অতি সম্প্রতি রাঙামাটিতে এক প্রসুতি মেয়ের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে স্বার্থান্বেষী মহল অপপ্রচারে নেমেছে; কোন কারণ ছাড়াই এবারো তাদের টার্গেট সেনাবাহিনী। ঘটনার বিবরণে জানা যায়, রানিকা চাকমা নামের এক প্রসূতি নারীর বাবার বাড়ি রাঙামাটি পার্বত্য জেলার জুড়াছড়ি উপজেলায়, আর শশুর বাড়ি জেলার বরকল উপজেলায়। গত ২৪শে এপ্রিল শুক্রবার সকালে রানিকা চাকমা তার বাবার বাড়ি জুরাছড়ি উপজেলার বনযোগীছড়া ইউনিয়নের বহেরাছড়িতে অবস্থানকালীন সময়ে তার প্রসব ব্যথা উঠে। সেসময় তার বাবার বাড়ির লোকজন কোন প্রশিক্ষিত ধাত্রীকে না ডেকে স্থানীয় এক বৈদ্যের কাছ থেকে তাকে পানি পড়াসহ ঝাড়ফুক করায়। কিন্তু শেষ মুহূর্তেও তার অবস্থার অবনতি হলে বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে না নিয়ে বাড়ির লোকজন তাকে পানিপথে লঞ্চে করে রাঙামাটি সদর হাসপাতালের দিকে রওনা দেয়। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে এক উপজেলার লোকজন অন্য উপজেলায় প্রবেশে কড়াকড়ি থাকায় রাস্তায় সেনাবাহিনীসহ আইন-শৃঙখলা বাহিনীর তল্লাশী, জিজ্ঞাসাবাদ ও নাম-ঠিকানা এন্ট্রি করার ধারাবাহিকতায় সেদিন রানিকা চাকমাকে বহণকারী লঞ্চটি সুবলং এলাকায় পৌঁছালে সেখানে সুবলং আর্মি ক্যাম্পে কর্তব্যরত সেনাসদস্যরা দূরত্ব বজায় রেখে লঞ্চটি তল্লাশি চালিয়ে ভেতরে গর্ভবতী নারী আছে জানতে পেরে সাথে সাথেই লঞ্চটিকে ছেড়ে দেয়। মেয়েটির স্বজনরা তাকে নিয়ে রাঙামাটি হাসপাতালে পৌঁছালে সে মৃত্যুবরণ করে।
এদিকে এঘটনাটিকে রং মাখিয়ে সেনাবাহিনীর তল্লাশী কার্যক্রমকে বিতর্কিত করে সেনাবাহিনী কর্তৃক লঞ্চটিকে আটকানোর কারণে রানিকা চাকমার মৃত্যুর জন্য তাদেরকে জড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিভিন্ন পোষ্ট করেছে স্বার্থান্বেষী একটি মহল! তবে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নগুলোতে কমিউনিটি ক্লিনিকসহ বিভিন্ন বেসরকারী এনজিও পরিচালিত স্বাস্থ্য বিভাগ এমনকি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকলেও বিভিন্ন সময়ে কতিপয় উপজাতি ব্যক্তিবর্গ স্বাস্থ্য বিভাগের সেবা গ্রহণ না করে নিজেদের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলে কুসংস্কার তথা বৈদ্য প্রথাকে প্রাধাণ্য দিয়ে আসছে। মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বিধান নিশ্চিতের পাশাপাশি বিভিন্ন মহামারিতে পাহাড়ী জনসাধারণের পাশে থাকা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার মধ্য দিয়ে রানিকা চাকমার বাবার বাড়িতে প্রসবকালীন প্রাথমিক অবস্থায় প্রথাগত কুসংস্কার আর অবহেলার বিষয়টিকে আড়াল করতেই সেনাবাহিনীকে দায়ী করা হচ্ছে বলে অভিমত স্থানীয় সচতেন মহলের।
প্রসুতি জিতনি তংচঙ্গ্যাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে সেনাসদস্যরা |
অনুসন্ধানে জানা যায়, এর আগেও গত বছরের ২৯শে এপ্রিল সোমবার একই উপজেলার দুর্গম এলাকার এক প্রসূতি নারীকে হেলিকপ্টারে করে হাসপাতালে নিয়ে এসে নজির গড়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর এমন দায়িত্বশীলতায় বেঁচে গিয়েছে দুটি প্রাণ। রাঙামাটির জুরাছড়ি উপজেলার প্রত্যন্ত বগাখালী গ্রামের এক প্রসূতি নারী জিতনি তংচঙ্গ্যার (২৩) হঠাৎ প্রসব ব্যথা শুরু হয়। পরিবারের পক্ষ থেকে স্থানীয়ভাবে ডাকা হয়েছিল ধাত্রী ও ওঝাকে। কিন্তু চারদিন ধরে ধাত্রী তার প্রসব করাতে ব্যর্থ হয়। এদিকে কাছাকাছি কোনো হাসপাতাল না থাকায় এক পর্যায়ে তাকে বাঁচানো অসম্ভব বলেই ধরে নিয়েছিল তার পরিবার। এভাবে চার দিন ধরে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েন তিনি। গ্রামটি এতটাই প্রত্যন্ত যে, তাকে হাসপাতালে নিতে হলে ঝিরি, নদী ও রাস্তা মিলিয়ে শহরে যেতে প্রায় ৭ দিন লেগে যেত। তাই কোনো উপায় না পেয়ে অবশেষে তাকে হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিয়ে প্রাণে বাঁচিয়েছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এর