বৃহস্পতিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৭

পার্বত্য সমস্যা ও সমাধান প্রসঙ্গে

“পার্বত্য চট্টগ্রাম” বর্তমান বাংলাদেশে আলোচ্য সকল বিষয়বস্তুর মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি বিষয়। বলতে গেলে সমস্যার বেষ্টনীর আরেক নাম হলো- “পার্বত্য চট্টগ্রাম”। সম্ভবত: বাংলাদেশে প্রচার মাধ্যমগুলোতে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চবার এই ইস্যুটই প্রধান শিরোনাম হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। যে বিষয়টির সঙ্গে রাষ্ট্রের অখণ্ডতা জড়িত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর হতে আজ অবধি ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপ্রধান, দেশের বড় বড় সুশীল মহোদয়রা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে বিভিন্ন আলোচনা-পর্যালোচনা, পদক্ষেপ গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করেছেন। কিন্তু আজ অবধি এই সমস্যার সমাধানতো হয়ইনি বরঞ্চ ক্রমে ক্রমে তা আরো মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। তবে হ্যাঁ, সরকার প্রধান কর্তৃক দুইটি সিদ্ধান্ত সফল হয়েছে বলে আমি মনে করি। প্রথমটি হলো ১৯৭৯ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কর্তৃক পাহাড়ে বাঙালি পুনর্বাসন করা। যে সিদ্ধান্তের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম এখনো বাংলাদেশের অংশ হিসেবে রয়ে গেছে। দ্বিতীয়টি হলো- বর্তমান সরকার কর্তৃক ১৯৯৭ সালে জেএসএস নেতা সন্তু লারমার সাথে ‘শান্তিচুক্তি’তে আবদ্ধ হওয়া। যে চুক্তি বর্তমান পাহাড়ের সশস্ত্র কার্যক্রম পর্যালোচনায় বিফল মনে হলেও সমসাময়িক সামপ্রদায়িক সংঘাত বন্ধ করতে যুগান্তকারী অবদান রেখেছে। পার্বত্য বর্তমান সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আপাতদৃষ্টিতে দেশের সুশীলদের বক্তব্য ও প্রচার মাধ্যমের সংবাদ পর্যালোচনায় বলা যায় পার্বত্য বাঙালিরাই পার্বত্য সমস্যার জন্য দায়ী। বস্তুত: তা কিন্তু নয়। পার্বত্য এলাকার সমস্যা পাহাড়ে বাঙালি পুনর্বাসন করার পূর্বেই জন্ম নিয়েছে।
তবুও পত্রিকার পাতায় এবং সুশীল সমাজের বক্তব্যে প্রচারিত ভাবমূর্তিতে দেশের সাধারণ মানুষ এই সমস্যা সমাধানের বিষয়ে তিনটি প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসে। প্রশ্ন তিনটি হলো: 

১। এখান থেকে বাঙালিদের সরিয়ে নিলেই কি সমস্যা মিটে যাবে? ২। সন্তু লারমার চাহিদা অনুযায়ী চুক্তির ধারা বাস্তবায়ন করলেই কি সমস্যার সমাধান হবে? ৩। উপজাতিদের ভাষায় পাহাড়ে সামরিক শাসন চলছে। তাই পার্বত্য সমস্যা সমাধানে সেনা প্রত্যাহারই কি যথেষ্ট? আমি মনে করি এই তিনটি পদক্ষেপের যে কোনো একটি নয়, এর মধ্যে সবগুলোও যদি বাস্তবায়ন করা হয় তবুও পাহাড়ে শান্তি আসবে না। কারণ, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের মাথায় এখনো পার্বত্য সমস্যার নেপথ্যে যে রহস্য রয়েছে তা পৌঁছেনি, আমরাই পৌঁছাতে পারিনি। প্রথম প্রশ্ন অনুযায়ী আপনি যদি আজই পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে পার্বত্য বাঙালিদের উচ্ছেদ করেন, তাহলে কাল থেকেই এখানে আর লাল-সবুজের পতাকা উড়বে না। উড়বে বৈদেশিক অপশক্তির ছত্রছায়ায় বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র “জুম্মল্যান্ড”-এর পতাকা। সংকুচিত হবে বাংলাদেশ সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। যেখানে সরকার চাইলেও কিছু করতে পারবে না। দ্বিতীয় প্রশ্ন অনুযায়ী পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে বলতে গেলে বলতে হয়, ইতিমধ্যেই সরকার শান্তি চুক্তির অধিকাংশ ধারা বাস্তবায়ন করে ফেলেছে। অর্থাৎ চুক্তির ৭২ টি ধারার মধ্যে ৪৮ টির পূর্ণাঙ্গ, ১৫ টি ধারা আংশিক বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং অবশিষ্ট ৯ টি ধারা বাস্তবায়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। 

