মঙ্গলবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৬

কারা বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করলো এবং কার স্বার্থে - পর্ব ৩

three leaders

আগের পর্ব: পর্ব ১ , পর্ব ২  আমরা উল্লেখ করেছি যে, মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা নামে যে পরিকল্পনা পরিচিত তা মূলত রচনা করেছিলেন প্যাটেলের সঙ্গে আলোচনা করে ভি. পি. মেনন [Menon, op cit., 364-5]।
এই পরিকল্পনার সংক্ষিপ্ত খসড়া ১৯৪৬-এর ডিসেম্বরে অথবা ১৯৪৭-এর জানুয়ারিতে প্যাটেলের সঙ্গে আলোচনা করে মেনন তৈরি করেছিলেন।


তাঁরা স্পষ্টই বলেছিলেন যে, খসড়া পরিকল্পনার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল, সেই সময়ে বিভিন্ন জাতিসত্তার যে আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি উঠেছিল- যাকে কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হবার প্রবণতা (“centrifugal tendencis”) বলা হয়েছে- তাকে রোধ করার জন্য একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করা [Ibid., 358-9]। অতএব গণভোটের মাধ্যমে বাংলার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবিকে স্বীকার করার প্রশ্নই ছিল না নেহরু-প্যাটেলদের কাছে।
গণভোট যাতে না হতে পারে, কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হবার প্রবণতাগুলি যাতে শক্তিশালী না হতে পারে, তার জন্য এবং সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদ-বিরোধী শ্রমিক, কৃষক ও জনগণের অন্যান্য অংশকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রয়োজন হয়েছিল যত শীঘ্র সম্ভব ডোমিনিয়ন স্টেটাসের ভিত্তিতে দিল্লীর গদি লাভ করা। নেহরুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু কৃষ্ণ মেনন ১৯৪৭-এর ১৩ই মার্চ মাউন্টব্যাটেনকে এক দীর্ঘ চিঠিতে বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করার  প্রস্তাব দিয়ে লিখেছিলেন,
বিভাগের বিরুদ্ধে বাংলার তুলনামূলকভাবে প্রবল বিরুদ্ধতা আছে। তবু স্থায়িত্বের (stability-র) জন্য দেশবিভাগ-রূপ দাম বাংলাকে দিতে হবে [ Mansergh, N. (Editor-in-Chief), Constitutional Relations between Britain and India: The Transfer of Power 1942-7, সংক্ষেপে(TOP), IX,949]।
প্রশ্ন হচ্ছে, কাদের স্থায়িত্ব? অবশ্যই বিড়লা-গোয়েঙ্কা প্রমুখ বড় মুৎসুদ্দিদের পুঁজির স্থায়িত্ব- তাদের শোষণের স্থায়িত্ব ও বৃদ্ধি। অন্যদিকে, বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করে অসংখ্য বাঙালীর জীবন, বাসভূমি ও ভবিষ্যৎ অস্থায়ী হয়ে গিয়েছিল।
ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার ভারত-বর্মা কমিটিকে মাউন্টব্যাটেন বলেছিলেন :
“বাংলা পৃথক ডোমিনিয়ন হিসাবে থাকতে সক্ষম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সর্বভারতীয় কমনওয়েলথের জরুরি প্রয়োজনের তাগিদে শিখদের মত বাংলার ঐক্যকে অবশ্যই বলি দিতে হবে…”[See Moore, Endgame of Empire, 7,170]।
