সোমবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৬

পাহাড়ের গুচ্ছগ্রামে বাঙালিদের সমস্যা ও মিডিয়ার ভূমিকা

পার্বত্য চট্টগ্রামের ভাগ্যবিড়ম্বিত বাঙালিরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। এখানকার অসহায় বাঙালিরা নানাবিধ বঞ্চনা আর নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন। দুর্গম এ অঞ্চলে যেখানে প্রশাসনের হাত অবারিত নয় এবং যেখানে উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ প্রবল প্রতাপশালী। সেখানে আজ বাঙালিরা বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের শিকার। এমনকি কখনো কখনো সমষ্টিগতভাবে তাদের জীবন হুমকির সম্মুখীন। এছাড়া এ অঞ্চলের উপজাতিদের স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে বরাবর বাঙালিদের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়েছে, কখনো আন্দোলন দমিয়ে রাখার জন্য কখনো উপজাতি গোষ্ঠীর সন্তুষ্টির জন্য, কখনো বা পাহাড়িদের জীবনের মানোন্নয়নের জন্য। আর এর ফলে বাঙালিদের মৌলিক অধিকার খর্ব হচ্ছে। এ অঞ্চল নিয়ে গবেষণামূলক বা বিশ্লেষণধর্মী লেখার অভাব রয়েছে। এ বিষয়ে সুশীল সমাজ এবং মিডিয়ার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও সে দায়িত্বটি সঠিকভাবে পালন করা হয়নি। ফলে বাঙালিদের অভাব-অভিযোগ যথার্থভাবে উত্থাপিত হয়নি এবং এর কোনো সুরাহাও হয়নি।

পার্বত্যাঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনার বর্ণনাই কেবল সংবাদপত্রে স্থান পায় এবং দেশবাসী তা অবহিত হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘটনার কলকাঠি যারা নাড়ে বা যাদের প্ররোচণায় তা ঘটে- তারা অন্তরালে থেকে যায়। এছাড়া এখন সংবাদে অধিকাংশ সময় কেবল পাহাড়িদের ভাষ্যই স্থান পায়। উপজাতি গোষ্ঠী এমন অবস্থান প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছে যার মধ্য দিয়ে দেখানো হয় কেবল তারাই নিষ্প্রেষিত, নিগৃহীত। ফলে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সমাধান্তিকামী বা সহানুভূতিশীল যে কোনো পক্ষই তাদের নিয়ে চিহ্নিত হয়ে পড়ে। অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে, সকলে তাদের বক্তব্য, ভাষ্য বা মতামত গ্রহণেই অধিক মনোযোগী হয়। অপরদিকে বহুবিধ সমস্যার আবর্তে বিপর্যস্ত বাঙালি জনগোষ্ঠীর সমস্যা যেন গুরুত্বপূর্ণ নয় বা সেগুলো দেখার দায়িত্ব যেন কারো নেই। ধরা যাক, সরকার কর্তৃক উপজাতীয়দের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়ার ব্যাপারটি। একই এলাকায় বসবাসকারী উপজাতিগণ যখন উচ্চশিক্ষা, কর্মসংস্থান ও ভূমি সংস্থানে অগ্রাধিকার পায়, তখন বাঙালিদের ভাগ্যে আসে কেবল উচ্ছিষ্ট, বঞ্চনা আর তিরস্কার। এসবই বাঙালিদের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার করে, যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়া ঘটে যাওয়া কোনো অঘটনের দায়-দায়িত্বের জন্যে সচরাচর অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয় বাঙালিদের দিকে। গত ৩ এপ্রিল ২০১১ তারিখে রাতে বরকলের ধন্ধছড়ায় একটি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে, যেখানে স্বামী-স্ত্রী খুন হন এবং তাদের শিশু সন্তান মারাত্মকভাবে জখম হয়। দুর্ঘটনাস্থল বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা হতে বহুদূরে, এছাড়া ঘটনাটি ঘটে রাতে। সুতরাং যুক্তিসঙ্গতভাবে ধরে নেয়া যায় যে, রাতের অাঁধারে এমন দূরবর্তী স্থানে হত্যার উদ্দেশ্যে কোনো বাঙালি যাওয়ার সাহস পাবে না। তবু কোনো রকম অনুসন্ধান ছাড়াই বাঙালিদের এ খুনের জন্যে দোষারোপ করা হয়েছে। মনগড়া ‘সন্দেহভাজন' বাঙালিদের গ্রেফতার করানো হয়েছে।

