বুধবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৬

জনগণকে জানাতে চাই : প্রসঙ্গ পার্বত্য চট্টগ্রাম

সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক, মেজর জেনারেল (অব:) চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যটন বান্ধব : ২০১৬ সালটি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ঘোষিত ‘পর্যটন বছর’। বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট এবং দেশী পর্যটকদের উৎসাহিত করতে সরকার অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। পর্যটকদের কাছে যেসব আকর্ষণীয় স্থান আছে, তার মধ্যে অন্যতম কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত। তার পরই উল্লেখ করার মতো স্থান হচ্ছে পার্বত্য তিন জেলায় রাঙ্গামাটি শহর ও রাঙ্গামাটি লেক (হ্রদ), খাগড়াছড়ি শহর ও আলুটিলা পাহাড়, বান্দরবান শহর ও মেঘলা, চিম্বুক, নীলগিরি ইত্যাদি। বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটনমূল্য বা ট্যুরিজম ভ্যালু বাড়ানোর জন্য অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও নেবে। পর্যটন বাড়লে, পার্বত্য চট্টগ্রাম যেমন আরো বিকশিত হবে তেমনি দেশেরও লাভ হবে; কিন্তু সরকারের উদ্যোগের সাথে সরেজমিন পরিস্থিতি সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে(যেটা বর্তমানে আংশিকভাবে নেই বলে মনে করি)।


ভৌগোলিক ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয়
সম্মানিত পাঠক, যদি কষ্ট করে বাংলাদেশের মানচিত্র দেখেন তাহলে বুঝবেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূপ্রকৃতি সমগ্র বাংলাদেশ থেকে ভিন্ন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগোলিক অবস্থান হচ্ছে ভূরাজনৈতিক এবং সামরিক আঙ্গিকে (ইংরেজি পরিভাষায় : জিও-স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড মিলিটারি কনসিডারেশন) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো হচ্ছে হিমালয় পর্বতমালার দূরবর্তী ফুট হিলস বা পাদটিলা। পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের মধ্যে যারা ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর অংশ, তাদেরই মতো নৃতাত্ত্বিক মানুষের (ইংরেজি পরিভাষায় : অফ সেইম এথনিক অরিজিন) বিস্তৃত বসতি, পূর্ব দিকে, উত্তর-পূর্ব দিকে এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিকে, সমুদ্র বা মহাসমুদ্র পানির তীর পর্যন্ত। অর্থাৎ চায়না, তিব্বত, মঙ্গোলিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, ভারতের উত্তর-পূর্বের সাতটি প্রদেশ ইত্যাদি অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠী, নৃতাত্ত্বিকভাবে মঙ্গোলয়েড। এই বিশাল নৃগোষ্ঠীর সমপারিবারিক বা সমগোত্রীয় (ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র) অংশ হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৩টি উপজাতি যথা চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তংচঙ্গা, বোম, পাংখু, ম্রো, চাক, গুর্খা ইত্যাদি। তাহলে এটা হালকা মেজাজের ভাষায় বলাই যায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম হচ্ছে দু’টি বিশাল জনগোষ্ঠীর মিলনস্থান এবং দু’টি বিশাল ভূপ্রকৃতিরও মিলনস্থান।
আড়াই শ’ বছরের ইতিহাস
মোগল সাম্রাজ্যে, দক্ষিণ-পূর্বে সবচেয়ে দূরবর্তী জেলা ছিল চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রাম মানে আজ ২০১৬ সালের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান। ১৭৬০ সালে দুর্বল মোগল সম্রাট চট্টগ্রাম জেলাকে, উদীয়মান শক্তি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে হস্তান্তর করেছিল। ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চট্টগ্রাম জেলার পূর্ব অংশে অবস্থিত (ভূপ্রাকৃতিকভাবে পাহাড়ি বা পার্বত্য) অংশকে আলাদা জেলা করে দেয়। সেটার নাম হয়েছিল হিল ট্রাক্টস অব চিটাগং অর্থাৎ চট্টগ্রামের পার্বত্য অংশ। ব্রিটিশ ভারতে এটা একটি প্রান্তিক অঞ্চল এবং এখানকার মানুষ যেমন প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ছিল, অনুরূপ ব্রিটিশ ভারতের উত্তর-পশ্চিমে, পশ্চিমে, উত্তর-পূর্বে এবং পূর্ব দিকে এমনই আরো অনেক প্রান্তিক এলাকা ও জনগোষ্ঠী ছিল। এইরূপ প্রান্তিক এলাকা ও জনগোষ্ঠীগুলোর শাসনতান্ত্রিক বা প্রশাসনিক মর্যাদা বৃহত্তর ব্রিটিশ ভারত থেকে একটু ভিন্ন ছিল। ব্রিটিশদের আকাক্সক্ষা ছিল, ওই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী প্রান্তিকই থাকুক; ওদের নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার কোনো প্রয়োজন নেই; ওই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ব্রিটিশদের আনুগত্য মেনে নিয়ে খাজনা দিলেই যথেষ্ট। সময়ের সাথে সাথে ব্রিটিশ ভারতের সাংবিধানিক ও শাসনতান্ত্রিক অবস্থান পরিবর্তিত হয়ে যায়। পৃথিবী ক্রমান্বয়ে উন্নত হচ্ছে; যোগাযোগব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে উন্নত হচ্ছে এবং লেখাপড়ার বিস্তৃতি ঘটছে; ক্রমান্বয়ে মানুষে মানুষে মেলামেশা বৃদ্ধি পাচ্ছে; কিন্তু এরূপ সব ইতিবাচক অগ্রগতির অবশ্যম্ভাবী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় অত্যাচারী লোভী দুর্বৃত্তদের কর্মকাণ্ডও বেড়ে যায়; কিন্তু ওদের আগ্রাসী ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য উপযুক্ত ও যথেষ্ট ব্যবস্থা সমানুপাতে শক্তিশালী হতে পারেনি। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এ রকমই একটি ভৌগোলিক অঞ্চল এবং সেখানকার নৃতাত্ত্বিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী এরূপ একটি আলোচিত বিষয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম : পাকিস্তানে ও বাংলাদেশে
ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক ভাগ্য বিভাজিত হওয়ার প্রক্রিয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়েছিল এবং স্বাধীনতার পর থেকে এটি বাংলাদেশের অংশ। পাকিস্তানের ২৩ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হয়েছে কাপ্তাইতে স্থাপিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য। এই প্রকল্পের মারাত্মক নেতিবাচক ফলাফল ও প্রতিক্রিয়াও ছিল। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সন্ধিলগ্ন হলো ১৯৭১ সাল। ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের ভূমিকা হালকাভাবে ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং জোরালোভাবে ও বিশদভাবে ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে। ৪৫ বছর ধরে বাংলাদেশের সরকারগুলো অনেক ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য; কোনো কোনো পদক্ষেপ জনগণ সাদরে গ্রহণ করেছে; কোনো কোনো পদক্ষেপ জনগণের পক্ষ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে; কোনো কোনো পদক্ষেপ জন্ম দিয়েছে বিশৃঙ্খলার। প্রান্তিক এলাকা পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা সেখানকার প্রান্তিক উপজাতীয় জনগোষ্ঠী প্রসঙ্গে বাংলাদেশের যে অভিজ্ঞতা, এরূপ অভিজ্ঞতা বা একই ধরনের পরিবেশ পরিস্থিতিতে কর্মকাণ্ডের অভিজ্ঞতা আমাদের আশপাশেই এবং কিছু দূরে আরো অনেক দেশে আছে। সব দেশই ভালো কাজ যেমন করেছে, বিতর্কিত কাজও করেছে। প্রতিটি দেশ বা দেশের সরকার নিজ নিজ দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়েই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। আমাদের দেশের জন্যও এটা সত্য। স্বাধীন বাংলাদেশের ৪৫ বছর মেয়াদের মধ্যে, ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৭ (২২ বছর) পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগণ থেকে সৃষ্ট একটি সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিল। পর্যায়ক্রমে বা ধাপে ধাপে সেই সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি ও পরিবেশকেও নিরুত্তপ্ত (ইংরেজি পরিভাষায় : মিটিগেট) করা হয়েছে। তারপরও আজ ৪৫ বছরের শেষ মাথায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্কট উত্তরণের নিমিত্তে গৃহীত কিছু পদক্ষেপ সঙ্কটকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে বলে মনে করি; অথবা সঙ্কটকে বাড়িয়ে তোলার আশঙ্কা আছে (ইংরেজি পরিভাষায় : হ্যাজ দি পোটেনশিয়ালিটি টু ইনক্রিজ অর ইনসাইট) বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশের সংহতির নিমিত্তে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের বিভিন্ন অংশের বা বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ ও সমন্বিত সহ-অবস্থান ও উন্নতির স্বার্থে এ বিষয়গুলোর প্রতি বাংলাদেশের জ্ঞানীগুণী সচেতন নাগরিকদের মনোযোগ দেয়া আবশ্যক বলে আমরা মনে করি। বাংলাদেশ সরকারের মনোযোগ এসব বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ করা অতি জরুরি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা প্রসঙ্গ
পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি রাজনৈতিক সমস্যা বা আংশিকভাবে জাতিগত সমস্যা বিদ্যমান ছিল, ওই সমস্যা এখনো বিদ্যমান আছে এবং সর্বাত্মক চেষ্টা করলেও সমস্যাটি এক দিনে দূরীভূত হবে না; কিন্তু এ জন্য চেষ্টা করে যেতে হবে। অতীতেও চেষ্টা হয়েছে, বর্তমানেও চেষ্টা চলছে, ভবিষ্যতেও যেন হয় সেটাই দেশবাসীর কামনা। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর (অফিসারসহ) শত শত সদস্য এবং বাংলাদেশের বিডিআর-পুলিশ-আনসার ভিডিপি সদস্য প্রাণ দিয়েছেন বাংলাদেশের পক্ষে, সরকারের হুকুমে দায়িত্ব পালনকালে। পার্বত্য চট্টগ্রামে হাজার হাজার বাঙালি নারী-পুরুষ-শিশু প্রাণ দিয়েছে বাংলাদেশের স্বার্থে। পার্বত্য চট্টগ্রামে হাজার হাজার নিরীহ পাহাড়ি নারী-পুরুষ-শিশু প্রাণ দিয়েছে দুই পক্ষের যুদ্ধের মাঝখানে পড়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শত শত পাহাড়ি তরুণ প্রাণ দিয়েছেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তথা বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি স্থাপনের জন্য অনেক দিন ধরেই বিভিন্ন পর্যায়ে, বিভিন্ন আঙ্গিকে চেষ্টা করা হয়েছে; কোনো উদ্যোগ আংশিকভাবে সফল হয়েছে; কোনো উদ্যোগ সাফল্যের দ্বারপ্রান্ত পর্যন্ত গিয়েছে। উদ্যোগগুলোর বিস্তারিত বিবরণ এই কলামে স্থানাভাবে দিতে পারছি না, পাঠক কষ্ট করে প্রয়োজনীয় রেফারেন্স বই পড়লে বিস্তারিত জানতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে একটি বইয়ের নাম উল্লেখ করছি। মাওলা ব্রাদার্স কর্তৃক প্রকাশিত বইটির নাম : ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি প্রক্রিয়া ও পরিবেশ-পরিস্থিতির মূল্যায়ন’। পার্বত্য চট্টগ্রামে সরেজমিন অভিজ্ঞতা ও দীর্ঘ দিন সম্পৃক্ততার সুবাদে পুস্তকটি আমার নিজেরই লেখা। মাওলা ব্রাদার্সের ঠিকানা : ৩৯, বাংলাবাজার ঢাকা, ফোন নম্বর : ৭১৭৫২২৭ অথবা ৭১১৯৪৬৩; ই-মেইল mowlabrothers@gmail.com; চার শ’ পৃষ্ঠার পুস্তকটিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার উৎপত্তি, সমস্যা সমাধান তথা শান্তি স্থাপনের উদ্যোগ, এই উদ্যোগগুলোর সীমাবদ্ধতা, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর ভুলত্রুটি, হালনাগাদ অবস্থা ইত্যাদি বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। পুস্তকটি অনেক দোকানে পাওয়া যায়, আবার অনেক দোকানে পাওয়া যাবেও না। কারণ, এর বিষয়বস্তু রসকষবিহীন এবং আনকমন। তবে ঢাকা মহানগরের বেইলি রোডে এবং চট্টগ্রাম মহানগরের প্রেস ক্লাবের বিল্ডিংয়ে সব সময়ই বইটি পাওয়া যায়।
