
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) বলেছেন, চুক্তি হয়েছিল দু’ভাবে। একটি লিখিতভাবে অন্যটি অলিখিত ভাবে। এই অলিখিত চুক্তির মধ্যে অন্যতম হল পাহাড়ের বিদ্যমান আইনের লঙ্ঘন করে জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় যে নিরীহ বাঙালিদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাদেরকে সম্মানজনকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে পুনর্বাসন করা। কিন্তু সেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টাও এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। সোমবার (২ ডিসেম্বর) পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২২ তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে ‘‘জাতীয় নাগরিক” উদ্যোগে রাজধানীর উইমেন্স ভলান্টারি এসোসিয়েশন্স মিলায়তনে এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
এখানে বলা বাহুল্য যে, সেটেলার বলতে Refugee বা শরণার্থী বা আশ্রয়প্রার্থী বা উদ্বাস্তু বা নতুন উন্নয়নশীল দেশে বাস করতে আসা বিদেশী বসতকার বা অনুপ্রবেশকারী বা বসতিস্থাপনকারী কে বুঝায়। শর্তগুলোর একটি ও বাঙালীদের জন্য প্রযোজ্য নয়। প্রকৃতপক্ষে উপজাতিরা মিয়ানমার ও ভারত থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আসা Refugee বা শরণার্থী বা আশ্রয়প্রার্থী বা উদ্বাস্তু বা নতুন উন্নয়নশীল দেশে বাস করতে আসা বিদেশী বসতকার বা অনুপ্রবেশকারী বা বসতিস্থাপনকারী। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতিদের পরিবর্তে বাঙালীদের উপর এ দায় চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে।
বিষয়টি কেন চুক্তিতে লেখা হয়নি তা’র প্রেক্ষাপট নিয়ে তিনি আরও বলেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এই সেটলার বাঙালিদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসনের ব্যাপারটি চুক্তিতে উল্লেখ না করতে অনুরোধ করেছিলেন। কেননা, এটি চুক্তিতে লেখা হলে দেশে বিভিন্ন মহলে নানা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে বলে ধারণা করেছিলেন। সেইসাথে তিনি তাঁর (তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী) উপর বিশ্বাস রেখে উক্ত সেটলার বাঙালিদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসন করবেন বলে আশ্বস্ত করেন। কিন্তু আজ অবধি সেই বিশ্বাস রাখা হয়নি বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়টি হচ্ছে -ভূমি। কিন্তু এই ভূমি বিষয়টি এখনো পার্বত্য তিন জেলা পরিষদে হস্তান্তরিত হয়নি। তাই ভূমি সমস্যা সমাধানে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের বিধিমালা যদি প্রণীতও হয় তারপরও এই কমিশনের মাধ্যমে সেই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হবে না বলেও অভিযোগ তুলে ধরেন তনি।
সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক নয় বলে অভিযোগ করে তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। এ দেওয়াল থেকে সামনে এগিয়ে আসার জন্য পাহাড়ের মানুষ উদ্যোগ নিচ্ছে বলেও হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেন তিনি।
জাতীয় নাগরিক উদ্যোগের অন্যতম সদস্য অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌসের পরিচালনায় ও বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্যের সভাপতিত্বে উক্ত অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট বিশিষ্ট গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ, মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক মেসবাহ কামাল, নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. জোবাইদা নাসরীন কণা, আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং।
বিশিষ্ট গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, সরকার প্রতি বছর বিভিন্ন পত্রিকায় পার্বত্য চুক্তি উপলক্ষে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেন। কিন্তু এই ক্রোড়পত্রে চুক্তি স্বাক্ষরকারী অন্যতম ব্যক্তি সন্তু লারমার বক্তব্যও থাকা জরুরী। কেননা, সরকার কেবল মাত্র একতরফাভাবে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন।
তিনি আরও বলেন, সরকার বলে থাকে চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি বাস্তাবায়ন হয়েছে। এই কথাটি ২০১৩ সাল থেকে সরকার বলে আসছে। তাহলে এই ৬টি বছরে কেন আরও বেশি হয়নি তার একটি ব্যখ্যা সরকারের থাকা উচিত। তিনি আরও দাবি করেন, সরকার হয়ত ১০০ বছর পূর্তিতেও বলবেন ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৯টি বাস্তবায়িত হয়েছে।
