বৃহস্পতিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র আন্দোলনঃ ঐতিহাসিক সূত্র ও বিভিন্ন দল-উপদল

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠালগ্নে চাকমা জাতি দশ বছরব্যাপী প্রতিরোধ আন্দোলনে লিপ্ত ছিল। ব্রিটিশরাজ্যের একটি স্বশাসিত এলাকারূপে পার্বত্য চট্রগ্রামের স্বীকৃতি লাভ ছিল ওই আন্দোলনের লক্ষ্য। উনিশ শতকের শেষ নাগাদ পার্বত্য চট্টগ্রামবাসী পুনরায় সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে। এরই ফলে ১৯০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম অধ্যাদেশ ঘোষিত হয়। ওই অধ্যাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি বিশেষ প্রশাসনিক এলাকা হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়।(১) এই অধ্যাদেশকেই পার্বত্য চট্টগ্রামস্থ জনজাতীর বিদ্রোহী অংশ তাঁদের রক্ষাকবচ মনে করে থাকে। কিন্তু আধুনিক জাতিরাষ্ট্র কাঠামোয় দুই দুইবার স্বাধীন হওয়া একটি রাষ্টে কিভাবে উপনিবেশিক বন্ধোবস্ত কার্যকর থাকতে পারে? এই বোঝাপড়ায় আমরা আজও আসতে পারিনি। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হয়। রাজমোহন দেওয়ানের নেতৃত্বে ১৯১৫ সালে সর্বপ্রথম চাকমা যুবক সমিতি গঠিত হয়। ১৯১৯ সালে ঘনশ্যাম দেওয়ানের নেতৃত্বে গঠিত হয় চাকমা যুবক সংঘ। ১৯২০ সালে কামিনী মোহন দেওয়ান গঠন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসমিতি। প্রায় দু’দশক ধরে এ সংগঠনটি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। ১৯৩৯ সালে যামিনী রঞ্জন দেওয়ান ও স্নেহকুমার চাকমা এ সংগঠনের যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। তখন থেকেই জনসমিতির রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির প্রাক্কালে জনসমিতি পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করার চেষ্টা করে।(২)




পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটো আলাদা রাষ্ট্র ঘোষিত হবার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম পড়ল পাকিস্তান অংশে। তথাপি স্নেহকুমার চাকমার গ্রুপ সেটা মানতে অস্বীকার করে সেখানে ভারতীয় পতাকা উত্তলন করে রাখে। তিনদিন পর নব গঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেখানে অভিযান চালিয়ে পাকিস্তানী পতাকা উত্তলন করে। সেখান থেকে পাহাড়ীদের প্রতি এক ধরণের অবিশ্বাসের সূত্রপাত ঘটে, প্রতিরক্ষা বাহিনীকে দেখা হয় নেতিবাচক দৃষ্টিতে।(৩)

পাকিস্তান আমলে ১৯৫৬ সালে পাহাড়ি ছাত্রদের দাবি আদায় সংক্রান্ত একটি সংগঠন হিল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হয়। ১৯৬৬ সালের ডিসেম্বরে পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতীয় কল্যাণ সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন অনন্ত বিহারী খীসা ও জে বি লারমা। এ সমিতির সমর্থনে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ১৯৭২ সালের ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশের খসড়া সংবিধান প্রণেতাদের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসনের দাবিসহ মোট চার দফা দাবি পেশ করেন। দাবিগুলো ছিল:

(ক) পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসন এবং নিজস্ব আইন পরিষদ গঠন; (খ) সংবিধানে ১৯০০ সালের রেগুলেশনের অনুরূপ সংবিধির অন্তর্ভুক্তি; (গ) উপজাতীয় রাজাদের দপ্তর সংরক্ষণ; (ঘ) ১৯০০ সালের রেগুলেশন সংশোধনের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বিধিনিষেধ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের বসতি স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ। সরকার কর্তৃক এই দাবী প্রত্যাখাত হলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয় এবং জুম্ম জাতীয়তাবাদ ও জুম্মল্যান্ড ধারণা জন্ম নেয়।(২)