শান্তির উদ্যোগ ১৯৮৭-৮৯; ১৯৯৬-৯৭
পার্বত্য চট্টগ্রামে যারা বিদ্রোহ করেছিলেন তাদের একটি রাজনৈতিক নাম ছিল। তা হলো, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বা ইংরেজিতে PCJSS. এ সংগঠনের সশস্ত্র শাখা ছিল ‘শান্তিবাহিনী’। বাংলাদেশ সরকার এবং পিসিজেএসএসের মধ্যে অনেকবারই শান্তির লক্ষ্যে আলোচনা হয়েছিল। ১৯৮৮-৮৯ সালে প্রেসিডেন্ট এরশাদের আমলে, একটি নিবিড় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল শান্তি স্থাপনের জন্য। বিদ্রোহী শান্তিবাহিনী, বাংলাদেশ সরকারের সাথে আলোচনাটি মাঝপথে ভেঙে দিয়েছিল; অতএব সরকার সাধারণ জনগণের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সাথে আলাপ-আলোচনা করেই সমঝোতায় উপনীত হয়েছিলেন। ওই সমঝোতার ফলে তিনটি পার্বত্য জেলায় স্থানীয় সরকার জেলা পরিষদ স্থাপন করা হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ একটির নাম ছিল রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে উদ্যোগটি ছিল অনবদ্য ও অভূতপূর্ব। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ ও ২৯ ধারার একাধিক উপধারার বক্তব্যে শক্তিমান হয়ে সরকার এই প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তুলেছিল। এই জেলা পরিষদগুলো নির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত। ১৯৮৯ সালের ২৫ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো পরিষদ গঠিত হয়েছিল; কিন্তু পরে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও আর নির্বাচন হয়নি; আজ অবধি হয়নি। ১৯৮৭-৮৯ সালের শান্তি উদ্যোগের ফলে গঠিত পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদগুলো পার্বত্যবাসীকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নিজেদের ওপর শাসন নিজেরাই যেন করতে পারেন, সেই বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল, আংশিকভাবে হলেও। শান্তিবাহিনী এ বন্দোবস্তটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেনি। তারা ঘোষণা দিয়েছিল, তারা জেলা পরিষদ ব্যবস্থা মানে না। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় বিএনপি সরকারের আমলে শান্তিপ্রক্রিয়া অধিকতর বিস্তারিত ও অধিকতর অংশীদারিমূলক করার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল; কিন্তু উদ্যোগগুলো সফল হয়নি। পেছনের দিকে তাকিয়ে যে মূল্যায়ন করছি, সেই মূল্যায়ন মোতাবেক, শান্তিবাহিনী কৌশলে বিএনপি সরকারকে প্রভাবিত করেছিল যেন স্থানীয় সরকার পরিষদের সময়মতো নির্বাচন না হয়। শান্তিবাহিনী কৌশলে এবং দেশের ভেতরে বা বাইরের কৌশলগত সমর্থনে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল, যেন বিএনপি তাদের শান্তি উদ্যোগগুলোতে সফল না হয়। ১৯৯৬ সালের জুন মাসে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। আওয়ামী লীগ সরকার আগে থেকেই বা ইতোমধ্যে চলমান উদ্যোগগুলোতে নতুন জীবন দান করেছিল। ফলে দেড় বছরের মাথাতেই আওয়ামী লীগ সরকার একটি উপসংহারে আসে। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসের ২ তারিখ বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে একজন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির ফলে সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রকোপ কমে আসে; যদিও সব অবৈধ অস্ত্র কোনো দিনই সরকারের কাছে জমা হয়নি বলে অনুভব করি। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য হলো, ১৯৯৬-৯৭ সালের শান্তি আলোচনা, ওইরূপ আলোচনার ফলাফল; এর ফলে স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তি ইত্যাদি সব কিছুর ভিত্তি বা ফাউন্ডেশন হলো অতীতের শান্তি আলোচনা ও অতীতের সমঝোতা এবং অতীতের আইনগুলো; বিশেষ কর ১৯৮৭-৮৯ এর শান্তি আলোচনার ফলে স্থাপিত পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইনগুলো ও জেলা পরিষদ ব্যবস্থা। পিসিজেএসএস তথা শান্তিবাহিনী জেলা পরিষদ ব্যবস্থাকে যদিও ১৯৮৮-৮৯ সালে সশস্ত্রভাবে বিরোধিতা করেছিল, ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে তারা এই ব্যবস্থাকে মেনে নিয়েই বাকি উপসংহারে উপনীত হন। ডিসেম্বর ১৯৯৭-এর শান্তিচুক্তির অনেক ভালো দিক আছে, অনেক মন্দ দিকও আছে। মন্দ দিকগুলোর মধ্যে দু’টি উল্লেখ করছি। প্রথমটি হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালি জনগোষ্ঠীর ভোটাধিকার।
বাঙালিদের ভোটাধিকার প্রসঙ্গ
৯৭ সালের চুক্তি দিয়ে এই ভোটাধিকারকে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ, খণ্ডিত তথা খর্ব করা হয়েছে। বুঝিয়ে বললে এরূপ দাঁড়ায়; পার্বত্য চট্টগ্রামে দু’টি ভিন্ন ভিন্ন ভোটার তালিকা প্রণীত হবে। একটি ভোটার তালিকায় পাহাড়ি-বাঙালি সবার নাম থাকবে নিঃশর্তভাবে, দেশের সব জায়গায় যেমন হয় তেমনভাবে; পার্লামেন্ট নির্বাচনে ভোট দেয়ার জন্য। আরেকটি ভোটার তালিকাকে আমরা আঞ্চলিক তালিকা বলতে পারি। দ্বিতীয় ভোটার তালিকা তথা আঞ্চলিক তালিকায় সব পাহাড়ির নাম তো থাকবেই; কিন্তু শুধু ওইসব বাঙালির নাম থাকবে, পার্বত্য চট্টগ্রামে যাদের স্থায়ী ঠিকানা আছে। ‘স্থায়ী’ ঠিকানার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে চুক্তিতে এবং তৎপরবর্তী আইনে বলা হলো, যাদের নিজ নামে বৈধ জায়গা-জমি বা ভূসম্পত্তি আছে, তাদেরই স্থায়ী ঠিকানা আছে বলে মনে করা হবে। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি সহজ ও সরল। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে, চুক্তি স্বাক্ষরকারী দু’পক্ষই ধরে নিয়েছে যে, স্থায়ী ঠিকানা নেই এমন বাঙালি পার্বত্য চট্টগ্রামে অবশ্যই আছে অথবা অনেক বাঙালি পার্বত্য চট্টগ্রামে আছে যাদের স্থায়ী ঠিকানা বিতর্কিত; অথবা প্রশ্নসাপেক্ষ। যদি আঞ্চলিক ভোটার তালিকায় বাঙালি ভোটারদের সংখ্যা কমাতে হয় তাহলে স্থায়ী ঠিকানা আছে এমন বাঙালির সংখ্যা কমাতে হবে। এরূপ সংখ্যা কমানোর জন্য ব্যবহারযোগ্য একটি পন্থা বা অস্ত্র হলো, ভূসম্পদের মালিকানা নিয়ে সন্দেহ বা বিতর্ক সৃষ্টি করা; এবং সন্দেহ বা বিতর্কের একপর্যায়ে মালিকানা বাতিল করে দেয়া হবে। মালিকানা বাতিল করলে সংশ্লিষ্ট বাঙালির স্থায়ী ঠিকানা পার্বত্য চট্টগ্রামে আর থাকবে না; যদি ঠিকানা না হয় তাহলে তিনি আঞ্চলিক নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন না; আঞ্চলিক নির্বাচনে ভোট দিতে না পারলে তার মতামত বা সমর্থন প্রতিফলিত হবে না; মতামত বা সমর্থন প্রতিফলিত না হলে তাকে কোনো ভোটপ্রার্থী মূল্যায়ন করবে না ও দাম দেবে না। যদি কোনো নাগরিকের ভোটাধিকার না থাকে তাহলে তার জীবনযাত্রা মার্জিনালাইজড হয়ে যায়। অন্য কথায় বলতে গেলে, ওই নাগরিক দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়ে যেতে হবে। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কোনো নাগরিক কোনো পরিবেশে বা কোনো স্থানে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকতে চান না। অতএব তখন পরিস্থিতির ওপর ত্যক্তবিরক্ত হয়ে ওই নাগরিক বলতেই পারেন, এই পার্বত্য চট্টগ্রামে থেকে লাভ কী?
স্থায়ী ঠিকানা বা ভোটাধিকার না থাকলে কী হতে পারে?
১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রশাসনিক কার্যক্রম ইত্যাদি অনেক কিছুতেই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে প্রাধান্য বা অগ্রাধিকার (ইংরেজিতে প্রেফারেন্স বা প্রায়োরিটি) দেয়া হয়েছে। পরিস্থিতি বা পরিবেশ এমন যে, বেঁচে থাকার নিমিত্তেই বাঙালি জনগোষ্ঠীকে অনেকাংশেই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর দয়া বা উদারতার ওপর নির্ভর করতে হবে। দয়া ও উদারতার বিপরীত শব্দ হলো যথাক্রমে নির্দয়তা বা নির্মমতা এবং তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য। এই অনুচ্ছেদের এই অংশে আমরা কল্পনা করি যে, কয়েকটি বাঙালি পরিবার একটি গ্রামে থাকে। তাদের নিজের কোনো জায়গাজমি নেই। কারণ বিতর্কিত পন্থা ও পদ্ধতিতে তাদের মালিকানা হরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করতে গিয়ে বা তাদের ছেলেমেয়েরা চাকরি খুঁজতে গিয়ে বা স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করতে গিয়ে হেনস্তা হচ্ছে, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হচ্ছে। স্থায়ী ঠিকানাবিহীন হেনস্তার শিকার এই পরিবারগুলো কী সিদ্ধান্ত নিতে পারে? যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে যে, তারা সিদ্ধান্ত নেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে চলে যাওয়ার। কেউ তো তাদের জোর করে গলাধাক্কা দিয়ে তাদের গ্রাম থেকে তথা পার্বত্য জেলা থেকে বের করে দিচ্ছে না; তারা পরিবেশ পরিস্থিতির শিকার হয়েই চলে যাচ্ছে। সম্মানিত পাঠক, আমরা এমন একটা পরিস্থিতিতে আজ ২০১৬ সালের এই আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে এসে দাঁড়িয়েছি। এ জন্যই বিষয়টির অবতারণা করা হলো। আপনাদের মনে অতি ন্যায়সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, বাঙালিরা ওখানে গেলই বা কখন আর তাদের ওখানে থাকতে দিতেই বা চায় না কারা? অথবা, কেনই বা থাকতে দিতে চায় না; এতে কার কী লাভ বা ক্ষতি? আরেকটু পেছনের দিকে গেলে প্রশ্নটি দাঁড়াবে, ‘শান্তিবাহিনী’ নামের সংগঠন আসলে কেন বিদ্রোহ করেছিল; তারা কী চেয়েছিল, তারা কী চায়, তারা ইতোমধ্যে কী পেয়েছে? তাদের চাওয়া-পাওয়ার সাথে বাঙালিদের ওখানে থাকা বা না থাকার কী সম্পর্ক? এসব ন্যায়সঙ্গত জিজ্ঞাসার উত্তর দেয়া প্রয়োজন। যেহেতু পত্রিকার কলামের পরিসর সীমিত, সেহেতু উত্তর অতি সংক্ষেপেই দিতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সঙ্কটের কারণ
এ প্রসঙ্গে সঠিক ইতিহাস জানতে হলে একাধিক আঙ্গিক থেকে লেখা পুস্তক পড়া উচিত; কিন্তু এটা অনেকের জন্যই বাস্তবসম্মত হয়ে ওঠে না। এই কলামের ওপরের অংশে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি প্রক্রিয়া ও পরিবেশ পরিস্থিতি মূল্যায়ন নামক যে পুস্তকটির উল্লেখ করেছি সেটিতে সততার সাথে শান্তিবাহিনী ও তাদের দাবি-দাওয়ার প্রসঙ্গটি আলোচিত হয়েছে। কাপ্তাই লেক সৃষ্টি হওয়ার কারণে হাজার হাজার উপজাতীয় পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, যার কারণে একটি সাধারণ বিক্ষুব্ধতা ওই অঞ্চলের মানুষের মনে ছিল। দ্বিতীয় একটি কারণ হলো, মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর ভূমিকার ফলে কিছু নেতিবাচক সামাজিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল; এটিও তাদের মনকে বিক্ষুব্ধ করেছিল। তৃতীয় একটি কারণÑ বাংলাদেশের ১৯৭২-এর সংবিধান, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়কে অস্বীকার করেছিল; ১৯৭৩ সালে সরকারপ্রধানের মৌখিক ঘোষণায় এই অস্বীকৃতি শক্তিশালী হয়েছিল; এ কারণে তারা বিক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। চতুর্থ আরেকটি কারণ; ১৯৬০-এর দশকে উপজাতীয় জনগণের মধ্যে আধুনিক শিক্ষা বিস্তৃত হয়েছিল; বামপন্থী রাজনীতি তাদের মনকে আক্রান্ত করেছিল এবং পার্বত্য বামপন্থীরা তাদের অঞ্চলের সামন্তবাদী (ইংরেজি পরিভাষায় : ফিউডাল) সামাজিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার পরিবর্তন চাচ্ছিলেন। পৃথিবীব্যাপী তখন সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন আনার প্রবণতা ছিল। 
এই কলামটি কেন একটি বিশেষ কলাম?
