আগের পর্ব: পর্ব-১ পর্ব-২
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার ইতিহাস : পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা বহুল আলোচিত এবং প্রচুর পরিমাণে পর্যালোচিত। এর ইতিহাস সম্পর্কে এখন প্রায় প্রত্যেকেই জানেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা কোন দলের সমস্যা নয়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সমস্যা। এ অঞ্চলে বসবাসরত উপজাতীয় জনসমষ্টি যে ভূমিজ সন্তান নন এবং এ অঞ্চলে ইতিহাসের কোন পর্যায়ে যে স্বতন্ত্র শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি তাও সবাই জানেন। এও জানেন যে, এ অঞ্চলে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে উপজাতীয় এবং অ-উপজাতীয় জনগণ পাশাপাশি বসবাস করেছেন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে। মাত্র কিছু সংখ্যক গণবিচ্ছিন্ন নেতা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য এই শান্তিপূর্ণ নীরব অঞ্চলকে জাতীয় রাজনীতির অঙ্গন ছাড়িয়ে তুলে আনতে চেয়েছেন আঞ্চলিক, এমনকি আন্তর্জাতিক রাজনীতির বৃহৎ পরিমন্ডলে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার প্রথম প্রকাশ ঘটে এ শতকের চতুর্থ দশকের মাঝামাঝি। তখন কিছু সংখ্যক উপজাতীয় নেতা ভারত বিভক্তি অপরিহার্য জেনে কিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে তৎকালীন পূর্ব বাংলা ও বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা যায় তার পথ অনুসন্ধান করেছেন, দাবী তুলেছেন। যোগাযোগ করেছেন হিন্দু ব্রাহ্মন্যবাদী নিখিল ভারত কংগ্রেস নেতৃত্বের সাথে। মহাত্মাগান্ধী, (১৮৬৯-১৯৪৮) সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল, আচার্য কৃপালনী, জয় প্রকাশ নারায়ণ (১৯০২-১৯৭৯) ও কংগ্রেস সভাপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ সহ কংগ্রেসের অন্যান্য নেতা এবং শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীর মতো হিন্দু মহাসভা নেতার সাথে তারা যোগাযোগ করেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, নিখিল ভারত কংগ্রেস নেতৃত্ব সরেজমিনে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য এই এলাকায় একটি প্রতিনিধি দলও প্রেরণ করেন। এ সময় কংগ্রেস নেতা এ. বি. ঠক্কর সহ অন্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিনিধিদল নিয়ে এসে সেখানকার উপজাতীয়দের ভারতের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হবার জন্যে প্রকাশ্য প্রবল প্রচারণা চালায়। তাতে কাজ না হলে উপজাতীয় রাজারা ভারতীয় দেশীয় রাজ্যের রাজন্যদের মত মর্যাদাবান না হয়েও ১৯৪৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে গঠন করেন ‘দি হিলমেন এসোসিয়েশন’ ('The Hillmen
Association')। লক্ষ্য ছিল অন্যান্য দেশীয় রাজ্যের রাজন্যদের মত পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি ‘দেশীয় রাজ্যে’ (Princely
State) পরিণত করে প্রতিবেশী ত্রিপুরা, খাসিয়া বা কুচবিহারের ন্যায় রাজা শাসিত রাজ্যগুলির সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামকে জুড়ে একটি আলাদা রাষ্ট্র সমবায় (Confederation) গঠন করা এবং ভারতের কেন্দ্রীয় শাসনের অন্তর্ভুক্ত হওয়া। তাও যখন সম্ভব হয়নি তখন কংগ্রেস নেতা জওহর লাল নেহেরুর (১৮৮৯-১৯৬৪) মাধ্যমে ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড লুই মাউন্ট ব্যাটেনের উপর চাপ সৃষ্টি করা হয় যেন র্যাডক্লিফ কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করেন। প্রাচীন রেকর্ডপত্রে পাওয়া যায়, বাউন্ডারী কমিশনের (Boundary
