১৮ এপ্রিল ২০০১ তারিখে ভোরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) রৌমারীর বড়াইবাড়ী গ্রামে ভোর বেলায় অতর্কিতভাবে প্রবেশ করে তাণ্ডব চালায়। হামলার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছিল বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) আর ও গ্রামবাসীদের মিলিত প্রতিরোধে পর্যদুস্তু হয় বিএসএফ। সেদিন ১৬ জনের লাশ ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল বিএসএফ। এ ঘটনায় শহীদ হন তৎকালীন বিডিআর এর তিন সদস্য। ৩জন বীর বিডিআর সৈনিক শাহাদাত বরণ করেছিলেন দেশের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখতে। শহীদ হন বাংলাদেশের ৩৩ রাইফেল ব্যাটালিয়ানের ল্যান্স নায়েক ওহিদুজ্জামান, সিপাহী মাহফুজার রহমান এবং ২৬ রাইফেলস ব্যাটালিয়ানের সিপাহী আব্দুল কাদের। এছাড়া আহত হন হাবিলদার আব্দুল গনি, নায়েক নজরুল ইসলাম,ল্যান্স নায়েক আবু বক্কর সিদ্দিক, সিপাহী হাবিবুর রহমান ও সিপাহী জাহিদুর নবী।বিএসএফরা যে বেআইনীভাবে বড়াইবাড়ি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ ভূ-খন্ডে প্রবেশ করেছিল তা নিয়ে কারো কোন সন্দেহ ছিল না। সেসময় বিএসএফ-এর তাণ্ডবে পুড়ে ছাই হয়েছিল বড়াইবাড়ী গ্রামের ৬৯টি বাড়ি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল প্রায় ২ কোটি টাকার সম্পদ। ৩০ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম একসঙ্গে ১৬ জন বিএসএফের মৃত্যু ঘটে।‘পাদুয়া' ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির দুই দফা অনুযায়ী একটি অপদখলীয় এলাকা। দুই দেশের মধ্যে অপদখলীয় এলাকার তালিকা ও আয়তন নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। ১৯৯৭ সালের ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২ হাজার ৩শ' ২৬.১৬ একর ভারতীয় জমি বাংলাদেশের অপদখলে এবং ৩ হাজার ২শ' ১৮.৫৬ একর বাংলাদেশের জমি ভারতের অপদখলে রয়েছে। অপরদিকে ভারতের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের ২ হাজার ৫শ' ৪.৮৯ একর ভারতের অপদখলে এবং ২ হাজার ২শ' ৬০.৮৪ একর ভারতীয় জমি বাংলাদেশের অপদখলে রয়েছে। ভারতের সবচেয়ে বড় বন্ধু আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পরও এ ব্যাপারে জটিলতার অবসান হয়নি।
১৯৯৭ সালের ২৫ নবেম্বর অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের এক সভায় অপদখলীয় এলাকার পরিমাণ যৌথ জরিপের মাধ্যমে নির্ণয় করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই অনুযায়ী, বেরুবাড়ী ও সিংপাড়া-ক্ষুদিপাড়া এলাকায় অপদখলীয় এলাকার পরিমাণ যৌথ জরিপের মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়। ১৯৯৮ সালের ৬ থেকে ১২ আগস্ট অনুষ্ঠিত মহাপরিচালক/পরিচালক আসাম ও মেঘালয় সেক্টরে সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত যৌথ সম্মেলনে অপদখলীয় এলাকা যৌথ জরিপের মাধ্যমে জমির পরিমাণ নির্ণয়ের বিষয়ে আলোচনা করা হয়। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে এই বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত/নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। ৯ সেপ্টেম্বর একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকের কার্যপত্রে লেখা হয়, ‘১৯৭৪ সালের চুক্তি অনুযায়ী অপদখলীয় এলাকা সংশ্লিষ্ট দেশের কাছে ছেড়ে দেয়ার দ্বিপাক্ষিক সম্মতি রয়েছে।' উক্ত চুক্তি অনুযায়ী, বাউন্ডারী স্ট্রিপ ম্যাপ উভয় দেশের পেনিপোটেনশিয়ারি কর্তৃক স্বাক্ষরিত হওয়ার পর অপদখলীয় এলাকা হস্তান্তর হওয়ার কথা। কিন্তু স্ট্রিপ ম্যাপ পেনিপোটেনশিয়ারি কর্তৃক স্বাক্ষরিত না হওয়ার কারণে অপদখলীয় এলাকা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব হয়নি।