শান্তিচুক্তির বাকি ধারা বাস্তবায়ন করে এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। তাছাড়া, এহেন চুক্তির এত দ্রুত বাস্তবায়নের অগ্রগতি বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন। তবুও বরাবরই সন্তু লারমা মিথ্যাচার করছেন শান্তিচুক্তি নিয়ে। তবে হ্যাঁ, আপনি যদি সন্তু লারমার বর্তমান ভাষ্য অনুযায়ী চুক্তির বাস্তবায়ন চান তবে আপনাকে নিশ্চিত মানচিত্র হারাতে হবে। সন্তু লারমার অস্ত্রের মুখে জিম্মি হতে হবে পার্বত্য আপামর নিরীহ জনপদকে। কেননা, সন্তু লারমার কাছে অত্যাধুনিক অবৈধ অস্ত্র মজুত রয়েছে। সুতরাং দেশের কতিপয় সুশীলের কথাকে অবলম্বন করে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে সরকারকে দোষারোপ করে সন্তু লারমাকে ধোয়া তুলসি পাতা ভাবার কোনো অবকাশ নেই। তাছাড়া যেহেতু চুক্তি অনুযায়ী জেএসএস তাদের সকল অস্ত্র জমা দিয়েছে। উপজাতিরা সশস্ত্র জীবন ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। সুতরাং পাহাড়ে আর অবৈধ অস্ত্র থাকবার কথা নয়! থাকার কথা নয় পাহাড়ে সশস্ত্র উপজাতীয় গ্রুপ!! তবে কেন নিত্য অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি? আর এটা করছেই বা কারা? এর উত্তর খুব সহজ- পাহাড়ের সশস্ত্র ৪ টি সন্ত্রাসী সংগঠন। চুক্তির অধিকাংশ ধারা বাস্তবায়নের ফলে সন্তু লারমা ও তার সমমনাদের আরাম আয়েশ দেখে রোষানলে পুড়ছে আরেকটি চুক্তি বিরোধী উপজাতীয় সশস্ত্র সংগঠন- ইউপিডিএফ। তাদের সাথেই হচ্ছে সন্তু লারমার পাহাড়ে ক্ষমতা দখলের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। এতে সরকারের দোষ কোথায়? বরঞ্চ সরকার পার্বত্য সকল প্রতিকূল অবস্থার মাঝেও শান্তিচুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে এখনো অনড়। আর পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে সেনা প্রত্যাহার?!! 

সত্যিকার অর্থে পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে সেনাবাহিনীর উপস্থিতির কারণেই উপজাতি সন্ত্রাসীরা নির্বিঘ্নে অপকর্ম করার সুযোগ পাচ্ছে না। তাই তো সেনাবাহিনী নিয়ে তাদের এত মনঃকষ্ট। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনের দিকে তাকালে দেখতে পাবেন যে প্রশাসন নিয়ন্ত্রণের সব চেয়ারে বসে আছে উপজাতীয় নেতারা। তাদের হুকুমেই চলছে প্রশাসন। প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা সমস্ত অপকর্ম করছে, আর তা প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করছে। সেনাবাহিনী বিভিন্ন সময়ে অস্ত্রসহ সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার করছে বটে তবে তা পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাস বন্ধ করার জন্য অপ্রতুল। সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে চিকিৎসা, শিক্ষা, ত্রাণ বিতরণ, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নসহ উপজাতিদের পিছনে যে পরিমাণ অর্থ ও সহায়তা প্রদান করছে তাতে আমাদের বাঙালিদের মনে হয় যে এই সেনাবাহিনী কি শুধুই উপজাতিদের মঙ্গলের জন্যই পাহাড়ে নিয়োজিত? তাই এমন সেনাবাহিনী পাহাড়ে থাকা আর না থাকা আমাদের পার্বত্য বাঙালিদের জন্য সমান কথা। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি নেতাদের অস্পষ্ট নয়, সুস্পষ্ট দাবি একটাই। তা হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সরকার হতে আলাদা শাসন ব্যবস্থা চালু আর নতুন রাষ্ট্র কায়েম করা। আলাদা রাষ্ট্র কায়েম করার ইচ্ছা যদি না থাকতো তবে শান্তিচুক্তির ফলে সরকার জেএসএস নেতা-কর্মীদের যেসমস্ত সুবিধা দিয়েছেন তাতে তাদের এহেন আন্দোলনের প্রশ্নই আসে না। আর এটাকে কি দাবি আদায়ের আন্দোলন বলে? কখনোই না। পৃথিবীর ইতিহাসে বঞ্চিত জনোগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের সফল আন্দোলনের নজির অসংখ্য। সেই আন্দোলনের ইতিহাস দেখলে আর পার্বত্য উপজাতি নেতাদের আন্দোলন দেখলে সহজেই কিছুটা হলেও তাদের রূপ বুঝতে পারবেন। দাবি আদায়ের আন্দোলনের নামে খুন, গুম, চাঁদাবাজি, লুটতরাজ, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, ভূমি দখল করে পাহাড়কে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের শান্তিকুঞ্জে পরিণত করেছে উপজাতীয় সশস্ত্র আঞ্চলিক সংগঠনগুলো। যাদের অধিকার আদায়ের নামে তারা আন্দোলন করছে তারাই আজ আন্দোলনকারীদের হাতে নিষ্পেষিত হচ্ছে। সুতরাং এটা কখনো নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের আন্দোলন হতে পারে না। পাহাড়ের সাধারণ উপজাতি-বাঙালি সবাই শান্তি চায়। কিন্তু উপজাতি সশস্ত্র এই সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের মুখে সবাই বন্দি। তাহলে কীভাবে পাহাড়ের সমস্যা সমাধান করে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করা যায়? আমার এই লেখায় আমি পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে তিনটি সুপারিশ রাখছি। প্রথমত: পার্বত্য শান্তিচুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করা। পাহাড়ে সকল সমপ্রদায়ের জনমতের ভিত্তিতে পার্বত্য শান্তিচুক্তিতে উল্লিখিত অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক ধারা বাতিল করা। যাতে পাহাড়ের প্রতিটি নাগরিকের তার রাষ্ট্রীয় অধিকার সমুন্নত থাকে। উপজাতি সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অপশক্তির কর্তৃত্ব খর্ব করে গণতান্ত্রিক শাসন নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত: পাহাড় হতে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা। উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের নির্মূল করে পার্বত্য জনমনে আস্থা ফিরিয়ে আনা। যাতে প্রতিটি নাগরিক নিরাপদে নিশ্চিন্ত মনে পাহাড়ে বিচরণ করতে পারে। 

