মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৯

পাহাড়ের সঙ্কট ও মানবেন্দ্র লারমার দ্বৈত ভূমিকা


মাহের ইসলাম  :   এম এন লারমার রাজনৈতিক মতাদর্শ 
নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই – মাওবাদী কমিউনিস্ট, যারা ‘বন্দুকের নলকেই সকল ক্ষমতার উৎস’ হিসেবে বিবেচনা করে। খুব কম সময়ের ব্যবধানে আত্নপ্রকাশকৃত রাঙ্গামাটি কমিউনিস্ট পার্টি , পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এবং শান্তি বাহিনী- এই তিন সংগঠনের মূল পরিকল্পনাকারী, উদ্যোক্তা এবং বাস্তবায়নকারী মূলত একজনই, স্বয়ং এম এন লারমা। এই তিন সংগঠনের সার্বিক বিষয়াবলী পর্যবেক্ষণে প্রতীয়মান হয় যে, সশস্ত্র আন্দোলনের প্রস্তুতির জন্যে যে সময়ের প্রয়োজন ছিল, সেই সময় লাভের উদ্দেশ্যেই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে পা বাড়িয়েছিলেন এম এন লারমা। আপাতদৃষ্টিতে বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে এই সংগঠনগুলো আত্নপ্রকাশ করলেও চুড়ান্তভাবে সব কিছু একটি মাত্র লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হয়েছে – যা ছিল দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম।
পাহাড়িদের স্বার্থ রক্ষা আর আত্ন নিয়ন্ত্রনাধিকারের অভিপ্রায়ে, আত্নপ্রকাশের মুহূর্ত থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্বশাসনের দাবী উত্থাপনের পাশাপাশি, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ পাহাড়িদের অস্তিত্ব বিপন্ন করবে’ – এই ধারনা ব্যাপক প্রচার করা হয়। অন্যদিকে, এই দুই আওয়াজের উপর ভর করে এম এন লারমা পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৩টি উপজাতিকে ‘জুম্ম জাতিয়তাবাদ’-এর নামে নতুন এক জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করার তোলার প্রয়াসে লিপ্ত হন। ফলশ্রুতিতে, মাওবাদের অনুসারী গোপন রাঙামাটি কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত এম এন লারমা মার্কসবাদ- লেনিনবাদের অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে ‘জুম্ম জাতীয়তাবাদী’ চিন্তাধারার প্রবর্তক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভে সমর্থ হয়েছিলেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার সুত্রপাত প্রসঙ্গে আলোকপাত করতে গিয়ে অনেক গবেষক, লেখক এবং বিদ্বান ব্যক্তি মন্তব্য করেছেন যে, মূলত নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়াতেই এম এন লারমা সশস্ত্র আন্দোলনের পথে পা বাড়িয়েছিলেন। অনেকে এমন মন্তব্যও করেছেন যে, বঞ্চনা ও নির্যাতন বন্ধের কোন পথ খুঁজে না পেয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরা অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিল। নূহ-উল-আলম লেনিন (১৯৯৯) রচিত ’পার্বত্য চট্টগ্রামঃ সমুখে শান্তি পারাবার’ গ্রন্থে (পৃ-৬৯-৭০) উল্লেখ করেছেন যে, ঠিক এই সময় দাবি আদায়ের গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে মনে করে লারমা ও তার সহযোগীবৃন্দ একই সঙ্গে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণের উদ্দেশ্যে জনসংহতি সমিতির সামরিক শাখা হিসেবে ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি গঠন করেন ‘শান্তি বাহিনী’।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৮ জানুয়ারি ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত বাসদের এক পুস্তিকায় প্রকাশিত কমরেড খালেকুজ্জামান রচিত, ‘পার্বত্য চুক্তি প্রসঙ্গ’ শীর্ষক নিবন্ধের সুত্রে জিব্লু রহমান (২০১৮) তার ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা ও সমাধান (১৯৭২-১৯৯৮)’ বইয়ে (পৃ-১৭২-১৭৩) উল্লেখ করেছেন যে, স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের কাছে থেকে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় তাদের দাবী আদায় করতে পারবে না বুঝতে পেরে পাহাড়ি জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে শান্তি বাহিনী গঠিত হয়।