১৯৯৭ সালের ২৫ নবেম্বর অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের এক সভায় অপদখলীয় এলাকার পরিমাণ যৌথ জরিপের মাধ্যমে নির্ণয় করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই অনুযায়ী, বেরুবাড়ী ও সিংপাড়া-ক্ষুদিপাড়া এলাকায় অপদখলীয় এলাকার পরিমাণ যৌথ জরিপের মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়। ১৯৯৮ সালের ৬ থেকে ১২ আগস্ট অনুষ্ঠিত মহাপরিচালক/পরিচালক আসাম ও মেঘালয় সেক্টরে সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত যৌথ সম্মেলনে অপদখলীয় এলাকা যৌথ জরিপের মাধ্যমে জমির পরিমাণ নির্ণয়ের বিষয়ে আলোচনা করা হয়। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে এই বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত/নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। ৯ সেপ্টেম্বর একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকের কার্যপত্রে লেখা হয়, ‘১৯৭৪ সালের চুক্তি অনুযায়ী অপদখলীয় এলাকা সংশ্লিষ্ট দেশের কাছে ছেড়ে দেয়ার দ্বিপাক্ষিক সম্মতি রয়েছে।' উক্ত চুক্তি অনুযায়ী, বাউন্ডারী স্ট্রিপ ম্যাপ উভয় দেশের পেনিপোটেনশিয়ারি কর্তৃক স্বাক্ষরিত হওয়ার পর অপদখলীয় এলাকা হস্তান্তর হওয়ার কথা। কিন্তু স্ট্রিপ ম্যাপ পেনিপোটেনশিয়ারি কর্তৃক স্বাক্ষরিত না হওয়ার কারণে অপদখলীয় এলাকা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব হয়নি।
কেন এই সংঘর্ষ?
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার প্রতাপপুর সীমান্তে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তরেখার ২শ' ৫০ গজ ভিতরে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প ছিল। দেশ স্বাধীনের পর অরণ্যবেষ্টিত পাহাড়ী এলাকা পাদুয়ার মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পসহ দু'শ' ৩০ একর ভূমি বিএসএফ অপদখল করে নেয়। ক্যাম্পের আশপাশে বাংলাদেশের জনগণের বসবাস রয়েছে। ১৯৭২ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বিএসএফ সদস্যরা এই ক্যাম্প দখলে রেখে আশপাশের বাংলাদেশীদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে আসছিল। সীমান্ত লাইন থেকে অনেক ভিতরে অবস্থিত বিএসএফ-এর এই ক্যাম্পটি প্রত্যাহারের একাধিকবার আলোচনা হয়েছিল। ১৯৯৯ সাল থেকে বিডিআর-এর উপ-মহাপরিচালক ও বিএসএফ-এর আইজি পর্যায়ে প্রতিটি সভায় পাদুয়া গ্রামটি নিয়ে আলোচনা হয়। বিএসএফ পাদুয়া ক্যাম্পের অবস্থান বাংলাদেশের অভ্যন্তরে-এ কথা স্বীকার করলেও নানা অজুহাতে ক্যাম্পটি সরিয়ে নিতে গড়িমসি করছিল। এই এলাকাটির কাছাকাছি আরও কয়েকটি অপদখলীয় এলাকা রয়েছে। ১৯৯৯ সালের মাঝামাঝি সিলেট সীমান্তের লাতু এলাকা থেকে কয়েকজন বিডিআর সদস্যকে বিএসএফ ধরে নিয়ে যায়। এ সময় বিডিআরের মহাপরিচালক ছিলেন মেজর আজিজুর রহমান। বিডিআর এ সময় পাদুয়া দখলে নিতে বিএসএফকে হুশিয়ারি জানিয়েছিল। এই ঘটনাটি ছাড়া পাদুয়ায় বিএসএফের ফাঁড়ি নিয়ে আর কখনও উচ্চবাচ্য হয়নি। সর্বশেষ ঘটনার দু'মাস আগেও বিএসএফকে