তৃতীয়ত: সকল বিদেশি দাতা সংস্থাকে পাহাড়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা। আমার উল্লিখিত দ্বিতীয় সুপারিশের সঙ্গে এটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বর্তমানে পাহাড়ে সকল অপকর্মের মূলে রয়েছে উপজাতি সন্ত্রাসীরা। তারা নিত্য চাঁদাবাজি, অপহরণ, গুম, হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। ঠিকাদারি কাজ, ফলজ বাগান হতে শুরু করে সামান্য একটি ডিমের জন্যও চাঁদা দিতে হয় উপজাতি সন্ত্রাসীদের। অর্থাৎ সন্ত্রাসীদের জ্বালাতনে বর্তমান পার্বত্য অর্থনীতি ও জনপদ শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। এ অবস্থায় পাহাড়ে যৌথবাহিনীর চিরুনি অভিযানের মাধ্যমে সন্ত্রাস নির্মূল অতীব জরুরি। তবে হ্যাঁ, এই সন্ত্রাস নির্মূলে পাহাড় সাময়িক উত্তেজিত হলেও এতে নিরীহ উপজাতি-বাঙালিসহ রাষ্ট্রের বৃহৎ কল্যাণ নিহিত আছে। পরিশেষে বলবো পার্বত্য সমস্যা এখন আর আগের মতো অস্পষ্ট নয়। এই সমস্যা সচেতন মহলের কাছে অনেকটাই সুস্পষ্ট। বর্তমান পার্বত্য সমস্যার সঙ্গে শান্তিচুক্তির কোনো সম্পর্ক নেই, বরং তা চুক্তি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধক। বর্তমান পরিস্থিতিতে সন্তু লারমার চাহিদামাফিক চুক্তি বাস্তবায়ন করা হলে শান্তিচুক্তির আদর্শ ব্যাহত হবে আর এতে উপকৃত হবে সন্ত্রাসীগোষ্ঠী। ফলে চিরতরে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আপামর পার্বত্যবাসী তথা রাষ্ট্র।
লেখক: আবু উবাইদা , পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক এবং একজন পার্বত্য বাঙালি।


পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা সমূহ:

·      পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা

·     পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক সেনাহত্যার ইতিহাস


[লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে? তাহলে দয়াকরে গবেষণামূলক ও ইতিহাস ভিত্তিক এই সাইটটি চালিয়ে যেতে সাহায্য করুন। পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার বঞ্চিত বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী সাইটটি পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার কতৃক চরমভাবে অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত, পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ঠ এনজিও সমূহের একচোখা নীতি, সন্তু লারমা ও প্রসীত খীসাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) 'এর নিপিড়িত, নির্যাতিত ও বর্বরতম সন্ত্রাসের নির্মম ও অসহায় শিকার - পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠির সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ক্ষুদ্রতম এক প্রয়াস]