গণতন্ত্রের ধূয়া তুলে যে ইউরোপীয় দেশগুলোর মুখ ফেনিয়ে গেছে, এক সময় এরাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছলে বলে কৌশলে উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল। সম্পদের পাহাড় গড়তে এরা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করতেও দ্বিধা করেনি। তাদের উপনিবেশের বাসিন্দারা ছিল ‘ ইতর প্রাণী’ । আর তারা ছিলেন ত্রাতা। বিখ্যাত ফরাসী ঐতিহাসিক ও রাজনীতিবিদ অ্যালেক্সিস দ্য তকিউভিলে ১৮৩৫ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘Democracy in America’ গ্রন্থে এ বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, ‘আমরা যদি আমাদের চিন্তাধারার প্রতি লক্ষ্য করি, আমাদেরকে প্রায় এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয় যে, ইউরোপীয়রা মানবজাতির এক ভিন্ন গোত্রভুক্ত সম্প্রদায়, যেমন ইতর প্রাণীর বিপরীতে মানব সম্প্রদায়। সে তার নিজের প্রয়োজনে তাদেরকে বশীভূত করে এবং যখন তা করতে ব্যর্থ হয় তার বিনাশ সাধন করে।’
এই বিনাশের মাত্রাটা বেশি ছিল আফ্রিকা মহাদেশে। আফ্রিকার প্রাকৃতিক সম্পদ কুক্ষিগত করতে হেন অপকর্ম নেই যা করেনি ইউরোপীয়রা। তাদের কাছে আফ্রিকার মানুষ ছিল ওরাং ওটাং। ইউরোপের গোত্রভুক্ত ফ্রান্স ১৯ শতকের শুরুতে উপনিবেশ বিস্তার করতে শুরু করে। বর্তমানে ফ্রান্সের আয়তন ৬ লাখ ৭৪ হাজার ৮৪৩ বর্গ কিলোমিটার। অথচ ১৯৬০ সাল পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদী এ দেশটির অধিভুক্ত এলাকা ছিল ১ কোটি ১৬ লাখ ৭২ হাজার ১৫৭ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে বড় একটি অংশ ছিল আফ্রিকা মহাদেশে।
১৮৩০ সালে আলজেরিয়া দখলের মধ্য দিয়ে আফ্রিকায় প্রবেশ করে ফ্রান্স। তারা দেশটি শাসন করে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত। আলজেরীয় তথ্যসূত্র মতে প্রায় ১৩০ বছরের ‘সভ্যতার মিশনে’ তারা ২০ লাখের বেশি আলজেরীয়কে হত্যা করেছে। ফ্রান্সের হিসাব অনুযায়ী দশ লাখ আলজেরীয় এবং এক লাখ ফরাসি নিহত হয়েছে।
এবার আসি আলজেরিয়ায় পরিচালিত ফ্রান্সের সেই গণহত্যার ইতিহাসের দিকে। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে জেনারেল শার্ল দ্য গলের আহ্বানে আলজেরিয়ার তরুণরা ফ্রান্সের পক্ষে অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয়।১৯৪৫ সালে নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে ফ্রান্স ও মিত্র বাহিনী জয় লাভ করে। বিজয় উদযাপনের জন্য ৮ মে আলজেরিয়ার সেফিত শহরে জমায়েত হয় তরুণরা। সেখানে সাল বোউজিত নামে এক কিশোর স্বাধীন আলজেরিয়ায় পতাকা নিয়ে এলে আলজেরীয়দের অনেকেই স্বাধীনতার স্বপক্ষে স্লোগান দেয়া শুরু করে। এসময় সেখানে জেনারেল দুঁভালের নেতৃত্বে ফরাসি সেনারা গুলি চালালে ওই কিশোর নিহত হয়। মুহূর্তে পুরো এলাকায় তাণ্ডব শুরু করে ফরাসি সেনারা। ওই দিন সেতিফে এক হাজার আলজেরীয় নিহত হয়। সেতিফের পাশের শহর গুয়েলমাতে একই দিন বিক্ষোভ মিছিল বের করে আলজেরীয়রা। সেখানেও গুলি চালায় ফরাসি সেনারা।
এর ফলে শহর দুটিতে ফরাসি বসতি স্থাপনকারীদের সঙ্গে দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়ে আলজেরীয়রা। ইউরোপীয় ইতিহাসবিদদের মতে, দাঙ্গায় ১০৩ জন ফরাসি নাগরিক নিহত হয়েছে। তবে আলজেরীয়রা বলেছে, নিহত ফরাসির সংখ্যা সর্বসাকুল্যে ১২। এর প্রতিক্রিয়ায় আলজেরিয়া জুড়ে হত্যার উৎসবে মেতে ওঠে ফরাসি সেনারা। আলজেরীয়দের দমনের জন্য তাৎক্ষণিক যে গণহত্যা চালানো হয়, তাতে নিহত হয় প্রায় ৪৫ হাজার লোক। কতোটা নৃশংস হত্যাকাণ্ড ছিলো তা ফুটে ওঠে এক ফরাসি সেনা কর্মকর্তার মন্তব্যে।