চিঠি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। এরই প্রেক্ষিতে বিডিআর ১৫ এপ্রিল ২০০১ রাতে পাদুয়া গ্রাম পুনরুদ্ধার করে এবং সেখানে ৩টি ক্যাম্প স্থাপন করে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে। গ্রামটি পুনরুদ্ধারের সময় কোন পক্ষ থেকে গোলাগুলি হয়নি। পাশাপাশি পাদুয়া গ্রামটি থেকে ৬ কিলোমিটার পশ্চিমে সোনাপুর সীমান্ত পর্যবেক্ষণ চৌকির উল্টোদিকে ভারত একটি পাকা রাস্তা তৈরি করে। সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করে জিরো লাইন থেকে ৩০ মিটার দূরে নির্মিত রাস্তাটি নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। ফলে ঐ সীমান্ত এলাকায় দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। পাদুয়ার ঘটনা থেকে দেখা যাচ্ছে, বিএসএফ অবৈধভাবে নোম্যান্সল্যান্ডে রাস্তা নির্মাণ করছিল। এই নির্মাণ কাজে বাধা দেয়া ছিল বিডিআরের রুটিন মাফিক দায়িত্ব।
ভারতের ইংরেজী দৈনিক টেলিগ্রাফের সংবাদদাতা প্রণয় শর্মা ২০ এপ্রিল নতুন দিল্লী ডেটলাইনে লিখেছেন, ‘‘ভারত ফুটপাথ বিতর্কের প্রসঙ্গটি জনসমক্ষে আনেনি। সীমান্ত গাইড লাইনে বলা আছে, সড়কসহ কোন প্রতিরক্ষামূলক নির্মাণ জিরো লাইনের ১৫০ মিটারের মধ্যে নির্মাণ করা যাবে না। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিবাদ সত্ত্বেও বিএসএফ নির্মাণ কাজ অব্যাহত রেখেছিল। গত সপ্তাহান্তে বিডিআর ফুটপাথ নির্মাণ বন্ধ করতে ঐ এলাকায় অভিযান চালায়।’’
বড়াইবাড়ি অপারেশন
প্রতিশোধ নেয়ার জন্য বিএসএফ পাদুয়া ঘটনার মাত্র তিনদিনের মধ্যে বড়াইবাড়ী অপারেশন চালায়। বাংলাদেশের বড়াইবাড়ি, হিজলামারী, খেওয়ারচর, বিডিআর ক্যাম্পগুলো যেমন দুর্গম তেমনি অনুন্নত। বিএসএফ'রা ১৬ এপ্রিল দুপুরে বড়াইবাড়ি অপারেশন পরিকল্পনা করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মহেন্দগঞ্জ-কামালপুর পাকা সড়ক নির্মাণ সহজ করা এবং বড়াইবাড়ির চার কিলোমিটার অতি উর্বরা জমি ভারতীয়দের দখলে আনা। ধুবরী, মহেন্দ্রগঞ্জ, গৌহাটি থেকে রাতেই তিন প্লাটুন ক্যাটস আই কমান্ডো ও দু'শর বেশি অতিরিক্ত বিএসএফ এসে গোপনে অবস্থান নেয় মাইনকারচর ক্যাম্পের আশেপাশে। এদিকে বাংলাদেশী পত্রবাহক (বিডিআর-এর বিভিন্ন চিঠি বিএসএফ ক্যাম্পে পৌঁছায়) লুৎফর রহমান মাইনকারচর বিএসএফ ক্যাম্প ঘুরে এসে বলেছিলেন সেখানে ভারতীয় সেনাসদস্যরাও ব্যাংকারে অবস্থান নিয়েছে। প্রস্তুত আছে মর্টার, কামান, মেশিনগান ও সাঁজোয়া যান। বাংলাদেশ সীমান্তে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার না থাকায় বড়াইবাড়ী ক্যাম্পের বিডিআর'রা বিএসএফ-এর আক্রমণের প্রস্তুতি আগে বুঝতে পারেনি। কিন্তু বিকাল ৫টায় বিএসএফ-এর কাছ থেকে ফ্ল্যাগ মিটিং-এর একটি রহস্যময় প্রস্তাব সম্বলিত চিঠি আসায় বড়াইবাড়ী ফাঁড়ির বিডিআর কমান্ডার নজরুল ইসলামের সন্দেহ হয়। কোন সংঘাত, সংঘর্ষ, অঘটন নেই তবুও কেন বিএসএফ ফ্ল্যাগ মিটিং-এর জন্য প্রস্তাব দিল। আসলে বিএসএফ চেয়েছিল ফ্ল্যাগ মিটিং এর জন্য বিডিআরের ৫/৬ জন বড়াইবাড়ী ক্যাম্পে ভারতের সীমানায় গেলে তারা বিডিআরদের আটকে রেখে বড়াইবাড়ী হামলা করবে। পরে বিএসএফ-এর পক্ষ থেকে খবর ছড়ানো হতো বাংলাদেশের বিডিআররা প্রথমে ভারতীয় সীমান্ত এলাকা অতিক্রম করে আক্রমণ করেছে। এই অজুহাতে তাদের বড়াইবাড়ী অপারেশন হতো সাকসেসফুল। ফ্ল্যাগ মিটিং-এর জন্য পাঠানো ওই চিঠিটি ষড়যন্ত্রমূলক মনে হওয়ায় বড়াইবাড়ী ক্যাম্পের কমান্ডার নজরুল ইসলাম ভারতীয়দের পাতানো ফাঁদে পা দেননি।
