মঙ্গলবার, ৮ আগস্ট, ২০১৭

পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি জনসংহতি সমিতি সৃষ্টির ইতিহাস

পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো সংগঠন হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। যে সংগঠনের প্রধান হলেন শন্তু লারমা। আমরা কি জানি কেন এবং কোন পরিস্থিতিতে এই সংগঠনটি সৃষ্টি হয়েছিলো? তাছাড়া, এই সংগঠনের দায়িত্বে রয়েছে কারা? আমি আজ আপনাদের কাছে সংক্ষিপ্ত আকারে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সৃষ্টির ইতিহাস তুলে ধরছি। ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান বিভক্তির সময় কামিনীমোহন দেওয়ান ও স্নেহ কুমার চাকমার নেতৃত্ব্যে এবং ভুবন মোহন রায়ের নেতৃত্ব্যে আরেকটি দল দিল্লি কংগ্রেস নেতাদের সাথে দেখা করে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের সাথে অন্তর্ভূক্তির আবেদন করেন। কিন্তু র্যাডক্লিফ কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভূক্ত করেন। ভারত যে সেদিন পার্বত্য চট্টগ্রামও দখলে চেয়েছিলো সেটা এখানে পরিস্কার। র্যাডক্লিফ কমিশন কলকাতা তাদের দিলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম দিতে পারেনি। ভারত পাকিস্তান বিভক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানের অংশ হয়েছিলো বলে তৎকালীন উপজাতীয় নেতারা তা মানতে পারেননি। তাই ১৪ই আগষ্টের পর রাঙ্গামাটিতে চাকমারা উড়ান ভারতীয় পতাকা, বান্দরবানে মারমারা উড়ান বার্মার পতাকা।

১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্থরের জনসাধারণ যখন পাকিস্তানী শোষকদের বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন বাজী রেখে সংগ্রাম করেছিলো তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় নেতারা মহান মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অবস্থান নেন। ১৯৪৭ সালে তারা যেই পাকিস্তানের বিরোধীতা করেছিলেন ১৯৭১ এ এসে সেই পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেন। চাকমা রাজা রাজাকার ত্রিদিব রায়, বান্দরবারের মং রাজা সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেন। তাই সাধারন উপজাতিরা থাকেন মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রের কাঠামো গঠনে ব্যস্ত। তাছাড়া সদ্য স্বাধীন দেশ নানাবিধ সমস্যা বিদ্যমান। সেই মূহুর্তে ১৯৭২ সালের ২৯ জানুয়ারি স্বায়ত্বশাষনের দাবিতে চারু বিকাশ চাকমার নেতৃত্ব্যে একদল উপজাতীয় প্রতিনিধি শেখ মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সদ্য শেষ হওয়া মুক্তিযুদ্ধে যারা পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো, তাদের স্বয়ত্বশাষনের দাবি একজন রাষ্ট্র নায়ক কিভাবে মেনে নিতে পারে?? সেদিন শেখ মুজিব তাদের রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যা না দিয়ে বরংচ বাঙ্গালী হয়ে বাংলাদেশে বসবাস করতে বলেন।

আমাদের অনেকেই এখনো বঙ্গবন্ধুর উপজাতিদের বাঙ্গালী হয়ে যাওয়ার বক্তব্যের তাৎপর্য না বুঝে তার বিরোধীতা করেন। আপনি একবার ভাবুন তখন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমাদের পরিচয় কি ছিলো? জিয়া সরকার ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রের নাগরিকের বাংলাদেশী পরিচয় সৃষ্টির পূর্বে আমাদের সকল সম্প্রাদায়ের পরিচয় ছিলো বাঙ্গালী। তাহলে শেখ মুজিব কি ভূল বলেছিলেন? বরংচ আপাত দৃষ্টিতে দেশপ্রেমিক চিত্তে বঙ্গবন্ধুর উচিত ছিলো উপজাতীয় নেতাদের বলা যে "তোমরা পাকিস্তান চলে যাও। কেননা তোমরা স্বাধীন বাংলাদেশ চাওনি, চেয়েছো পাকিস্তান। " কিন্তু তা না করে বঙ্গবন্ধু তাদের বাংলাদেশে একজন রাষ্ট্রের নাগরিক পরিচয়ে বসবাস করতে বলেছেন বলে কি অপরাধ করেছিলেন??

সেদিন তারা বঙ্গবন্ধুর কাছে স্বায়ত্বশাষনের দাবি আদায়ের আলোচনায় ব্যর্থ হন। এরপর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ১৯৭২ সালের ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশের খসড়া সংবিধান প্রণেতাদের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসনের দাবিসহ মোট চার দফা দাবি পেশ করেন।
দাবিগুলো ছিল:
√(১) পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসন এবং নিজস্ব আইন পরিষদ গঠন;
√ (২) সংবিধানে ১৯০০ সালের রেগুলেশনের অনুরূপ সংবিধির অন্তর্ভুক্তি;
√(৩) উপজাতীয় রাজাদের দপ্তর সংরক্ষণ;
√(৪) ১৯০০ সালের রেগুলেশন সংশোধনের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বিধিনিষেধ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের বসতি স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ।

