মেহেদী হাসান পলাশ: ১৪শ’ বছরেরও অধিককালের পুরাতন বাংলা নববর্ষ এবারো এসেছে আমাদের জাতীয় জীবনে। কর্পোরেট ধামাকা তাতে এনেছে নতুন জৌলুস। পূর্বে বাংলা নববর্ষ পূর্বে পালিত হতো ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। প্রথমে একে ফসলী সন বলা হতো। কৃষিকাজের সুবিধার্থে মুঘল স¤্রাট আকবর ১৫৮৪ ঈসাব্দের ১০/১১ মার্চ বাংলা সন চালু করেন। ১৫৫৬ ঈসাব্দের ৫ নভেম্বর আকবরের সিংহাসনে আরোহণের সময়কাল থেকে হিজরী চান্দ্র সনকে ভিত্তি করে বাংলা সৌরসন প্রবর্তিত হয়। এ সময় এটি বঙ্গাব্দ বলে পরিচিত হতে থাকে। জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হওয়া পর্যন্ত পহেলা বৈশাখ নববর্ষ উৎসব পালিত হতো। তখন বাংলার কৃষকেরা চৈত্রমাসের শেষ দিন পর্যন্ত জমিদার ও ভূ-স্বামীদের খাজনা পরিশোধ করতো। পরদিন বা নববর্ষে জমিদারগণ কৃষক বা প্রজাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এ উপলক্ষে জমিদার বাড়ি প্রাঙ্গণে মেলা বসত। মেলায় স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সকলপ্রকার হস্তশিল্পজাত, মৃৎশিল্পজাত ও নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা সামগ্রী এবং বাংলার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির পসরা বসতো।
অন্যদিকে মেলা উপলক্ষে জমিদার বাড়ির আঙিনায় যাত্রা, পালাগান, জারীগান, কবিগান, বিচার গান, গাজীর গানসহ বিভিন্ন লোক সঙ্গীতের আসর বসতো। এছাড়াও পুতুল নাচ, নাগর দোলা, নৌকা বাইচ, ঘোড় দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, ঘুড়ি ওড়ানোসহ নানা প্রতিযোগিতা চলতো নববর্ষের উৎসবকে ঘিরে। এককথায় নববর্ষকে ঘিরে সমগ্র বাংলা জেগে উঠতো উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে।
বাংলা নববর্ষের উৎসবে আরেকটি মাত্রা যুক্ত করে ব্যবসায়ীদের হাল খাতা। গ্রামগঞ্জের হাট বাজারের ব্যবসায়ীরা এদিন তাদের একটি বছরের পুরাতন ব্যবসায়িক লেনদেনের হিসাব চুকিয়ে নতুন খাতা খোলেন। এ উৎসব তাদের কাছে হালখাতা নামে পরিচিত। হালখাতা উৎসবে ব্যবসায়ীরা ক্রেতারদের আমন্ত্রণ করেন তাদের দোকানে। ক্রেতাগণ এদিন গত এক বছরের বাকী পরিশোধ করেন আর ব্যবসায়ীগণ ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতা সম্পর্ক নবায়নের নতুন খাতা- হালখাতা খোলেন। এভাবেই পহেলা বৈশাখ সার্বজনীন বাংলাভাষীদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে।
কালের বিবর্তন, ঋতুর পরিবর্তন আর প্রযুক্তির উন্নয়নে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের লোকজ আঙ্গিকে কিছু পরিবর্তন হয়তো এসেছে কিছু তাতে উৎসবের উদ্দামতা কমেনি এতোটুকু বরং বেড়েছে বহুগুণে। তাইতো নববর্ষের উৎসবে ফায়দা লুটতে এগিয়ে এসেছে আধুনিক বাজার অর্থনীতির ধারক কর্পোরেট কোম্পানিগুলো। পহেলা বৈশাখে তারা বাজারে আনে নতুন ফ্যাশনের পোশাক, প্যাকেজ ইত্যাদি। এভাবেই বাংলা নববর্ষ বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাপনে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে শত শত বছর ধরে।
কিন্তু রাজধানীতে রমনাপার্কে অশ্বত্থবৃক্ষের বেদীমূলে মাঙ্গলিক গান গেয়ে নববর্ষ বরণের যে কালচার অথবা রেওয়াজ চলছে তার ইতিহাস খুব বেশি দিন নয়। ১৯৬৭ (মতান্তরে ১৯৬৫) সালে ছায়ানট শিল্পীগোষ্ঠী এর প্রবর্তন করে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পর থেকে পাকিস্তানে রবীন্দ্র চর্চা নিয়ে বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে বিভেদ তৈরি হয়। এই বিভেদের মধ্যেই ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদসহ কয়েকটি সংগঠনের উদ্যোগে পূর্বপাকিস্তানে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপিত হয়।
রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের পর আয়োজক কিছু রবীন্দ্রভক্তের উদ্যোগে সেবছরই ছায়ানট প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এর প্রথম সভাপতি ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। ১৯৬৭ সালে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতারমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন রেডিওতে রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। খাজা শাহাবুদ্দিনের এই ঘোষণায় পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্র চর্চা নিয়ে চলমান বিভেদ নতুন করে চাঙ্গা হয়ে ওঠে। মূলতঃ তৎকালীন সরকারের রবীন্দ্র চর্চা নিষিদ্ধ নীতির বিরোধিতা করেই ছায়ানট রমনার অশ্বত্থমূলে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করে ১৯৬৭ সালে।