আজকের কলামটি হচ্ছে একটি নাতিদীর্ঘ রচনার অংশ। এর মূল বিষয়বস্তু, বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত তিনটি পার্বত্য জেলার সমন্বয়ে যে ভৌগোলিক এলাকাটিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বলা হয়, সেখানকার দু-একটি সমস্যা। সমস্যাগুলো ওখানকার হলেও, এর তাৎপর্য বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের ভৌগোলিক আয়তনের দশ ভাগের এক ভাগ। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের ষোলো কোটি জনগণের অংশ। রাষ্ট্রের সব জনগণের মতো, পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের প্রতিও রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব আছে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের মধ্যে আনুমানিক ৬০ বা ৬৫ শতাংশ হচ্ছেন পাহাড়ি বা উপজাতীয় বা ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠীর অংশ (ইংরেজি পরিভাষায় : এথনিক মাইনরিটি বা স্মল ন্যাশনালিটিজ) এবং বাকিরা হচ্ছে বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশের ষোলো কোটি মানুষের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের ছয়-সাত লাখ মানুষের অনুপাত হচ্ছে, ১০০ ভাগের এক ভাগের মধ্যে, কম-বেশি অর্ধেক (০.৫%)। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান সমস্যাটির গুরুত্ব, ওইরূপ ক্ষুদ্র নয়। সমস্যাটির সাথে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা জড়িত; আজকে একটু কম দেখা গেলেও, সমস্যাটি গভীর। বাংলাদেশের শান্তি-সমৃদ্ধি তো জড়িত আছেই। এ লেখার প্রথম পর্ব যে পর্যায়ে শেষ হয়েছিল, আজ সেখান থেকেই শুরু করছি।
শান্তিবাহিনীর বক্তব্য
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ছিল একটি রাজনৈতিক সংগঠন। কিন্তু তারা একটি সশস্ত্র উপসংগঠন সৃষ্টি করেছিল। এর নাম শান্তিবাহিনী। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর এবং ’৭৫-এর নভেম্বরের উত্তাল সময়টি অতিক্রান্ত হওয়ার পরপরই, শান্তিবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র কর্মকাণ্ড শুরু করে। ওই সশস্ত্র কর্মকাণ্ডগুলো ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ। বিখ্যাত প্রকাশনী সংস্থা ‘অনন্যা’ (০১৭১১-৫২১১৩৪) থেকে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারির বইমেলায় প্রকাশিত আমার এগারোতম বই ‘মিশ্র কথন’-এ আমি পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসঙ্গে একটি অধ্যায় যোগ করেছি (পৃষ্ঠা নম্বর : ২৪৫-৩১৫)। মিশ্র কথনের সেই অধ্যায়টিতে সাবেক শান্তিবাহিনীর সদস্যদের বরাত দিয়ে, ভারতীয় সহযোগিতার কথা লিখেছি; তা ছাড়া আমি সরেজমিন তো অনেক কিছুই প্রত্যক্ষ করেছি। যা হোক, ওই বিষয়টি এখন ২০১৬ সালে গৌণ। আমরা ডিসেম্বর ১৯৭৫-এ ফিরে যাই। ডিসেম্বর ১৯৭৫-এ সশস্ত্র বিদ্রোহ বা যুদ্ধ শুরু করার আগে, শান্তিবাহিনী লিখিতভাবে বাংলাদেশ সরকারকে কোনো দিনই জানায়নি, তাদের দাবি পূরণ করা না হলে তারা যুদ্ধে যাবে। শান্তিবাহিনী যেহেতু যুদ্ধ শুরু করেই দিয়েছিল; সেহেতু বাংলাদেশ সরকারকে সেটা মোকাবেলা করতেই হতো। অতএব এটি একটি সশস্ত্র সঙ্ঘাতে রূপ নেয়।
এক আমলের পরিস্থিতির দায়ভার অন্য আমলে
১৯৭৫-এর আগস্টের পর বাংলাদেশের সরকারব্যবস্থা অস্থিতিশীল ছিল। ১৯৭৫-এর নভেম্বরের ৭ তারিখের পর, ওই অস্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। ১৯৭৫-এর ডিসেম্বর থেকে শান্তিবাহিনী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করে, সেই যুদ্ধ শুরু হওয়ার জন্য কিন্তু ১৯৭৫-এর আগস্ট বা নভেম্বরের পরবর্তী সরকার কোনোমতেই দায়ী নয়। ১৯৪০, ১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশকে সৃষ্ট কারণগুলোর কথা অতি সংক্ষেপে এই নাতিদীর্ঘ কলামের প্রথম পর্বে একটি অনুচ্ছেদে উল্লেখ করেছি। ১৯৭১ থেকে ’৭৫-এর বাংলাদেশের পরিবেশ পরিস্থিতি কী ছিল সেটাও আজকের দিনের যেকোনো সচেতন নাগরিক মোটামুটিভাবে জানেন। তাহলে অতীতের কারণে সৃষ্ট অঘোষিত যুদ্ধ মোকাবেলা করতে হয়েছিল ১৯৭৫-এর নভেম্বরের পরবর্তী বাংলাদেশ সরকারকে। মোকাবেলা করতে গিয়ে অনেক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে পরবর্তী ৫, ১০, ১৫ বা ২২ বছরে। এই পদক্ষেপগুলোতেও ভালো এবং মন্দ দিক আছে। এগুলো থেকেই আজ ২০১৬ সালের সঙ্কটের উৎপত্তি। তবে সমস্যা সমাধান করতে গেলে নতুন সমস্যা উৎপত্তি হতেই পারে। কিন্তু এমন কোনো সমস্যাকে স্বাগতম জানানো যায় না বা যাবে না, যেগুলো রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বা রাষ্ট্রের সংবিধানের ‘কোর’-কে আঘাত করে। কাজটি কঠিন। এক দিকে বিদ্রোহী বা আন্দোলনরত জনগোষ্ঠীর কষ্ট দূর করা বা চাহিদা মেটানো, অপর দিকে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা সংবিধানের সংহতি রক্ষা করা, এই কাজটি কঠিন বৈকি। সে জন্যই সচেতন নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে অবদান (ইনপুট বা কন্ট্রিবিউশন) প্রয়োজন। সে জন্যই এই লেখা।
সশস্ত্র বিদ্রোহ মোকাবেলার পন্থাগুলো
সশস্ত্র যুদ্ধ বা সশস্ত্র বিপ্লব মোকাবেলা করার দু’টি উন্মুক্ত পন্থা আছে। একটি হলো উভয়পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসা এবং যুদ্ধবিরতিতে উপনীত হওয়া। আরেকটি হলো, যুদ্ধের মাধ্যমেই প্রতিপক্ষকে দমন করা। পৃথিবীব্যাপী, প্রথম পন্থাটি বেশি গ্রহণযোগ্য। এর অর্থ এই নয়, যুদ্ধ হচ্ছে না বা যুদ্ধের মাধ্যমে কেউ কাউকে দুর্বল করছে না। কিন্তু সবচেয়ে জ্ঞানী হলেন তারাই, যারা যুদ্ধের কারণগুলো খুঁজে বের করেন এবং ওই কারণগুলো দূর করতে চেষ্টা করেন। যুদ্ধ শুরুর কারণগুলো যদি দূর করা যায়, তাহলে যুদ্ধের যৌক্তিকতা কমে যায়। ব্যক্তিগতভাবে আমি এ রকমই একটি পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে সরেজমিন সম্পৃক্ত ছিলাম। সেনাবাহিনীর ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে, বিদ্রোহ মোকাবেলার দায়িত্ব পালন করেছি, আবার সরকারের নির্দেশে বা আমার ওপর সরকারের আস্থার কারণে, শান্তি স্থাপনের জন্যও (বিয়ন্ড দি কল অব ডিউটি গমন করে), পরিশ্রম করেছি; জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থা ও সুসম্পর্ক সৃষ্টির জন্য পরিশ্রম করেছি। সে জন্য আমি যা বলছি বা লিখছি, সেটা আমার অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ; কোনো মতেই শুধু তাত্ত্বিক নয়। 
পৃথিবীর অনেক জায়গা থেকে উদাহরণ
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে যেই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল এবং সমাধানের যে চেষ্টা করা হয়েছে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশ বা স্থান থেকে সেরকম ঘটনার বা কর্মকাণ্ডের অনেক উদাহরণ দিতে পারি; কিন্তু মাত্র কয়েকটি উল্লেখ করছি। প্রথমে দিচ্ছি- ইন্দোনেশিয়ার সর্ব উত্তর-পশ্চিমের দ্বীপ সুমাত্রার সর্ব উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ‘আচেহ’ প্রদেশ এবং ফিলিপাইনের দক্ষিণে মিন্দানাও প্রদেশের উদাহরণ। তারপর অন্য উদাহরণগুলো। বাংলাদেশের অতি কাছে প্রতিবেশী ভারতের পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব অংশে অবস্থিত প্রদেশগুলোতে (যথা- পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলা, আসাম, ত্রিপুরা, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মনিপুর) একই ধরনের পরিস্থিতি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। আসামে উলফা নামক সংগঠনের কথা এবং তার অন্যতম নেতা পরেশ বড়ুয়ার নাম বাংলাদেশের অনেকেই জানেন। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার উত্তর-পশ্চিমাংশে তামিল বিদ্রোহীরা ২৫ বছরের বেশি সময় শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে; এখন থেকে চার-পাঁচ বছর আগে তারা সশস্ত্রভাবে পরাজিত হয়েছে; তাদের নেতা প্রভাকরণের নাম অনেকেই জানেন। মিন্দানাও, মিজোরাম, ত্রিপুরা রাজ্য, মনিপুর, আসাম, নাগাল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি সব জায়গাতেই সামরিক বাহিনী মোতায়েন হয়েছিল। সব জায়গাতেই শান্তির আলোচনা হয়েছিল; সব জায়গাতেই এক বা একাধিক সমঝোতা বা শান্তিচুক্তি হয়েছিল। সব জায়গাতেই শান্তিচুক্তি ভঙ্গ হয়েছে আংশিকভাবে; পুনরায় শান্তি আলোচনা হয়েছে এবং পুনরায় সমঝোতা বা চুক্তি হয়েছে। সব জায়গাতেই শান্তিচুক্তি অব্যাহতভাবে মূল্যায়নের (কন্টিনিউয়াস ইভ্যালুয়েশন) প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃত এবং মূল্যায়নের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। সব জায়গাতেই সমঝোতা বা শান্তিচুক্তির ফলে কিছু সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল। সব জায়গাতেই যারা ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠী তাদের অনুকূলে, বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে বা রাষ্ট্রকে একটু ছাড় দিতে হয়েছে। সব জায়গাতেই ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠী বা তাদের পক্ষে যুদ্ধরত সংগঠনগুলোকে রাষ্ট্রের ও শান্তির অনুকূলে একটু ছাড় দিতে হয়েছে। 
দক্ষিণ আমেরিকার কলোম্বিয়ার উদাহরণ
খবরটি এএফপি এবং রয়টার্স পরিবেশিত। খবরটির শিরোনাম : ‘কলম্বিয়ায় অর্ধ শতাব্দী পর শান্তির সুবাতাস’। কলম্বিয়া হচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকার একটি দেশ। খবরটি নিম্নরূপ: : ‘বামপন্থী বিদ্রোহী সংগঠন ও সরকারের মধ্যে অস্ত্রবিরতি কার্যকর হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দেশটিতে প্রায় ৫২ বছর ধরে চলা বিদ্রোহের অবসান হতে যাচ্ছে। তবে দুই পক্ষের মধ্যে চূড়ান্ত শান্তিচুক্তি হচ্ছে কি হচ্ছে না, তার জন্য ২ অক্টোবরের গণভোটের রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কিউবায়, কলম্বিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠী ‘দ্য রেভুলিউশনারি আর্মড ফোর্সেস অফ কলম্বিয়া (ফার্ক)’ ও সরকারের মধ্যে চার বছর ধরে আলোচনার পর স্থানীয় সময় সোমবার মধ্য রাত থেকে এই অস্ত্রবিরতি কার্যকর হয়। দুই পক্ষের মধ্যে চূড়ান্ত অস্ত্রবিরতি চুক্তি আগামী মাসে স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা রয়েছে। ২৪ আগস্ট কিউবার রাজধানী হাভানায় ৫২ বছর ধরে চলে আসা বিদ্রোহের অবসান ঘটাতে ফার্ক বিদ্রোহী এবং কলম্বিয়া সরকারের মধ্যে শান্তি সমঝোতা হয়। সেই সাথে অস্ত্রবিরতিও ঘোষণা করা হয়। এই সমঝোতা অনুযায়ী, ফার্ক, সশস্ত্র বিদ্রোহের পথ ত্যাগ করে কলম্বিয়ার নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে অংশ নেবে। সেই সাথে বিদ্রোহীদের পুনর্বাসনের জন্য উদ্যোগ নেবে সরকার। চলতি বছর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি ফার্ক নেতারা ওই সমঝোতা চুক্তি অনুমোদন নিয়ে বৈঠকে বসবেন। ১৩ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর ফার্কের নিয়ন্ত্রণে থাকা কলম্বিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে ওই কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হবে। আগামী ২ অক্টোবর শান্তি চুক্তি গ্রহণ করা বা না করার বিষয়ে গণভোটের ডাক দিয়েছে কলম্বিয়া সরকার। ফার্ক নেতা রডরিগো লন্ডনো, গুলিবর্ষণ বন্ধের নির্দেশ দেন।’
উদাহরণ দিতে গিয়ে এই অনুচ্ছেদে এবং তার উপরের অনুচ্ছেদে যতগুলো জায়গার নাম নিয়েছি, সব জায়গার সমস্যা সম্পর্কে সম্মানিত পাঠক বিস্তারিত অবহিত হওয়া কষ্টকর। কিন্তু কলম্বিয়ার সমস্যাটি একটি অনুচ্ছেদে বর্ণনা করেছি; যাতে পাঠক নিজেই অনুমান করতে পারেন যে, এ ধরনের সমস্যার সমাধান করতে গেলে কী কী প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয় বা কী কী সমস্যা উপস্থাপিত হয়। এই খবরটিতে অনেক রাজনৈতিক ইশারা আছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যায় তিনটি পক্ষ জড়িত, কেন?