১৯৭২ সালকে প্রশিক্ষণ শুরুর বছর (মোর্তোজা, ২০০০ ) এবং ৭ জানুয়ারি ১৯৭৩ তারিখকে শান্তি বাহিনীর আত্নপ্রকাশের সময়কাল বিবেচনায়, বাস্তবিকপক্ষেই লেনিন (১৯৯৯) এবং খালেকুজ্জামান (১৯৯৮) উভয়ের বক্তব্যের যথার্থতা নিয়ে সন্দেহের বিন্দুমাত্র সুযোগ অবশিষ্ট থাকে না। অন্য ভাষায় বললে, এম এন লারমা ১৯৭২ সালেই বিশ্বাস করতেন যে, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে কাংখিত ফল লাভ হবে না। আবার, বন্দুকের নলের মাধ্যমে ইপ্সিত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব বলে বিশ্বাসী হলেও সশস্ত্র আন্দোলনের প্রস্তুতির সময় প্রয়োজন। তাই কাংখিত সময় লাভের জন্যে তিনি ‘দ্বৈত ভুমিকা’ পালনে ব্রতী হয়ে পড়েন।

একাধিক লেখক/গবেষকের লেখায়ও এম এন লারমার ‘দ্বৈত ভূমিকা’ পালনের স্বীকৃতি উঠে এসেছে। তন্মধ্যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম গবেষক আতিকুর রহমান (২০০৭) রচিত ‘পার্বত্য তথ্য কোষ (প্রথম খন্ড)’-এ তার মতামত ব্যক্ত করেছেন এই বলে যে,

“লারমা দ্বৈত ভূমিকা পালনে অবতীর্ণ হোন।…………………….

তার লক্ষ্য ছিলোঃ আগে শক্তি সঞ্চয় ও তৎপর বাধ্যকরণ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেনঃ আওয়ামী লীগ নিয়ন্ত্রিত সরকার ও সংসদে তার স্বায়ত্বশাসন লাভের দাবী হবে অরণ্যে রোদন। তিনি সতর্কতার সাথে শান্তি বাহিনী সংক্রান্ত উৎসাহ আর সংশ্লিষ্টতা গোপন রাখতে সচেষ্ট হোন। তাই তাকে প্রকাশ্যে বিদ্রোহী পক্ষ বলে অভিযুক্তও করা যাচ্ছিল না। তার লক্ষ্য ছিলো চূড়ান্ত প্রস্তুতি পর্যন্ত গোপনীয়তা বজায় রাখা, আত্নরক্ষা ও সময় ক্ষেপন এবং সংসদীয় ক্ষমতায় টিকে থাকা। এই কৌশলের অংশ হিসাবে তার বাকশালে যোগদানকেও মুল্যায়িত করা যায়।” (রহমান, ২০০৭, পৃ-৬৪-৬৬)।

লারমার দ্বৈত ভুমিকার প্রমাণ পাওয়া যায় মেজর জেনারেল ইবরাহিম রচিত ‘মিশ্র কথন’ বইয়েও। শান্তি বাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ এবং দায়িত্বশীল পদে নিয়োজিত ছিলেন এমন এক উপজাতীয় ব্যক্তির সুত্রে তিনি জানিয়েছেন যে, ১৯৭৩ -৭৪ সালে গোয়েন্দা রিপোর্টে পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রস্তুতির সংবাদ পেয়ে সরকার অনেক ছাত্রের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারী করে। ফলে তারা আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে যায় এবং বিভিন্ন দায়িত্ব কাধে তুলে নেয়।

সেই সাথে তিনি আরো জানিয়েছেন,

“আন্ডার গ্রাউন্ড এর কাজের সুবিধার্থে বিভিন্ন দপ্তর বন্টনসহ একটা কেন্দ্রীয় সদর দপ্তর খোলা হয়। তখন মি. লারমা ছাড়া কতিপয় নেতৃবৃন্দরা সবাই সেই সদর দপ্তরে চলে গেলেন। আবার অনেকেই খুব সতর্কাবস্থায় কিছু ভিতরে কিছু বাইরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ চালাতেন, মি. লারমা নেপথ্যে থেকে রাঙামাটি এবং ঢাকায় বসে সব নেতৃত্ব দিতেন। ……..

সংসদ থেকে রাঙামাটিতে যখন ফিরে যেতেন তখন সব সময় একটি কথা বলতেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা, জনগণের উদ্দেশ্য লক্ষ্য সংসদের মাধ্যমে চেয়ার টেবিলের সামনে বসে সমাধান হবে না। বন্দুকের নল ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের কোনো পরিবর্তন আসবে না, জুম্ম জাতির কোনো অস্তিত্ব রক্ষা হবে না।” …………..