উল্টো রাতে ক্যাম্পে ১০ জন সহযোগীকে তিনি সারারাত সতর্ক থাকার নির্দেশ দেন। কাঁটাতারের বেড়ার মাঝে পূর্ব অংশের গেট দিয়ে রাত ৩টার দিকে ভারতীয় কমান্ডো, সেনা ও বিএসএফ-এর প্রায় চারশত সদস্যের যৌথ-বাহিনী ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে ঢুকে পড়ে বড়াইবাড়ী সীমানায়। শুকিয়ে যাওয়া খাল দিয়ে তারা ক্রস করে এগিয়ে তিনদিক থেকে বড়াইবাড়ী ক্যাম্প আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। এর আগে গেট পেরিয়ে ভারতীয় বাহিনীর বড়াইবাড়ীতে ঢুকে পড়ার দৃশ্যটি দেখে ফেলে ঐ গ্রামের মিনহাজ। ভোর সাড়ে ৩টায় ধানক্ষেতে সেচ দিতে গিয়ে মিনহাজ কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে সারি সারি সৈন্য আসতে দেখতে পায়। তখনই সে দৌড়ে খবর দেয় বড়াইবাড়ী ক্যাম্পে। সাথে সাথে ওয়্যারলেসে খবর চলে যায় পার্শ্ববর্তী হিজলমারী ও খেওয়ারচর ক্যাম্পে। ভোর সাড়ে ৪টার দিকে পূর্বদিক থেকে বিএসএফ বড়াইবাড়ী ক্যাম্পে গুলীবর্ষণ যখন শুরু করে তখন প্রথম ১০ মিনিট বিডিআররা ছিল নিশ্চুপ। ভারতীয় বাহিনী এ ঘটনায় মনে করেছিল বিডিআররা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়েছে। এরপর তাদের একটি বাহিনী পশ্চিম গ্রামের দিক থেকে একটি দল ক্যাম্পের দিকে অসতর্কভাবে এগুতে শুরু করলে বড়াইবাড়ী বিওপি থেকে বিডিআর-এর চারটি মেশিনগান একযোগে গুলীবর্ষণ শুরু করে। এই মেশিনগান এক একটি মিনিটে সাতশ গুলী ছুঁড়তে পারে। অকস্মাৎ এ আক্রমণে ভারতীয় বাহিনী হতচকিত হয়ে দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করে। তারা ভেবে বসে উল্টো দিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলা হয়েছে। তাই বিডিআর এর ল্যান্স নায়ক ওহিদুজ্জামান ও ১৬ জন বিএসএফ নিহত হয়। এরপর হিজলমারী ও খেওয়ারচর বিওপি থেকে বড়াইবাড়ী ক্যাম্পের ১০ জন বিডিআর-এর সাথে আরো ১৬ জন বিডিআর যোগ দেন ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে। ভারতীয় বাহিনী সকাল ১০টা পর্যন্ত বিওপি'র দু'শ গজ দূরে বাংলাদেশের সীমানায় ছিল।
জামালপুর থেকে ৩৩ রাইফেল ব্যাটেলিয়ান-এর কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল এস জামান-এর নেতৃত্বে অতিরিক্ত বিডিআর বড়াইবাড়ীতে পৌঁছার পর ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের সীমানা ছেড়ে ওপারে পালিয়ে যায়। এরপর লাগাতার প্রায় দু'দিন চলে উভয়পক্ষের মধ্যে গুলীবিনিময়। এই সংঘর্ষে বিএসএফ আরো নিহত হয়েছে বলে জানা গেলেও নিশ্চিতভাবে সংখ্যা জানা যায়নি। নিহত হন মাহফুজার রহমান এবং আঃ কাদের নামক আরো দু'জন বিডিআর। আহত হন হাবিলদার আঃ গনি, সিপাহী আঃ রহমান, সিপাহী জাহেদুর, দুলাল বড়ুয়া, নজরুল ইসলাম, আওলাদ হোসেন, নূরুল ইসলাম প্রমুখ। গ্রামবাসীদের মধ্যে আহত হন শেখ সাদী (৪), বিলকিস খাতুন (১২), মকবুল হোসেন (৬০), ছমিরন নেছা (৫৫) এবং গোলাম মোস্তফা (৩৫)। গ্রামবাসীর হাতে ধরা পড়ে অক্ষয় কুমার ও বিমল প্রসাদ নামক দু'জন বিএসএফ সদস্য। পরে বিডিআর উদ্ধার করে মোট ১৬ জন বিএসএফ-এর লাশ। যা পরে ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বিডিআর আরও্ধার করে দু'টি এলএমজি, ১৫টি এসএলআরসহ গুলী, ম্যাগাজিন, জুতা, ওয়্যারলেস সেট প্রভৃতি। এগুলো সবই বিএসএফ-এর। পরবর্তীতে উচ্চপর্যায়ের চাপে ফ্ল্যাগ মিটিং-এর মাধ্যমে বন্ধ হয় সংঘর্ষ। প্রশমিত হয় উত্তেজনা। ঐ সময়ে ঐ সীমান্তের আশপাশের প্রায় ৩০টি গ্রামের ৩৫ হাজার মানুষ বাড়ি-ঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। এদের ভোগ করতে হয় অবর্ণনীয় কষ্ট ও দুর্ভোগ।