উপরের দু’টি অনুচ্ছেদে বিভিন্ন উদাহরণ পর্যবেক্ষণের পর আমরাও বলতে পারি, পার্বত্য চট্টগ্রামে যে সমস্যা ছিল, সেটিও সমাধানের অযোগ্য কোনো সমস্যা নয়; আমরা বলতে পারি, সেই সমস্যা সমাধানের জন্য সব পক্ষকেই কিছু না কিছু ছাড় দিতে হয়েছে অথবা ভবিষ্যতেও দিতে হতে পারে। এখানে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় তুলে ধরতে চাই। পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র বিদ্রোহমূলক সমস্যায়, ’৭০, ’৮০ ও ’৯০-এর দশকে দু’টি পক্ষ ছিল। পক্ষগুলোর পরিচয় নিম্নরূপভাবে দেয়া যায়। একপক্ষে পাহাড়ি জনগণ বা তাদের (কাঙ্ক্ষিত বা অনাকাঙ্ক্ষিত) প্রতিনিধিত্বে পিসিজেএসএস বা শান্তিবাহিনী এবং অপরপক্ষে বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু ১৯৮৮ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে স্বাক্ষরিত সমঝোতার পর থেকে শুরু করে এই মুহূর্ত পর্যন্ত, সেখানে তিনটি পক্ষ আছে।
প্রথম পক্ষ হলো- বাংলাদেশের জনগণ তথা বাংলাদেশ সরকার, দ্বিতীয় পক্ষ হলো- পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি বা উপজাতীয় জনগণ তথা পিসিজেএসএস (শান্তি বাহিনীসহ)। তৃতীয় পক্ষটি হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালি জনগোষ্ঠী। যত দিন পর্যন্ত পিসিজেএসএস বা বাংলাদেশ সরকার এই তৃতীয় পক্ষের মর্মবেদনা ও কষ্টগুলো না বুঝবে এবং তাদের শান্তি স্থাপন প্রক্রিয়ায় পক্ষভুক্ত না করবে, তত দিন এই সমস্যার আন্তরিক সমাধান সম্ভব নয়। যারা আজকের এই লেখাটি পড়ছেন, তারা বলতেই পারেন, ষোলো কোটি বাঙালির মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আড়াই বা তিন লাখ বাঙালির এমন কী সমস্যা থাকতে পারে যেটা জাতীয় পর্যায়ে ধর্তব্যের মধ্যে নিতে হবে?
বোঝার বিষয়টি ক্রুশিয়াল, সূক্ষ্ম ও স্পর্শকাতর
এটি একটি ক্রুশিয়াল পয়েন্ট, অতি সূক্ষ্ম ও স্পর্শকাতর বিষয়। কাউকে যেমন বুঝতে বাধ্য করা যাবে না, তেমনি আমার প্রকাশভঙ্গির বা প্রকাশ ক্ষমতার দুর্বলতার কারণেও হয়তো অনেকের বুঝতে কষ্ট হতে পারে। সে জন্যই বিনয়ের সাথে আহ্বান জানাচ্ছি, পাঠক যেন কষ্ট করে এই বিষয়টি বুঝে নেন। এই পয়েন্টটি বোঝার সাথে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা জড়িত; বাংলাদেশের সংবিধানের কয়েকটি ধারার ব্যাখ্যা জড়িত; বাংলাদেশের ভবিষ্যতের কোনো সম্ভাব্য বিপদের দিনে সামরিক বাহিনীর সম্ভাব্য মোতায়েন জড়িত এবং সর্বোপরি, ষোলো কোটি মানুষের মনের শান্তি জড়িত। তাই এই পয়েন্ট সূক্ষ্ম বিষয়টি বোঝা বা এর তাৎপর্য অনুধাবন করা এবং এই তাৎপর্য প্রসঙ্গে উপযুক্ত জায়গাগুলোতে সচেতন নাগরিকেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করা অত্যন্ত জরুরি।
উদ্বেগের কেন্দ্রবিন্দু বাঙালি জনগোষ্ঠী
এই লেখার প্রথম পর্ব গত ৩১ আগস্ট প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে দু’টি ভিন্ন ভোটার তালিকার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছি। অতি কৌশলে, পরিস্থিতিগত বা পরোক্ষ চাপ সৃষ্টি করে, বাঙালিদের সংখ্যা কমানোর একটি সুযোগ যে ওখানে আছে সেটি উল্লেখ করেছি। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সরকার এবং শান্তিবাহিনীর মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তার আগে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। ১৯৮৭-৮৮ সালেও আলোচনা হয়েছে। আমি অন্ততপক্ষে ১৯৮৭-৮৮ সালের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য দিচ্ছি পিসিজেএসএস বা শান্তিবাহিনী দাবি করতে যেন, বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। আমরা তথা সরকারপক্ষ সেই ১৯৮৭-৮৮ সালে, জোরালো কিন্তু ভদ্রভাবে সে দাবি প্রত্যাখ্যান করেছি। আমরা বলেছিলাম, যে বাঙালিরা ইতোমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করছে, তারা থাকবেই। তাদের নিয়েই আগামী দিনের পার্বত্য রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক সংসার গড়ে তুলতে হবে। তাদের বাদ দিয়ে নয়। ১৯৮৮ সালের সমঝোতা মোতাবেক বা ১৯৮৯-এর ফেব্রুয়ারিতে প্রচারিত পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন মোতাবেক, জেলা পরিষদগুলোতে বাঙালি সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেই ১৯৮৮ সালে বাঙালি জনসংখ্যার যে অনুপাত ছিল, জেলা পরিষদে বাঙালি সদস্যের সংখ্যা ওই অনুপাতে হয়নি, কম হয়েছে, কিন্তু সবার জ্ঞাতসারে। উদ্দেশ্য, পাহাড়ি ভাইদের প্রাধান্য যেন নিশ্চিত থাকে। পাহাড়ি ভাইদের স্বকীয় জাতিসত্তাকে নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে। জায়গা-জমি ক্রয়-বিক্রয় সম্বন্ধে, পাহাড়ি ভাইদের নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে এবং সার্বিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমিত কৃষি বা শিল্প জমিকেও নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে।
১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের আগে, দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। নিশ্চিতভাবেই, বাঙালিদের প্রসঙ্গ সেখানে এসেছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী (যিনি বর্তমানেও প্রধানমন্ত্রী) তিনি বা তার হয়ে সরকারি প্রতিনিধিদল শান্তিবাহিনীকে কী উত্তর দিয়েছিলেন বাঙালিদের প্রসঙ্গে, সেটা আমাদের পক্ষে হুবহু জানা সম্ভব নয়। হয়তো, তিনি বলেছেন বাঙালিরা থাকবেই থাকবে, কিন্তু তাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা আলাদা করা হবে। অথবা হয়তো তিনি বলেছিলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে বাঙালিদের, প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে বা চুক্তি করে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রত্যাহার করা সম্ভব নয়, এটা রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের জন্য আত্মঘাতী হতে পারে। তৎকালীন সরকার হয়তো বলে থাকতেও পারেন, বাঙালিরা যেন পরিস্থিতির চাপে পড়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম ত্যাগ করে, সেই বন্দোবস্ত করা যাবে। হুবহু কী কথা হয়েছিল সেটা আমরা বলতে পারছি না সে জন্য দুঃখিত; তাই পাঠককে কল্পনা বা অনুমান করতে হবে। এই লেখা পড়তে গিয়ে, পাঠকের মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন এসেছে, বাঙালিদের উপস্থিতিতে, শান্তিবাহিনীর আপত্তি কেন? অথবা, ১৯৮৭-৮৮ সালে বা বর্তমানেও আমরা কেন বলছি যে, বাঙালিরা থাকতেই হবে?
সরকারি সিদ্ধান্তে বাঙালি জনগোষ্ঠী গিয়েছিল
উপরে এক জায়গায় লিখেছি, সশস্ত্র বিদ্রোহ মোকাবেলায় কিছু পন্থা অবলম্বন করতে হয়। কিছু পদক্ষেপ নিতে হয়। পদক্ষেপগুলো কোনো ধর্ম-গ্রন্থের পবিত্র বাণী নয়; যেই দেশে যেই পরিস্থিতি, সেই মোতাবেকই পদক্ষেপ নিতে হয়। কিন্তু সব দেশের পরিস্থিতির মধ্যে ও পন্থাগুলোর মধ্যে অনেক অনেক মিল থাকে। কিছু পদক্ষেপ আছে যেগুলোকে কৌশলগত পদক্ষেপ বলা যেতে পারে। কিছু পদক্ষেপ আছে যেগুলো সরেজমিন প্রয়োজনীয়তা থেকে উদ্ভব হয়। পদক্ষেপগুলোর সাথে সরাসরি সম্পর্ক হচ্ছে বিদ্রোহী কর্মকাণ্ড বা বিদ্রোহীদের চাহিদা।
কল্পনার জগতে একটি সম্মেলন
পাঠক কল্পনা করুন, আপনি ১৯৭৬-৭৭-১৯৭৮ সালের সেনাবাহিনীর একজন মেজর জেনারেল অথবা বাংলাদেশ সরকারে একজন সচিব অথবা বাংলাদেশের গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান। আপনারা, আপনাদেরই মধ্যে কোনো একজনের অফিসে বসে বা সম্মেলন কক্ষে বসে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছেন। শান্তিবাহিনী গত কিছু দিন যাবত কী ধরনের কাজ করছে, কে তাদের সাহায্য করছে, তাদের সমর্থকদের মুখে মুখে কী কথা ঘুরে বেড়াচ্ছে ইত্যাদি কথা সবাই মিলে মূল্যায়ন করলেন। ওই মূল্যায়নের পরিপ্রেক্ষিতে, গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হলো, বিদ্রোহী শান্তিবাহিনী কী চায় বা তাদের চাহিদা কী হতে পারে এবং বাংলাদেশ সরকারের কী পদক্ষেপ নেয়া উচিত? আমি, তথা আজকের কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান, ওই কল্পনার আলোচনা সভায় ছিলাম না।
আমি আমার সামরিক অভিজ্ঞতার আলোকে এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার আলোকে, আমার বিশ্লেষণ শক্তি ব্যবহার করে, ১৯৭৬-৭৭-৭৮ সালের ঘটনাবলিকে গল্পের আকারে উপস্থাপন করছি। সম্মেলন কক্ষে আলোচনার পর, উপসংহার হলো, শান্তিবাহিনী বিচ্ছিন্নতার পথে যেতে পারে অথবা নিদেনপক্ষে স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে যেতে পারে। যে পথেই যাক, জনগণের মতামত তাদের অনুকূলে থাকতে হবে এবং জনগণ তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে। শান্তিবাহিনী যে পথেই যাক, তারা সশস্ত্র কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখবে। অতএব, বাংলাদেশ সরকারকেও ওই পরিস্থিতি সশস্ত্রভাবে মোকাবেলা করতে হবে। অতিরিক্ত, বাংলাদেশ সরকারকে গভীর মনোযোগের সাথে সেখানে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করতে হবে বা করাতে হবে। সরকার, সামরিক বাহিনী মোতায়েনের পাশাপাশি এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালু করার পাশাপাশি, ১৯৭৬-৭৭-৭৮ সালে বারবার আহ্বান জানিয়েছিল শান্তিবাহিনীর প্রতি এই মর্মে যে, ভাইয়েরা আপনারা আসেন, আলোচনা করুন, সবাই মিলে সমস্যার সমাধান করি। আলোচনায় আসবে কি আসবে না এই নিয়ে শান্তিবাহিনী দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল এবং প্রায় তিন-চার বছর নিজেদের মধ্যে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত ছিল। যা হোক, এখন মনে হচ্ছে, ১৯৭৮ সালে সরকার শান্তিবাহিনী থেকে সাড়া না পেয়ে সিদ্ধান্ত নিলো, একাধিক কৌশলগত কারণে, বাঙালি জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়বে। 
বাঙালি বসতির সম্ভাব্য প্রেক্ষাপট
১৯৭৬-৭৭-৭৮ এইরূপ সময়ের কথা। শান্তিবাহিনীর শুরু করে দেয়া সশস্ত্র বিদ্রোহ বা যুদ্ধ মোকাবেলার জন্য অন্যতম পদক্ষেপ ছিল সেনাবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ ইত্যাদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন। এসব বাহিনীকে একযোগে আমরা নিরাপত্তা বাহিনী (সিকিউরিটি ফোর্সেস) বলতে পারি। নিরাপত্তা বাহিনী, বিশেষত সেনাবাহিনী মোতায়েনের পর দেখা গেল- ওইখানে পরিবেশ একান্তই বৈরী, কোনো কর্মকাণ্ডে কায়িক শ্রম দেয়ার মতোও কেউ নেই। সরকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বা রাস্তাঘাট নির্মাণ করতে গিয়ে দেখল শ্রমিক নেই।