সাম্রাজ্যবাদ ও তার মুৎসুদ্দিদের যূপকাষ্ঠে বাংলা ও পাঞ্জাবের জনগণকে বলি দেওয়া হয়েছিল। মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হবার পরে ৫ই জুন বি. এম. বিড়লা প্যাটেলকে অভিনন্দন জানিয়ে লিখেছিলেন :
“আপনি যা চেয়েছিলেন সেভাবেই সব ঘটেছে। বাংলাকে বিভিক্ত করার প্রশ্নটাও যে আপনি সমাধান করেছেন তার জন্য আমি খুবই আনন্দিত ” [Durga Das (ed) op cit., IV, 55-6]।
বিড়লা প্রমুখ বড় মুৎসুদ্দিদের অনেক দিনের পরিকল্পনা সফল হলো। যখন অসংখ্য বাঙালীর মনে দুর্ভাবনা, আতঙ্ক ও গভীর নিরানন্দ তখন বড় মুৎসুদ্দিরা আনন্দিত, উৎফুল্ল ও উল্লসিত। ওই চিঠিতেই বি. এম. বিড়লা প্যাটেলের কাছে দুটি সুপারিশ করেছিলেন।
এক, হিন্দু ধর্মকে রাষ্ট্রের ধর্ম হিসাবে গ্রহণ করে হিন্দুস্থানকে হিন্দু রাষ্ট্ররূপে গণ্য করা হোক। দুই, ভবিষ্যৎ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের আইনসভায় কংগ্রেস দলের নেতা (অর্থাৎ মুখমন্ত্রী) হিসাবে শ্যামপ্রসাদকে নির্বাচন করার জন্য কংগ্রেসের কার্যনির্বাহক কমিটি উপযুক্ত উপদেশ পাঠান। (বলা বাহুল্য, শ্যামাপ্রসাদ সারা ভারত হিন্দু মহাসভার সভাপতি ছিলেন ও কংগ্রেসের সাধারণ সদস্যও ছিলেন না) ।
বাংলা বিভাজনের পক্ষে কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের, বিশেষ করে নেহরু, এবং কিছু পণ্ডিতদের একটি যুক্তি উল্লেখ করতে চাই। এঁরা বলেছেন, প্রথমে পৃথক বাংলা রাষ্ট্র হলেও পরে সমগ্র বাংলা পাকিস্তানে চলে যেতো।মুসলিম লীগের তাই ছিল উদ্দেশ্য; অবিভক্ত পৃথক বাংলা রাষ্ট্রের পরিকল্পনা ছিল তাদের একটি কৌশল। শরৎ বোস ও কিছু হিন্দু নেতা দূরদৃষ্টির অভাবে এই কৌশলের শিকার হয়েছিলেন। দেখা যাক এই যুক্তির কী ভিত্তি আছে।
প্রথম, বাংলার প্রতিনিধিস্থানীয় কংগ্রেস নেতারা ও লীগ নেতারা যে সংশোধিত খসড়া সংবিধান রচনা করেন তার প্রথম ধারা ছিল : স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র অবশিষ্ট ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্ক নির্ধারণ করবে। কোনো যুক্তরাষ্ট্রে (অর্থাৎ ভারত বা পাকিস্তানে) যোগদান করতে হলে বাংলার আইনসভার অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন চাই। এই ধারা অবিভক্ত বাংলার পৃথক অস্তিত্বকে অক্ষুণ্ন রাখতো।
দ্বিতীয়, ১৯৪৫-এর সেপ্টেম্বরে নির্বাচনের আগে বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম‘শুরু হোক সংগ্রাম’ (‘Let us go to war’) নামে একটি ইস্তাহার প্রকাশ করেছিলেন। তাতে বলা হয়েছিল :
“স্বাধীন ভারত কখনও এক দেশ ছিল না। স্বাধীন ভারতীয়েরা কখনও এক জাতি ছিল না। অতীতে মোগল ও মৌর্য আধিপত্যে ভারত ছিল অখণ্ড এবং বর্তমানে গ্রেট ব্রিটেনের আধিপত্যে রয়েছে অখণ্ড। স্বাধীন ভারতকে আল্লাহতায়ালা যেমন সৃষ্টি করেছেন সেইভাবে হতে হবে একটি উপমহাদেশ যেখানে প্রতিটি বসবাসকারী জাতি সম্পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করবে। বোম্বাইয়ের পুঁজিপতিদের প্রতি কংগ্রেসের যতই দুর্বলতা থাকুক এবং অখণ্ড ভারতের দোহাই দিয়ে সমগ্র ভারতকে শোষণ করার ক্ষেত্রে তাদের জন্য তাঁরা যতই সুযোগ সৃষ্টি করুণ, প্রতিটি ভারতীয় মুসলিম ভারতে কংগ্রেস কর্তৃক যে কোনো চক্র, গ্রুপ অথবা সংগঠনের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগকে প্রতিরোধ করবে ” [আবুল হাশিম, In Retrospection-এর শাহাবুদ্দীন মুহম্মদ আলী কর্তৃক অনুবাদিত আমার জীবন ও বিভাগপুর্ব বাংলাদেশের রাজনীতি, কলিকাতা, ১৯৯৮, ১৫২] ।
