছে। ইসমাইল বিরাট চিন্তার মধ্যে ডুবে গেল!
এদিকে উঠানে গ্রামের সবচেয়ে ধনী মানুষ চৌধুরি সাহেবের আগমন ঘটলো। তিনি ইসমাইলের বাবাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ এখন আমার একমাত্র মেয়ের সাথে আপনার ছেলের বিয়ে দিতে কোন আপত্তি নাই! গতমাসে আপনাদের ফিরিয়ে দেয়ার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন!’
ইসমাইলের বাবা হাসি মুখে চৌধুরি সাহেবকে জড়িয়ে ধরে বললেন,‘ক্ষমা চাওয়ার কী আছে! বুকে আসেন বেয়াই সাহেব!”
ইসমাইলের এই হোম কোয়ারেন্টাইন ও তার বাড়িতে জনসমাগমের এই খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। সেই খবরের গন্ধ শুঁকে শুঁকে ঢাকা থেকে বেশ কিছু টিভি সাংবাদিকও চলে আসলো। তারপর ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে মাস্ক লাগিয়ে জ্বালাময়ী নিউজ করা শুরু করলো, ‘এই গ্রামের এক যুবককে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার জন্য বলা হয়েছিলো। কিন্তু দেখুন তার বাড়ির কী অবস্থা! দেখে মনে হচ্ছে কোন বিয়ে বাড়ি! এভাবেই করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে যেতে পারে সারা গ্রামে! এমন দায়িত্বহীনতার জন্য আমরা সবাই বিপদে পড়বো! গ্রামের মানুষের এই মূর্খতার জন্য করোনা পরিস্থিতি দেশে মহামারি আকারে দেখা দিতে পারে! বকবক বাতেন, আনন্দপুর।
নিউজ শেষ। ক্যামেরা বন্ধ হতেই ইসমাইলের বাবা পরিতোষের রসগোল্লা নিয়ে সাংবাদিকদের বললেন, ‘আমাদের গ্রামের সেরা রসগোল্লা! পরিতোষের দোকানের! একটু খেয়ে দেখেন!’
সব সাংবাদিক রসগোল্লা দেখে দ্রুত তাদের মুখের মাস্ক খুলে ফেললেন! তারপর গপাগপ সাটাতে থাকলেন! গ্রামের চেয়ারম্যান এসে বললেন, ‘আমি এই গ্রামের পরপর টানা চারবার চেয়ারম্যান হয়েছি! আমার একটা ইন্টারভিউ নিয়েন!আর গ্রামের নামটা বেশ কয়েকবার বলবেন! সারা বিশ্ব দেখুক এই গ্রামকে! দেখুক এই গ্রামের ইসমাইলকে!’
ইসমাইলের বাবা এবার বিনয়ে বিগলিত হয়ে সাংবাদিকদের বললেন, ‘আপনারা অবশ্যই দুপুরে খেয়ে যাবেন! ছেলের হোম কোয়ারেন্টাইন সম্মান অর্জনের জন্য গরুর রেজালা, প্লেইন পোলাও, মুরগীর রোস্ট, বোরহানি, জদ্দা সহযোগে চারটা ডাল ভাতের আয়োজন করেছি!আমি গরিব মানুষ! এর বেশি কিছু আর করতে পারি নাই! এর জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন!’"
এ কেমন জাতি আমরা?
এটি একটি কাল্পনিক গল্প। আসুন সকলে সচেতন হই।
আসুন আমরা সকলে ঘরে অবস্থান করি। নিয়মিত হাত ধুই। হাঁচি বা কাশি দেওয়ার সময় টিস্যু দিয়ে মুখ ঢেকে রাখি। মুখে মাস্ক পড়ি। লালা, থুথু বা সর্দির ফোটা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলি। সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে চলাফেরা করি।
আসুন আমরা সকলে ঘরে অবস্থান করি। নিয়মিত হাত ধুই। হাঁচি বা কাশি দেওয়ার সময় টিস্যু দিয়ে মুখ ঢেকে রাখি। মুখে মাস্ক পড়ি। লালা, থুথু বা সর্দির ফোটা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলি। সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে চলাফেরা করি।