আগে, বাঁচানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে সোমবার সকালে জতনিকে বগাখালীর বিজিবির সীমান্ত চৌকিতে নিয়ে যান তার পরিবারের সদস্যরা। খবর পেয়ে সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি এই প্রসূতিকে হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রামে নিয়ে আসার নির্দেশ দেন। দুপুর ২টার দিকে হেলিকপ্টার সেনানিবাসে অবতরণের পর দ্রুত অ্যাম্বুলেন্সে করে জিতনিকে সিএমএইচে নেয়া হয়। এর আগে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর একই গ্রাম থেকে সোনাপতি চাকমা নামে আরো এক প্রসূতিকে হেলিকপ্টারে সিএমএইচে এনে প্রাণ বাঁচায় সেনাবাহিনী।
ভাল্লুকের আক্রমনে আহত পুর্ন বিকাশ ত্রিপুরাকে হেলিকপ্টারে তুলে দিচ্ছেন বিজিবি সদস্যরা |
এছাড়া রাঙ্গামাটি জেলার সাজেকের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় জুম চাষ শেষে বাড়ি ফেরার পথে গতবছর সাজেক ইউনিয়নের নিওথাংনাং পাড়ার অলীন্দ বিকাশ ত্রিপুরার ছেলে পণবিকাশ ত্রিপুরাকে (১৬) আক্রমণ করে একটি বন্য ভালুক। ক্ষতবিক্ষত হয় কিশোরের পুরো শরীর। ভালুকের থাবায় কয়েকটি দাঁতও পড়ে যায় তার। ২০১৯ সালের ১২ মে রবিবার বেলা সোয়া ২টায় আহত কিশোরকে নিয়ে রাঙ্গামাটি থেকে আসা হেলিকপ্টারটি চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অবতরণ করে। এসময় সেনাবাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তা ওই কিশোরকে হেলিকপ্টার থেকে নামিয়ে সিএমএইচের অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেন।
হামে আক্রান্ত ৫শিশুকে উন্নত চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারে চট্টগ্রাম নিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনী |
অতি সম্প্রতি রাঙামাটির সাজেকের দুর্গম এলাকা লুংথিয়ান ত্রিপুরাপাড়ায় হামে আক্রান্ত মুমূর্ষু পাঁচ শিশুকে বাঁচিয়ে রাখতে চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনীর এক বিশেষ হেলিকপ্টার গিয়ে সেখান থেকে তাদের এনে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত ২৫শে মার্চ বুধবার দুপুরে তাদের রাঙামাটির সাজেকের দুর্গম শিয়ালদহ মৌজার লুংথিয়ান ত্রিপুরাপাড়া থেকে সেনাবাহিনীর বিশেষ হেলিকপ্টারে প্রথমে চট্টগ্রাম সেনা ক্যান্টনমেন্টে, পরে সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসা নিয়ে তারা সুস্থ হয়ে বাড়িও ফিরে যায়।
সূত্র মতে, দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারী অনেক মুমূর্ষু রোগীর প্রাণ বেঁচেছে সেনাবাহিনীর দায়িত্বশীল ভূমিকার কারণে। এদের মধ্যে রয়েছে- পায়ে পচন ধরা বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের সদস্য চাথুইমা মারমা, লক্ষ্মীছড়ি থানার পুলিশ কনস্টেবল মংজয় চাকমা প্রমুখ। গতবছর খাগড়াছড়ির দুরছড়ি এলাকায় ডায়রিয়া দেখা দিলে সেনা সদস্যরা মানবিক সহযোগিতা দিয়ে প্রায় ৩০টি পরিবারের সদস্যদের সুস্থ করে তোলে। এর পাশাপাশি সাজেকে মহামারি ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিলে সেখানেও মেডিকেল ক্যাম্প করে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আক্রান্তদের সুস্থ করে তোলে সেনাবাহিনী।
যে সেনাবাহিনী সাধারণ মানুষের কল্যাণে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করছে, দুর্গম এলাকায় বসবাসরত মানুষদের বিভিন্ন সময় মহামারিসহ অন্যান্য চিকিৎসা সুবিধা দিয়েছে, সেই সেনাবাহিনীর পক্ষে কি সম্ভব একজন প্রসুতি মেয়ের ক্ষতি করতে! তাছাড়া ঐ মেয়ের ক্ষতি হলে সেনাবাহিনীর কি লাভ? তাই সংশ্লিষ্টদের উচিত হবে বাস্তবতাবিবর্জিত কোন মন্তব্য করে সাধারণ জনগনকে বিভ্রান্ত না করতে। ডিজিটাল বাংলাদেশের এই যুগে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ থেকে বিরত থাকতে হবে, একজন রানিকা চাকমার মৃত্যু থেকে শিক্ষা নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার সুযোগ গ্রহণ করতে হবে।