ফজলুল হক প্রমুখ অনেক বাঙালী মুসলমান নেতার মত লীগেরও অনেক নেতা যেমন আবুল হাশিম দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাস করতেন না। ১৯৪৩-এর নভেম্বরে তিনি বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক হবার পরে লীগ বাংলায় আগের থেকে অনেক বেশি সংগঠিত হয়েছিল। বাংলায় লীগের বড় অংশের উপর তাঁর ছিল ব্যাপক প্রভাব। আমরা দেখেছি, ১৯৪০-এর লাহোর প্রস্তাব ছিল মূলত ভারতের উত্তর-পশ্চিমে ও পূর্বে মুসলমান-প্রধান দুটি স্বাধীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব। কিন্তু ১৯৪৬-এর প্রথমদিকে প্রাদেশিক আইনসভাগুলির নির্বাচন শেষ হয়ে যাবার পরে বিভিন্ন আইনসভায় নব-নির্বাচিত লীগ সদস্যদের এক সম্মেলন জিন্না দিল্লীতে আহ্বান করেছিলেন। ৭ই থেকে ১০ই এপ্রিল ১৯৪৮-এ সেই সম্মেলন হয়েছিল। সেখানেই প্রথম জিন্না দুই নয়, এক মুসলিম-প্রধান রাষ্ট্র্রের দাবি পেশ করেন। তার বিরোধিতা করে আবুল হাশিম বলেছিলেন যে, জিন্নার প্রস্তাব বাতিলযোগ্য ও অবৈধ (‘void and ultra vires’), কারণ এই প্রস্তাব লাহোর প্রস্তাবের বিরোধী ও লাহোর প্রস্তাবকে পরিবর্তন করার অধিকার আইনসভার সদস্যদের ছিল না [ঐ, পৃষ্টা ১০০]।
আমরা আগে উল্লেখ করেছি, শরৎ বোসের সঙ্গে ১০ই মে ১৯৪৭-এ আবুল হাশিম যখন হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান থেকে পৃথক অবিভক্ত বাংলা রাষ্ট্রের প্রস্তাব নিয়ে গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন, তখন হাশিম একই ভাষা, একই সংস্কৃতি এবং একই ইতিহাস যা বাংলার হিন্দু ও মুসলমান উভয়কে ঐক্যসূত্রে গ্রথিত করেছিল তার উপর জোর দিয়ে ঐক্যবদ্ধ বাংলার পক্ষে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, হিন্দু হোক বা মুসলমান হোক, একজন বাঙালী বাঙালীই। উভয়েই হাজার মাইলেরও বেশি দূরের পাকিস্তানীদের শাসনকে ঘৃণা করে [Cited in Sunil Das, “The Fateful Partition and the Plan of United Sovereign Bengal ” in Sarat Chandra Bose Commemoration Volume, 79; শাহাবুদ্দীন মুহম্মদ আলী কর্তৃক অনুবাদিত আমার জীবন ও বিভাগপুর্ব বাংলাদেশের রাজনীতি, কলিকাতা, ১৯৯৮, ১৩০]।
বাংলার ব্যাপক মুসলমান নেতা ও কর্মী চেয়েছিলেন কেন্দ্রের শাসন থেকে সম্পূর্ণ স্বশাসিত স্বতন্ত্র রাষ্ট্র যেখানে সব সম্প্রদায়ের মানুষ সৌহার্দ্যের সঙ্গে বাস করবে। আমরা আগে বলেছি, ১৯৪৪ সালে বাংলার গভর্নর কেসি এই কথাই ওয়াভেলকে জানিয়েছিলেন। আমরা আরও উল্লেখ করেছি, ১লা মার্চ ১৯৪৬-এ স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে লেখা অধ্যাপক হোরেস আলেকজান্ডারের চিঠির বক্তব্য। আমরা তা পুনরুল্লেখ করছি। তিনি লিখেছিলেন : উত্তর-পশ্চিম ভারতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে সমগ্র বাংলাকে অথবা পূর্ব বাংলাকে জুড়ে দিতে একজনও বাঙালী মুসলমান আন্তরিকভাবে চান বলে আমি বিশ্বাস করি না। হিন্দুদের মতই সমান দৃঢ়তার সঙ্গে বাঙালী মুসলমানরা শেষ পর্যন্ত তাকে বাধা দেবেন- যদিও আগামী নির্বাচনে মুসলিম লীগ বোধ হয় প্রায় সব আসনে জয়ী হবে [TOP. VI, 109]।