আলজেরীয়দের লাশ গুম করার দায়িত্বে নিয়োজিত ওই সেনা কর্মকর্তা তার সঙ্গের অফিসারকে বলেন, তুমি এত দ্রুতগতিতে তাদেরকে কচুকাটা করে চলেছো যে, আমি মাটিচাপা দিয়ে শেষ করতে পারছি না। মুসলমানদের এলাকাগুলোতে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়ে ফরাসি সশস্ত্র বাহিনী কারাটা ও বুগি এলাকায় বিমান হামলা চালায়। ফরাসি সেনারা জাইলস শহরে আলজেরীয় বন্দিদের নির্বিচারে হত্যা করে। ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের দাবি নিহত আলজেরীয়দের সংখ্যা ৬ হাজার। তবে নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকদের দাবি পাঁচ দিনে ফরাসি সেনারা পুরো আলজেরিয়ায় ৪৫ হাজার লোককে হত্যা করেছে।
ব্রিটিশ ঐতিহাসিক অ্যালিস্টার হর্ন তার বিখ্যাত অ্য সেভেজ ওয়্যার অব পিস বইতে লিখেছেন, অভিযান চলাকালে নৃশংসভাবে আলজেরীয় নারীদের ধর্ষণ করে ফরাসি সেনারা। ধর্ষণ শেষে অনেক নারীর স্তুন তারা কেটে ফেলে। হত্যার পর অনেকের মৃতদেহ বিকৃত করতেও কসুর করেনি সেনারা। এই গণহত্যার পর আলজেরিয়ার জনগণের স্বাধীনতার আন্দোলন জোরদার হয়। ১৯৫৪ সালে ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আলজেরীয়দের গণজাগরণ শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৬২ সালে ফরাসিরা আলজেরিয়াকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয়। তবে এই সময়ের মধ্যে অভিযান ও বিচারের নামে দেশটির অন্তত ১০ লাখ মুসলমানকে হত্যা করা হয়।
আলজেরিয়ায় নির্যাতনের কথা স্বীকার করল ফ্রান্স
একটি প্রজম্ম ভুল করলে আরেকটি প্রজম্ম ক্ষমা চাইবে- সভ্যতার আলো মানুষকে তাই শিক্ষা দিয়েছে। কিন্তু নিজেদের স্বার্থ রক্ষার বেলায় যারা মানবাধিকারের তুবড়ি ছোটাতে দক্ষ সেই ফরাসিরা কিন্তু আজও আলজেরিয়ায় চালানো গণহত্যার বিষয়ে ক্ষমা চায়নি। ২০১২ সালে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ আলজেরিয়ার জনগণের ওপর চালানো ‘হত্যাযজ্ঞের’ কথা স্বীকার করেছেন। তবে ওই নির্মমতার জন্য ফ্রান্সের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাননি তিনি!
১৩২ বছর আলজেরিয়াকে উপনিবেশ বানিয়ে ‘অন্যায্য’ ও ‘বর্বরোচিত’ কাজ করেছে ফ্রান্স। আলজেরিয়ায় রাষ্ট্রীয় সফরের দ্বিতীয় দিনে আজ বৃহস্পতিবার দেশটির পার্লামেন্টে এক বক্তৃতায় এ কথা বলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ। ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর খবরে বলা হয়, ওলাঁদ সাত বছরব্যাপী স্বাধীনতাযুদ্ধে আলজেরিয়ার জনগণের ওপর চালানো ‘হত্যাযজ্ঞের’ কথা স্বীকার করেন। তবে ওই নির্মমতার জন্য ফ্রান্সের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাননি তিনি।
১৯৬২ সালে অর্জিত আলজেরিয়ার স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সে দেশে যান ওলাঁদ। আজ তিনি আলজেরিয়ার স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়কার জাতীয়তাবাদী নেতা মেসালি হাজের জন্মভূমি লেমসেনে যান।
সফরের শুরুতে ওলাঁদ বলেছিলেন, তিনি ও আলজেরীয় প্রেসিডেন্ট আবদেল আজিজ বৌতেফ্লিকা কৌশলগত অংশীদারির ক্ষেত্রে ‘নতুন যুগ’ সৃষ্টি করেছেন। আজ আলজেরিয়ার পার্লামেন্টে তিনি বলেন, ‘দুই দেশের (আলজেরিয়া ও ফ্রান্স) ইতিহাস বিয়োগান্ত ও বেদনাদায়ক হলেও তা বলা উচিত।’
আলজেরিয়ায় গণহত্যা চালানো হয়েছে এমন তিনটি স্থানের নামও তালিকাভুক্ত করেন ওলাঁদ। এর মধ্যে অন্যতম একটি স্থান সেটিফ। আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্স থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে ওই স্থানে ১৯৪৫ সালে ফ্রান্সের বাহিনীর সঙ্গে আলজেরিয়ার জনগণের সংঘর্ষ বাধে। সে সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আলজেরিয়ার জনগণের এক উদযাপনে ফ্রান্সের পুলিশ বাধা দেয়। পরে বিক্ষুব্ধ আলজেরীয়রা ফ্রান্সের কয়েকজন নাগরিককে হত্যা করে। এর জবাবে পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে ফ্রান্স যুদ্ধজাহাজ থেকে আলজেরীয়দের ওপর ব্যাপক গোলাবর্ষণ করে। এ গোলাবর্ষণে ৪৫ হাজার মানুষ নিহত হয় বলে দাবি করা হয়। তবে ফ্রান্সের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ওই সময় ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষ মারা যায়।