পাঠক বিশ্বাস করুন বা নাই করুন, বাস্তবতা হলো সব সরকারি কর্মকাণ্ডকে শান্তিবাহিনী একবাক্যে উড়িয়ে দিত। বাক্যটি ছিল এরূপ। সরকার এটা করছে বা ওটা করছে জুম্মু জাতির অস্তিত্ব বিলুপ্ত করার জন্য। অতএব কোনো ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে পাহাড়ি জনগণ চাইলেও সরকারকে সহযোগিতা করতে পারত না। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ প্রয়োজন ছিল। অতএব সরকার দুঃস্থ, গরিব, নদী ভাঙা এ ধরনের বাঙালি পরিবারগুলোকে বিভিন্ন জেলা থেকে এনে পার্বত্য চট্টগ্রামে যথাসম্ভব (কিন্তু নিরাপত্তার গ্যারান্টি ছাড়া) পরিকল্পিতভাবে বসতি স্থাপনের সুযোগ করে দিলো। তিন-চার বছরের মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ হাজার পরিবার তথা দেড় থেকে দুই লাখ বাঙালি জনগণ বসতি স্থাপন করল। তিনটি পার্বত্য জেলার মধ্যে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতেই বেশি ব্যবস্থা হয়। বাংলাদেশ সরকার ১৯৮২ সালের শেষাংশে এইরূপ প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়।

বসতি নিয়ে দু’টি প্রশ্ন : রাজনৈতিক ও সামাজিক
তখন, অর্থাৎ আশির দশকের শুরুতে বা শেষে যারা যুবক ছিল, আজ তারা প্রৌঢ় অথবা বৃদ্ধ। তখন যারা বৃদ্ধ ছিল, আজ তারা কবরে; মুরুব্বিদের কবরের সাথে ধর্মীয় ও সামাজিক আবেগ জড়িত। তখন যারা শিশু ছিল আজ তারা নিজেরাই পিতা-মাতা বা অল্প বয়সের দাদা-দাদী বা নানা-নানী। বাঙালিদের বসতি স্থাপন, পিসিজেএসএসের কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় ছিল। যদি শান্তিবাহিনী সশস্ত্র বিদ্রোহ না করত বা যদি শান্তিবাহিনী ১৯৭৭-৭৮ সালেই সরকারি আহ্বানে সাড়া দিয়ে আলোচনায় আসত, তাহলে বাঙালিদের বসতি স্থাপনের চিন্তা বা পরিকল্পনা কোনো কিছুই সামনে ওঠে আসত না হয়তো। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রয়োজনে করা হয়েছিল। দরিদ্র নিঃস্ব বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন রাষ্ট্রের বা সরকারের আহ্বানে। কিন্তু বসতি স্থাপনের সময় থেকে শুরু করে পরবর্তী ১৫-২০ বা ২৫ বছর, রাষ্ট্র বা সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি মোকাবেলায় যথেষ্ট সতর্ক না থাকায়, হালনাগাদ না থাকায়, যথেষ্ট কৌশলী না হওয়ায়, এইরূপ বসতি স্থাপনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যেমন ইতিবাচক হয়েছে, তেমন নেতিবাচকও হয়েছে।
বাঙালি বসতির প্রতি শান্তিবাহিনীর প্রতিক্রিয়া
বাঙালি বসতিগুলো অচিরেই শান্তিবাহিনীর ব্যাপক আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। বাঙালিদের বসতি স্থাপন করার সময়, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিশ্চিতভাবে ভুল করেছেন অনেক ক্ষেত্রেই, ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক। বসতি স্থাপনের সময় বাঙালি জনগণ অনেক জায়গাতেই সরকারের দেয়া জায়গা-জমির বাইরে তাদের দৃষ্টি বা তাদের হাত প্রসারিত করেছিল। বাঙালিদের বসতি স্থাপনের সময়, সবার মধ্যে না হলেও অনেক পাহাড়ি ভাইদের মধ্যে যেমন উত্তপ্ত বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল, তেমনই অনেক বাঙালি ভাইদের মধ্যেও সনাতন সামাজিক প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছিল অর্থাৎ ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করো। বাঙালিদেরকে ক্ষুদ্র খণ্ড জমি দেয়া হয়েছিল বসতভিটার জন্য এবং কিছু জমি দেয়া হয়েছিল চাষাবাদ করে খাওয়ার জন্য। সরকারের মতে, বাঙালিদের দেয়া জমিগুলো খাস জমি। পাহাড়ি ভাইদের বা শান্তিবাহিনীর মতে, পাহাড়িদের জমিকেও খাস জমি বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে জায়গা-জমি নিয়ে গণ্ডগোল প্রায় প্রথম দিন থেকেই শুরু।
বাঙালিরা ছিল নিরস্ত্র, শান্তিবাহিনী ছিল সশস্ত্র। ক্ষেতে-খামারে কাজ করার সময় অথবা পাহাড়ের ঢালুতে বাগান করার সময় অথবা গ্রামে রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় বাঙালিরা শান্তি বাহিনীর আক্রমণের শিকার হতেন। শান্তিবাহিনী আক্রমণ করেই লুকিয়ে যেত। আক্রান্ত বাঙালিরা, উত্তপ্ত বিক্ষুব্ধতায় প্রতিবেশী পাহাড়ি গ্রামের ওপরে আক্রমণ করত। বাঙালিদের আক্রমণের আগে ভয়ে অথবা আক্রমণের পর পাহাড়িরা জঙ্গলে পালিয়ে যেতেন অথবা ভারতে পালিয়ে যেতেন। এটি হয়ে পড়েছিল একটি দুষ্টচক্র তথা ভিসাজ সাইকেল অব ভায়োলেন্স। এর প্রতিকার প্রয়োজন ছিল। 
গুচ্ছ গ্রামে এলেও, জমির মালিকানা থেকে যায়
১৯৮৮ সালের এপ্রিল-মে মাসে শান্তিবাহিনীর মারাত্মক আগ্রাসী কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে, বাঙালি জনগণকে নিজ নিজ বসতি থেকে সরিয়ে আনা হয় সুবিধাজনক বা নিরাপদ ভৌগোলিক অবস্থানে। এগুলোর নাম গুচ্ছগ্রাম। গুচ্ছগ্রামে বাঙালিরা নিজ ইচ্ছায় আসেননি। তৎকালীন এরশাদ সরকারের পরিকল্পনায় ও আহ্বানে বাঙালিরা গুচ্ছগ্রামে এসেছিলেন। তৎকালীন সরকারপ্রধান বলেছিলেন, আমাকে তিন বছর সময় দাও, আমি পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপ বা সার্ভে করিয়ে নিচ্ছি, অতঃপর বাঙালিদের পুনরায় তাদের বরাদ্দ ভূমিতে বা ভিটাবাড়িতে ফেরত দেবো। যদি অরিজিনাল বসতি স্থাপনের সময় কোনো ভুলভ্রান্তি হয়ে থাকে, তাহলে ভূমি জরিপ বা সার্ভের পরপরই অরিজিনাল ভুলগুলো সংশোধন করা হবে।
কিন্তু বিধি বাম! ১৯৮৮ সালের অক্টোবরে গুচ্ছগ্রাম হলো; পাহাড়ি সামাজিক ও নাগরিক নেতাদের সাথে সমঝোতা হলো। ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে চারটি আইন পাস হলো; ২৫ জুন তারিখে জেলা পরিষদ নির্বাচন হলো। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে এরশাদ সাহেবের পতন হলো। তাহলে ভূমি জরিপ কোথায় গেল? আজ প্রায় ২৮ বছর গুচ্ছগ্রামের বাঙালিরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সরকারের অপ্রতুল রেশনে তারা বেঁচে আছেন। সরকার না তাদের ফেলছে, না তাদের তুলছে। গুচ্ছগ্রামে তারা লাফাতে লাফাতে নিজ ইচ্ছায় যাননি। সেই ১৯৭৮-৭৯-৮০-৮১ সালে যেসব জমির মালিকানা কাগজ তাদের দেয়া হয়েছিল সেগুলো তাদের কাছে আছে। যাদের নামে জমি ছিল তাদেরও অনেকে মারা গেছে হয় শান্তিবাহিনীর আক্রমণে অথবা স্বাভাবিক নিয়মে অসুখ-বিসুখে। মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীরা নিজেদের নামে সহায়-সম্পত্তি প্রক্রিয়া করতে পারছেন না। বাঙালিদের মালিকানাধীন সহায়-সম্পত্তি নিয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাহাড়িদের আপত্তি আছে; অর্থাৎ বিরোধ আছে। পাহাড়িদের মধ্যেও পারস্পরিক বিরোধ আছে। বিরোধ থাকলে নিষ্পত্তি করতে হবে। কিন্তু যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও কৌশলগতভাবে মূল্যবান ভূখণ্ড, সেহেতু সেখানে যা-ই করা হোক না কেন, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিসহ সব কাজ, সেটি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সাথে অনুকূল হতে হবে।
পরিবেশ-পরিস্থিতি: ১৯০০ সাল ও ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ
পার্বত্য চট্টগ্রামের জায়গা-জমির মালিকানা একটি ক্রান্তিকালীন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের আচার-আচরণ সামাজিক কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রের সাথে ইন্টার অ্যাকশন ইত্যাদি সবকিছু একটি ক্রান্তিকালীন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ব্রিটিশরা ১৯০০ সালে যে আইন করেছিল, সেই আইন এখনো আছে; কেউ বলছে বহাল এবং বৈধ, কেউ বলছেন সুপারসিডেড এবং অপ্রযোজ্য। পার্বত্য চট্টগ্রামের জায়গা-জমির মালিকানা অতীতে বৃহদাংশে ছিল সামষ্টিক; সবাই মিলেমিশে চাষাবাদ করত, সবাই মিলেমিশে চলত। ১৯০০ সালে যত জনগণ ছিল, ২০১৬ সালে সেই সংখ্যা তিন-চার গুণ বেশি স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু ১৯০০ সালে যতটুকু পাহাড়ি ঢালু জমিতে, জঙ্গল পুড়িয়ে পাহাড়িরা চাষ করতে পারত, ২০১৬ সালে প্রাকৃতিক নিয়মেই ওই জমির পরিমাণ অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। ১৯০০ সালে পাহাড়ি তরুণ-তরুণীরা জুমচাষে যেতে আনন্দ পেতেন এবং এটিই প্রধান কর্ম ছিল; ২০১৬ সালে শিক্ষাদীক্ষা এবং সামাজিক চিন্তা চেতনায় পরিবর্তনের কারণে জুমচাষের প্রতি নিবেদন কমে গিয়েছে। উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। অর্থাৎ যেকোনো জনগোষ্ঠী যেমন আর্থ-সামাজিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে অগ্রগতি করে, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীও ওইরূপ করছে; অতিরিক্ত যোগ হয়েছে রাজনৈতিক কর্মসূচি বা রাজনৈতিক বিবর্তন।
জমির পরিমাণ এবং ভূমি জরিপ
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগোলিক আয়তন কতটুকু, সে সম্বন্ধে সবার ধারণা আছে; বাংলাদেশের দশ ভাগের এক ভাগ। সেখানে সংরক্ষিত বনাঞ্চল আছে, উঁচু উঁচু পাহাড়ি এলাকা আছে, লেক আছে, নদী ও ছড়া আছে, বর্ষাকালে ডুবে যায়; কিন্তু শুকনা কালে চাষাবাদযোগ্য হয় এমন জমি আছে। সাধারণ জ্ঞান বা সাধারণ অভিজ্ঞতার আলোকে বলতেই পারি যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে জুমচাষ ছাড়া সমতলীয় কৃষিযোগ্য জমির পরিমাণ সীমিত। সাধারণত পাহাড় শ্রেণীর মাঝখানে উপত্যকায় অথবা নদী ও ছড়াগুলোর উভয় তীরে অঞ্চলগুলোই আবাদযোগ্য কৃষিজমি। অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা পাঠকের সামনে উপস্থাপন করছি।
কথাটি এই যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনোদিনই বৈজ্ঞানিক বা পদ্ধতিগত ভূমি জরিপ হয়নি। জায়গা-জমি ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে জড়িত যারা, অথবা আইনজীবী সম্প্রদায় অথবা গ্রামের মুরুব্বিরা, আমাদের এই দক্ষিণ-এশীয় উপমহাদেশে যেই ভূমি জরিপকে, প্রথম জরিপ হিসেবে জানি, সেটির নাম ক্যাডেস্টাল সার্ভে বা সিএস জরিপ। ওই সিএস জরিপ পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনোদিন হয়নি; গুরুতর কোনো প্রয়োজন দেখা দেয়নি, সে জন্য জরিপও হয়নি। কালের বিবর্তনে, জরিপ করা এখন সময়ের দাবি। যেখানে সিএস জরিপই হয়নি, সেখানে পরের আরএস-বিএস ইত্যাদি হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। বাঙালি জাতি, বাংলাদেশ সরকার ও পাহাড়ি ভাইদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপ হবে কি হবে না?