তৃতীয়, ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে, গান্ধীর কাছে আবুল হাশিমের বক্তব্য ও আলেকজান্ডারের ধারণা সম্পূর্ণ সঠিক ছিল। বাংলা ও ভারত-বিভাজনের কিছু পর থেকেই পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের বিদ্রোহের সূচনা হয়। ১৯৫২ সালের শুরুতে এই বিদ্রোহ কিছু বলিষ্ঠতা লাভ করে এবং ১৯৭১-এ তার পরিণতি হয় পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানী শাসনের অবসানে এবং স্বতন্ত্র বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়।
নেহরুদের অভিযোগ যে অবিভক্ত পৃথক বাংলা রাষ্ট্রের পরিকল্পনা সমগ্র বাংলাকে পাকিস্তানে নিয়ে যাবার মুসলমান নেতাদের পাতা একটা ফাঁদ ছিল, তা বাংলার চরম দুর্গতির জন্য তাঁদের দায়িত্বকে ঢাকা দেবার একটা স্বভাবসিদ্ধ অপকৌশল ছাড়া আর কিছু ছিল না। কিছু বাঙালী হিন্দু পণ্ডিত বা অপপণ্ডিত আজও যে নেহরুর সুরে সুর মেলান- সেটা তাঁদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
আমরা আগে দেখেছি, মুসলমান বড় মুৎসুদ্দি ইস্পাহানিও অবিভক্ত স্বতন্ত্র বাংলা রাষ্ট্রের পরিকল্পনাকে একটি ফাঁদ বলেছিলেন। নেহরুদের সঙ্গে তফাত এই যে, তিনি এটিকে হিন্দুদের চক্রান্ত বলেছিলেন। তার মতে, বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও শিক্ষায় ও আর্থিক দিক থেকে অনগ্রসর মুসলমানদের গ্রাস করে ফেলা ছিল হিন্দুদের রচিত এই ফাঁদের উদ্দেশ্য। বিড়লাদের রাজনৈতিক মুখপাত্ররা এবং ইস্পাহানি, দুই বিরোধী পক্ষ, এই পরিকল্পনাকে আক্রমণ করেছিলেন- অবশ্য দুই বিপরীত দিক থেকে। সেটাই স্বাভাবিক। এই পরিকল্পনা দুই মুৎসুদ্দি গোষ্ঠীরই স্বার্থের প্রতিকূল ছিল। বাংলা-বিভাজনে দুইয়েরই স্বার্থ ছিল।
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের গুণগ্রাহী হিন্দু মহাসভার নেতা বলরাজ মাধোক লিখেছিলেন যে, শ্যামাপ্রসাদ বলেছিলেন :
“কংগ্রেস ভারত-বিভাজন করেছিল আর আমি করেছিলাম পাকিস্তান-বিভাজন” [Balraj Madok, “Dr Shyamaprasad Mookerjee”, in S.P.Sen (ed), Dictionary of National Biography, III, Calcutta, 1974, 173]। তিনি দাবি করেছেন যে, বাংলা ও পাঞ্জাবকে ভাগ করে তিনিই পশ্চিম বাংলা ও পূর্ব পাঞ্জাবকে পাকিস্তান থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিলেন।
এ দাবি একান্তই হাস্যকর হতো যদি বাংলা ও পাঞ্জাব-বিভাজন তথা ভারত-বিভাজন এত মর্মান্তিক না হতো। এই বিভাজনে শ্যামাপ্রসাদ ও হিন্দু মহাসভার কী গুরুত্ব ছিল সে সম্বন্ধে বেশি কথা বলা নিষ্প্রয়োজন। সেদিন ভারতবর্ষের রাজনীতিতে তাঁদের গুরুত্বের পরিমাপ কিছুটা হয়েছিল ১৯৪৫-এর শেষের দিকে কেন্দ্রীয় আইনসভার এবং ১৯৪৬-এর প্রথম দিকে প্রাদেশিক আইনসভাগুলোর নির্বাচনে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তাদের গুরুত্ব বুঝতে ভুল করেনি।