সংবিধান প্রনেতাদের নিকট প্রেরিত উপরের এই দাবিগুলো একবার ভাবুন। একজন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী ব্যক্তি কখনো এই দাবি মেনে নিতে পারেনা। একজন সংবিধান প্রনেতা কিভাবে রাষ্ট্রের ভিতরে আরেকটা রাষ্ট্র সৃষ্টি হবে এমন শব্দ যুক্ত করাকে সমর্থন দিবেন? তাই সংবিধান প্রনেতারা উপজাতীয় নেতাদের দাবিকে প্রত্যাক্ষান করেন। মূলতঃ এই স্বায়ত্বশাষনের দাবির অর্থ হলো সাধারন উপজাতিদের বাংলাদেশের নাগরিক পরিচয় খর্ব করে রাষ্ট্রের ভিতরে আলাদা শোষকগোষ্ঠী দ্বারা শোষন করা। যেহতু উপজাতীয় নেতারা অন্তর থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে মেনে নিতে পারেনি। তাই সর্বশেষ সংবিধানে নিজেদের শোষক হিসেবে যুক্ত করতে না পেরে তারা ১৯৭৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নামক সংগঠন সৃষ্টি করে। যা কিনা আজ অবধী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে।

জেএসএস সৃষ্টির পরে খাগড়াছড়ির ইটছড়ি জঙ্গলে সৃষ্টি হয় তাদের সসস্ত্র শাখা শান্তি বাহিনী। যার নেতৃত্ব্যে ছিলেন বর্তমান জেএসএস প্রধান শন্তু লারমা। এবার আসুন জেনে নিই কারা এই শান্তি বাহিনীর সদস্য ছিলেন, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার চাকামা রাজা ত্রিদিব রায় এবং বোমাং রাজা মংশুয়ে প্রু চৌধুরী উপজাতিয় যুবকের নিয়ে পাকবাহিনীদের সহায়তা করার জন্য সিভিল আর্মড ফোর্সেস অথবা রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন। এরপর পাকিস্তানীদের সাথে একাট্টা হয়ে অসখ্য মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ মানুষকে তারা হত্যা করে। পাকিস্তানী সৈন্যদের রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান হতে সার্বিক সহযোগীতা করেন ত্রিদিব রায় এবং বোমাং রাজা মংশুয়ে প্রু চৌধুরী। তাদের বিশ্বাস ছিল বাংলাদেশ কখনো স্বাধিন হবেনা। তাই পাকিস্তানিদের পক্ষ নিয়ে পরবর্তীতে অতিরিক্ত সুবিধা আদায় করা।

 কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদের বিনিময়ে আমরা আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করি। দেশ স্বাধিন হবার পরে
সরকার রাজাকার বাহিনী, সিভিল আর্মড ফোর্সের সদস্য ও পাকবাহিনীর সহযোগীদের খুঝতে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুলিশ ও বিডিআর বাহিনী নিয়োগ করে। কারন, এই সকল স্বাধিনতা বিরোধীরা অস্ত্রসহ পাহাড়ের গভীর অরণ্যে লুকিয়ে ছিল। অস্ত্রসহ কিছু রাজাকারদের ধরতে পারলেও অধিকাংশ ধরা ছোয়ার বাইরে থেকে যায়। তাছাড়া যারা পাকিস্তানী ছিলো তারা চলে যায় পাকিস্তানে। ইতিমধ্যে সরকার মাইকিং করে সকল রাজাকারদের ক্ষমা ঘোষনা এবং সবাইকে আত্বসমর্পনের অনুরোধ জানায় । ফলে সামান্য কিছু ব্যক্তি আত্বসমর্পন করলেও রয়ে যায় সসস্ত্র মূল রাজাকাররা। যারা সাধারন ক্ষমার পরেও বাংলাদেশের নাগরিকত্ব মেনে নিতে পারেনি তারা পরক্ষনে উপজাতীয় নেতাদের আদলে পূনরায় নিজেদের সুসংগঠিত করতে থাকে । পরবর্তীতে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা ও তার ছোট ভাই শন্তু লারমা জনসংহতি সমিতি কমিটি করলে তারা জনসংহতি সমিতিতে যোগদান করেন। সেই সাথে সসস্ত্র রাজাকাররা জনসংহতি সমিতির Armed Wing এর সদস্য হয়। তখন সন্তু লারমা এই বাহিনীর প্রধান হন। এই বিষয়ে শরদিন্দু শেখর চাকমা তার লিখিত "পার্বত্য চট্টগ্রামের একাল সেকাল” বইটিতে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন যে জেএসএস সসস্ত্র রাজাকার নির্ভরশীল সংগঠন ।

আশাকরি আমার এই সংক্ষিপ্ত লেখায় আপনারা বর্তমান উপজাতীয় আঞ্চলিক সংগঠন জেএসএস সম্পর্কে তুলনামূলক ধারনা অর্জন করতে পেরেছেন।
আবু উবায়দা
[লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে? তাহলে দয়াকরে গবেষণামূলক ইতিহাস ভিত্তিক এই সাইটটি চালিয়ে যেতে সাহায্য করুন পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার বঞ্চিত বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী সাইটটি পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার কতৃক চরমভাবে অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত, পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ঠ এনজিও সমূহের একচোখা নীতি, সন্তু লারমা প্রসীত খীসাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) 'এর নিপিড়িত, নির্যাতিত ও বর্বরতম সন্ত্রাসের নির্মম অসহায় শিকার - পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠির সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ক্ষুদ্রতম এক প্রয়াস]