পাহাড়ি ভাইয়েরা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির মালিক আমরা পাহাড়িরাই; অন্য কারো পদচিহ্ন রাখার জায়গা নেই। ব্রিটিশ সরকার, পাকিস্তান সরকার এবং বাংলাদেশ সরকার বলছে যে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জায়গা সেখান আছে। পাহাড়ি ভাইয়েরা বলেন, মালিকানা ঠিক না করলে জরিপ কার নামে হবে? বাঙালি ভাইয়েরা বলেন, জরিপ না করলে মালিকানা কিভাবে ঠিক হবে? এখন থেকে ১০০ বছর আগে যখন সিএস জরিপ শুরু হয় এই দক্ষিণ-এশিয়া উপমহাদেশে, তখন কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল সেটি কি আমাদের কারো মনে নেই? মনে থাকুক বা না থাকুক, আলোচনা করে নিশ্চয়ই সুপন্থা বের করা যায়।
১৯৮০-এর দশকে একাধিকবার, ১৯৯০-এর দশকে একাধিকবার সরকার পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল, পার্বত্য চট্টগ্রাম জরিপ করার জন্য; কিন্তু পিসিজেএসএসের বিরোধিতার কারণে সেটি করা হয়নি। অতএব, সবাইকে সম্পৃক্ত করে, আলোচনার পর জরিপ নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।
ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন
একটু আগেই লিপিবদ্ধ করেছি যে, ভূমি নিয়ে বিরোধ ছিল এবং আছে। এই বিরোধ নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরের শান্তিচুক্তিতে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন করার কথা বলা ছিল এবং গঠন হয়েছিলও। কমিশন কিছুদিন কাজ করেছিল। ভূমি কমিশনের গঠনে বা সদস্যসংখ্যা নিরূপণে এবং কমিশনের কার্যপ্রণালীতে, শান্তিবাহিনীর আপত্তি ছিল। পিসিজেএসএস সরকারের প্রতি ইত্যাদি বিষয় সংশোধনের জন্য প্রস্তাব দেয়।
২০১৬ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধিত হয়েছে। এখন সংশোধিত আইনই কার্যকর। সংশোধনের পর পরিস্থিতি বন্যার পানির মতো, পাহাড়ি ভাইদের অনুকূলে চলে গেছে। কমিশন গঠন এমনভাবে সংশোধন করা হয়েছে এবং কমিশনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এমন করা হয়েছে যে, বাঙালিদের পক্ষে কথা বলার, কোনো আপত্তি দেয়ার বা আপত্তি বিবেচনা করার কোনো অর্থবহ পরিবেশ আর থাকছে না। চেয়ারম্যান হবেন একজন অবসরপ্রাপ্ত মাননীয় বিচারপতি। চেয়ারম্যান ছাড়া কমিশনের সদস্য সংখ্যার মধ্যে ৮০ শতাংশ হচ্ছেন পাহাড়ি। অতএব বিরোধ নিষ্পত্তিগুলো পাহাড়ি পক্ষের অনুকূলে হওয়ার সম্ভাবনা অনেক।
এটা তো গত তিন দশক ধরেই দৃশ্যমান যে, পাহাড়িরা ভূমি নিয়ে বিক্ষুব্ধ এবং বাঙালিরা ভূমি নিয়ে উদ্বিগ্ন। আইন মোতাবেক, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন প্রদত্ত সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত; বাংলাদেশের অন্যত্র সব জায়গায় প্রযোজ্য ভূমি আপিল বোর্ড বা মহামান্য হাইকোর্ট ইত্যাদিতে কোথাও যাওয়া যাবে না। অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন প্রদত্ত রায় চূড়ান্ত ও সর্বশেষ।
কমিশনের সম্ভাব্য রায়গুলোর ফলাফল
ইংরেজিতে প্রবাদ বাক্য আছে, ‘হোপ ফর দ্য বেস্ট অ্যান্ড প্রিপেয়ার ফর দ্য ওয়ার্স্ট।’ মানে হলো, সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতির জন্য প্রার্থনা কর বা আশা কর, কিন্তু সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ কর। আমরা একটি পরিস্থিতি কল্পনা করি। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে তিন হাজার বিরোধ নিষ্পত্তি করল। আমরা কল্পনা করি, নিষ্পত্তি হওয়া বিরোধের মধ্যে রায় ৮০ শতাংশই বাঙালিদের বিপক্ষে গেল। অতএব, যারা জায়গা-জমি হারালেন, সেই সব বাঙালি কোন দিকে যাবেন? আমি জানি না। আসলে কী ঘটবে, কী ঘটতে পারে, জানি না। জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরা সবাই মিলে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে পারলে ভালো হতো।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর, সেই চুক্তির নেতিবাচক আঙ্গিকগুলোর প্রতিবাদে বা চুক্তির কারণে আগামী দিনের নেতিবাচক পরিস্থিতির প্রতিবাদে, তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ঢাকা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামমুখী লংমার্চ হয়েছিল। সেটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় প্রতিবাদ। কিন্তু ২০০১ থেকে ২০০৬ সময়কালে, ওই বিষয়গুলোর প্রতি সরকারি মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয়নি, যেকোনো কারণেই হোক।
সরেজমিনে সাংগঠনিক কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতিবাদ এক জিনিস এবং জ্ঞান-বুদ্ধি খাটিয়ে চিন্তাভাবনা করে সমস্যা থেকে উত্তরণ করার কর্মযজ্ঞ আরেক বিষয়। উভয়টির জন্য ব্যক্তি ইবরাহিম বা তার দল বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি যথেষ্ট সক্ষম নয়। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির শাখা-প্রশাখাও পার্বত্য জেলার কোথাও নেই। সবাই মিলে ইতিবাচকভাবে পরিস্থিতিটির প্রতি মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন।
বাঙালি জনসংখ্যার গুরুত্ব :১৯৬২ ও ১৯৭১
মনে করি বাঙালি জনগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে কমে গেল; মনে করি বাঙালি জনসংখ্যা পাঁচ বা দশ শতাংশে চলে এলো। তাহলে কি ডেমোগ্রাফিক্যালি অর্থাৎ সংখ্যা-তাত্ত্বিকভাবে, জনসংখ্যা কি ১৯৭৫-৭৬-৭৭ ইত্যাদি বছরে ফিরে গেল না? পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং মিয়ানমারের সাথে সীমান্ত এলাকায় অথবা পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ভারতের মিজোরাম প্রদেশের সীমান্ত এলাকায় অথবা পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ভারতের ত্রিপুরা প্রদেশের সীমান্ত এলাকায় যেসব বাঙালি বসতি আছে, সেই বসতিগুলো যদি হালকা হয়ে যায় বা শূন্য হয়ে যায়, তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে?
১৯৬২ সালে ভারত ও চীনের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল, ভারত দুর্বল পক্ষ ছিল। বর্তমানে ভারতের সর্ব উত্তর-পূর্বে অবস্থিত অরুণাচল প্রদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে যুদ্ধ হয়েছিল; বাংলাদেশের সিলেটের পাঁচ বা সাত শ’ কিলোমিটার উত্তর-উত্তর পূর্ব দিকে। সেই সময় ওই সব অঞ্চলে ভারতীয় জনগণের বসতি ছিল না। গত চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে ওইসব অঞ্চলে ব্যাপক ভৌত কাঠামো এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন করা হয়েছে যেন ভারতীয় জনগণ ওই সীমান্তবর্তী অঞ্চলে, আবহাওয়ার উপযোগিতা সাপেক্ষে বসতি স্থাপন করে থাকতে পারেন। কেন? উত্তর দেয়ার জন্য সামরিক বাহিনীর সদস্য বা নিরাপত্তাবিশ্লেষক হওয়ার প্রয়োজন নেই; যেকোনো সাধারণ সচেতন নাগরিক চিন্তা করলেই পাবেন।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষ অংশে, ভারতীয় সেনাবাহিনী যখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে, তখন পথে পথে স্তরে স্তরে বাঙালিরা ভারতীয় বাহিনীকে সহায়তা-সহযোগিতা করেছিল। ভারত ও বাংলাদেশের পরিস্থিতি থেকে উদাহরণ দিয়ে বুঝাতে চাইলাম, ক্রুসিয়াল বা গুরুত্বপূর্ণ স্পর্শকাতর ভৌগোলিক এলাকায়, সরকার ও রাষ্ট্রের প্রতি প্রশ্নাতীতভাবে অনুগত জনগোষ্ঠী অতি প্রয়োজনীয়।
উপজাতি না কি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নাকি আদিবাসী
আমরা এতক্ষণ বাঙালি জনগোষ্ঠী এবং ভূমি সমস্যা নিয়ে আলোচনা করলাম। ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তির প্রেক্ষাপটে বা শান্তিচুক্তি থেকে উদ্ভূত কিছু কিছু সমস্যার কথা এখনো আলোচনা করা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৩টি উপজাতির বাস। ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তিতে তাদের উপজাতি বলে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতিক তাদের উপজাতি না বলে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী (এথিনিক মাইনোরিটি) বলা হচ্ছে। ভালো; আমার ব্যক্তিগত কোনো সমস্যা নেই। তবে এরকম এথিনিক মাইনোরিটি পৃথিবীর বহু দেশে আছে। পৃথিবীর বহু দেশের মেজরিটি জনসংখ্যা, অত্যাচার করে, অন্যায় করে, তাদের দেশের এথিনিক মাইনোরিটিকে প্রায় বিলুপ্ত করে ফেলেছে।
ধ্বংসের কাজ যখন প্রায় শেষ তখন তাদের বিবেক জাগ্রত হয়েছে। এথিনিক মাইনোরিটি জনগোষ্ঠীকে বাঁচানোর জন্য সম্মিলিত চেষ্টা শুরু হয়েছে। উদ্যোগগুলো শুভ। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে বা বাংলাদেশেও অনেক ভুলভ্রান্তি হয়েছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে এথিনিক মাইনোরিটি বিপদগ্রস্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামের এথনিক মাইনোরিটি ভাগ্যবান এই মর্মে যে, তারা অনেকেই একসাথে একটি সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায়। তারপরও তাদের ওপর বিপদ-আপদ আছে।
অপরপক্ষে বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ অঞ্চল সমতল ভূমি। সেই ৯০ শতাংশ সমতল ভূমিতে যারা অএথিনিক মাইনোরিটি ছিল বিভিন্ন জায়গায় ছড়ানো-ছিটানো, তাদের এখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সার্বিকভাবে এই প্রেক্ষাপটে, পার্বত্য চট্টগ্রামের এথিনিক মাইনোরিটি নিজেদেরকে আদিবাসী (ইংরেজি পরিভাষায় ইনডিজেনাস) দাবি করছেন এবং আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত কিছু কনভেনশন বা প্রটোকল বা ডিক্লারেশনের আওতায় নিজেদের আশ্রয় চাচ্ছেন। ওই চাওয়া এবং চাওয়া পূরণ না হওয়া, এরও গুরুত্বপূর্ণ আঙ্গিক আছে।
বাংলাদেশ যদি আন্তর্জাতিক আহ্বান মোতাবেক, আনুষ্ঠানিকভাবে, অ্যাথিনিক মাইনরিটি জনগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ বা ইনডিজেনাস বলে মেনে নেয়; তাহলে বাংলাদেশ রাষ্ট্র বা সরকারের পক্ষ থেকে ওই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতি কতগুলো আইনি দায়বদ্ধতা এসে যাবে। ওই সব আইনি দায়বদ্ধতা পালন করা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য ক্ষতিকারক বা হুমকি হওয়ার সম্ভাবনা ৯৯ শতাংশ। অতএব এই বিষয়টি সামাজিক, রাজনৈতিক, ভূ-কৌশলগত, সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সব জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তির সামনে উপস্থাপন করা প্রয়োজন।
আজ যে কলাম সম্মানিত পাঠক পড়ছেন, সেটি হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে আমার শুধু এই সপ্তাহে নিবেদনের চতুর্থ বা শেষ পর্ব। সাত দিন আগে গত বুধবারে প্রথম পর্ব বের হয়েছিল। মাঝখানে আরো দু’টি পর্ব গিয়েছে। ২০১৫ সালের ১১ মার্চ, ১৮ মার্চ, ২৫ মার্চ, ১ এপ্রিল, ৮ এপ্রিল ১৬ এপ্রিল, ২২ এপ্রিল ২০১৫ এবং সর্বশেষ ৫ মে ২০১৫ তারিখেও ধারাবাহিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে এই পত্রিকাতেই কলাম লিখেছি। এই পরিপ্রেক্ষিতে, পত্রিকার কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এবং যে পাঠকমণ্ডলী কষ্ট করে আগের তিনটি আর আজকের একটিসহ মোট চারটি পর্ব পড়েছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। যারা সময়ের অভাবে পড়তে পারেননি তাদের জন্য আমার ওয়েবসাইট যথা : www.generalibrahim.com ঠিকানায় আপ করা আছে। এই ওয়েবসাইটটিতে ঢুকলেই, ‘কলাম’ ক্যাপশনটি নজরে আসবে। ওখানে কলামগুলো পাবেন; উপরে-নিচে গেলেই আগের বা পেছনের কলামগুলো দেখা যাবে। অথবা কেউ যদি আমাকে ইমেইল করেন, তাকে আমরা ইমেইলে কপি পাঠিয়ে দেবো।