পহেলা বৈশাখ সার্বজনীন সর্ববৃহৎ বাঙালি উৎসব। সারাদেশে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালিরা এই উৎসবে শামিল হয় প্রাণের টানে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে কিছুটা ব্যতিক্রম রয়েছে। কেননা, একই সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিগুলোর সর্ববৃহৎ অনুষ্ঠান বৈসাবি শুরু হয়ে যায়। ত্রিপুরাদের বৈসু, মারমাদের সাংগ্রাই ও চাকমাদের বিজু উৎসবের নামের অদ্যাক্ষর নিয়ে গঠিত হয়েছে ‘বৈসাবি’ শব্দ। তবে এ উৎসবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিই অংশ নিয়ে থাকে।
যদিও পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্ধেক জনগোষ্ঠি বাঙালি। কিন্তু অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকায় বাঙালির উৎসব চাপা পড়ে যায় প্রচারের অন্ধকারে। যদিও এসময় বাঙালিরা তাদের সাধ্যমত চেষ্টা করে নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে নানা আয়োজনের। বিভিন্ন স্থানে র্যালি, মেলা, খেলাধুলার মতো আয়োজন চোখে পড়ে। কিন্তু বৈসাবির প্রচারের আলোয় তা ম্রিয়মান হয়ে পড়ে বাঙালিদের সকল আয়োজন। এতে করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জনগোষ্ঠিসমূহের মধ্যে পারস্পারিক যোগাযোগ, সম্পর্ক, সৌহার্দ, সম্প্রীতি, সহাবস্থান, মেলবন্ধন ও মিথস্ক্রিয়ায় চ্ছেদ পড়ে।
এই ব্যবধান ও দূরত্ব কমাতে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সকল সম্প্রদায়কে এক সুঁতোর মালায় গাঁথতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষণা সংস্থা সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশন ২০১৫ সাল থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির বৈসাবি ও বাঙালির নববর্ষ এক সাথে পালনের জন্য ‘বৈসাবিন’ নামে উদযাপনের জন্য বিভিন্ন স্তরে জনমত গঠনের কাজ চালিয়ে আসছে।
প্রথমদিকে সামাজিক গণমাধ্যমে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা এ প্রসঙ্গটি প্রকাশ্যে নিয়ে এলে ধারণাটি বিভিন্ন মহলে আলোচিত ও সমাদৃত হয়। এর মধ্যেই বেশ কয়েকটি স্থানে ‘বৈসাবিন’ উদযাপিতও হয়েছে। বিশেষ করে বাংলা ১৪২২ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গুইমারা রিজিয়ন বৈসাবি অনুষ্ঠান বৈসাবিন নামে উদযাপন করলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়।
অন্যদিকে সরকারি অনুষ্ঠানগুলো আগে যেখানে শুধু বৈসাবি অনুষ্ঠান নাম দিয়ে পালিত হতো তারাও বৈসাবি ও নববর্ষ শিরোনামে একসাথে উদযাপন শুরু করে। গত বছর তিন পার্বত্য জেলার প্রায় সকল সরকারি অনুষ্ঠান বৈসাবি ও নববর্ষ শিরোনামে একসাথে উদযাপিত হয়েছে। আমরা এটিকে শুভ লক্ষণ মনে করি। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্তঃসম্প্রদায়গুলোর মধ্যে আস্থা, বিশ্বাস ও সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনতে এ ধরনের উদ্যোগ বেশি বেশি ও আরো বৃহৎ পরিসরে পালনের আহ্বান জানাই।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পারিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, সহাবস্থান, আস্থা সৃষ্টি করতে সকলকে এক সুঁতোর মালার বন্ধনে জড়াতে হবে। তাই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ভাইবোনদের বৈসাবি ও বাঙালির নববর্ষ যুথবদ্ধ হয়ে পালিত হোক বৈসাবিন নামে এ প্রত্যাশা সকলের।
♦ লেখক: সম্পাদক, পার্বত্য নিউজডটকম ও পাক্ষিক পার্বত্যনিউজ।
·
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা
· পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক সেনাহত্যার ইতিহাস
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি
সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা সমূহ:
·
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা
· পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক সেনাহত্যার ইতিহাস
[লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে? তাহলে দয়াকরে গবেষণামূলক ও ইতিহাস
ভিত্তিক এই সাইটটি চালিয়ে যেতে সাহায্য করুন। পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার বঞ্চিত
বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী সাইটটি পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার কতৃক চরমভাবে অবহেলিত ও
সুবিধা বঞ্চিত, পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ঠ এনজিও সমূহের একচোখা নীতি, সন্তু লারমা ও
প্রসীত খীসাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম
জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) 'এর নিপিড়িত, নির্যাতিত ও বর্বরতম সন্ত্রাসের নির্মম ও অসহায়
শিকার - পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠির সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে
ক্ষুদ্রতম এক প্রয়াস]