জঙ্গলঘন দুর্গম বসতিহীন পাহাড়ে একটা গুহার মত স্থানে আটকে রাখা হয়েছে আমাকে রাত দুটো থেকে। এখন সকাল। কোন মানুষ দেখছিনা আমি। কিন্তু অদুরে ওদের আলাপ-চারিতার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার মত দুর্বোধ্য ভাষাতে কি যেন বলছে ওরা। তবে আমাকে মৌটুসির বাড়ি থেকে অপহরণের সময় মঙ্গোলীয় চেহারার মুখোশ পরা এ পাহাড়ি যুবকদের আমি দেখেছি। মৌটুসি চাকমা আর তার মা-বাবা ওদের ভাষা জানে। তারা ভয়ার্ত হলেও নানা আকুতি করে কি সব বলেছিল ওদের! সম্ভবত আমার প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিল। কিন্তু ওরা শোনেনি মৌটুসি, তার বৃদ্ধ মা-বাবার অশ্রুময় আকুতি। ওদের খুঁটির সাথে বেঁধে আমাকে রাতের আঁধারে তুলে আনে এ উপজাতি সন্ত্রাসি গ্রুপ! কেন অপহরণ করেছে আমাকে জানিনা আমি এখনো। আমার কাছে কোন টাকা পয়সাও চায়নি ওরা। তবে আমার পকেটে ৩/৪ হাজার যা ছিল তা, আমার দামী মোবাইলটা, আর ল্যাপটপটা কেড়ে নিয়েছে ওরা অপহরণের সময়ই। বাঙালি হয়ে একজন উপজাতির বাড়িতে বেড়াতে এসেছি আমি এটা কি আমার অপরাধ?
এ বাংলাদেশে ধর্মান্ধরা, সন্ত্রাসিরা আর কতকাল ধর্ম আর জাতিভেদ করবে মানুষে মানুষে? কেবল ওদের মত মঙ্গোলীয় গাত্রবর্ণ নয় আমার. নিরেট তামাটে বাঙালি আমি। ওদের মত তিব্বতি-বর্মী মিশ্র ভাষাতে কথা না বলে, জীবনানন্দ অমিয় চক্রর্তীর ভাষাতে কথা বলি আমি, এটা কি আমার অপরাধ? এ অপরাধেই হত্যা করবে আমাকে ওরা!
এ বাংলাদেশে ধর্মান্ধরা, সন্ত্রাসিরা আর কতকাল ধর্ম আর জাতিভেদ করবে মানুষে মানুষে? কেবল ওদের মত মঙ্গোলীয় গাত্রবর্ণ নয় আমার. নিরেট তামাটে বাঙালি আমি। ওদের মত তিব্বতি-বর্মী মিশ্র ভাষাতে কথা না বলে, জীবনানন্দ অমিয় চক্রর্তীর ভাষাতে কথা বলি আমি, এটা কি আমার অপরাধ? এ অপরাধেই হত্যা করবে আমাকে ওরা!
পিপাসায় বুক ফেটে যাচ্ছে আমার। এখন দুুপুর। রাত দুটো থেকে এ জঙ্গলের মধ্যে হাতপা আর মুখে কাপড় গোজা আমার। প্রচন্ড ভ্যাপসা গরমে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল আমার। ঢাকাতে একটু গরমে ঘুমুতে পারতাম না আমি। একটা দ্বীপে স্বাধীন মুক্ত জলবাতাসে মানুষ হয়েছি আমি, সেই আমি কিনা দম বন্ধ হয়ে খাগড়াছড়ির পানছড়ুির চেংগি নদী সন্নিহিত মগপাড়ার কাছাকাছি একটা পাহাড়ে গুহার মত স্থানে আটকে পড়ে আছি! আমাদের সেনারা কি খবর পেয়েছে আমাকে অপহরণের? ওরা কি উদ্ধার করতে পারবে আমাকে? মৌটুসি কি খবর দিয়েছে বাংলাদেশের সেনাদের? মৌটুসি কি মুক্ত? নাকি তাকেও মেরে ফেলেছে উপজাতি উগ্রবাদিরা? মা-হীন, আলোহীন, ভালবাসাহীন এ গহীন জঙ্গলে মরে পড়ে থাকবো আমি!
