সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় ‘সার্বভৌমত্ব বিরোধী’ পার্বত্য চুক্তি করে আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য বাঙালীর মনে যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল ‘আদিবাসী’ বিষয়ে সরকারের কঠোর ও সঠিক অবস্থান সেই ক্ষতে প্রলেপ লাগিয়েছিল অনেকখানি। কিন্তু গত ৩ জুন হঠাৎ করেই আওয়ামী লীগ সরকার জেএসএস নেতা সন্তু লারমার দাবী পার্বত্য ভ’মি কমিশনের সংশোধনী প্রস্তাব পাশ করে ক্ষতটি খুচিয়ে আবার রক্তাক্ত করে দিল। ফলে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্ধেক জনগোষ্ঠী বাঙালীরা। ইতোমধ্যে তারা ৫ দিন নজিরবিহীন সফল হরতাল পালন করছে। সামনে আরো কঠিন কর্মসূচী আসছে। এদিকে বাঙালীদের এই কর্মসূচীর বিরুদ্ধে প্রথমে চুপচাপ থাকলেও ধীরে ধীরে মাঠে নামতে শুরু করেছে পাহাড়ী বিভিন্ন সংগঠন। ফলে আগামী দিনে ভয়াবহ জাতিগত দাঙ্গা ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দিকে পরিস্থিতি ধাবিত হচ্ছে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, ক্ষমতার শেষ দিকে এসে হঠাৎ করে সরকার কেন এই ধরনের একটি বিতর্কিত ও সংবেদনশীল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিল? পাহাড় সংশ্লিষ্টদের ধারণা, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে ও এর আওতায় ভূমি কমিশন আইন সংশোধনী অনুমোদন বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সক্রিয় বিভিন্ন পাশ্চাত্যের দেশ, দাতা সংস্থা ও খ্রিস্টান মিশনারীদের প্রবল চাপ ছিল। ড. ইউনূস, পদ্মা সেতুসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে কোণঠাসা সরকার পাশ্চাত্যে তার আন্তর্জাতিক ভাবমর্যাদা উদ্ধার করতেই ক্ষমতার শেষদিকে এসে এ ধরণের একটি সংবেদনশীল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার মধ্যে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি স্বাক্ষরের সময় উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চুক্তির ঘ খণ্ডের ৪ নং ধারায় প্রত্যাবাসিত উপজাতীয়দের পুনর্বাসনের সহায়তায় তাদের ভূমির মালিকানা ফিরিয়ে দিতে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি ভূমি কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয় এবং ২ নং ধারায় ‘যথাশীঘ্র সম্ভব ভূমি জরীপ কাজ শুরু’ করার কথা বলা হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় এই চুক্তি ও আইনের সংশ্লিষ্ট ধারাপাঠ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই আলোচনার সুবিধার্থে এই আইনের সংশ্লিষ্ট কয়েকটি ধারা উল্লেখ করা হলো: শান্তিচুক্তির ঘ খণ্ডের ৪ নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘জায়গা-জমি বিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তিকল্পে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি কমিশন(ল্যান্ডকমিশন) গঠিত হইবে। পুনর্বাসিত শরণার্থীদের জমি জমা বিষয়ক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি করা ছাড়াও এ যাবত যেইসব জায়গা জমি ও পাহাড় অবৈধভাবে বন্দোবস্ত ও বেদখল হইয়াছে সেই সমস্ত জমি ও পাহাড়ের মালিকানা স্বত্ব বাতিলকরণের পূর্ণ ক্ষমতা এই কমিশনের থাকিবে। এই কমিশনের রায়ের বিরুদ্ধে কোনো আপীল চলিবে না এবং এই কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলিয়া বিবেচিত হইবে। ফ্রীঞ্জল্যান্ডের(জলে ভাসা জমি) ক্ষেত্রে ইহা প্রযোজ্য হইবে।’
৬(খ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি করিবেন।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভূমির বৈশিষ্ট বিবেচনায় ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির আগে ভূমি জরীপ সম্পন্ন হওয়া জরুরী ছিল। ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে একাধিকবার এ বিষয়ে সরকারকে তাগিদ দেয়া হয়েছিল। তাদের যুক্তি ছিল আগে ভূমি জরীপ করে ভূমির সীমানা ও মালিকানা নির্ধারণ করার পর বিরোধিত জমির সিদ্ধান্ত ভূমি কমিশনের কাছে হস্তান্তর করা হোক। কিন্তু উপজাতীয় সংগঠনগুলোর প্রবল বিরোধিতার কারণে ভূমি জরীপ নিষ্পন্ন করা যায়নি। এভাবে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলে সরকার বিভিন্ন পক্ষের চাপের মুখে ভূমি জরীপ ছাড়াই ২০০১ সালের ১৭ জুলাই ভূমি কমিশন আইন পাস করে। এরপরও ভূমি জরীপ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কিন্তু নিরাপত্তার কারণে বা অজুহাতে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
এখানে পরবর্তী আলোচনার সুবিধার্থে ভূমি কমিশন আইনের কয়েকটি ধারা উল্লেখ করা হলো:
‘৩। কমিশনের গঠন : (১) এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন নামে একটি কমিশন থাকিবে।
(২) নিম্নবর্ণিত সদস্যগণ সমন্বয়ে কমিশন গঠিত হইবে, যথা :
(ক) বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, যিনি উহার চেয়ারম্যানও হইবেন,
(খ) সার্কেল চীফ (সংশ্লিষ্ট),
(গ) আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান বা তাহার প্রতিনিধি হিসেবে তৎকর্তৃক মনোনীত উক্ত পরিষদের একজন সদস্য,
(ঘ) সংশ্লিষ্ট পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, পদাধিকারবলে,
(ঙ) চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় কশিনার বা তৎকর্তৃক মনোনীত একজন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার।
ব্যাখ্যা : দফা (গ) এবং (ঘ)-এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে ‘সংশ্লিষ্ট’ অর্থ বিরোধীয় ভূমি যথাক্রমে যে পার্বত্য জেলা এবং যে সার্কেলের অন্তর্ভুক্ত সেই পার্বত্য জেলা এবং সেই সার্কেল।
৬। কমিশনের কার্যাবলী ও ক্ষমতা : (১) কমিশনের কার্যাবলী নিম্নরূপ হইবে, যথা :
(ক) পুনর্বাসিত শরণার্থীদের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন ও রীতি অনুযায়ী নিষ্পত্তি করা,
(খ) আবেদনে উল্লিখিত ভূমিতে আবেদনকারী বা ক্ষেত্রমত সংশ্লিষ্ট প্রতিপক্ষের স্বত্ব বা অন্যবিধ অধিকার পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন ও রীতি অনুযায়ী নির্ধারণ এবং প্রয়োজনবোধে দখল পুনর্বহাল,
(গ) পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আইন-বহির্ভূতভাবে কোনো ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান করা হইয়া থাকিলে উহা বাতিলকরণ এবং উক্ত বন্দোবস্তজনিত কারণে কোনো বৈধ মালিক ভূমি হইতে বেদখল হইয়া থাকিলে তাহার দখল পুনর্বহাল :
তবে শর্ত থাকে যে, প্রযোজ্য আইনের অধীনে অধিগ্রহণকৃত ভূমি এবং রক্ষিত (Reserved) বনাঞ্চল, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা, বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ এলাকা, রাষ্ট্রীয় মালিকাধীন শিল্প কারখানা ও সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নামে রেকর্ডকৃত ভূমির ক্ষেত্রে এই উপ-ধারা প্রযোজ্য হইবে না।
১৬। কমিশনের সিদ্ধান্তের আইনগত প্রকৃতি এবং চূড়ান্ত। ধারা ৬(১)-এ বর্ণিত কোনো বিষয়ে দাখিলকৃত আবেদনের উপর কমিশন প্রদত্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ানী আদালতের ডিক্রি বলিয়া গণ্য হইবে, তবে উক্ত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো আদালত বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের নিকট আপিল বা রিভিশন দায়ের বা উহার বৈধতা সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।