সংখ্যা থেকেও গুরুত্ব বেশি দায়িত্বের
পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যার মধ্যে ৬০-৬৫ শতাংশ বা কারো কারো মতে, ৫২-৫৩ শতাংশ হলো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্য (এথিনিক মাইনরিটি); অবশিষ্টরা বাঙালি। গত ছয় দিনের মধ্যে একটি কলামে উল্লেখ করেছি, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠী নিজেদের নাম বা সংজ্ঞা পরিবর্তন করছেন। তারা নিজেদের আদিবাসী (ইংরেজি পরিভাষায় : ইনডিজেনাস) বলতে চান। তারা চাচ্ছেন, বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ২০০৭ সালের জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার ঘোষণা অনুস্বাক্ষর (ইংরেজি পরিভাষায় : রেটিফাই) করুক এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগণসহ বাংলাদেশে যত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠী আছে, বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তা আছে, তাদের অফিসিয়ালি ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দিক। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়; উপজাতীয় জনগণের ভাষায় এটি তাদের অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত; আমার মতে (এবং আমার মতো লাখ লাখ বাঙালির মতে), এটি বাংলাদেশের নিরাপত্তা, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার সাথে সম্পর্কিত বিষয়। অতএব, এখানে এই অনুচ্ছেদে আর বেশি কিছু আলোচনা করছি না। এই কলামে আমি শুধু সহজ আলোচনার স্বার্থে, ‘উপজাতি’ শব্দটি ব্যবহার করছি।
জনগণের কষ্ট এবং শান্তিবাহিনীর যুদ্ধ
পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগণ ইতিহাসের পরতে পরতে কষ্ট, নিগ্রহ আর বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। এটা প্রণিধানযোগ্য। ব্রিটিশ আমলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে করে তারা স্বাধীন অস্তিত্ব বা স্বকীয়তা রক্ষা করতে চেয়েছিলেন; পারেননি। ১৯৪৭-এ তাদের নেতারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু পারেননি। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬২- এই সময়টিতে জনগোষ্ঠীর মারাত্মক স্থান পরিবর্তন (ইংরেজি পরিভাষায় : ডেমোগ্রাফিক রি-লোকেশন) ঘটে, কাপ্তাইতে কর্ণফুলী নদীর ওপর বাঁধ দেয়ার কারণে। বাঁধের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে কিছু মানুষ চলে যায় ভারতের অরুনাচল ও মিজোরাম প্রদেশে; ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বৃহদাংশ যায় বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন স্থানে। অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে তারা নতুন জায়গায় নিজেদের ঠিকানা গড়ে নেয়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাদের বেশির ভাগ নেতা পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেন; ফলে স্বাধীন বাংলাদেশে তারা কঠোর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি অথবা তাদের সশস্ত্র সংগঠন (শান্তিবাহিনী) সামন্তবাদের বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিল। হয়তোবা শান্তিবাহিনীর সামনে যুদ্ধে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো পন্থা বাকি ছিল না; হয়তো শান্তিবাহিনী ধৈর্য ধরতে ব্যর্থ হয়েছিল; হয়তোবা শান্তিবাহিনী যুদ্ধ শুরু করার সময়টি বেছে নিতে ভুল করেছিল; কোনটি সঠিক তা হলফ করে বলতে পারব না। ’৭০-এর দশকে আমি নিজেও তো একজন তরুণ অফিসার ছিলাম। সব মিলিয়ে পুরো জনগোষ্ঠী সঙ্কটে পড়েছিল এবং পড়েছে। সামন্তবাদ উচ্ছেদ হয়নি; বাংলাদেশ সরকার উচ্ছেদ হয়নি। তবে হ্যাঁ, বাংলাদেশ সরকারের কাছে কিছু বিষয় উদ্ভাসিত বা প্রতিভাত হয়েছে।
শান্তি স্থাপন ও শান্তিবাহিনীর চাহিদা : উভয়ের সমন্বয়
পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি স্থাপনের নিমিত্তে, রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণের ইতিহাস ১৯৭৭-৭৮ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত বিস্তৃত। ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় সংসদ কর্তৃক চারটি আইন পাস করা হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসঙ্গে; সেগুলোর মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্ঘাতপূর্ণ ইতিহাসে নতুন মাইলফলক সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৮৮-৮৯ এর পদক্ষেপগুলোর ওপর ভিত্তি করেই, আরেকটি অতিরিক্ত যোগ করে, ১৯৯৭-এ একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। শান্তি স্থাপনের প্রয়াস এবং শান্তিবাহিনীর চাহিদা, এ দু’টির মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করা কঠিন বৈকি। শান্তিবাহিনী কী চেয়েছিল? তারা চেয়েছিলেন বাংলাদেশকে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র বানাতে; পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে গঠিত ক্ষুদ্র প্রদেশটির রাজধানী হবে রাঙামাটি; প্রদেশটির নাম হবে জুম্মল্যান্ড। বড় প্রদেশটির রাজধানী হবে ঢাকা এবং সমগ্র দেশের রাজধানীও হবে ঢাকা। কেন্দ্রের হাতে থাকবে মাত্র চারটি বিষয়; বাকি সব থাকবে প্রদেশের হাতে। এরূপ দাবি ১৯৬৬ সালে (ছয় দফা দাবিনামা) তৎকালীন আওয়ামী লীগ করেছিল তদানীন্তন পাকিস্তানের সরকারের প্রতি। তৎকালীন পাকিস্তানের সরকারগুলো মনে করেছিল, যদি এই ছয় দফা মেনে নেয়া হয় তাহলে আজ হোক কাল হোক, পূর্বপাকিস্তান একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হবে। শান্তিবাহিনী যখন তাদের দাবিনামা আমার হাতে বা আমাদের হাতে দিয়েছিল, আমরাও ঠিক ওই একই আশঙ্কা করেছিলাম। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এসেও, আমি অন্তত নিশ্চিত নই যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নামক রাজনৈতিক দলটি, পার্বত্য চট্টগ্রামকে প্রদেশ করার প্রকাশ্য বা গোপন দাবি থেকে সরে এসেছে। প্রত্যেকটি দেশই তাদের প্রান্তিক অঞ্চল নিয়ে শঙ্কিত থাকে, বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়; ভারত অধিকৃত কাশ্মির (বা ভারতীয় কাশ্মির) এর জ্বলন্ত উদাহরণ।
আমাদের স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন
শান্তিবাহিনী কর্তৃক উপস্থাপিত পাঁচ দফা দাবিনামা নিয়ে আলোচনা না করলেও, বাংলাদেশ সরকার এটি স্বীকার করেছিল এবং আমরা এখনো স্বীকার করি এবং সর্বতোভাবে কামনা করি, বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায়, সংবিধানের সংশ্লিষ্ট আর্টিক্যালগুলোর উদার ব্যাখ্যার মাধ্যমে, বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা উপজাতীয় জনগণের ধর্মীয়, ভাষাগত, সাংস্কৃতি, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সুরক্ষা যেন দেয়া হয়। ষোলো কোটি মানুষের দেশে, সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চার থেকে পাঁচ লাখ ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেয়ার অলংঘনীয় দায়িত্ব বাকি পনেরো কোটি পঁচানব্বই লাখ মানুষের। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগণের স্বকীয়তা রক্ষার জন্য অবশ্যই আইনগত বা সাংবিধানিক ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজনৈতিকভাবে আমরা মূল্যায়ন করেছিলাম যে, স্থানীয় সরকার পদ্ধতির মাধ্যমে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের করা ক্ষমতায়ন ও আংশিকভাবে নিজস্ব প্রশাসন দেয়া যেতে পারে। এর ভিত্তিতেই ১৯৮৮ সালের অক্টোবরে সমঝোতা হয়েছিল এবং ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আইন প্রণীত হয়েছিল। যারা এই অনুচ্ছেদের বক্তব্যগুলোর আগের কথা খুঁজছেন, তারা মেহেরবানি করে গত সাত দিনে প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট তিনটি কলাম পড়ুন। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলামÑ এমন কোনো বন্দোবস্ত করা যাবে না, এমন কোনো পরিবেশ সৃষ্টি করা যাবে না, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের অখণ্ডতা বা একক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য (ইংরেজি পরিভাষায় : ইউনিটারি ক্যারেক্টার অফ দি স্টেট) হুমকির মুখে পড়ে। ওই সময় (১৯৮৮-৮৯) শান্তিবাহিনী ওই বন্দোবস্তগুলোর বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু ১৯৯৭ সালে, আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে আলোচনাকালে তারা এগুলোকে মেনে তো অবশ্যই নিয়েছিল, অতিরিক্ত আরো কিছু দাবি করে আদায় করে নিয়েছিল। ১৯৯৭ সালে সরকার যে শান্তিচুক্তি করেছে, সে শান্তিচুক্তি এবং এর থেকে প্রসূত রিজিওনাল কাউন্সিল নামক প্রতিষ্ঠানটি অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের চোখে প্রশ্নবোধক, অনেক সাংবিধানিক বিশ্লেষকের চোখে প্রশ্নবোধক, এমনকি হাইকোর্টের একাধিক রায়েও প্রশ্নবোধক। রিজিওনাল কাউন্সিল কি ওই অঞ্চলের জন্য স্বায়ত্তশাসনের দুয়ার খুলে দিলো? অথবা, প্রাদেশিক মর্যাদা প্রাপ্তির দাবি পুনরুজ্জীবিত করবে? বাঙালিবিহীন পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক দৃশ্যপট কেমন হতে পারে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর যুগপৎ আশঙ্কাজনক ও অনিশ্চিত।
বাংলাদেশের সংবিধান ও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী
বাংলাদেশের সংবিধান লিখিতভাবে বা প্রকাশ্যভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ কোনো মর্যাদা দেয়নি; যেমন কিনা ব্রিটিশ আমলে এবং পাকিস্তান আমলে দেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের সংবিধান কোনো অঞ্চলের কোনো জনগোষ্ঠীকেও ‘পশ্চাৎপদ’ বলে ঘোষণা দেয়নি; এমনকি পশ্চাৎপদতা নির্ণয়ের প্রক্রিয়া বা মাপকাঠি সম্বন্ধেও কোনো বিধান রাখেনি। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানের ২৩, ২৩ক, ২৪, ২৭, ২৮ এবং ২৯ নম্বর আর্টিক্যালে কিছু বক্তব্য আছে, যেই বক্তব্যগুলো সরকারকে শক্তি জোগায় অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কল্যাণের নিমিত্তে বিবিধ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আইনগত পদক্ষেপ নিতে। এর ওপর ভিত্তি করেই ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আইনগুলো করা হয়েছিল; এবং ১৯৯৮ সালের আইনগুলো করা হয়েছিল। ২০১৬ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে যে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধন করা হলো, সেই অরিজিনাল আইনটিও ’৯৭-এর শান্তিচুক্তি থেকে প্রসূত।
পশ্চাৎপদতা দূর করার উদ্যোগ