এখানে আরেকটি দুরভিসন্ধিমূলক ঘটনা উল্লেখের দাবি রাখে। ১৬ মে ২০১১ তারিখে খাগড়াছড়ির মহালছড়ি হতে রূপন মহাজন নামক এক বাঙালি ব্যবসায়ী চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক অপহৃত হওয়ার পর স্থানীয় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে পরিস্থিতি বিস্ফোরোন্মূখ হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে বাঙালিরা প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। এ সমাবেশে উপজাতি সন্ত্রাসীরা নির্বিচারে গুলী চালালে ঘটনাস্থলে ৪ জন বাঙালি গুরুতর আহত হয়, যা স্থানীয় বাঙালিদের উত্তেজিত করে তুলে। ফলস্বরূপ এ এলাকায় সৃষ্ট গোলযোগ দাঙ্গার আকার ধারণ করে, বেশ কয়েকটি উপজাতি গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। এতে অনেক বাড়িঘর পুড়ে যায়। দৃশ্যত বাঙালিদের দোষী মনে হলেও এর পেছনে কি চক্রান্ত ছিল পরবর্তীতে তা আর উন্মোচিত হয়নি। ফলে প্রশাসন কেবলমাত্র বাঙালিদের ধরপাকড় করেছে। অন্যদিকে স্থানীয় উপজাতি অধিবাসী যাদের মাঝেই অনেকে প্ররোচণাকারী রয়েছে, তারাসহ সকলে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ হতে সকল প্রকার সহায়তা পেয়েছে। এক কথায় বলা যায় যে, এক্ষেত্রে উপজাতীয়দের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুদৃঢ় রাখার দায়িত্ব যেমন এক পক্ষের নয়, তেমনি ঘটে যাওয়া যে কোনো বিরূপ পরিস্থিতিতে প্রশাসন কর্তৃক দোষী সকল পক্ষের বিরুদ্ধেই আইনগত ব্যবস্থা নেয়া উচিত। কিন্তু মহালছড়ি ঘটনার ক্ষেত্রে তা হয়নি যা নিন্দনীয়। এরপর আসা যাক ইউএনডিপি'র উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যাপারে। অপর্যাপ্ত সরকারি উন্নয়ন কর্মকান্ডের কারণে বিভিন্ন এনজিও, বিদেশী দাতা সংস্থা পার্বত্যবাসীদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে। এটি একটি শুভ লক্ষণ।

কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, তারা এ আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল জেএসএম এবং আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও সাবেক গেরিলা নেতা সন্তু লারমার উগ্র, একপেশে এবং বাস্তবতাবিবর্জিত পরামর্শে চলছে। কারণ, ইউএনডিপি কর্তৃক গৃহীত উন্নয়ন কার্যক্রমে প্রাথমিকভাবে মাটিরাঙ্গা থানা অন্তর্ভুক্ত থাকলেও বাঙালি অধ্যুষিত হওয়ার কারণে সন্তু লারমার তদবিরের ফলস্বরূপ তা লিস্টের বাইরে চলে যায়। পরবর্তীতে জনরোষের মুখে এবং সরকারি মধ্যস্থতায় তা পুনরায় তালিকাভুক্ত করা হয়। সন্তু লারমার বিষবা হতে আপাতদৃষ্টিতে মুক্ত হলেও এই ভাগ্যবিড়ম্বিত বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সর্বক্ষণ চলছে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র। ফলে বাঙালিরা শঙ্কামুক্ত হতে পারেনি। কারণ, সর্বশেষ পরিস্থিতি এই যে, মাটিরাঙ্গা থানাকে উন্নয়ন কার্যক্রমের আওতায় আনা হলেও এখনো উন্নয়ন কার্যক্রমের কোনো লক্ষণ এই এলাকায় পরিলক্ষিত হয়নি।