১৭। কমিশনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন।- (১) অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন কমিশনের সিদ্ধান্ত দেওয়ানী আদালতের ডিক্রি বা ক্ষেত্রমতো আদেশের ন্যায় উহার কর্মকর্তা ও কর্মচারীর মাধ্যমে বা প্রয়োজনবোধে সরকারি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করিতে বা করাইতে পারিবে।’
কিন্তু শুরু থেকেই এই আইনের বিরোধিতা করে আসছিলেন জেএসএস নেতা সন্তু লারমাসহ কিছু উপজাতীয় নেতা। তাদের বিরোধিতার কারণেই সরকার গঠিত চারটি ভূমি কমিশন কার্যকর হতে পারেনি। সন্তু লারমার দাবী, শান্তি চুক্তির একটি লিখিত ফর্ম ও একটি অলিখিত ফর্ম(সাধারণ সমঝোতা) ছিল। তিনি সেভাবেই ভূমি কমিশন সংস্কারের লক্ষ্যে ২৩ দফা সংস্কার প্রস্তাব করেন। অনেক আলাপ আলোচনার পর ২০১২ সালের ৩০ জুলাই সরকার এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে এর ১৩টি প্রস্তাব গ্রহণ করে।
কিন্তু সে সময় পার্বত্য বাঙালীরা এর বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন গড়ে তুললে সরকার সে সংশোধনী অনুমোদন করা থেকে বিরত থাকে। এ ঘটনার প্রায় ৯ মাস পর পার্বত্য সচিব নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে নতুন করে এ সংশোধনী অনুমোদনের উদ্যোগ নেয়। ফলে ২৭ মে মন্ত্রী সভায় সংশোধনীর খসড়া প্রস্তাব ও ৩ জুন চূড়ান্ত প্রস্তাব পাশ করা হয়।
উল্লেখযোগ্য সংশোধনীসমূহ:
ধারা ৬(১)ক : “পুনর্বাসিত শরণার্থীদের জমি-জমা বিষয়ক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি করা ছাড়াও অবৈধভাবে বন্দোবস্ত ও বেদখল হওয়া জায়গা জমি ও পাহাড়ের মালিকানাস্বত্ত্ব বাতিলকরণসহ সমস্ত ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী নিষ্পত্তি করা।”
ধারা ৬(১)(গ) : “পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি বহির্ভূতভাবে ফ্রীঞ্জল্যান্ড (জলেভাসা জমি)সহ কোন ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান এবং বন্দোবস্তজনিত কারণে কোন বৈধ মালিক ভূমি হইতে বেদখল হইয়া থাকিলে তাহার দখল পুনর্বহাল:” শব্দাবলী প্রতিস্থাপন করা।
ধারা ৭ এর (৫) : “চেয়ারম্যান উপস্থিত অন্যান্য সদস্যদের সহিত আলোচনার ভিত্তিতে ৬(১)-এ বর্ণিত বিষয়টিসহ উহার এখতিয়ারভুক্ত অন্যান্য বিষয়ে সর্বসম্মতির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবেন, তবে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে উপনীত সম্ভব না হইলে চেয়ারম্যানসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের গৃহীত সিদ্ধান্তই কমিশনের সিদ্ধান্ত বলিয়া গণ্য হইবে;।”
১৩(২) ধারার পরে নতুন উপধারা সংযোজন : “(৩) এই ধারার অধীন কমিশনের সচিব এবং অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে পার্বত্য জেলার উপজাতীয়দের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করা হইবে।”
এ সংশোধনী পাশের পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালীরা হরতাল অবোরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করে আসছে। তাদের দাবী, এই প্রস্তাব পাশ করা হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালীর অবস্থান ও অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। এসকল কর্মসূচী সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে যে বিপূল স্বতস্ফুতর্তার সাথে পালিত হয়েছে তাতে প্রমাণ করে দলমত নির্বিশেষে পার্বত্য বাঙালীরা কিভাবে দেখছে এই আইনকে।
এখানে উল্লেখ্য যে, ইতোমধ্যে বাংলাদেশের হাইকোর্টে শান্তিচুক্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একটি রীট দায়ের করা হয়েছিল। দীর্ঘ শুনানীর পর ২০০৯ সালে আদালত সম্পূর্ণ চুক্তিকে বাতিল না করে এর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ধারাকে বাংলাদেশের সংবিধান, ও সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রিয় অখণ্ডতা বিরোধী বলে তা বাতিল ঘোষণা করে। কিন্তু সরকার এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীমকোর্টে আপীল করলে সুপ্রীমকোর্ট আপীল গ্রহণ করে রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত ঘোষণা করে। সংবাদপত্রের রিপোর্ট সূত্রে জানা গিয়েছিল, সেই রীটের শুনানীতে আদালতে ভূমি কমিশন প্রসঙ্গ এলে সরকার পক্ষ থেকে বলা হয়ছিল, এখনো সরকার ভূমি কমিশন বাস্তবায়ন করছেনা বরং ভূমি জরিপের পর কমিশন কাজ করবে। কাজেই এটা নিয়ে এখনই আলোচনার কিছু নেই। এ কথার প্রেক্ষিতে আদালতও যখন ভূমি কমিশন বাস্তবায়ন হবে তখন এ বিষয় নিয়ে ভাবা যাবে বলে মন্তব্য।
পার্বত্য ভূমি কমিশন আইন সংশোধনী বিশ্লেষণের আগে শান্তি চুক্তি ও ভুমি কমিশন আইনের কয়েকটি ধারা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন।
১. শান্তিচুক্তিতে ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসাবে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির কথা বলা হলেও ভূমি কমিশন আইনে বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির কথা বলা হয়।
২. শান্তিচুক্তির ঘ খণ্ডের ৪ নং ধারায় কেবলমাত্র ‘ পুনর্বাসিত শরণার্থিদের জমি জমা বিষয়ক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি’র কথা বলা হয়েছে। একইভাবে ভূমি কমিশন আইনের ৬(ক) ধারায়ও ‘পুনর্বাসিত শরণার্থীদের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন ও রীতি অনুযায়ী নিষ্পত্তি করা’র কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ আইন অনুযায়ী কেবল পুনর্বাসিত শরণার্থিদের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি এর দায়িত্ব। এখানে পার্বত্য অঞ্চলের বৃহৎ জনগোষ্ঠী বাঙালীদের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ নেই।
৩. শান্তিচুক্তির ৬(খ). ধারায় বলা হয়েছে, কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি করিবেন। আবার আইনের ৬(গ) ধারায় বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আইন বহির্ভুতভাবে কোন ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান করা হইয়া থাকিলে উহা বাতিলকরণ এবং উক্ত বন্দোবস্তজনিত কারণে কোন বৈধ মালিক ভূমি হইতে বেদখল হইয়া থাকিলে তাহার দখল পুনর্বহাল। সংশোধনীতে তা বলা হয়েছে, ধারা ৬(১)(গ) : “পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি বহির্ভুতভাবে ফ্রীঞ্জল্যান্ড (জলেভাসা জমি)সহ কোন ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান এবং বন্দোবস্তজনিত কারণে কোন বৈধ মালিক ভূমি হইতে বেদখল হইয়া থাকিলে তাহার দখল পুনর্বহাল:” শব্দাবলী প্রতিস্থাপন করা।
অর্থাৎ এই ভূমি কমিশন কাজ করবে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন অনুযায়ী। বাংলাদেশর আইন অনুযায়ী নয়। এর সাথে স্থানীয় ‘রীতি’ ও ‘পদ্ধতি’ শব্দটিও যুক্ত করা হয়েছে। এখানে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন’, ‘রীতি’ ও ‘পদ্ধতি’ শব্দগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের অখণ্ডতা, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, সংবিধান, সরকারের কৃর্তৃত্ব ও বাঙালীর অস্তিত্বের স্বার্থে খুবই গুরুত্বপুর্ণ।
৪. চুক্তির ঘ খন্ডের ৪ নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘কমিশনের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল চলিবেনা’। অন্যদিকে ভূমি কমিশন আইনের ১৬ নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘ উক্ত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোন আদালত বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষের নিকট আপীল বা রিভিশন দায়ের বা উহার বৈধতা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’ এখানে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের কর্তৃত্ব, ক্ষমতা ও এখতিয়ারকে খর্ব করা হয়েছে।