আমাদের সাধারণ অনুভূতি মোতাবেক, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠী অনগ্রসর ছিল। এই প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমল থেকে শুরু করে আজ অবধি বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকার, পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীকে পশ্চাৎপদ বলে মনে করে এবং সেই পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে অনেক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ওই সব পদক্ষেপের কারণে, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর বৃহদংশ, সাধারণ জ্ঞান বা সাধারণ অনুভূতি মোতাবেক এখন আর পশ্চাৎপদ নেই। বরং পার্বত্য চট্টগ্রামে গত পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর বসবাসরত বাঙালি জনগোষ্ঠী এবং বান্দরবান জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাসরত উপজাতীয় জনগোষ্ঠী পশ্চাৎপদ রয়ে গেছেন। প্রবাদ বাক্য আছে, রোম মহানগরী একদিনে নির্মিত হয়নি (ইংরেজি পরিভাষায় : রোম ওয়াজ নট বিল্ট ইন অ্যা ডে)। আজকের পৃথিবী যে পার্বত্য চট্টগ্রাম দেখছে সেটিও একদিনে হয়নি; বহু মানুষ, বহু সংগঠন, বহু লেখক, বহু সামরিক ব্যক্তি, বহু রাজনৈতিক ব্যক্তি, বহু সাংবাদিক, বহু সরকারি আমলা, বহু উপজাতীয় নেতা ও মানুষ, সে প্রক্রিয়ায় অবদান রেখেছেন। কিন্তু কাজগুলো করতে গেলেই কোনো না কোনো প্রকারের ত্রুটি বা ব্যত্যয় হতেই পারে। অতএব, উত্তরসূরি প্রজন্মের দায়িত্ব হলো, সেই ত্রুটিগুলোকে সংশোধনের নিমিত্তে উদ্যোগ নেয়া। পার্বত্য চট্টগ্রামেও এরূপ বৃহত্তর মঙ্গলপ্রচেষ্টার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়, অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। যেমনÑ সাদামাটা ভাষায় বলা যায়, শান্তি আলোচনা করাটা অত্যন্ত বৈধ ও প্রয়োজনীয়; শান্তিচুক্তি করাটাও বৈধ ও প্রয়োজনীয়। কিন্তু চুক্তির ফলে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো কিছু করা কাম্য নয়। অপর ভাষায় বলতে গেলে, এই দাঁড়ায়, যা করা হবে তাকে সংবিধানের আওতাতেই রেখে করতে হবে; অথবা সংবিধানকে সংশোধন করতে হবে।
একাধিক আইনের সমন্বয় প্রয়োজন
আমি বা আমার মতো নিশ্চয়ই শত-সহস্র আছেন যারা কায়মনোবাক্যে চাচ্ছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি শান্তিপূর্ণ অঞ্চল হয়ে উঠুক। এরূপ অঞ্চল হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে, সেখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত হতে হবে, এবং জনগণের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি সৃষ্টি করতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই মুহূর্তের পার্বত্য চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত নয়; সশস্ত্র বিশৃঙ্খলা দৃশ্যমান; চাঁদাবাজি চরম পর্যায়ে আছে এবং গুম খুন ইত্যাদি অপরাধ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে দু’টি প্রধান সম্প্রদায় আছে যথা উপজাতীয় জনগোষ্ঠী এবং বাঙালি জনগোষ্ঠী। উপজাতীয় জনগোষ্ঠী কর্তৃত্বের পর্যায়ে বা সুবিধাজনক পর্যায়ে আছে; বাঙালি জনগোষ্ঠী আতঙ্কজনক অবস্থায় এবং মানসিক অনিশ্চয়তার পর্যায়ে আছে। এর কারণগুলো গত ছয় দিনের তিনটি কলামে আলোচনা করেছি। সবচেয়ে বড় সমস্যা প্রশাসন নিয়ে। অবশ্যই প্রশাসনে কর্মরত ব্যক্তিদের দিকে ইঙ্গিত করছি না। আমি ইঙ্গিত করছি পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসঙ্গে যে সব আইন বা বিধিবিধান প্রযোজ্য সেগুলোর সমন্বয়হীনতার প্রতি, পারস্পরিক অসামঞ্জস্যতার প্রতি, আইন বা বিধিবিধান প্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষের অমনোযোগিতার প্রতি।
প্রযোজ্য আইনের অসংলগ্নতা
ব্রিটিশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে শান্তিপূর্ণভাবে শাসন করার জন্য প্রণীত হয়েছিল চিটাগাং হিল ট্রাক্টস রেগুলেশন অব ১৯০০। পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ এবং বাংলাদেশ হওয়ার পর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ দেশের প্রয়োজনে আগের আমলের অনেক আইনকে অ্যাডাপ্ট বা চলমান করে নিয়েছেন এবং নতুন নতুন অনেক আইন প্রণয়ন করেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য কিছু আলাদা আইনও প্রণয়ন করা হয়েছে। সারা দেশের জন্য যেসব আইন আছে, ওই আইনগুলোর মধ্যে কিছু কিছু আইন অথবা আইনের অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য অপ্রযোজ্য ঘোষণা করা হয়েছে। সারা দেশের জন্য যেসব আইন আছে, ওই আইনগুলোর মধ্যে কিছু আইনের ভাষায় বা ভাষ্যে এমন কিছু বলা নেই যে, এটা পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য, না কি অপ্রযোজ্য? কোনো কোনো আইনে লেখা আছে, এই আইনটি অতীতের আইনের ওপর অগ্রাধিকার পাবে। কিন্তু কোনো আইনেই অতি সুস্পষ্টভাবে লেখা নেই যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯০০ সালের শাসনবিধি এখনো বলবৎ আছে কি নেই; কেউ বলছেন আছে, কেউ বলছেন নেই; কোনো মহামান্য আদালত বলছেন, বলবৎ আছে; কোনো মহামান্য আদালত বলছেন, বলবৎ নেই। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন প্রয়োজনে বিভিন্ন আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। জটিলতার কারণে বিরোধ সৃষ্টি হচ্ছে, বিরোধের কারণে মামলার পাহাড় গড়ে উঠছে। এখানে সুস্পষ্টভাবে আরো একটি বিষয় তুলে ধরছি।
১৯৯৭ এর পরে সৃষ্ট আইনি প্রশ্ন
বিশেষ করে ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তির পর, জেলা পরিষদগুলোর পরিচয় থেকে ‘স্থানীয় সরকার’ শব্দগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে রাঙামাটিতে একটি আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়েছে। কেউ বলছেন ওই আঞ্চলিক পরিষদ বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক, কেউ বলছেন সাংঘর্ষিক নয়। এই নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা হয়েছে। একই প্রকারের মামলার রায়, বিভিন্নমুখী হয়েছে। আমাদের তিনটি বিষয় নির্ধারণ করতেই হবে 
০১. পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা পরিষদ বা একমাত্র আঞ্চলিক পরিষদ বাংলাদেশের সংবিধানের সুনির্দিষ্ট কয়েকটি আর্টিক্যালের সাথে বা ইতোপূর্বে প্রদত্ত সুপ্রিম কোর্টের রায়ের সাথে সাংঘর্ষিক কি না; অথবা সাংঘর্ষিক নয়। 
০২. সিএইচটি রেগুলেশন অভ ১৯০০ পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য এখনো কি পূর্ণভাবে প্রযোজ্য, না কি আংশিকভাবে প্রযোজ্য, না কি কোনোমতেই প্রযোজ্য নয়? 
০৩. বিশেষত ভূমি প্রশাসন বিষয়ে বা ভূমিসংক্রান্ত সার্বিক বিষয়ে, বাংলাদেশের কোন কোন আইন পার্বত্য চট্টগ্রামে, কতটুকু পরিমাণ প্রযোজ্য বা প্রযোজ্য নয়?
অনেক মামলা ও রায়ের উদাহরণ
এই অনুচ্ছেদে অনেক মামলার উল্লেখ করছি। এই মামলাগুলোতে রায় হয়েছে। কোনোটির রায় পক্ষে কোনোটির রায় বিপক্ষে। এই কলামের সম্মানিত পাঠকদের মধ্যে, যারা আইন বিষয়ে আগ্রহী ও বিজ্ঞ, তারা কষ্ট করে এগুলো নিয়ে একটু চিন্তা করবেন এবং কী করলে সমাধান হয়, তা নিয়ে গবেষণা করবেন বলে আমি আহ্বান জানাচ্ছি। 
মামলার নামগুলো যদিও ইংরেজিতে থাকে, এখানে বাংলায় লিখে দিচ্ছি। 
০১. রাঙামাটি ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড ভার্সাস কমিশনার অফ কাস্টমস অ্যান্ড আদারস রিপোর্টেড ইন ১০ বিএলসি (২০০৫) ৫২৫। 
০২. মুস্তাফা আনসারী ভার্সাস ডিসি সিএইচটি অ্যান্ড অ্যানাদার (৭ ডিএলআর ১৯৬৫, ৫৫৩)। 
০৩. কালেক্টার অভ সেন্ট্রাল এক্সসাইজ অ্যান্ড ল্যান্ড কাস্টমস ভার্সাস আজিজুদ্দিন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (২৩ ডিএলআর এসসি, ১৯৭১, ৭৩)। 
০৪. স্যুজ হ্লা প্রু টিকে ভার্সাস কমিশনার চিটাগং অ্যান্ড আদার্স (৪৪ ডিএলআর, ১৯৯২, ৫৩৯)। 
০৫. অং স্যু প্রু চৌধুরী ভার্সাস ক্যয় সাইন প্রু চৌধুরী অ্যান্ড আদার্স (৫০ ডিএলআর, এডি, ১৯৯৮, ৭৩)। 
০৬. সম্প্রীতি চাকমা ভার্সাস কমিশনার অভ কাস্টমস অ্যান্ড আদারস (৫ বিএলসসি ২০০১, ৪৩৬)। 
০৭. বিক্রম কিশোর চাকমা ভার্সাস ল্যান্ড অ্যাপিল বোর্ড (৬ বিএলসি ২০০১, ৪৩৬)। 
০৮. বিএফআইডিসি অ্যান্ড আদার্স ভার্সাস শেখ আব্দুল জাব্বার (৫৪ ডিএলআর ২০০১)। 
০৯. আবু তাহের ভার্সাস ল্যান্ড আপিল বোর্ড (৮ বিএলসি, ২০০৩, ৪৫৩)। 
১০. রাজ কুমারী উনিকা দেবী ভার্সাস বাংলাদেশ অ্যান্ড আদার্স (৯ বিএলসি, এডি, ২০০৪, ১৮১)। এ ছাড়াও যে তিনটি মামলার রায় আমি নিজে পড়েছি, সেগুলোও উল্লেখ করলাম। 
১১. চারটি রিট পিটিশনের একটি সম্মিলিত রায়। রিট পিটিশন নম্বর ১০৫৮, ২৬৫৯, ২৯৬৬ এবং ৪২১২ অভ ১৯৯৭; জিয়াউর রহমান খান এমপি অ্যান্ড আদার্স ভার্সাস গভর্নমেন্ট অব বাংলাদেশ। রায় দেয়ার তারিখ ৫ আগস্ট ১৯৯৭। 
১২. দু’টি রিট পিটিশনের একটি সম্মিলিত রায়। রিট পিটিশন নম্বর ২৬৬৯ অভ ২০০০ মোহাম্মদ বদিউজ্জামান ভার্সাস বাংলাদেশ অ্যান্ড আদার্স এবং রিট পিটিশন নম্বর ৬৪৫১ অফ ২০০৭ অ্যাডভোকেট এমডি তাজুল ইসলাম ভার্সাস বাংলাদেশ অ্যান্ড আদার্স। রায় দেয়ার তারিখ ১২ ও ১৩ এপ্রিল ২০১০। 
১৩. একটি আপিল মামলার রায়। সিভিল আপিল নম্বর ১৪৭ অভ ২০০৭; ওয়াগ্গা ছড়া টি এস্টেট লিমিটেড ভার্সাস মোহাম্মদ আবু তাহের অ্যান্ড আদার্স; রায় দেয়ার তারিখ ২ ডিসেম্বর ২০১৪।
সময়ের কাজ সময়ে করা
আমাকে কেউ এই কলামগুলো লিখতে বলেনি। নিজের আগ্রহে, নিজের উদ্যোগে লিখলাম। এই পরিশ্রমের ও আগ্রহের উদ্দেশ্য একটিই, সেটি হলো সচেতনতা সৃষ্টি করা। আমার বা আমাদের কাজ জানিয়ে রাখা; কপালে যা আছে তাই হবে। বাংলায় একটি প্রবাদ বাক্য আছে : ‘গরিবের কথা বাসি হলে ফলে’। আমি প্রতীকী অর্থেই নিজেকে গরিব বলছি। বিনয়ের সাথে জানিয়ে রাখছি, আমি ইচ্ছা করলেও সবসময়ই যে আমার দায়িত্ব পালন করতে পারব এমন নিশ্চয়তা নেই। এরূপ একটি অনিশ্চয়তা সব ব্যক্তির জন্যই প্রযোজ্য। কারণ, অসুস্থ থাকতে পারি, সক্ষমতা হারাতে পারি, আগ্রহও হারাতে পারি। তাই সব উপাত্ত ইতিবাচকভাবে বহাল থাকতে থাকতেই আমার কাজটি করলাম। 
লেখক: সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক, মেজর জেনারেল (অব:) চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি

পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা সমূহ:

·      পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা

·     পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক সেনাহত্যার ইতিহাস


[লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে? তাহলে দয়াকরে গবেষণামূলক ও ইতিহাস ভিত্তিক এই সাইটটি চালিয়ে যেতে সাহায্য করুন। পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার বঞ্চিত বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী সাইটটি পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার কতৃক চরমভাবে অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত, পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ঠ এনজিও সমূহের একচোখা নীতি, সন্তু লারমা ও প্রসীত খীসাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) 'এর নিপিড়িত, নির্যাতিত ও বর্বরতম সন্ত্রাসের নির্মম ও অসহায় শিকার - পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠির সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ক্ষুদ্রতম এক প্রয়াস]