পাহাড়িদের স্বার্থ আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠিত হয়। শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পথে দাবি আদায় সম্ভব নয় মনে করে ১৯৭৩ সালে জনসংহতি সমিতির সামরিক শাখা শান্তি বাহিনী গঠিত হয়। সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামকে ছয়টি সামরিক সেক্টরে বিভক্ত করে সদর দফতরকে বিশেষ সেক্টররূপে চিহ্নিত করা হয়। প্রতিটি সেক্টর ৪টি জোনে এবং প্রতিটি জোন কয়েকটি সাব-জোনে বিভক্ত করা হয়। (২)

এখানে যেটা লক্ষ্যণীয়, বাংলাদেশ হবার পর পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা কার্যক্রম শুরু হবার আগেই সেখানে একটি সশস্ত্র রাজনৈতিক বাহিনীর কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে এরকম একটি সামরিক বিচ্ছিন্নতাবাদী ফোর্সকে কোন রাষ্ট্রই মেনে নেয়ার রীতি নেই। তথাপি, কমিউনিস্ট মতাদর্শে উজ্জীবিত এম এন লারমা ও তাঁর সতীর্থরা যে মতাদর্শকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়েছে, সেই আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার ধারণাকে ভিত্তি করেই বাংলাদেশ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্ন-স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্যে সশস্ত্র আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান।(৪)

পার্বত্য চট্টগ্রামে উপস্থিত দল-উপদলঃ

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই জনসংহতি সমিতির অভ্যন্তরে দুটি মতাদর্শ বিদ্যমান ছিল। একদিকে মানবেন্দ্র লারমার নেতৃত্বাধীন বামপন্থী লারমা গ্রুপ, অন্যদিকে প্রীতিকুমার চাকমার নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী প্রীতি গ্রুপ। ১৯৮২ সালের ২৪ অক্টোবর আদর্শগত সংঘাত থেকে শান্তি বাহিনী দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। এর কিছুদিন পর ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের হামলায় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা নিহত হন। এরপর তাঁর ছোট ভাই জোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৮৫ সালের এপ্রিলে প্রীতি গ্রুপের ২৩৬ জন সদস্য সরকারের নিকট আত্মসমর্পণ করলে ঐ গ্রুপের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়।(২)

১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের পর থেকেই শান্তি বাহিনী ভারতের সহযোগীতায় সশস্ত্র লড়াই শুরু করে। পরবর্তী সরকারগুলো বিভিন্ন সময় জনসংহতি সমিতির সাথে আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতায় পৌঁছুতে চেষ্টা করে। ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তির মাধ্যমে সন্তু লারমার নেতৃত্বে শান্তি বাহিনী অস্ত্র সমর্পন করে জনসংহতি সমিতি বৈধ রাজনৈতিক দিল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু জনসংহতি সমিতির ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের বড় একটি অংশ ঐ চুক্তির বিরোধিতা করে ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে বেরিয়ে গিয়ে তৈরি করে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। এর নেতৃত্বে ছিলেন প্রসিত বিকাশ খীসা। দলটি গঠনের পরই জেএসএস'র সঙ্গে তারা সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে।(৫)

যেসব কারণে বাংলাদেশের বাম আন্দোলনে হুটহাট দল উপদল সৃষ্টি হয় প্রায় একই ধরণের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামেও একাধিক দল তৈরি হয়েছে। ২০১০ সালে সন্তু লারমার জেএসএস ভেঙ্গে গঠিত হয় আরেকটি দল জেএসএস (এমএন লারমা বা জেএসএস সংস্কার)। গত বছর নভেম্বর মাসে ইউপিডিএফ থেকে বেরিয়ে গিয়ে গঠিত হয় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)।(৬) এই ধরণের আরো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রুপ রয়েছে। যারা নিজেদের মধ্যেই খুনাখুনি করে থাকে এবং যাদের বিরুদ্ধে রয়েছে ব্যাপক চাঁদাবাজির অভিযোগ।