তবে মি. লারমা তার আদর্শকে চাপিয়ে দিলেও বাস্তব ক্ষেত্রে অর্থাৎ জনসমক্ষে কিংবা সাধারণ কর্মীদের কাছে কমিউনিস্ট আদর্শের কথা বলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল।” (ইবরাহিম, ২০১৪, পৃ-৩০০-৩০১)।

বিখ্যাত সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক (১৯৯৬) লারমার দ্বৈত ভুমিকার কথা উল্লেখ করেছেন ‘Insurgent Crossfire North-East India’ গ্রন্থে, এভাবে,

“পূর্ব পাকিস্তানে রক্তাক্ত গেরিলা সংগ্রামের সময় লারমা ভাতৃদ্বয়ের স্পষ্ট নিষ্ক্রিয়তায়, যারা ১৯৬০ এর দশকের শেষের দিকে তাদের দ্বারা অনুসৃত ‘ডুয়াল লাইন’ সম্পর্কে অবগত নন, তাদের বিভ্রান্ত করে। লারমা ভ্রাতৃদ্বয়ের উভয়েই ছাত্রজীবনে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ পড়েছেন এবং মাও সে তুং এর চিন্তাধারায় গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।“ এই ভাবধারায় প্রভাবান্বিত হওয়ার কারণেই তারা বিশ্বাস করতেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণকে একটি দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। যার চূড়ান্ত ফল স্বরূপ, ১৯৭০ সালের ১৬ই মে তারিখে রাঙ্গামটিতে এক গোপন মিটিং এর মাধ্যমে তারা প্রতিষ্ঠা করে রাঙামাটি কমিউনিস্ট পার্টি। (ভৌমিক, ১৯৯৬, পৃ-২৫০-২৫১)।

লক্ষণীয় যে, ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্যে যে প্রচেষ্টা ছিল, একই সময়ে শান্তি বাহিনী গঠন এবং সশস্ত্র আন্দোলনের প্রস্তুতির জন্যে প্রচেষ্টা ছিল অনেক অনেক বেশি। সংসদের ভিতরে এম এন লারমা একা নিয়মতান্ত্রিকভাবে দাবী আদায়ের চেষ্টা করছিলেন। সংসদের বাইরে বা অন্য কোথাও এম এন লারমা অথবা তাদের অনুসারিদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের তেমন কোনো প্রচেষ্টা চোখে পড়ে না। অন্যদিকে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়ে তার সাথি-অনুসারীদের প্রায় সকলেই সশস্ত্র আন্দোলনের জোর প্রচেস্টায় নিমগ্ন ছিল। বলতে দ্বিধা নেই যে, প্রকৃতপক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের চেয়ে বহুগুণ বেশি এবং কার্যকর প্রচেষ্টা ছিল সশস্ত্র আন্দোলনের জন্যে। যার প্রমাণ উঠে এসেছে সুবীর ভৌমিকের (১৯৯৬) কণ্ঠেও,

“১৯৭৪ সালের শুরুর দিকে, পিসিজেএসএস ইতোমধ্যে তার “দ্বৈত লাইন কৌশল” বাস্তবায়ন করেছিলঃ সাংবিধানিক রাজনীতির পথ অনুসরণের পাশাপাশি সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্বশাসনের জন্যে জাতীয় সংসদে এম. এন. লারমা যুদ্ধ করছিল। অন্যদিকে, তার ছোট ভাই জে. বি. লারমা একটি গোপন গণ বাহিনী (an underground people’s force) গড়ে তোলার জন্যে সশস্ত্র স্বেচ্ছসেবীদের সংখ্যা বাড়িয়ে তুলছিলেন।“(ভৌমিক, ১৯৯৬, পৃ-২৬২)।

ভৌমিক (১৯৯৬) এম এন লারমার ‘দ্বৈত ভূমিকা’র অর্জিত ফলাফল নিয়ে মতামত তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন,

“১৯৭০ হতে ১৯৭২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর জন্য পৃথক রাজনৈতিক ও স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন গড়ে তোলার ভিত্তি স্থাপন করা হয়ে থাকলে, ১৯৭২-৭৫ পর্যায়ে ‘দ্বৈত লাইন’ পদ্ধতির অনুসরণ করে, লারমা ভ্রাতৃদ্বয় ও অনুগত রাজনৈতিক সক্রিয় কর্মীরা কেবলমাত্র পিএসজেএসএসকে একটি আধুনিক রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়েই তুলেনি, বরং সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক শাখাটিকে (the armed vounteer wing) একটি দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেছিল।“(ভৌমিক, ১৯৯৬, পৃ-২৬৪)।

বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎকালে ২৯ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখে উপজাতীয় প্রতিনিধিদলকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ছাড়াও ১৯৭৩ এবং ১৯৭৫ সালে রাঙামাটিতে প্রদত্ত ভাষন, রাঙ্গামাটির সাংসদ সুদিপ্তা দেওয়ানের সাথে সাক্ষাতকালে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি এবং বঙ্গবন্ধুর আমলে বিভিন্ন সময়ে গৃহীত পদক্ষেপসমুহে এটা প্রমানিত যে, বঙ্গবন্ধু পার্বত্য চট্টগ্রামকে অনগ্রসর এলাকা হিসেবে বিবেচনা করে বিশেষ সুবিধা প্রদানের ব্যাপারে আন্তরিক ছিলেন এবং বেশ কিছু বাস্তব পদক্ষেপও গ্রহণ করেছিলেন।

শুধু তাই নয়, তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানে আরো কিছু বিশেষ পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন বলে জানা যায়। এতদসত্বেও, গৃহীত বাস্তব পদক্ষেপসমুহকে সম্পূর্ণ আড়াল করে এবং প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির কোনো ধরনের উল্লেখ না করে শুধুমাত্র নির্বাচিত কয়েকটি বক্তব্যকে ব্যাপক প্রচার করা হয়েছিল নিতান্তই রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্যে। রাজনৈতিক ফায়দার বিষয়টি উন্মোচিত হয়ে পড়ে, যখন পরবর্তীতে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ এর পরিবর্তে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ বাংলাদেশের সংবিধানে গ্রহনের পরেও শান্তি বাহিনীর সশস্ত্র আন্দোলনে ভাটা পরেনি।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এম এন লারমার দাবী নামার মধ্যে যে আন্তরিকতা ছিল না সেটা বুঝতে সময় লাগে না যখন চোখে পড়ে যে, ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুআরিতে তিনি ‘ব্রিটিশ রেগুলেশন ১৯০০’ এবং রাজাদের দফতর বহাল রাখার দাবী পেশ করেন। অথচ জিব্লু রহমানের পূর্বোক্ত বই হতে জানা যায়, ১৯৭৩ সালের ২৩ জুন তারিখে তিনি নিজেই জাতীয় সংসদে বলেছিলেন,

“যে অঞ্চল থেকে আমি এসেছি, সে অঞ্চল বাংলাদেশের একটি পিছিয়ে পড়া অঞ্চল। আপনারা বিশ্বাস করতে পারবেন না যে, আমাদের ওখানে এখনও আদিম যুগের মানুষ রয়েছে।
……. আপনারা বিশ্বাস করবেন না, এরা অর্ধউলঙ্গ অবস্থায় এখনও বাস করে।

……. মাননীয় স্পীকার সাহেব, ব্রিটিশের সময়ে এবং পাকিস্তানের আমলে আমাদেরকে চিড়িয়াখানার জীবের মতো করে রাখা হয়েছিল” (রহমান, ২০১৮, পৃ-১৪২)।

উল্লেখ্য যে, কমিউনিস্ট পার্টির মেনিফেস্টোতে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানী সরকারের পাশাপাশি, সামন্তবাদি প্রথা এবং বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধেই বক্তব্য ছিল।

পরবর্তীতে, ১৯৭২ সালের ২৪ এপ্রিলে খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে প্রদত্ত দাবিনামায় ব্রিটিশ রেগুলেশন ১৯০০ এবং রাজাদের দফতর বহাল রাখার দাবী ছিল না। যা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, নিজেদের রাজনৈতিক প্লাটফর্ম ( যেখানে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য শান্তি বাহিনী ছিল) তৈরি হওয়া মাত্রই তিনি নিজের পূর্বের দাবী পরিবর্তন করে ফেলেছেন।

একই ভাবে, এমন ধারনা অমূলক নয় যে, ১৯৭২ সালে শেখ মুজিব তাদের দাবী মেনে নিলেই তারা শান্তি বাহিনীর কার্যকলাপ বন্ধ করে ফেলত না। বরং বিভিন্ন ঘটনাবলী, বিশেষত ১৯৭৩-৭৫ সালে শান্তি বাহিনীর প্রস্তুতি এবং মুজিব হত্যা পরবর্তী সময়ে ভারতের সহযোগিতার আশ্বাস প্রাপ্তিতে ১৯৭৬ সালে সশস্ত্র আন্দোলনের আত্নপ্রকাশের প্রেক্ষিতে এটাই অনুমিত যে, স্বায়ত্বশাসনের সুযোগে তারা তাদের সশস্ত্র আন্দোলনের বেগ আরো জোরদার করার চেষ্টা করতো এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি আরো জোরালো হুমকি হয়ে আবির্ভূত হতো।