সাম্রাজ্যবাদ তার স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখার জন্য কংগ্রেস ও লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গেই আপস করেছিল এবং সেই আপসের ফলেই বাংলা ও পাঞ্জাব-বিভাজন তথা বিভাজন হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে শ্যামাপ্রসাদরা অবান্তর। আমরা দেখেছি, বিড়লা-গান্ধী-নেহরু-প্যাটেলরা দীর্ঘদিন ধরে চেয়েছিলেন হয় অখণ্ড ভারত অথবা বাংলা ও পাঞ্জাবকে চিরে এই দুই প্রদেশের এক এক খণ্ড তাঁদের শাসিত ভারতের সঙ্গে জুড়ে দিতে। দ্বিতীয়টা ছিল তাঁদের ন্যূনতম দাবি। এবং সেই দাবি তাঁরাই আদায় করেছিলেন। (পরে পাকিস্তানকে যাঁরা বিভাজন করেছিলেন তাঁরা হচ্ছেন পূর্ব বাংলার জনগণ-১৯৭১ সালে।)
তবে শ্যামাপ্রসাদদের ভূমিকা কি কিছু ছিল না? অবশ্যই ছিল। যে বিপুল বিরাট নরমেধের আয়োজন হয়েছিল সেদিন, বিড়লা-নেহরু-প্যাটেলদের অনুগামী হয়ে এবং তাঁদের সমর্থন-পুষ্ট হয়ে তাঁরা সেই যজ্ঞে কিছু ইন্ধন যুগিয়েছিলেন। আমরা সেই প্রসঙ্গে আসছি। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন যখন শ্যামাপ্রসাদ পরিচালনা করছিলেন তখন ১৯শে মার্চ ১৯৪৭-এ এক বিবৃতিতে তিনি বলেছিলেন :
“প্রদেশটি যে গুরুতর সাম্প্রদায়িক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে তার একমাত্র শান্তিপূর্ণ সমাধান হচ্ছে বাংলার বিভাজন। এর ফলে যে যে অঞ্চলে বাংলার দুটি প্রধান সম্প্রদায়ের সংখ্যাধিক্য আছে সেখানে তারা নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বিকশিত করার পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করবে, তারা উভয়ই শীঘ্র উপলব্ধি করবে যে, দুটি (প্রস্তাবিত) প্রদেশে সংখ্যালঘুদের পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা উভয়েরই স্বার্থের অনুকূল হবে”[Lar, 1947,1, 48; quoted in Gordon, Brothers against the Raj, 574-5]।
(এখানে উল্লেখযোগ্য যে, হিন্দু জাতীয়তার প্রবক্তারা বাংলার হিন্দু-মুসলমানের একই ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী নন, যদিও রবীন্দ্রনাথ থেকে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এই ঐক্যের কথা বলে গেছেন। গান্ধী, জিন্না, নেহরুরাও সেটা স্বীকার করেছিলেন)।
পরে সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ (যিনি ওই সময় বাংলা প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন ও শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে একযোগে কাজ করছিলেন) এক সাক্ষাৎকারে গর্ডনকে বলেছিলেন যে, শ্যামাপ্রসাদ সেই সময়ে একান্তে বলছিলেন:
এখন আমরা বিভক্ত করি এবং ইংরেজরা চলে যাক। তারপর আমরা সমগ্র অঞ্চল দখল করে নেবো  [Interview with S.M. Ghosh, New Delhi, 26 June 1972, ibid, 575]।
সুরেন্দ্রমোহন ঘোষের এই বক্তব্যের মধ্যে সত্যতা আছে। কারণ, বাংলা-তথা ভারত-বিভাজন ঠিক হয়ে যাবার পরেই হিন্দু মহাসভা কর্তৃক গৃহীত এক প্রস্তাব থেকে মনে হয় শ্যামাপ্রসাদ মাত্র কিছুদিন আগে (১৯শে মার্চ) বাংলা বিভাজনের পক্ষে যে যুক্তি দিয়েছিলেন তা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন এবং ‘যুদ্ধং দেহি’ মনোভাব গ্রহণ করেছিলেন। হিন্দু মহাসভার প্রস্তাবে বলা হয়েছিল :