১৮ এপ্রিল দৈনিক যুগান্তরকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আ.ল.ম. ফজলুর রহমান বলেন, ‘বিনা কারণে রৌমারী সীমান্তে বিএসএফয়ের গুলীবর্ষণ, ও প্রাণহানির জন্য ভারতকে ক্ষমা চাইতে হবে। ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।' ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশোবন্ত সিং ১৯ এপ্রিল মন্তব্য করেন যে, ‘পাদুয়ায় বিডিআরের অবাঞ্ছিত প্রবেশে শেখ হাসিনা সরকারের সায় ছিল না।' ২০ এপ্রিল বিকেলে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় পররাষ্ট্র সচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী বলেন, ‘সিলেটের তামাবিল এলাকার পাদুয়া থেকে বাংলাদেশ রাইফেলস বা বিডিআর-এর ঘেরাও তুলে নেয়া হয়েছে। ভারতও তার বিরোধপূর্ণ রাস্তাটি ভেঙ্গে দিয়েছে।' ২১ এপ্রিল ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনার মনিলাল ত্রিপাঠি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এক খবরে বলা হয়, ‘প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলবেন বলে ভারতে পত্র-পত্রিকায় যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, ভারতের একজন মুখপাত্র তা নাকচ করে দেন।'
বড়াইবাড়ীতে রাতের আধারে সীমান্ত অতিক্রম করে শত শত ভারতীয় সৈন্যের বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশ, বিডিআর সৈন্যদের হত্যা, বাংলাদেশের গ্রাম লুট ও জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনায় যখন সারাদেশে ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করার দাবি উঠেছে ঠিক তখনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২২ এপ্রিল দিবাগত রাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর সাথে আধাঘণ্টাব্যাপী এক টেলিফোন সংলাপে বসেন এবং এই সময়ে শেখ হাসিনার ৩ বার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিডিআরের ভূমিকায় (বীরত্বের জন্য) দুঃখ প্রকাশ করেন। এদিকে নিজ দেশে বাজপেয়ী সরকারের মুখ রক্ষা করতে শেখ হাসিনা দুঃখ প্রকাশ করলে ভারতীয় পক্ষ থেকে তাদের দেশে শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে এ ঘটনায় দায়ভার এককভাবে বিডিআর প্রধানের উপর চাপিয়ে দেয়। কিন্তু বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল ফজলুর রহমান দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় (২১-৪-২০১১) দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমার বিশ্বাস প্রধানমন্ত্রীর এতে সমর্থন থাকবে। এই আস্থা নিয়েই আমি অগ্রসর হয়েছি। আমি প্রধানমন্ত্রীকে চিনি। খুব কাছ থেকে দেখেছি।' পত্রিকাটি আরও জানায়, ‘ভূমি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে বিডিআর প্রধানকে নিরুৎসাহিত করলে তিনি নিজ উদ্যোগে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম তেহেলকা ডটকম জানায়, ‘নির্বাচত যতই ঘনিয়ে আসছে প্রধামন্ত্রী (শেখ হাসিনা) ততই শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন এবং সেনাবাহিনী ও মৌলবাদীদের কাছে ঘেঁষতে তাকে এ কৌশল নিতে হয়েছে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও মৌলবাদীরা ভারত বিদ্বেষী। বর্তমান উত্তপ্ত পরিবেশে থেকে দেখিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে বাংলাদেশ ছেড়ে কথা বলে না। শেখ হাসিনার জন্য ভোট আদায়ের এটি একটি কৌশল মাত্র।'