৫. আইনের ১৬ নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘বর্ণিত কোন বিষয়ে দাখিলকৃত আবেদনের উপর কমিশন প্রদত্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ানী আদালতের ডিক্রী বলিয়া গণ্য হইবে।’ দেওয়ানী আদালত একটি সাংবিধানিক আদালত। এর বিচারপতিগণ বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও সংবিধান রক্ষায় শপথবদ্ধ থাকেন। অন্যদিকে কমিশনের প্রধান ও অন্যান্য সদস্যরা কেউই শপথবদ্ধ নন। চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি হওয়ায় তিনি শপথবদ্ধ নন, আবার বাকি সদস্যরা সাধারণ উপজাতীয়, যারা হয়তো চুক্তির আগে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন এমন কেউ হতে পারেন, অথচ তারা শপথবদ্ধ নন। প্রকৃতপক্ষে আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদ থেকে যে নামগুলো আসবে তাদের জেএসএস ও ইউপিডিএফ’র বর্তমান বা সাবেক ও প্রকাশ্য বা গোপন সদস্য হবার সম্ভাবনাই বেশী।
গত ১৬ জুন পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধনী-২০১৩ জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছেন ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা। বিলটি উপস্থাপনের আগে বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্য জাফরুল ইসলাম চৌধুরী বিলের উপর আপত্তি দিয়ে বিলটি সংসদে উপস্থাপন না করার জন্য স্পিকারকে অনুরোধ করেন। সংসদ সদস্যের আপত্তির মুখে স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী বিলটি কণ্ঠ ভোটে দেন। বিলটিতে সরকার দলীয় সংসদীয় সদস্যরা হ্যাঁ ভোট ও বিরোধী দলীয় জোট সদস্যরা না ভোট দিলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতায় হ্যাঁ ভোট জয়যুক্ত হলে বিলটি সংসদে উপস্থাপন করেন ভূমিমন্ত্রী।
বিলটি উপস্থাপনের পর বিলটি পরীক্ষা নীরিক্ষা করে ৭দিন পর সংসদে উপস্থাপনের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে প্রেরনের জন্য স্পিকার কণ্ঠভোটে দেন। বিরোধী দলীয় সদস্যরা না ভোট দিলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিলটি ভূমি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটিতে প্রেরিত হয়। সে হিসাবে আগামী ২৩ জুন সংসদে পরীক্ষিত বিলটি চুড়ান্তভাবে পাশের জন্য উপস্থাপিত হওয়ার কথা।
১৭৫৭ সালের এই ২৩ জুনে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার ভাগ্য বিপর্যয় ঘটেছিল। ২৫৫ বছর পর আরেক ২৩ জুনে পার্বত্য বাঙালীর ভাগ্য নির্ধারিত হতে পারে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে। শুধু বাঙালীর নয় বাংলাদেশের ভাগ্যও হয়তো এ দিনেই লেখা হতে পারে। কারণ এই সংশোধনী প্রস্তাবে এমন কিছু ধারা রয়েছে যা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক।
পার্বত্য চুক্তির ঘ খন্ডের ৪ নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘কমিশনের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল চলিবেনা’। অন্যদিকে ভূমি কমিশন আইনের ১৬ নং ধারায় বলা হয়েছে,‘ উক্ত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোন আদালত বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষের নিকট আপীল বা রিভিশন দায়ের বা উহার বৈধতা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’ এখানে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের কর্তৃত্ব, ক্ষমতা ও এখতিয়ারকে খর্ব করা হয়েছে এবং একই সাথে তা সংবিধান বিরোধী। কারণ বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার খণ্ডে ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী।’ কিন্তু পার্বত্য চুক্তি ও ভূমি কমিশন আইনের ফলে সেখানকার অধিবাসীরা কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপীল করতে পারবেন না। কমিশন ও এর আইন উপজাতি ঘেঁষা হওয়ায় সেখানে বৈষম্যের শিকার হবেন পার্বত্য বাঙালীরা।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী ও পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেনা।’ কিন্তু কমিশনে সদস্য, সচিব ও কর্মচারী নিয়োগের বেলায় এই বৈষম্য প্রকটাকারে পরিদৃষ্ট।
এখানে কেউ কেউ হয়তো সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদ, ২৯(৩)(ক) ধারা উল্লেখ করে ‘নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশের’ জন্য সংবিধানের উল্লিখিত ধারার বিশেষ রেয়াতের সুবিধা নিতে চাইবেন। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশের’ মধ্যে ৮৭% শিক্ষিত চাকমারা পড়েন কিনা তা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ভেবে দেখতে হবে। একই সাথে যুগ যুগ ধরে বৈষম্যের শিকার পার্বত্য বাঙালীরা কোন বিবেচনায় ‘অগ্রসর’ জনগোষ্ঠীভুক্ত হলেন তাও রাষ্ট্রকে তদন্ত করে দেখতে হবে। কারণ, শিক্ষাদীক্ষা, চাকুরী ও অবস্থানগত সুবিধার কারণে শুধু বাঙালী নয় উপজাতীয় অন্যসকল গোত্র শোষিত হচ্ছে চাকমাদের দ্বারা। পার্বত্যাঞ্চলের জন্য রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাকিতভাবে বরাদ্দকৃত কোটাসহ সকল প্রদত্ত সুবিধা ভোগ করছে চাকমা জনগোষ্ঠী। পারফেক্টলি বললে বলতে হয়, চাকমা সমাজের কয়েকটি গোত্র মাত্র। অন্যসকল উপজাতি এ সুবিধার সামান্যই ভোগ করতে পারে।
একইভাবে পার্বত্য চুক্তি ও ভূমি কমিশনের উল্লিখিত ধারা বাংলাদেশ হাইকোর্ট ও সুপ্রীম কোর্টের এখতিয়ারকে খর্ব করে। সংবিধানের ১০১, ১০২(২) এর উপধারা (অ), (আ), ও ১০৯ ধারার সাথে তা সরাসরি সাংঘর্ষিক।
শান্তিচুক্তির ঘ খণ্ডে ৪ নং ধারায় কেবলমাত্র ‘ পুনর্বাসিত শরণার্থীদের জমিজমা বিষয়ক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি’র কথা বলা হয়েছে। একইভাবে ভূমি কমিশন আইনের ৬(ক) ধারায়ও ‘পুনর্বাসিত শরণার্থীদের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন ও রীতি অনুযায়ী নিষ্পত্তি করা’র কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ চুক্তি ও আইন অনুযায়ী কেবল পুনর্বাসিত শরণার্থীদের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করাই এ কমিশনের দায়িত্ব। এখানে পার্বত্য অঞ্চলের বৃহৎ জনগোষ্ঠী বাঙালীদের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ নেই। কাজেই বাঙালীদের কোনো কোনো সংগঠন তাদের দাবীতে ভূমি কমিশনে সমানুপাতিক হারে বাঙালী সদস্য রাখার যে দাবী তুলছে তা, হয় আইন না জানা কিংবা না বোঝার ফল অথবা আপসকামিতার দৃষ্টান্ত। ভূমি কমিশনে সমানুপাতিক হারে কেন, সকল সদস্যই বাঙালী হলেও তাতে বাঙালীদের উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই যদি বিদ্যমান আইন বহাল থাকে। অর্থাৎ কমিশন সদস্যরা বিচার করবেন যে আইনে, সে আইন যতক্ষণ পর্যন্ত বাঙালী ও দেশের স্বার্থের অনুকূল না হবে, সে পর্যন্ত এই কমিশন বাঙালীর স্বার্থ বিরোধী হয়েই থাকবে। অন্য কথায় ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন’ উপজাতীয়দের ‘ঐতিহ্য’ ‘রীতি’ ও ‘পদ্ধতি’ অনুযায়ী বিচার পরিচালিত হলে কমিশনের সদস্য বাঙালী হলেও তাদের কিছুই করার থাকবে না। কারণ বিচার আইন অনুযায়ী পরিচালিত হবে।