গণমাধ্যম বিশেষতঃ দর্শকনন্দিত টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রায়শই বিভিন্ন রিপোর্টিং এ পাহাড়িদের স্বপ্নীল ও রোমান্টিক জীবন সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রদর্শিত হয় অথচ বাঙালিরা পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর ৪৫% হওয়া সত্ত্বেও তাদের দুঃখ-দুর্দশা কখনো গণমাধ্যমে স্থান পায় না। তারা যে মানবেতর জীবনযাপন করছে তা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা বা দায়িত্ব নেই। অথচ পাহাড়িদের বহুল আলোচিত ঐতিহ্যবাহী জীবনযাপনের ওপর নিয়মিত প্রতিবেদন প্রচার করা হয়। অপরদিকে পাহাড়িদের জুমচাষ এবং উপজাতি সন্ত্রাসীদের সহায়তায় অবৈধ কাঠ কাটা/পাচার বাণিজ্যের কারণে বনজ সম্পদ যে ধ্বংস হচ্ছে এ জাতীয় গর্হিত অপরাধের সচিত্র রিপোর্টিং কখনো হয় না। অথচ এরূপ অপরাধমূলক কর্মকান্ডের উপর রিপোর্ট যেমন একদিকে সংশ্লিষ্টমহলকে সচেতন করতে পারে তেমনি নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করবে। এ জাতীয় রিপোর্টিং তাই জাতি ও দেশবাসীর প্রতি গণমাধ্যমের দায়িত্বও বৈকি। এছাড়া উপজাতি সংগঠনগুলোর সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম খবরের কাগজে গুরুত্বের সাথে স্থান পেলেও বাঙালি সংগঠনগুলোর কোনো কার্যক্রম গণমাধ্যমে তেমন একটা স্থান পায় না।

পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসকারী বাঙালিদের রয়েছে অজস্র সমস্যা যা দেশবাসী জানে না। এসকল সমস্যা জর্জরিত বাঙালিরা বাধ্য হয়ে ন্যায়সঙ্গত অভাব-অভিযোগ ও দাবি-দাওয়া তুলে ধরার জন্যে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলেছে। কিন্তু পাহাড়ি উপজাতিদের গোপন সংগঠনসমূহ এবং সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী বাঙালিদের প্রকাশ্য ও নিয়মতান্ত্রিক সংগঠনিক কার্যক্রম মেনে নিতে পারছে না। বাঙালিদেরও দেখা যাচ্ছে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠতে, এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে এক ধরনের উত্তেজনা যা দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলকর নয়।

শান্তিপূর্ণ পরিবেশ এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি একটি দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত। তাই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ রাখার জন্যে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, এটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের জন্যে যারা দায়ী সে বিষয়ে তদন্তমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করে গণমাধ্যম সরকারকে সহায়তা করতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ এ দায়িত্ব পালনে গণমাধ্যমসমূহকে আরও বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ হতে হবে। এক্ষেত্রে মনে হয় গণমাধ্যম ব্যক্তিবর্গের মাঝে দ্বিধা-দ্বনদ্ব রয়েছে এবং এটাও হতে পারে যে, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর কাছ থেকে তাদের উপর হুমকিও চলে আসছে। তাছাড়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে উপজাতিদের প্রতি গণমাধ্যমের সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এ সুযোগটিও উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা কাজে লাগাচ্ছে। এখানে দেশ ও জাতির বৃহৎ স্বার্থে সাংবাদিকদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাহসী ভূমিকা রাখতে হবে। এটা নীতি-নির্ধারক ও সরকারের জন্যে সহায়ক হবে। পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিবেদন প্রচার নয় বরং বস্তুনিষ্ঠ এবং সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের মতামত প্রতিফলিত হয় এরকম প্রতিবেদন প্রচার করা উচিত। বিশেষ গোষ্ঠীর এভাবে প্রতিবেদন প্রচার করা ঠিক নয় যা পাবর্ত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিস্থিতি বিনষ্ট করে। গণমাধ্যমের নিরপেক্ষ ভূমিকা শান্তিপ্রিয় উপজাতি এবং বাঙালি উভয় সম্প্রদায়ের জন্যে মঙ্গলজনক।

আখতার হামিদ খান:

পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা সমূহ:

·      পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা

·     পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক সেনাহত্যার ইতিহাস


[লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে? তাহলে দয়াকরে গবেষণামূলক ও ইতিহাস ভিত্তিক এই সাইটটি চালিয়ে যেতে সাহায্য করুন। পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার বঞ্চিত বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী সাইটটি পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার কতৃক চরমভাবে অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত, পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ঠ এনজিও সমূহের একচোখা নীতি, সন্তু লারমা ও প্রসীত খীসাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) 'এর নিপিড়িত, নির্যাতিত ও বর্বরতম সন্ত্রাসের নির্মম ও অসহায় শিকার - পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠির সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ক্ষুদ্রতম এক প্রয়াস]