:
গত বছর ঢাকার বাণিজ্য মেলার একটা "উপজাতীদের তৈরি পোশাকের" স্টলে মৌটুসি চাকমার সাথে পরিচয় হয় আমার। ওর চমৎকার রিণরিণে হাসির মাঝে সুন্দর বাংলা উচ্চারণে বিমোহিত হয়েছিলাম আমি। আমার গল্প আর বিবিধ প্রবন্ধ ব্লগে পড়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে একটা কার্ড দিয়েছিলাম ওকে। এবং রাতেই ফেসবুকে নক করেছিল মৌটুসি আমায়। প্রথম দিনেই আমার ৭/৮টা গল্প পড়ে সে। এবং প্রেমে পড়ে মৌটুসি। আমার নয় আমার গল্পের। এক সপ্তাহে অন্তত একশর বেশি গল্প পড়ে শেষ করে সে। দেখতে চায় আমার বিদগ্ধ গল্পের সুমির মেয়ে সুতপাকে। একজন বিমোহিত পাঠক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে সে আমার কাছে। একদিন ইনবক্সে বলে নিসঙ্গোচে, কোন সুযোগ হলে বাঙালি কাউকে বিয়ে করতে চায় সে। ঢাকা কিংবা আধুনিক শহরে থাকতে চায় সে চাকুরি কিংবা বৈবাহিক সুত্রে। ধর্ম আর কুসংস্কার থেকে বেড়িয়ে মুক্ত আলোতে বেড়িয়ে আসা মৌটুসির কথাতে চমকিত হই আমি।
এবং এক ভোরে আকস্মিক সিদ্ধান্ত নেই মৌটুসিদের বাড়ি বেড়াতে যাবো আমি পানছড়ির চেংগি নদীর তীরঘেষা গাঁয়ে। কথা বলবো ওর মা বাবার সাথে। বুঝিয়ে বলবো মৌটুসির ইচ্ছে পাখিদের কথা। প্রথমে ঘাবড়ে যায় মৌটুসি। তারপর কি এক অমোঘ প্রজ্ঞাময়তায় বলে - "ওকে এসো।আমার মা বাবা খুব ভাল। তোমার কথা শুনলে, তোমার মানবিকতা দেখলে, হয়তো তোমার সাথে যেতে দেবে আমায় ঢাকাতে। কিন্তু একটু সাবধানে থাকতে হবে। কারণ আমাদের তরুণ চাকমা যুবকরা এটা পছন্দ করবেনা যে, একজন বাঙালি আমাদের বাড়িতে আসুক"। জানতে চাইলাম - "তারা কি বাঙালিদের ঘৃণা করে"? - "ঠিক ঘৃণা নয়। তবে বাঙালিদের সাথে চলাফেরা পছন্দ করেনা ওরা। যদিও আমি পার্থক্য করিনা বাঙালি চাকমাদের মধ্যে" বলে মৌটুসি।
এবং সারাপথ পাহাড় দেখতে দেখতে বিকেল ৪-টা মধ্যে চেংগি রাবার ড্যামের কাছে পৌঁছে যাই আমি, যেখানে ব্রিজের ওপরে অপেক্ষায় থাকার কথা মৌটুসির। মৌটুসি পাহাড়ে বড় হয়েছে। মা-বাবার সাথে কৈশোরে কৃষি কাজও করতো সে টিলাতে। ছড়ি থেকে জল আনতো নিজ ঘরে। ছেলেদের সাথে মার্বেল খেলতো রাস্তায়। আর পড়ালেখা করতো কাজের ফাঁকে ফাঁকে। একটি মাত্র কন্যা বলে মা-বাবা মৌটুসিকে উচ্চ শিক্ষিত বানাতে চায়। যেন সে শহুরে হয়ে আধুনিক জীবনকে ছুঁতে পারে অবলীলায়! এবং নদীর পার ধরে হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যের প্রাক্কালেই আমরা পৌঁছে যাই মৌটুসিদের বাঁশঘন ছায়াঘের বাড়িতে। ওর বাবা তখনো বাজার থেকে ফেরেনি। ঘরে ঢাকা থেকে অতিথি আসবে, এ সংবাদে বিকেলেই বাজারে গিয়েছে সে।
মৌটুসির মার কথা বুঝতে পারিনা আমি। আমার কথাও বুঝতে পারেনা সে একটুও!। তারপরো এ মায়ের ভালবাসাময় দৃষ্টিতে বিমুগ্ধ হই আমি। রাশিয়ার তাতিয়ানা আর দিমিত্রির মাকে মনে পড়ে আমার তখন। যে মা আমার দিকে তাকিয়েছিল এভাবে, যেন আমি তার সেই মৃত সন্তান দিমিত্রি! আসলে পৃথিবীর সব মারা সম্ভবত একই হয়, হোক সে আমার, মৌটুসির কিংবা তাতিয়ানার। জগতের সব মারা আসলেই সব বিদগ্ধ মা। ঘন্টাখানেক পর ফিরে আসে মৌটুসির বাবা। অল্প অল্প বাংলা জানে সে। এক পর্যায়ে অতি সরলতায় ভরা মানুষটি বলে, "বাবা তুমি বাঙালি। মৌটুসি বলেছে সব কথা আমাদের। কিন্তু বুঝতেই পারছো আমাদের লোকজন সহজভাবে দেখবেনা এটা। তুমি বরং খুব সকালেই কোন বাঙালির বাড়ি বা হোটেলে চলে যেও"।
আমি হেসে উড়িয়ে কথার প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাই। ঢাকা থেকে নেয়া প্রিমিয়ার সুইটসের মিষ্টির প্যাকেট খুলে ধরি ওদের সামনে। বাঁশের অঙ্কুরের “বাচ্ছুরি” আরো কত কি খাবার মৌটুসি আমার সামনে তুলে ধরে। কিছু কোন খাবার খেতে কেন যেন ইচ্ছে করেনা আমার। এক মুঠো সাদা ভাত আর সাধারণ সবজি খেয়ে ঘুমোতে যেতে চাই আমি। সারাদিনের জার্নির ক্লান্তিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি, বুঝতে পারিনা আমি এ অচেনা বাড়িতে। এবং আকস্মিক যখন ঘুম ভাঙে দেখি অন্ধকারে আমার সামনে ৪-মঙ্গোলীয় আগন্তক, যাদের হাতে আধুনিক অস্ত্র। এরা কি তবে সেই সব পাহাড়ি সন্ত্রাসি, যারা পাহাড় থেকে বাঙালিদের তাড়াতে চায়?