চুক্তির ৬(খ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কমিশন ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন’, ‘রীতি’ ও ‘পদ্ধতি’ অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি করিবেন’। আবার কমিশন আইনের ৬(গ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আইন বহির্ভুতভাবে কোন ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান করা হইয়া থাকিলে উহা বাতিলকরণ এবং উক্ত বন্দোবস্তজনিত কারণে কোন বৈধ মালিক ভূমি হইতে বেদখল হইয়া থাকিলে তাহার দখল পুনর্বহাল।’ সংশোধনীর ধারা ৬(১)(গ) তে বলা হয়েছে, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি বহির্ভুতভাবে ফ্রীঞ্জল্যান্ড (জলেভাসা জমি)সহ কোন ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান এবং বন্দোবস্তজনিত কারণে কোন বৈধ মালিক ভূমি হইতে বেদখল হইয়া থাকিলে তাহার দখল পুনর্বহাল শব্দাবলী প্রতিস্থাপন করা’।
অর্থাৎ এই ভূমি কমিশন কাজ করবে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন অনুযায়ী। বাংলাদেশর আইন অনুযায়ী নয়। এর সাথে স্থানীয় ‘রীতি’ ও ‘পদ্ধতি’ শব্দটিও যুক্ত করা হয়েছে। এখানে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন’, ‘রীতি’ ও ‘পদ্ধতি’ শব্দগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের অখণ্ডতা, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, সংবিধান, সরকারের কৃর্তৃত্ব ও বাঙালীর অস্তিত্বের স্বার্থে খুবই গুরুত্বপুর্ণ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন বলতে পার্বত্য ভূমি কমিশন আইনের ২(ছ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রচলিত আইন বলিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে এই আইন বলবৎ হইবার পূর্বে যে সমস্ত আইন, ঐতিহ্য, বিধি, প্রজ্ঞাপন প্রচলিত ছিল কেবলমাত্র সেইগুলিকে বুঝাইবে।’অর্থাৎ ২০০১ সালের পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আইন বোঝাবে।
এখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন বলতে আমরা কয়েকটি আইনের অস্তিত্ব দেখতে পাই। এর মধ্যে ১৯০০ সালে ব্রিটিশ সরকার প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি- পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বপ্রথম আইন। দুটি বিশেষ কারণে ব্রিটিশ সরকার এই আইন করেছিল বলে মনে করা হয়। ১. পার্বত্য জনগোষ্ঠীর বিশেষ প্রবণতার প্রতি লক্ষ্য করে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও ২. কর আদায়।
প্রথম কারণে বিট্রিশ সরকার এ আইনে বিপুল ক্ষমতা দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সুপারিন্টেন্ডেট নামে একটি পদ সৃষ্টি করে-যা পরে ডেপুটি কমিশনার নামে পরিচিত হয়। দ্বিতীয় কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনটি সার্কেল প্রধান বা রাজার অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়া হয়। যদিও সুপারিন্টেন্ডেন্ট পদটি এসেছে ১৮৬০ সালের আইন থেকে, ১৮৮১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্ত পুলিশ বিধি প্রণয়েনের মাধ্যমে পাহাড়ীদের মধ্য থেকে একটি পুলিশ বাহিনী গঠনের ক্ষমতা দেয়া হয়।
এ সব মিলেই ১৯০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি প্রণয়ন করা হয। মূলত কর আদায়ের সুবিধার্থে সেখানে রাষ্ট্রিয় কাঠামোর মধ্যে কারবারী আদালত, হেডম্যান আদালত ও সার্কেল চীফ আদালত গঠন করা হয়। কর, ভূমি ও সামাজিক সমস্যা নিরসনে পার্বত্য বাসিন্দারা প্রথম কারবারী আদালতে বিচার প্রার্থনা করবে, কারবারী আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হেডম্যান আদালতে এবং হেডম্যান আদালতের বিরুদ্ধে সার্কেল চীফের আদালতে আপীল করার ব্যবস্থা রয়েছে। আবার সার্কেল চীফের রায়ের বিরুদ্ধে ডেপুটি কমিশনারের কাছে আপীল করা যাবে। তবে ডেপুটি কমিশনারকে পার্বত্য রীতি, ঐতিহ্য ও পদ্ধতি সম্পর্কে সার্কেল চীফের পরামর্শ গ্রহণ করার বিধান রাখা হয়। তবে ব্রিটিশদের এই আইনে পার্বত্য চট্টগ্রামে হেডম্যানের অনুমতি ছাড়া অস্থানীয় কাউকে ভূমি বরাদ্দ বা ভূমি অধিগ্রহণ করার সুযোগ রাখা হয়নি।
ব্রিটিশদের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল একটি বহির্ভূত রাজ্য এলাকা। কর আদায়ই ছিল তাদের মূখ্য উদ্দেশ্য। ফলে ১৯০০ সালে প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রবিধানে তার প্রভাব পড়ে। ব্রিটিশ আইনটি পাহাড়ী জনগোষ্ঠী জন্য কোনো অনুকূল আইন ছিলনা। কারণ এই আইনের মাধ্যমেই পাহাড়ের ভূমি পাহাড়ীদের হাত থেকে দলিল ও বন্দোবস্তির নামে সরকারের হাতে চলে যায়। অর্থাৎ পাহাড়ের মালিকানা পাহাড়িদের পরিবর্তে সরকারের হাতে চলে যায়। কিন্তু রাজা হিসাবে সার্কেল চীফরা বহাল থাকায় তারা এই আইনের প্রতিবাদ করেনি। এটি ছিল ব্রিটিশের ডিভাইড এ- রুল পলিসির অংশ বিশেষ।
প্রতিকূল আইন হওয়া সত্ত্বেও আজ পাহাড়ীরা ১৯০০ সালের ব্রিটিশ প্রবিধানকে ধন্য ধন্য করছেন তার একমাত্র কারণ এই আইনে পাহাড়ে বাইরের লোকদের পাহাড়ে পুনর্বাসন ও জমির বন্দোবস্তি পাহাড়ীদের হাতে ছিল বলে। এ ছাড়া এই আইনে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসন স্বীকার করে নেয়া হয়।
অন্যদিকে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর এটি যখন রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত হয় তখন এই আইন তাদের পক্ষে আত্মিকরণ করা সম্ভব ছিলনা। বিশেষ করে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট যখন ভারত ভাগ হয় এবং পার্বত্য প্রভাবশালী জনগোষ্ঠী রাঙামাটিতে ভারতীয় পতাকা ও বান্দরবানে বার্মার পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন। সে পতাকা বেশ কিছুদিন যাবত পাকিস্তানে উড়েছিল।
১৭ আগস্ট র্যাডক্লিফ রায় প্রকাশিত হবার পর ২১ আগস্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেই পতাকা নামিয়ে ফেলে। ১৭ আগস্ট রায়ের পরও পাহাড়ীরা প্রতিবাদ জানিয়েছিল রায়ের বিরুদ্ধে। এ প্রেক্ষিতে পাকিস্তান সরকার ১৯০০ সালে প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রবিধানমালা- পাকিস্তানের রাষ্ট্রিয় কাঠামোতে অনুমোদন দেননি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্বশাসনকে মেনে নেননি। বরং ১৯৫৮ সালে ভূমি অধিগ্রহণের নিমিত্তে আরেকটি নতুন প্রজ্ঞাপন জারী করেন। এই প্রজ্ঞাপনের আওতায় ভূমি অধিগ্রহণ করে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরী করা হয়। এটিও পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বেশ কিছু উপজাতীয় সদস্য অংশগ্রহণ করলেও বর্তমান চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়ের পিতা ত্রিদিব রায় ও বোমাং রাজার এক ভাই পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিলেন। ত্রিদিব রায় আজীবন পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য পোষণ করে গত বছর পাকিস্তানেই মারা গেছেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানেও পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্বশাসন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি- ১৯০০ কে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। তবে এরশাদ সরকারের শাসনামলে ১৯৮৯ সালে ব্রিটিশ বিধি অনুসরণে জেলা পরিষদ আইন সৃষ্টি করা হয়। এ আইনে জমি বন্দোবস্তি হেডম্যানদের হাত থেকে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের হাতে অপর্ণ করা হয়। তবে আইন অনুযায়ী জেলা পরিষদ চেয়াম্যান অবশ্যই একজন উপজাতীয় হবেন।