commission) স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ মাউন্ট ব্যাটেনের সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এ কারণে যে, পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র সমুদ্র বন্দর ‘চট্টগ্রাম অরক্ষিত’ হয়ে পড়বে যদি পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়, যেমন পশ্চিম বাংলার রাজধানী কলকাতা অরক্ষিত হয়ে উঠবে যদি মুসলিম প্রধান মালদহ, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৪ই অগাস্ট ১৯৪৭ র্যাডক্লিফ কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করেন। একদিকে কংগ্রেস ভারতের পক্ষে আরও অনেক সুযোগ র্যাডক্লিফের বাউন্ডারী কমিশন থেকে হাতিয়ে নেয়া এবং অন্যদিকে মুসলিম লীগের প্রবল বিরোধিতার মুখে পার্বত্য চট্টগ্রামকে সরাসরি ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। রেডক্লিফ রোয়েদাদ অনুসারে পূর্ব বাংলার সঙ্গে থেকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐসব চাকমা নেতা পাকিস্তানকে মনে প্রাণে গ্রহণ করেননি। সবাই জানেন ১৯৪৭ সালের ১৪ অগাস্ট রাঙ্গামাটিতে ভারতীয় পতাকা উত্তোলিত হয় এবং ১৯ অগাস্ট পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীন হলে ভারতীয় কংগ্রেস নেতা এ. বি. ঠক্করের প্ররোচনায় রাম-রাজত্বের মোহে উম্মাদ চাকমা নেতা কামিনী মোহন দেওয়ান , স্নেহ কুমার চাকমা , ঘনশ্যাম দেওয়ান প্রমুখ রাঙ্গামাটিতে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট অফিসের সামনে ভারতীয় অশোক চক্রের পতাকা উত্তোলন করেন। সেই সময় কি ঘটে তা একজন চাকমা লেখকের ভাষায় শোনা যেতে পারে: ‘এত আশা-আকাঙ্খা নিয়ে ভারতীয় পতাকা উড়ানো হলেও সঙ্গে সঙ্গেই রশির গিঁট খুলে নিজেই পতাকাটি মাটিতে পড়ে যায়। ফ্লাগ পোল থেকে নিজে নিজে খুলে পড়ায় সেদিন অনেকেই বলেছিলেন, মনে হয় এই মাটিতে ভারতীয় পতাকা কোনদিনই উড়বে না। অগত্যা এক তরুন চাকমা বালকের বানরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার মত কয়েকবার চেষ্টা পরিশেষে তিন চার গিট দিয়ে ভারতীয় পতাকা উড়ানো নিশ্চিত করলেও এ.বি.ঠক্কর পার্বত্য চট্টগ্রামের ভারতের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে পারেন নি’। ১৫ অগাস্ট মারমারা বান্দরবানে উত্তোলন করেন বার্মার পতাকা। তখনকার চাকমা নেতা স্নেহকুমার চাকমা পাকিস্তান ত্যাগ করে ভারতে চলে যান। পরবর্তীকালে তিনি ত্রিপুরা রাজ্য বিধান সভার সদস্যও হন।
মোটকথা পূর্ব বাংলার সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করে যে ভারত বিভক্তি হয় সেটা তারা মানেননি। ২১ অগাস্ট ১৯৪৭ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেলুচ রেজিমেন্ট তাদের দমন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বাধীন পাকিস্তানের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। মোটকথা ১৯৪৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ ভারতীয় ইউনিয়নে যোগদানের পক্ষপাতী ছিলেন। তিন সার্কেলের তিনজন উপজাতীয় প্রধান বা রাজা পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি দেশীয় রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের আশায় বৃটিশ বেনিয়া কর্তৃপক্ষ ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের কাছে তদবীর করেছিলেন। তারা ত্রিপুরা, কুচবিহার ও খাসিয়া অঞ্চল সমন্বয়ে ভারতীয় কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে একটি কনফেডারেশন প্রতিষ্ঠারও প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু এসব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় ১৯৪৭ সালের ১৪ই অগাস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে তারা ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করে উল্লাস প্রকাশ করেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানের অংশ হওয়ার পর ১৯৪৮ সালে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ফ্রন্টিয়ার পুলিশ রেগুলেশন এ্যাক্ট ১৮৮১’ বাতিল করা হয়। ১৯৫৬ সালে অনন্ত বিহারী খীসা এবং মৃণাল কান্তি চাকমার নেতৃত্বে ‘হিল স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন’ গঠিত