দ্যা স্টেটম্যান ২০ এপ্রিল সংখ্যায় ‘বাংলা পলিটিক্স বিহাইন্ড ফায়ারিং শীর্ষক খবরে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত উত্তেজনা বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতির অংশ হতে পারে... নির্বাচন সন্নিকটে এবং আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলের জন্য ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। ভারত বিদ্বেষী মনোভাব নিয়ে বিএনপি মৌলবাদীদের হাত করতে সমর্থ কিন্তু আওয়ামী লীগের ভারতপন্থী ইমেজ রয়েছে। নির্বাচন সামনে রেখেই মৌলবাদীদের হাত করতেই আওয়ামী লীগ সরকার ভারত বিরোধী একটি ইমেজের অধিকারী নিজেদের করতে চায়।' হিন্দুস্তান টাইমস এই দিন তাদের সম্পাদকীয়তে বলেন, ‘নির্বাচনী সুবিধা অর্জনের স্বার্থে বরাবরের মত ভারত বিরোধী সেন্টিমেন্ট মোকাবিলার জন্য ঢাকা এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে।' অন্য এক প্রতিবেদনে টাইমস অব ইন্ডিয়া বলে, ‘শেখ হাসিনা নির্বাচনের আগে ভারতের পুতুল বলে নিজের পরিচিতিকে মুছে ফেলতে চান।' টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এসেছে। এমন অবস্থায়... শেখ হাসিনা সরকারে কড়া ভারত বিরোধী মনোভাব গ্রহণ ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই।' বাংলাদেশের চিন্তাশীল পাঠকের পত্রিকা পাক্ষিক ‘চিন্তা' অনেকের বরাত দিয়ে বলে, ‘অনেকে মনে করেন এটা বাজপেয়ীর ও হাসিনা সরকারের পাতানো খেলা।' (সূত্র : পাক্ষিক চিন্তা, ১৫ মে ২০০১)
মূলত, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে এত প্রাণহানির মতো সংঘর্ষ এর আগে আর কখনো ঘটেনি। কুড়িগ্রাম ও সিলেট বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে আওয়ামী সরকারের নীতি-নির্ধারকরা উদ্বিগ্ন ছিল। এই ঘটনায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার রীতিমত হতচকিত হয়ে যায়। প্রথমে ভারত সরকার বিষয়টি হজম করার চেষ্টা করলেও প্রচার মাধ্যম ও বিরোধী দলের চাপে পড়ে এ নিয়ে সোচ্চার হয়। ঘটনাটি ভারত ও তার বিশাল সামরিক বাহিনীর ইজ্জতের ওপর একটা বড় ধরনের আঘাত ছিল। স্বভাবতই তারা ক্ষিপ্ত হয় বাংলাদেশের উপর। আর এই ক্ষোভের বিষয়টি আওয়ামী লীগ সরকারকে উদ্বিগ্ন করে তুলে। আওয়ামী সরকারের একটি মহল বিডিআর-এর ভূমিকায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়। তারা মনে করেছে নির্বাচনের আগে এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে বিডিআর সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছে। এই মহল কোনভাবেই ভারতকে চটাতে রাজি ছিল না। পাদুয়া দখলমুক্ত করার পর তা আবার ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়ায় সিলেটসহ সারাদেশের মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এ বিষয়টিও আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকদের ভাবনায় ফেলে। সরকার কোনমতে সীমান্ত পরিস্থিতিকে শান্ত করে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে। যাতে এটি কোনভাবেই ইস্যু না হয়ে দাঁড়ায়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষকেও নানাভাবে বোঝানো হয় একে একটি দুর্ঘটনা হিসেবে।