অধ্যাপক মেসবাহ কামাল তাঁর বক্তব্যে বলেন, সরকারে চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্যে কাল ক্ষেপনের কৌশল আছে। এই কালক্ষেপন করা উচিত নয়। তিনি আরও বলেন, এই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য একটা সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা উচিত ছিল কিন্তু সরকার তা না করে কৌশল হিসেবে নানা ধরনের দমন-পীড়ন চালাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এই চুক্তি বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা পাহাড়ের নেতৃস্থানীয়রা যতটুকু বুঝেন সামরিক ও বেসামরিক আমলারা তেমন বুঝেন না। তিনি আরও অভিযোগ করেন, আজকে এই চুক্তি বাস্তবায়নে আজ পদে পদে বাঁধা। এই বাঁধা আসছে সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের পক্ষ থেকে।
মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, আমি ধরে নিলাম ৪৮ টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু আমার তো প্রধান বিষয়- ভূমি। এই ভূমির উপর যদি আমার নিয়ন্ত্রণ না থাকে, এই ধারাটি যদি সমাধান না হয় তাহলে এই ৪৮ টি বাস্তবায়ন অর্থহীন।
তিনি আরও বলেন, অস্ত্র জমা দিয়েই তো পাহাড়ি মানুষরা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর সন্তু লারমা বা পাহাড়ি মানুষরা কী এমন করেছে যা বাংলাদেশের স্বার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি স্বরূপ। সরকার কিন্তু এরকম একটি বিষয়ও দেখাতে পারবে না বলেও দাবি করেন তিনি।
তিনি পাহাড়ে চলমান হত্যাকাণ্ড নিয়ে বলেন, এই হত্যাকাণ্ড সংঘটনের পেছনে কারা জড়িত রয়েছে তাদেরকে খুঁজে বের করার সেরকম কোনো রাষ্ট্রীয় তাড়নাও আমরা দেখি না। একটি সভ্য রাষ্ট্রে একজন নিরপরাধ মানুষেরও অস্বাভাবিক মৃত্যু হতে পারে না। যদি সেটা হয় তাহলে সেখানে কোনো গলদ আছে বলে ধরে নিতে হবে।
চলমান শুদ্ধি অভিযানের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়কেও অভিযানের আওতায় আনা উচিত দাবি করে তিনি আরও বলেন, সরকারের মতে ৪৮টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে আর জনসংহতির মতে ২৫টি বাস্তবায়িত হয়েছে। এই দাবীর মধ্যে যে বিশাল তফাৎ এটাকে সামনে নিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন মানবাধিকার কমিশনের সাবেক এই চেয়ারম্যান।
সংহতি বক্তব্যে নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবির বলেন, সমাজের অর্ধেক অংশ নারীদের পেছনে ফেলে যেমন সমাজ এগিয়ে যেতে পারেনা তেমনি বাংলাদেশের একটা অংশ পাহাড়িদের পেছনে রেখে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জোবাইদা নাসরীণ কণা তাঁর বক্তব্যে বলেন, পাহাড়ে কোনো সহিংসতা ঘটলে দুটো জায়গাকে টার্গেট করা হয়। একটা পাহাড়ের নারী আর অপারটি ভূমি। এই আধিপত্যবাদী মননই পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের পথে মূল অন্তরায় বলে দাবি করেন তিনি।
কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ছিল রাষ্ট্রের সংগে জনগণের চুক্তি। কিন্তু এই চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়াটা এক ধরণের বঞ্চনা। এই চুক্তি যদি বাস্তবায়ন না হয় তাহলে তাদের আবার অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া ব্যতীত আর কোনো জায়গা থাকবে না। এই চুক্তি বাস্তবায়ন করতে না পারার দায় অবশ্যই সরকারকে নিতে হবে বলেও জানান তিনি।
অনুষ্ঠানের সভাপতি রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য সমাপনি বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশের এক দশমাংশ (পার্বত্য চট্টগ্রাম) জায়গায় সেনা শাসন বিদ্যমান থাকবে আর পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন হওয়ার দাবি করবেন এই স্ববিরোধীতা হতে পারে না। সরকার কর্তৃক প্রকাশিত ক্রোড়পত্র প্রতারণায় ভরা বলেও দাবি করেন তিনি। তিনি অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন দাবি করেন।
এছাড়া ওই অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. খাইরুল চৌধুরী, বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি নূর মোহাম্মদ তালুকদার, বিশিষ্ট সাংবাদিক নুরুল কবির সহ দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গ।
সূত্র: পার্বত্য নিউজ
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা সমূহ:
· পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা
· পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক সেনাহত্যার ইতিহাস
[লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে? তাহলে দয়াকরে গবেষণামূলক ও ইতিহাস ভিত্তিক এই সাইটটি চালিয়ে যেতে সাহায্য করুন। পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার বঞ্চিত বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী সাইটটি পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার কতৃক চরমভাবে অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত, পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ঠ এনজিও সমূহের একচোখা নীতি, সন্তু লারমা ও প্রসীত খীসাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) 'এর নিপিড়িত, নির্যাতিত ও বর্বরতম সন্ত্রাসের নির্মম ও অসহায় শিকার - পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠির সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ক্ষুদ্রতম এক প্রয়াস]