গতবছর দৈনিক মানবজমিনের এক প্রতিবেদনে গোয়েন্দা সূত্রের বরাতে বলা হয়, ''সমগ্র রাঙ্গামাটি জেলায়, খাগড়াছড়ি জেলার অল্প কিছু এলাকায় এবং বান্দরবানে জেএসএস (সন্তু) গ্রুপের মোটামুটি প্রভাব ও আধিপত্য রয়েছে বলে জানা যায়। অন্যদিকে ইউপিডিএফ’র আধিপত্য রয়েছে সমগ্র খাগড়াছড়ি জেলা, রাঙ্গামাটির কোনো কোনো এলাকা ও বান্দরবানের অল্প পরিমাণ এলাকায়। রিপোর্টে বলা হয়েছে, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে জেএসএস (সংস্কার)-এর মোটামুটি প্রভাব ও আধিপত্য থাকলেও রাঙ্গামাটিতে অল্প পরিমাণে প্রভাব রয়েছে বলে জানা যায়।''(৭)

নোটঃ
(১) বাংলাপিডিয়া, ‘শান্তিবাহিনী’, ৫ মে ২০১৪, https://goo.gl/8fEFfg
(২)শান্তনু মজুমদার, 'পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি', বাংলাপিডিয়া, ৫ মে ২০১৪, https://goo.gl/GRWpyQ
(৩) দেখুন বিস্তারিত; পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকট-পর্ব ১ঃ ১৯৪৭ সালে ভারতীয় পতাকা উত্তলনhttps://www.facebook.com/muldharabd/posts/1555745671155417:0
(৪)পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান সংকটের মূলে আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার ধারণা, https://www.facebook.com/muldharabd/posts/1831046726958642
(৫) প্রথম আলো, ইউপিডিএফ ভেঙে গেল, ১৫ নভেম্বর ২০১৭, https://goo.gl/CJRr1c
(৬) পরিবর্তন.কম, পার্বত্য চট্টগ্রামে দুই দশকে জনসংহতি সমিতি ভেঙে চার সশস্ত্র সংগঠন, নভেম্বর ৩০, ২০১৭, http://www.poriborton.com/national/88397
(৭) মানবজমিন, বিদেশি সশস্ত্র গ্রুপের সঙ্গে জেএসএস ও ইউপিডিএফ-এর সমঝোতা, ২৭ এপ্রিল ২০১৭, http://www.mzamin.com/details-archive2016.php?mzamin=63181

প্রাসঙ্গিক পোস্টঃ
পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকট-পর্ব ১ঃ ১৯৪৭ সালে ভারতীয় পতাকা উত্তলন, পাহাড়ীদের প্রতি বাঙালীদের অবিশ্বাসের সূত্রপাত https://www.facebook.com/muldharabd/posts/1555745671155417:0
পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকট-পর্ব ২ঃ উন্নয়নের বিপর্যয় কাপ্তাই বাঁধ
https://www.facebook.com/muldharabd/posts/1563196870410297


পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা সমূহ:

·      পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা

·     পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক সেনাহত্যার ইতিহাস


[লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে? তাহলে দয়াকরে গবেষণামূলক ও ইতিহাস ভিত্তিক এই সাইটটি চালিয়ে যেতে সাহায্য করুন। পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার বঞ্চিত বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী সাইটটি পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার কতৃক চরমভাবে অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত, পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ঠ এনজিও সমূহের একচোখা নীতি, সন্তু লারমা ও প্রসীত খীসাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) 'এর নিপিড়িত, নির্যাতিত ও বর্বরতম সন্ত্রাসের নির্মম ও অসহায় শিকার - পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠির সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ক্ষুদ্রতম এক প্রয়াস]