আবছা অন্ধকারে কারু ও চারুময় সুখ সংসারের মাটির শীতল কলসের দিকে তাকিয়ে থাকার মত মৌটুসি, তার মা-বাবাকে কাঁপতে দেখি আমি। বোধ আর মনোবিকলনের বিবেক শাসিত রাজ্য থেকে ওরা এ চাঁদডোবা অন্ধকারে টেনে নামায় আমায় মৌটুসিদের ঘর থেকে। প্রাগৈতিহাসিক মানুষের রোহিঙ্গাসম মৌলিক কাহিনি পেছনে ফেলে, ভেঙেচুড়ে আমাকে ওরা নিয়ে চলে দুর্গম অন্ধকারের সিঁড়িতে। মহাকাশীয় ক্রন্দনে আকাশ ভরা ছাইভস্মের মত আমার হৃদয়টা কাঁপতে থাকে এক অজানা আতঙ্কে। ইটে পেশা হলুদাভ সবুজ ঘাসের সাদারঙা কষ্ট বেদনায় ভিজে ভিজে নিজ মৃত্যুদহনে মৌটুসির কথা ভুলে যাই আমি। এবং বিষঘ্রাণময় বিষফুলের পঙ্কিলতার ক্লেদ গন্ধ শুকে শুকে এই দুর্গম পাহাড়ে নীত হই আমি।
দুপুর গড়িয়ে সূর্য ঢলে পড়ে কিন্তু কাউকে দেখিনা আমি আমার চারদিকে। আমি তৃষ্ণার্ত বুকে অপেক্ষা করতে থাকি এসব যুক্তরাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে ঢেকে রাখা বিষময় জ্যেষ্ঠ শামুকের দাঁত ভাঙতে কখন আসবে মৌটুসি আমাদের সেনাদের নিয়ে। মায়ের কাছে দুধঋণি যেমন ফুলের কাছে মৌমাছিরা, তেমনি মৌটুসির অপেক্ষায় থাকি আমি এ দুর্গম মৃত্যু পাহাড়ে। আমার মাথার উপর উড়তে থাকে বৈশ্বিক কষ্টসভ্যতার অশ্লীল কীটযুক্ত বুনো বাতাস শোঁ শোঁ করে। আমি মৃত্যুর আগে অন্তত একবার অকাল বোধনের নিবিড় স্পর্শ করা কৈশোরিক নারী মৌটসির ঘ্রাণ যেন পাই ঐ বুনে বাতাসে!
লেখক: জাহাঙ্গীর হোসেন
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা সমূহ:
·
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা
· পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক সেনাহত্যার ইতিহাস
[লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে? তাহলে দয়াকরে গবেষণামূলক ও ইতিহাস
ভিত্তিক এই সাইটটি চালিয়ে যেতে সাহায্য করুন। পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার বঞ্চিত
বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী সাইটটি পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার কতৃক চরমভাবে অবহেলিত ও
সুবিধা বঞ্চিত, পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ঠ এনজিও সমূহের একচোখা নীতি, সন্তু লারমা ও
প্রসীত খীসাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম
জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) 'এর নিপিড়িত, নির্যাতিত ও বর্বরতম সন্ত্রাসের নির্মম ও অসহায়
শিকার - পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠির সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে
ক্ষুদ্রতম এক প্রয়াস]