তবে অনেকেই এখন ১৯০০ সালে প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন বলে প্রচার করতে চাইছেন। কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামোতে এই বিধি গ্রহণের সুযোগ নেই। প্রথমত, এই বিধি একটি উপনিবেশিক ধারণা সঞ্জাত আইন। দ্বিতীয়ত, এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্বশাসনকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। সেকারণে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোতে এই বিধিকে গ্রহণ করা হয়নি। এখন যদি এই বিধি অনুসরণ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধান করা হয় তাহলে আইনগতভাবেই পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বায়ত্বশাসনের পথে এগিয়ে যাবে। কারণ এ বিধির উৎস ও পরিণতি সন্ধান করলেই এ কথা পরিস্কার বোঝা যাবে। এ বিষয়ে তথ্য প্রমাণ আমাদের হাতে রয়েছে। তবে এ লেখায় সেই দীর্ঘ আলোচনার সুযোগ নেই।
এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত ‘রীতি’, ‘পদ্ধতি’ ও ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত ‘রীতি’, ‘পদ্ধতি’ ও ‘ঐতিহ্য’ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও লিখিত কোনো দলিল পাওয়া যায়না। মূলত এটি কতকগুলো ধারণা ও আচারের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত রীতি, পদ্ধতি ও ‘ঐতিহ্য’ বলতে উপজাতীয়দের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রীতি, পদ্ধতি ও ঐতিহ্যকে বোঝায়। ভূমির ক্ষেত্রে এই রীতি, ঐতিহ্য ও পদ্ধতি হচ্ছে: পাহাড়ীরা ভূমির ক্ষেত্রে ব্যক্তি মালিকানা, দলিল দস্তাবেজে বিশ্বাসী নয়। তাদের কাছে ভূমি সামষ্টিক অধিকার। পাহাড়ের জমি হচ্ছে সর্বসাধারণের সম্পত্তি। যার মালিক হচ্ছে জনগোষ্ঠী, জ্ঞাতিগোষ্ঠী এমনকি তাদের প্রেত লোকের সদস্যরাও। একক পরিবারগুলো জমি ব্যবহারের অধিকার ভোগ করে থাকে মাত্র। ফলে পাহাড়ীরা মনে করে জমি সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এর মালিক তারাই।
জুম চাষের জন্য তারা প্রত্যেক বছর এক স্থান থেকে অন্য স্থনে বসতি স্থানান্তর করে থাকে। কাজেই বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন স্থানে যেখানে তারা জুম চাষ করেছে, বসতি গড়েছে সে জমি তাদের, আগামীতেও যে সকল জমি তাদের চাষের আওতায় আসতে পারে সে সকল জমিও তাদের। পাহাড়ের রীতি অনুযায়ী যে জমিতে তারা চাষাবাদ করেছে/করবে, যে জমি/পাহাড়/বন থেকে তারা আহার সংগ্রহ করেছে, করে বা করবে। যে জমিতে তারা বসতি স্থাপন করেছিল/করেছে/করতে পারে, যে জমি দিয়ে তারা চলাচলের জন্য ব্যবহার করে থাকে, যে জমি থেকে তাদের পোষা প্রাণী খাবার সংগ্রহ করে থাকে, যে জমি তার দৃষ্টি সীমায়, স্বপ্ন ও কল্পনায় তা তাদের সকলের। এখানে নির্দিষ্ট মালিকানা বা দলিলের অস্তিত্ব নেই।
কাজেই এই রীতি বা ঐতিহ্য বা পদ্ধতি অনুযায়ী যদি ভূমি কমিশন বিচার করে সে ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালীর অস্তিত্ব ও জাতীয় সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে বাধ্য।
আইনের ১৬ নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘বর্ণিত কোন বিষয়ে দাখিলকৃত আবেদনের উপর কমিশন প্রদত্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ানী আদালতের ডিক্রী বলিয়া গণ্য হইবে।’ দেওয়ানী আদালত একটি সাংবিধানিক আদালত। এর বিচারপতিগণ বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও সংবিধান রক্ষায় শপথবদ্ধ থাকেন। অন্যদিকে কমিশনের প্রধান ও অন্যান্য সদস্যরা কেউই শপথবদ্ধ নন। চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি হওয়ায় তিনিও শপথবদ্ধ নন, আবার বাকি সদস্যরা সাধারণ উপজাতীয় যারা হয়তো চুক্তির আগে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন এমন কেউ হতে পারে। বিশেষ করে জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ থেকে যাদের নাম আসবে তাদের ক্ষেত্রে সাবেক শান্তিবাহিনীর সদস্য আসা স্বাভাবিক অথচ তারা শপথবদ্ধ নন। হতে পারে তারা ইউপিডিএফ ও জেএসএস এর সামরিক শাখার গোপন সদস্য।
এছাড়াও অতীতে কোনো মামলা যদি দেওয়ানী আদালতে নিষ্পত্তি হয়ে থাকে, বা দেওয়ানী আদালতে চলমান কোনো মামলা যদি এই কমিশনের দৃষ্টিগোচর হয় তাহলে কমিশনের ভূমিকা কি হবে তা স্পষ্ট নয়। কিম্বা একই মামলা একপক্ষ কমিশনে এবং অন্যপক্ষ দেওয়ানী আদালতে বিচার প্রার্থনা করলে কমিশনের ভূমিকা কি হবে তাও স্পষ্ট নয়। দেওয়ানী আদালত ও কমিশনের মধ্যে কার অবস্থান ঊর্ধ্বে তাও পরিষ্কার নয়। সাংবিধানিক আদালতকে অসাংবিধানিক চুক্তির আওতায় গঠিত কমিশনের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া যায় কিনা সে প্রশ্নটিও বিশাল।
তাহলে সরকার কি করবে? শান্তিচুক্তির মধ্যে কিছু অসাংবিধানিক ধারা যে বিদ্যমান তা উচ্চ আদালতের রায় দ্বারা স্বীকৃত। যদিও সে রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত অবস্থায় রয়েছে। তবে উপরিউক্ত আলোচনায় এ কথা প্রমাণিত যে, ভূমি কমিশন তেমনি একটি ধারা বা আইন। বিষয়টি উচ্চ আদালতের দৃষ্টিতে নিলে তা বাতিল হতে বাধ্য বলে অনেক আইনজ্ঞ মনে করেন। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা মোকাবেলায় সরকারের করণীয় হলো, শান্তিচুক্তির ভূমি কমিশন সংক্রান্ত ধারা ও ভূমি কমিশন আইন বাতিল করে দেশের প্রচলিত দেওয়ানী আদালতে এ সমস্যার সমাধান করা। মামলা দ্রুততর করা ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটানোর ক্ষেত্রে সরকার একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ঘোষণা করতে পারে। তবে তার আগে অবশ্যই ভূমি জরীপের মাধ্যমে ভূমির সীমানা ও মালিকানা নির্ধারণ করতে হবে। নিরাপত্তার অজুহাতে যদি ভূমি জরীপ না করা হয়, বা করা সম্ভব না হয় তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তার জন্য বিশাল আয়োজনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
মনে রাখা প্রয়োজন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অংশ। এখানে যা কিছু করা হবে তা দেশের প্রচলিত সংবিধান ও আইন মেনেই করতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে গেলেই সমতলের অনেক বিজ্ঞজনকে বলতে শোনা যায়, ওটা তো পাহাড়িদের এলাকা। ওখানে বাঙালি নেয়া হলো কেন? বাঙালিরাই ওখানে যত সমস্যা সৃষ্টি করছে এবং এ কারণে তারা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকেও দায়ী করে থাকেন। কিন্তু আসলেই কি তাই? পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল সমস্যার মূলে কি বাঙালিরা? প্রেসিডেন্ট জিয়াই কি একা বাঙালি পুনর্বাসনের ‘অপরাধ’ করেছেন?
আলোচনার প্রথমেই একটি কথা বলা প্রয়োজন, বাঙালিরা ‘তাড়া খেয়ে’, ‘পালিয়ে’, ‘যাযাবর হয়ে’ বা কারো ‘দয়ায়’ পার্বত্য চট্টগ্রামে যায়নি। কারণ, বাঙালিদের জীবনধারণের উপযোগী স্থান সেটি নয়। কাজেই স্বেচ্ছায় তাদের সেখানে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তা সত্ত্বেও আদিকাল থেকে সেখানে বাঙালীদের যাতায়াত ও বসবাস ছিল। অত:পর বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে নেয়া হয়েছে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে। রাষ্ট্রের প্রয়োজন মেটাতেই বাঙালিরা সেখানে বসবাস করতে গিয়েছে। গিয়ে মশা, ম্যালেরিয়া ও সাপের কামড়ে, শান্তিবাহিনীর আক্রমণে অনেকেই জীবন বিলিয়ে দিয়েছে। পাহাড়কে আবাদ করেছে, মানুষের বাসযোগ্য করেছে, পর্যটকদের কাছে আকর্ষনীয় করেছে, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করেছে। বাঙালিরা যদি এই ত্যাগ স্বীকার করে সেখানে না যেতো, না থাকতো তা হলে কি হতো?
সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল নুরউদ্দীন সংসদে পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, বাংলাদেশের এই অংশ বহু পূর্বেই হাতছাড়া হয়ে যেত। শুধু এরা দু’জনই নন, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকের আরো অনেকে এ কথা বলেছেন। কাজেই এ কথা পরিষ্কার যে, বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে গমন, অবস্থান ও আত্মদান রাষ্ট্রের প্রয়োজনে, রাষ্ট্রিয় সার্বভৌমত্বের স্বার্থে।
ইতিহাস থেকে আমরা দেখতে পাই, পার্বত্য চট্টগ্রামের যে প্রাচীন মানচিত্র সেখানে বাঙালিরা সুপ্রাচীন কাল থেকেই বসবাস করতো। এর বাইরেও মোগল আমলে, ব্রিটিশ আমলে বাঙালিদের সেখানে গমনের ইতিহাস পাওয়া যায়। তবে ১৯০০ সালের শাসন বিধি পাস হওয়ার পর বাঙালিদের আর সেখানে গিয়ে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ ছিল না। পাকিস্তান আমলে উন্নয়ন কর্মকা- পরিচালনা বিশেষ করে কাপ্তাই বাঁধের কাজ করার জন্য প্রচুর সংখ্যক সেনা সদস্যও বাঙালিকে সেখানে পুনর্বাসন করা হয়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তো মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার মুখের উপর তাদের দাবিনামা ছুড়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘লারমা বেশি বাড়াবাড়ি করিস না। তোরা কি মনে করেছিস, তোদের সংখ্যা ৪-৫ লাখ। প্রয়োজনে পনেরো, বিশ লাখ বাঙালি পাঠিয়ে তোদের উচ্ছেদ করে দেবো। …তোরা সব বাঙালি হয়ে যা।’ দলিলপত্র ঘাটলে দেখা যায়, পাকিস্তান আমলের মতো করে সেসময়ও বাঙালি ও সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়েছিল।
কিন্তু পার্থক্য এই যে, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময় তা ব্যাপকভাবে হয়েছিল এবং জিয়াউর রহমানকেও সেটা করতে হয়েছিল রাষ্ট্রের বিশেষ প্রয়োজনে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ইন্দিরা গান্ধী ভারতের অভ্যন্তরে শান্তিবাহিনীর প্রশ্রয় ও মদদ বৃদ্ধি করেন। নতুন পৃষ্ঠপোষকতায় শক্তিশালী হয়ে শান্তিবাহিনী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জেরালো যুদ্ধ শুরু করে। তাছাড়া ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট যখন ভারত ভাগ হয় তখন পার্বত্য প্রভাবশালী জনগোষ্ঠী রাঙামাটিতে ভারতীয় পতাকা ও বান্দরবানে বার্মার পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন। সে পতাকা বেশ কিছুদিন ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে উড়েছিল। ১৭ আগস্ট র্যাডক্লিফ রেয়োদাদ রায় প্রকাশিত হবার পর ২১ আগস্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেই পতাকা নামিয়ে ফেলে। ১৭ আগস্ট র্যাডক্লিফের রায়ের পরও পাহাড়িরা প্রতিবাদ জানিয়েছিল রায়ের বিরুদ্ধে। সেই বিশেষ প্রেক্ষাপটে সেনাপ্রধান ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে জিয়াউর রহমানের পক্ষে ইতিহাসের এ ঘটনাবলী বিবেচনায় না নিয়ে উপায় ছিল না। এ প্রেক্ষাপটে বাধ্য হয়েই জিয়াউর রহমানকে অতিরিক্ত সৈন্য ও বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রেরণ করতে হয়েছিল।
এছাড়াও জিয়াউর রহমান এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংকের সহায়তায় ১৯৭৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড গঠন করে সেখানে যোগাযোগসহ বিভিন্ন সেক্টরে বিপুল উন্নয়ন কর্মকা- পরিচালনা করেন। কিন্তু পাহাড়িরা এই কাজে অভ্যস্ত বা অভিজ্ঞ ছিল না। ফলে উন্নয়ন কাজ সমাধা করার জন্য বাঙালি প্রকৌশলী, ঠিকাদার ও শ্রমিক প্রয়োজন হয়। শ্রমিকদের পক্ষে গহীন পাহাড় অরণ্যে কাজ করে দিনে দিনে ফিরে আসা সম্ভব ছিলনা। ফলে নিকটবর্তী স্থানে তাদের বসতি গড়তে হয়। কোনো পাহাড়ি শ্রমিক সরকারের কাজে সহায়তা করতে চাইলেও পারতো না শান্তিবাহিনীর হুমকির মুখে। কারণ পাহাড়িরা সে সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন বিরোধী ছিল।
অনেক ক্ষেত্রেই সে পরিস্থিতি আজো বদলায়নি। সন্তু লারমা এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশকিছু উন্নয়ন কর্মকা-ের বিরোধিতা করছেন। বাঙালি ছাত্র ও শিক্ষকরা পড়তে যাবে এই ভয়েই তার এ বাধা। এখনো সরকারি উন্নয়ন কর্মকা-ে কিছু পাহাড়ি ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার পাওয়া গেলেও শ্রমিকদের অধিকাংশই বাঙালি। বাঙালি শ্রমিক ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের এই অবকাঠামোগত উন্নয়ন সম্ভব ছিল না। কাজেই আজকে যে পার্বত্য চট্টগ্রামের সৌন্দর্য দেখে দেশি বিদেশি পর্যটকরা মুগ্ধ হন তার পেছনে রয়েছে বাঙালির শ্রম, ঘাম, রক্ত ও আত্মদান। এখানেই শেষ নয়; শিক্ষা, বৃক্ষরোপণ, উন্নত চাষাবাদ ও নাগরিক জীবনের অভিজ্ঞতাও পাহাড়িরা পেয়েছে বাঙালির কাছ থেকেই।
সরকার যদি বাঙালিদের সেখান থেকে ফিরিয়ে আনে তাতে বাঙালিদের ক্ষতি সামান্যই। কারণ সরকারকেই তাদের সকল সুবিধা ও পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে সমতলে পুনর্বাসন করতে হবে। কিন্তু পাহাড় থেকে যদি বাঙালিরা চলে আসে, তাহলে সেখানে সরকারের সকল উন্নয়ন কর্মকা- থেমে যাবে। পাহাড়ের নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে ‘জুম্ম’ নামক স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিদার সন্ত্রাসীদের হাতে। কাজেই বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থান তাদের নিজেদের স্বার্থে ও প্রয়োজনে নয়, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে একথা যারা বুঝতে চান না তাদের দেশপ্রেমিক বলার খুব বেশি সুযোগ নেই।
যাইহোক, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানও চেষ্টা করেছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার শান্তিপূর্ণ ও রাজনৈতিক সমাধান করতে। ১৯৭৭ সালে তিনি ট্রাইবাল কনভেনশন গঠন করেছিলেন। তিনি এমএন লারমা ও সন্তু লারমার ভগ্নীপতি ও সংসদ সদস্য উপেন্দ্রলাল চাকমাকে মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ করেছিলেন জনসংহতির সাথে আলোচনার জন্য। তিনি রাঙামাটিতে এ নিয়ে রুদ্ধদ্বার আলোচনাও করেছিলেন। শুভেচ্ছার নিদর্শন স্বরূপ অনেকের আপত্তি সত্ত্বেও বন্দি সন্তু লারমাকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন ১৯৮০ সালে। কিন্তু মুক্ত সন্তু লারমা শান্তির পথে না গিয়ে মুক্তি পেয়েই ভারতে পালিয়ে যান এবং সেনাবাহিনী ও বাঙালিদের উপর আক্রমণ শুরু করেন। ফলে জিয়াউর রহমানের আমলে শান্তির সুবর্ণ সুযোগটি নষ্ট হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দেয়াই যথেষ্ট। জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ৩০ মে শহীদ হন আর পরের মাসে ২০ হাজার পাহাড়ি ভারতে চলে যায় বলে অভিযোগ করা হয়। অর্থাৎ সাধারণ পাহাড়িদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও তিনি সতর্ক ছিলেন।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর ভারত পার্বত্য সমস্যাটির আন্তর্জাতিককীকরণের প্রক্রিয়া শুরু করে। ফলে প্রয়োজন হয় শরণার্থীর। ভারতের পৃষ্ঠপোষকতায় শান্তিবাহিনী আরো আক্রমণ শুরু করে পাহাড়ি ও বাঙালি গ্রামগুলোতে। শান্তিবাহিনী পাহাড়িদের ভারতে শরণার্থী হয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। যারা যেতে রাজি হয়নি তাদের পার্শবর্তী গ্রামগুলোতে এমনভাবে হামলা করে যাতে বাঙালিরা পাল্টা আঘাত দিতে পাহাড়ি গ্রামগুলোতে হামলা চালাতে বাধ্য হয়। এভাবেই শান্তিবাহিনী নিরীহ পাহাড়িদের ভারতে শরণার্থী হতে বাধ্য করে।