“…যতক্ষণ না বিচ্ছিন্ন অংশগুলিকে ভারতীয় ইউনিয়নে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে এবং এর অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করা হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত শান্তি আসবে না” [LAR, 1947,1,74 and Bengal Governor’s Reports for first half of June, July and Second half of July, quoted in Gordon,ibid, 586]।
হিন্দু মহাসভা আরও বলেছিল, প্রস্তাবিত এলাকা-বণ্টন ছিল অমুসলমানদের প্রতি অবিচার এবং মহাসভা তার জন্য অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিল। তাছাড়া, তাদের দাবি ছিল
পূর্ববাংলার হিন্দুরা ও জাতীয়তাবাদী মুসলমানরা ভারতীয় নাগরিক হিসাবে স্বীকৃত হোক। তাদের বিশ্বাস ছিল, ভারতীয় ইউনিয়নে পূর্ববাংলাকে ফিরিয়ে আনা মাত্র সময়ের প্রশ্ন [Ibid., 587]।
কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারাও নিশ্চিত ছিলেন, পূর্ববাংলা তথা পাকিস্তান হিন্দুস্থানে ফিরে আসতে বাধ্য হবে।  প্যাটেলও এই বক্তব্য রেখেছিলেন যে,
শক্তিশালী কেন্দ্রের অধীনে ভারতবর্ষ এত ক্ষমতাসম্পন্ন হবে যে পাকিস্তানকে শীঘ্রই তাঁরা ফিরে পাবেন [G. M. Mandurkar (ed.), Sardar Patel-In Tune with the Millions, I (Birth-Centenary Volume II), Ahmedabad, 1975, 5-9: see also Leonard Mosley, The Last Days of the British Raj, 107]।
(চলবে)           শেষ পর্ব
লিখেছেনঃ  সুনীতি কুমার ঘোষ
উৎসঃ  সুনীতি কুমার ঘোষ, কারা বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করলো এবং কার স্বার্থে, হাসান আজিজুল হক (সম্পাদিত), বঙ্গ বাংলা বাংলাদেশ, সময় প্রকাশন, ২০১২ (পৃষ্ঠা ২৭৩-২৭৮)

পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা সমূহ:

·      পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা

·     পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক সেনাহত্যার ইতিহাস


[লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে? তাহলে দয়াকরে গবেষণামূলক ও ইতিহাস ভিত্তিক এই সাইটটি চালিয়ে যেতে সাহায্য করুন। পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার বঞ্চিত বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী সাইটটি পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার কতৃক চরমভাবে অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত, পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ঠ এনজিও সমূহের একচোখা নীতি, সন্তু লারমা ও প্রসীত খীসাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) 'এর নিপিড়িত, নির্যাতিত ও বর্বরতম সন্ত্রাসের নির্মম ও অসহায় শিকার - পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠির সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ক্ষুদ্রতম এক প্রয়াস]