বঙ্গবন্ধুর আমলে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং শান্তি বাহিনীর কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণে এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, সরকার যখন আন্তরিক ভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নের জন্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, তখন শান্তি বাহিনী ক্রমান্বয়ে তার শক্তি বৃদ্ধি করে চলছিল। একদিকে সংসদে দাবিনামা পেশ আবার অন্যদিকে গোপনে সশস্ত্র আন্দোলনের প্রস্তুতির খন্ডচিত্র সচেতন পাঠককুলের অজ্ঞাত থাকার নয়।

যার ফলে, অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, এক্ষেত্রে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন ছিল একটা বাহানা মাত্র; যার আড়ালে পূর্ণ উদ্যমে সশস্ত্র আন্দোলনের প্রস্তুতি চলছিল। যেখানে, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন এবং সশস্ত্র আন্দোলন – উভয় ক্ষেত্রেই নেতৃত্বে ছিলেন এম এন লারমা। বলাই বাহুল্য যে, তিনি মুলত দ্বৈত ভূমিকা পালন করছিলেন – সশস্ত্র আন্দোলনের প্রস্তুতির পাশাপাশি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ খোলা রাখার জন্যে । এক কথায়, পার্বত্য সঙ্কট সৃষ্টিতে এমএন লারমা দ্বৈত ভূমিকা রেখেছিলেন। যেটা তার ভাই, সন্তু লারমাও অব্যাহত রেখেছেন বলে অনেকে ধারনা করছেন।

অবশ্য, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমসাময়িক বাস্তবতা মাথায় রেখে সন্তু লারমা আদৌ দ্বৈত ভুমিকা পালন করছেন কিনা সেটা বিবেচনার ভার পাঠকের উপর ছেড়ে দেয়াই উত্তম। কারন, জেএসএস এর সশস্ত্র দলের নিয়ন্ত্রনের ভার দলের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে সন্তু লারমার উপর কতটুকু বর্তায় এমন প্রশ্নের পাশাপাশি আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে গনতান্ত্রিক চেহারায় আড়ালে তিনি তথাকথিত জুম্মল্যান্ডের সশস্ত্র সৈন্য (জেএসএস এর সশস্ত্র দল) পরিচালনা করছেন কিনা? – এমন প্রশ্ন উঠা কতটুকু যুক্তিসংগত সেটা আপাতত পাঠকদের বিবেচ্য হয়েই থাকুক।
তথ্যসুত্রঃ
ইবরাহিম, মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ, বীর প্রতীক, (২০১৪). মিশ্র কথন. (৩য় প্রকাশ), ঢাকা: অনন্যা।
মোর্তোজা, গোলাম (২০০০ ). শান্তি বাহিনী গেরিলা জীবন. ঢাকা: সময় প্রকাশন।
রহমান, আতিকুর. (২০০৭). পার্বত্য তথ্য কোষ (প্রথম খন্ড). সিলেট: পর্বত প্রকাশনী।
রহমান, জিব্লু. (২০১৮). পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা ও সমাধান (১৯৭২-১৯৯৮). সিলেট: শ্রীহট্ট প্রকাশ।
লেনিন, নূহ-উল-আলম. (১৯৯৯). পার্বত্য চট্টগ্রামঃ সমুখে শান্তি পারাবার. ঢাকা: হাক্কানী পাবলিশার্স।
Bhaumik, Subir. (1996). Insurgent Crossfire North-East India. New Delhi: Lancer Publishers.

♦ লেখক: পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক


পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা সমূহ:

·      পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা

·     পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক সেনাহত্যার ইতিহাস


[লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে? তাহলে দয়াকরে গবেষণামূলক ও ইতিহাস ভিত্তিক এই সাইটটি চালিয়ে যেতে সাহায্য করুন। পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার বঞ্চিত বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী সাইটটি পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার কতৃক চরমভাবে অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত, পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ঠ এনজিও সমূহের একচোখা নীতি, সন্তু লারমা ও প্রসীত খীসাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) 'এর নিপিড়িত, নির্যাতিত ও বর্বরতম সন্ত্রাসের নির্মম ও অসহায় শিকার - পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠির সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ক্ষুদ্রতম এক প্রয়াস]