শান্তিবাহিনীর এ প্রক্রিয়া রোধ করতেই এরশাদ সরকার গুচ্ছগ্রাম সৃষ্টি করে নিরাপত্তার আওতায় বাঙালি ও পাহাড়িদের নিয়ে আসে। এ প্রক্রিয়ায় বাঙালিদের জন্য ১০৯টি গুচ্ছগ্রামে ৩১ হাজার ৬২০ পরিবারের এক লাখ ৩৬ হাজার ২৫৭ ব্যক্তিকে জায়গা-জমি দিয়ে পুনর্বাসন করা হয়। এতে বাঙালিরা নিরাপত্তা পেলেও সরকার প্রদত্ত তাদের বসত ভিটা ও চাষের জমি হারাতে হয়। সেই আশির দশকের শেষভাগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বাঙালিরা আর তাদের সেই বসত ভিটা ও আবাদী জমি ফেরত পায়নি। প্রতিবছর খাজনা দিয়ে ডিসি অফিসের খাতায় জমির দখল সত্ত্ব বহাল রাখলেও তাতে বসত করা, আবাদ করা সম্ভব হয় না। কারণ জমিতে চাষাবাদে গেলেই পাহাড়িরা তাদের উপর হামলা করে। পাহাড়ীদের মতে, পাহাড়ের সকল জমিই তাদের। বাঙালীদের অনেক জমি পাহাড়িরা দখল করে নিয়েছে। কোনো জমি দখল করে উঠেছে বৌদ্ধদের কিয়াং- যা সরানোর ক্ষমতা বাঙালি তো দূরের কথা রাষ্ট্রের পক্ষে দুঃসাধ্য। কারণ সে দিকে চোখ দিলেই ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, চীন, থাইল্যা-, বার্মা, ই-িয়াতে মিছিল শুরু হয়ে যাবে সাথে সাথে। বাঙালিদের ভূমিহীন করার কৌশল হিসাবে তাদের জমির খাজনা আবার পাহাড়ি হেডম্যানরা নেয় না, ডিসি অফিসে দিতে হয়।
এরশাদ সরকার শান্তিবাহিনীর হাত থেকে রক্ষাকল্পে গুচ্ছগ্রামের আদলে চাকমাদের জন্য ১৬টি শান্তিগ্রাম ও মারমা, ত্রিপুরাদের জন্য ৮০টি বড়গ্রাম স্থাপন করেছিল। কিন্তু শান্তিবাহিনীর অব্যাহত হুমকির মুখে সেসব গ্রামের উপজাতীয় বাসিন্দাদের একটি বড় অংশ ভারতে শরণার্থী হয়ে যেতে বাধ্য হয়, অন্যদের কেউ অন্যত্র, কেউ নিজ জমিতে ফিরে বসতি স্থাপন করে। তবে রেশন দেবার দিন এসে রেশন গ্রহণ করতো বহুদিন। ১৯৫০-৬০ সালের মধ্যে ব্রিটিশরা মালয়ে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছিল। সেই মডেল থেকেই এরশাদ সরকার গুচ্ছগ্রামের ধারণা নিয়েছিল বলে মনে করা হয়।
গুচ্ছগ্রামে সরকার পরিবার প্রতি একটি ২০ ফুট বাই ২০ ফুট ঘর, মাসিক ৮৫ কেজি চাল বরাদ্দ দিয়েছিল ১৯৮৮ সালে। তারপর থেকে সেই পরিবার ভেঙে পুত্র ও নাতির পরিবার হয়েছে। ঘর ও রেশন সেই একই রয়ে গেছে। এখন ৮৫ কেজি চালের পরিবর্তে ৩০ কেজি চাল ও ৫৫ কেজি গম দেয়া হয়। তাও আবার ৩ মাস পরপর। গুচ্ছগ্রামের ২০ ফিট বাই ২০ ফিট ঘরের মধ্যে বাবা, মা, ছেলে, মেয়ে, পুত্রবধূ, জামাই, নাতিদের নিয়ে একসাথে জেলখানার ‘ইলিশ ফাইলের’ মতো করে বসবাস করে বাঙালিরা। এরমধ্যে আবার বাঁধা থাকে গবাদি পশু। বাইরে রাখলে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের দ্বারা চুরি হবার ভয়ে ঐ ছোট্ট ঘরের মধ্যেই রাখতে হয় তাদের।
বসতবাড়ি ও ভিটার জমিতে খাজনা দিয়েও তাদের এই মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়। পরিবার যতোই আলাদা হোক ৮৫ কেজি চাল/গমের বরাদ্দ ও কার্ড সংখ্যা এখনো শুরুর দিনের মতোই। জরুরি প্রয়োজনে গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দারা কারো কাছে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কার্ড বন্ধকি রেখে টাকা নেয়। ফলে ঐ সময় কার্ডের রেশন সুবিধা গ্রহণ করে কার্ড বহনকারী। সেই দিনগুলো ঐ পরিবারের কাটে অমানবিক কষ্টে। শিক্ষা, চিকিৎসা, স্বাস্থ্য- জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলোর নূন্যতম উপস্থিতি নেই গুচ্ছগ্রামে।
প্রতি মাসেই একাধিক আন্তর্জাতিক টিম পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিদর্শন করে কিন্তু গুচ্ছগ্রামের বাঙালিদের কথা শোনার কোনো আগ্রহ নেই তাদের। এমনকি সক্রিয় আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ও মিশনারী সংস্থাগুলোরও গুচ্ছগ্রামের বাঙালিদের দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। পাহাড়িদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, ও অর্থ নিয়ে ঘুরছে ইউএনডিপি, এমএসএফ, ড্যানিডা, ডিএফএইডি প্রভৃতি। কিন্তু গুচ্ছ গ্রামের বাঙালিদের নিয়ে কোনো প্রকল্প করলে অর্থ দেয় না কোনো দাতা সংস্থা বা এনজিও। অর্থ পেলেও এমন এনজিও’র রেজিস্ট্রেশন দেয় না আঞ্চলিক পরিষদ। এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্টে পাতার পর পাতা ভরে পাহাড়িদের দুঃখ কষ্টের কথা লেখা হলেও তার একটি শব্দও খরচ হয় না গুচ্ছগ্রামের বাঙালিদের জন্য। তারা যেন মানুষ নয়, তাদের যেন কোনো মানবাধিকার থাকতে নেই। তবে হ্যাঁ, যদি তাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে পুনর্বাসনের কথা বলা হয়, তাহলে প্রচুর টাকা মিলবে সে ঘোষণাও দিয়ে রেখেছে এইসব মতলববাজ, একচোখা ও চক্রান্তকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। কারণ তাতে তাদের আসল উদ্দেশ্য সফল হবে।
শুধু বিদেশিদের দোষ দিয়ে কি লাভ! পার্বত্য বাঙালিদের জন্য বিমাতাসুলভ আচরণে পিছিয়ে নেই সরকারও। যে সরকার নিজের প্রয়োজনে একদিন সমতল থকে বাঙালিদের নিয়ে পাহাড়ে পুনর্বাসন করেছিল, আজ সেই সরকারই তাদের সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ করছে।
সমতলের বাঙালীরা খুব খুশী মনে সেখানে যায়নি। কারণ পাহাড়ের জলবায়ু, ভূমিরূপ ও ফুড চেইন তাদের বসবাসের জন্য উপযোগী নয়। পাহাড়ীদের খাবার তাদের বাসস্থানের পাশের পাহাড়ের জঙ্গলের লতা পাতা, পশুপাখি, পোকামাকড়ে চলে যায়। কিন্তু বাঙালীরা তো এমন খাবারে অভ্যস্ত নয়। কাজেই সমতলের বাঙালীদের পূনর্বাসনের পর প্রথমদিকে পাহাড়ে বসবাস কতোটা কষ্টষাধ্য ছিল তা বিবেকবান মানুষমাত্রই অনুধাবন করবেন। তবু রাষ্ট্রের প্রয়োজনে তারা সেখানে থেকে গেছে। কিন্তু সেই রাষ্ট্রই যখন তাদের জাতীয় পরিচিতি কেড়ে নিল, তখন পাহাড়ের বাঙালীরা প্রকৃতপক্ষে নিজভূমে পরবাসী হয়ে পড়ল। শান্তিচুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র তাদের ‘বাঙালী’ পরিচয় মুছে দিয়ে অদ্ভুত নতুন এক পরিচয়ে লিখল ‘অউপজাতীয়’। এ পরিচয়ে পাহাড়ে তারা অচ্ছুৎ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। আরো বিস্ময়ের কথা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২৪ বছর সংগ্রাম করে যে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যে বঙ্গবন্ধু পাহাড়িদের বাঙালি হতে বলেছিলেন, তার কন্যা শেখ হাসিনার হাতে পার্বত্য বাঙালিদের ‘বাঙালি’ পরিচয়ের অপমৃত্যু ঘটেছে। বঙ্গবন্ধু পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীগুলো থেকে তাদের পরিচয় কেড়ে নিতে চেয়েছিলেন এই অজুহাতে ৪২ বছর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে হাজার দশেক পাহাড়ি সন্ত্রাসী। কিন্তু বাঙালিত্ব হারিয়ে বাঙালিরা বেদনায় মূহ্যমান হলেও পাহাড়িদের মতো অস্ত্র হাতে তুলে নেয়নি। তারপরও বাঙালিদের প্রতি সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণ এতোটুকু কমেনি।
পাহাড়ে ব্যবসা করতে গেলে বাঙালিদের কর দিতে হয়, উপজাতিদের দিতে হয় না। উপজাতিদের ব্যাংকের সুদ ৫%, বাঙালিদের ১৬%। দুই লাখ টাকার নিচের ঠিকাদারী ব্যবসা একচেটিয়া পাহাড়িদের, তার উপরের কাজগুলোরও ১০% পাহাড়িদের জন্য নির্ধারিত। বাকি ৯০ ভাগ ওপেন টেন্ডারে করা হয়। পাহাড়ে এসআই পর্যন্ত পুলিশের সকল চাকরির নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে। জাতীয়ভাবেও চাকুরীতে ৫% কোটা তাদের জন্য। বিসিএসসহ অন্যান্য সরকারি চাকরিতে একই অবস্থা। বাংলাদেশের খ্যাতনামা এনজিও ও বিদেশি দূতাবাসগুলোতে চাকরির ক্ষেত্রে তাদের রয়েছে অগ্রাধিকার। একজন পার্বত্য বাঙালি ছাত্র ডাবল জিপিএ ফাইভ পেয়েও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে না। অন্যদিকে এ বা তার নিচের গ্রেড পেয়ে পাহাড়িরা বুয়েট-মেডিক্যালে চান্স পাচ্ছে। নানা সুবিধায় ওদের জন্য বিদেশে শিক্ষা ও চাকরির দ্বার অবারিত। কিন্তু গুচ্ছগ্রামের বাঙালি শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে অর্ধেক বই পড়ে, বাকি অর্ধেক বইয়ের সরকারি বরাদ্দ নেই। মাদ্রাসা/স্কুলের বেতন দিতে হয় রেশনের চাল/গম থেকে। পাহাড়ের সরকারি চাকরি পাহাড়িদের একচেটিয়া অধিকার। পার্বত্য বাঙালিদের বঞ্চনার কথা লিখতে গেলে একটা বই হয়ে যাবে।
আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারের মুখে পাহাড়িদের পুনর্বাসনে নানা উদ্যোগ ও পরিকল্পনার কথা শোনা যায়, কিন্তু গুচ্ছগ্রামের বাঙালিদের পুনর্বাসনে কোনো কথা শোনা যায় না কারো মুখে। সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর স্বার্থ দেখভালের জন্য একটা মন্ত্রণালয় করেছে। তারাও দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধকারী পাহাড়িদের পুনর্বাসনে গলদঘর্ম। কিন্তু দেশের স্বার্থে আত্মদানকারী বাঙালিদের পুনর্বাসনে কোনো উদ্যোগ নেই সেখানে। উল্টো ভূমি কমিশনের নামে এমন এক ব্যবস্থা চালু করেছে যাতে বাঙালিরা পাহাড় ছেড়ে একবারে চলে আসতে বাধ্য হয়। গত ২৫ বছরে গুচ্ছগ্রামের বাঙালিদের আবাদী জমি, বসতভিটা ফিরিয়ে দেয়ার কোনো উদ্যোগ সরকারকে নিতে দেখা যায়নি। এমনকি তাদের মানবিক ও মৌলিক জীবন যাপনের সুবিধা নিশ্চিত করতেও কেউ এগিয়ে আসেনি।
পার্বত্য বাঙালিদের এই বঞ্চনার কথা সমতলের বাঙালি তথা দেশবাসী খুব সামান্যই জানে। ফলে জাতীয় ইস্যুতে, জাতীয় রাজনীতিতে তাদের বঞ্চনার কথা বলা হয় না। জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর কেন্দ্রীয় কমিটিতে পার্বত্য বাঙালিদের ঠাঁই হয় না। এমনকি স্থানীয় কমিটির উচ্চপদে তার ঠাঁই খুব বেশী হয়না। এমনকি যে জিয়াউর রহমানের আহ্বানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি গড়েছিল বাঙালিরা, সেই জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিন পার্বত্য জেলার ৫ জন নেতা ঠাঁই পেলেও তার একজনও বাঙালি নয়। ফলে বাঙালির স্বার্থে অন্যদলগুলোতো বটেই বিএনপির বাঙালি নেতারাও কথা বলতে পারে না সিনিয়রদের চাপে। ঢাকায় পার্বত্য বাঙালিদের সেমিনারে কোনো বিএনপি নেতা আসতে ভয় পান এজন্য যে, পাহাড়ি নেতারা এসে যদি তার বিরুদ্ধে নেত্রীর কাছে নালিশ করে। যদিও খুব সামান্য পাহাড়িরাই বিএনপিতে ভোট দেয়।
সমতলের ‘রাজাকারদের’ গাড়িতে পতাকা তোলা নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে অনেক কথা বলা হয়। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের আমৃত্যু রাজাকারের পুত্রের গাড়িতে পতাকা উঠেছে, এমনকি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধকারী, বাঙালি ও সেনাবাহিনী হত্যাকারী সন্ত্রাসীদের গাড়িতে পতাকা উড়েছে, তা নিয়ে কোনো কথা বলা হয় না।
দু’একটি গণমাধ্যম ছাড়া দেশের অধিকাংশ গণমাধ্যম বাঙালীদেরকে পার্বত্যাঞ্চলের আপদ বলেই ভাবে। বুদ্ধিজীবীদের বেশিরভাগ অংশই বিদেশ সফর, ‘সুশীল’ খাতায় নাম তোলার প্রয়োজনে ও টুয়েসডে, থার্সডে পার্টিতে নিমন্ত্রণ হারানোর ভয়ে বাঙালির পক্ষে কথা বলতে নারাজ। বাংলাদেশের খুব বিখ্যাত একজন রাজনীতিক ও কলামিস্ট আমাকে একবার বলেছিলেন, একটি জাতীয় সেমিনারে পার্বত্য বাঙালিদের পক্ষে বক্তব্য দিয়ে বাসায় ফেরার সাথে সাথে একটি প্রভাবশালী পাশ্চাত্য দেশের দূতাবাস থেকে তার কাছে ফোন করে জানতে চাওয়া হয় তিনি বাঙালিদের পক্ষে ঐ সেমিনারে কোনো কথা বলেছিলেন কিনা?
বাঙালিদের বিরুদ্ধে লিখলে সাংবাদিকদের বিদেশ সফরসহ নানা সুবিধা মেলে সেখানে, পক্ষে লিখলে ততোটাই অবহেলা ও ঝুঁকির শিকার হতে হয়। সেখানে দায়িত্বরত সরকারি কর্মকর্তাদের প্রমোশন ও বিদেশে পোস্টিং মেলে না বাঙালি ঘেঁষা হলে। এক কথায় যে রাষ্ট্রের স্বার্থে বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থান সেই রাষ্ট্র তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
পার্বত্য বাঙালিরা শুধু রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন নয়, এখনো নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে সেনাবাহিনীর অবস্থানের জন্য। অনেকে প্রকাশ্যে স্বীকার করতে না চাইলেও এ কথা অত্যন্ত স্পষ্ট যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি ও সেনাবাহিনী একে অন্যের সম্পূরক ও পরিপূরক। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী না থাকলে যেমন বাঙালির অবস্থান অনিশ্চিত, ঠিক তেমনি বাঙালি না থাকলে সেনাবাহিনীর অবস্থান কষ্টসাধ্য। বাঙালিরা সেখানে সেনাবাহিনীর জন্য অতিরিক্ত একটি ডিফেন্স লাইন তৈরি করেছে- যার গুরুত্ব অপরিসীম। বিগত জোট সরকারের আমলে বাঙালী নেতা ওয়াদুদ ভুঁইয়া উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালে প্রতিরক্ষা কৌশলের অংশ হিসেবে কিছু বাঙালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে, বিশেষ করে প্রধান সড়কের বিশেষ বিশেষ স্থানে বসতির অনুমতি দেয়া হয়। এতে করে পার্বত্য অধিবাসী, সরকারি কর্মকর্তা, সেনাবাহিনী ও পর্যটকদের উপর অতর্কিত হামলা (এমবুশ), অপহরণ অনেকাংশে হ্রাস পায়।
তবে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী কিছু বাঙালি আমাকে বহুবার এ কথা বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী না থাকলে ‘সন্তুবাহিনী’ হয় আমাদের কাছে অস্ত্র সারেন্ডার করে মিলে মিশে থাকবে, না হয় ভারতে পালাবে। সম্প্রতিকালে ক্রমাগত সরকার, দাতা সংস্থা ও এনজিওগুলোর বৈষম্য ও বিদ্বেষমূলক কর্মকা-ের কারণে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালি জনগোষ্ঠী। উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের অত্যাচার, উপজাতীয় নেতৃবৃন্দের বাঙালি বিদ্বেষমূলক কর্মকা- এবং সেই সাথে সরকার, এনজিও ও দাতা সংস্থারগুলোর একপেশে নীতির কারণে পার্বত্য অঞ্চলের বাঙালি জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব সমাজের মূল স্রোতধারা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। ফলে তাদের মধ্যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ সহিংস প্রতিবাদের দিকে এগুচ্ছে। উল্লিখিত উক্তিটি তাদের সেই ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ।
লেখক: মেহেদী হাসান পলাশ, email: palash74@gmail.com, সৌজন্যে: দৈনিক ইনকিলাব ও পার্বত্য নিউজ.কম
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক
বাঙ্গালী গণহত্যা
সমূহ:
·
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা
· পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক সেনাহত্যার ইতিহাস
[লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে? তাহলে দয়াকরে
গবেষণামূলক ও ইতিহাস ভিত্তিক এই সাইটটি চালিয়ে যেতে সাহায্য করুন। পার্বত্য
চট্টগ্রামে অধিকার বঞ্চিত বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী সাইটটি পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার
কতৃক চরমভাবে অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত, পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ঠ এনজিও সমূহের একচোখা
নীতি, সন্তু লারমা ও প্রসীত খীসাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস
ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) 'এর নিপিড়িত, নির্যাতিত ও বর্বরতম
সন্ত্রাসের নির্মম ও অসহায় শিকার - পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠির
সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ক্ষুদ্রতম এক প্রয়াস]