শেখ হাসিনা সরকার শহীদ সিপাহীদের জাতীয় মর্যাদায় দাফন ও পুরস্কৃত করা তো দূরে থাক সরকারের একজন মন্ত্রীও রৌমারী পরিদর্শনে যাননি দীর্ঘদিন। এমনকি এ সময় বিডিআর প্রধানসহ বড়াইবাড়ীর বীর জওয়ানদের বদলী করা হয় (শান্তিস্বরূপ)। পাদুয়া এবং রৌমারীর ঘটনা যা-ই হোক না কেন পরবর্তীকালে বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনায় প্রমাণিত হয়েছে আসলে এটি ছিল একটি পাতানো খেলা। একটি ষড়যন্ত্র। বিশেষ করে ভারতীয় পত্র-পত্রিকা ও সংবাদ মাধ্যমের ফাঁস করে দেয়া তথ্যে এই ষড়যন্ত্র নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়। কিন্তু মাঝখানে বড়াইবাড়ী ক্যাম্পের ১১ জন সৈনিক নিজেদের অজ্ঞাতেই এই ষড়যন্ত্র ও পাতানো খেলাটির চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেয়, যা পরবর্তীতে ষড়যন্ত্রকারী উভয় পক্ষের জন্য বুমেরাং হয়ে পড়ে। ষড়যন্ত্রটি হল, ‘সে সময় নির্বাচন যতই নিকটবর্তী হচ্ছিল, আওয়ামী লীগের দুঃশাসন ও চারদলীয় জোটের ক্রমবর্ধমান গণজোয়ারে সরকার ভীত হয়ে পড়েছিল। আর এই ভীতি থেকেই তারা উদ্যোগ নেয়, যে কোনভাবে নির্বাচনে জয়লাভ সম্ভব না হলে নির্বাচন প্রতিরোধ করা। এ লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ বিজেপি সরকার সম্মিলিতভাবে এই ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করে। আওয়ামী লীগের ধারণা ছিল সীমান্তে একটি সঙ্কট সৃষ্টি করা গেলে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে নির্বাচন বাতিল করা যাবে। তা সম্ভব না হলে নিদেনপক্ষে আওয়ামী লীগের গা থেকে ভারত তোষণের দুর্নাম ঘুচবে এবং এন্টিইন্ডিয়ান ভোটগুলো নৌকায় পড়বে। অন্যদিকে কারগিল বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত বিজেপি সরকারও জনগণের দৃষ্টি অন্যত্র সরাতে সক্ষম হবেন। কিন্তু মাঝখানে বাদ সেধেছে বড়াইবাড়ী ক্যাম্পের ১১ জন বীর বিডিআর সদস্য ও স্থানীয় জনগণ-যারা এই ষড়যন্ত্রের কথা জানত না। কারণ ষড়যন্ত্রকারীদের এই ১১ জন দেশপ্রেমিক সৈন্যের বীরত্ব সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না। তাই তারা ষড়যন্ত্রের কথা এই সৈন্যদের জানানো প্রয়োজন মনে করেনি।
লেখক : জিবলু রহমান, সদস্য সচিব, শামসুর রহমান ফাউন্ডেশন, সিলেট
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা সমূহ:
·
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা
· পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক সেনাহত্যার ইতিহাস
[লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে? তাহলে দয়াকরে গবেষণামূলক ও ইতিহাস
ভিত্তিক এই সাইটটি চালিয়ে যেতে সাহায্য করুন। পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার বঞ্চিত
বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী সাইটটি পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার কতৃক চরমভাবে অবহেলিত ও
সুবিধা বঞ্চিত, পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ঠ এনজিও সমূহের একচোখা নীতি, সন্তু লারমা ও
প্রসীত খীসাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম
জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) 'এর নিপিড়িত, নির্যাতিত ও বর্বরতম সন্ত্রাসের নির্মম ও অসহায়
শিকার - পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠির সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে
ক্ষুদ্রতম এক প্রয়াস]