হয়। পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের দ্বারা গঠিত এটাই প্রথম উল্লেখযোগ্য সংগঠন। পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে যথাক্রমে ১৯৫৬ এবং ১৯৬২ সালের সংবিধানেও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে ‘বহির্ভূত এলাকা’ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কিন্তু ১৯৬৩ সালে সংবিধানের এক সংশোধনীর মাধ্যমে উক্ত অঞ্চলের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করা হয় এবং এই এলাকাকে ‘উপজাতি এলাকা’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। আইয়ূব খানের শাসনামলে মৌলিক গণতন্ত্র প্রবর্তনের মাধ্যমে উপজাতীয় জণগনকে জাতীয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত করা হয়। এ সময়ে উপজাতীয় কর্মচারীদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে বদলি করা হয়। শুধু উপজাতীয়দের দ্বারা গঠিত পুলিশ বাহিনী বাতিল করা হয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের আয়ত্তাধীনে আনা হয়। এভাবে বৃটিশ সরকার কর্তৃক দেয় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ মর্যাদার অবসান হয়।
১৯৬৫ সালের ১৮ জুন মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার নেতৃত্বে ‘পার্বত্য ছাত্র সমিতি’ নামে একটি সংগঠনের জন্ম হয়। পরের বছর অনন্ত বিহারী খীসা এবং জে. বি. লারমার নেতৃত্বে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতি (আদিবাসি) কল্যাণ সমিতি’ নামে আরো একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
কেউ কেউ বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার জন্ম হয় যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান মানবেন্দ্র নারায়ন লারমাকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন বিচ্ছিন্নতার পথ পরিহার করে বাঙালী জাতীয়তাবাদের মূল স্রোতে মিশে যেতে। ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামীলীগ সরকার বাংলাদেশী জাতিসত্তার বদলে বাঙালী জাতিসত্তার বিষয়টিকে একচ্ছত্র প্রতিষ্ঠা দিলে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা (১৯৭২-৭৫ এ স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য) এর প্রতিবাদ করেন, শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ডেপুটেশন নিয়ে যান, স্মারকলিপি দেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের অসন্তোষ উত্থাপন করে তা সমাধানের দাবী জানান। শেখ মুজিবুর রহমান মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে বাঙালি হয়ে যাবার কথা বলেন। তিনি বলেন ‘যা বাঙালি হইয়া যা’। শেখ মুজিবের এই প্রস্তাবে নিজেদের ঐতিহ্য ও স্বকীয় জাতিসত্তার ভবিষ্যত সম্পর্কে উপজাতিয়রা বিচলিত বোধ করেন। এখানে উল্লেখ্য যে ১৯৭২ সালের ২৯ জানুয়ারী চারু বিকাশ চাকমার নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি উপজাতীয় প্রতিনিধি দল পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। রাজা মং প্রু সাইন চৌধুরীর নেতৃত্বে আরেকটি পার্বত্য প্রতিনিধি দল শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন, তবে তারা তাদের দাবিগুলো রেখে যান।
মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১৫ তারিখে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করে উপজাতীয়দের চার দফা দাবি উত্থাপন করেন। দাবিগুলো ছিল-
১। পাবর্ত্য চট্টগ্রামের নিজস্ব আইন পরিষদ সংবলিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন। পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল হবে এবং এর একটি নিজস্ব আইন পরিষদ থাকবে।
২। উপজাতীয় জনগণের অধিকার সংরক্ষনের জন্য ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির অনুরূপ সংবিধি বাংলাদেশের সংবিধানে সংযোজন করা।
৩। উপজাতীয় রাজাদের দফতরগুলো সংরক্ষণ করা।
৪। সংবিধানে ১৯০০ সালের রেগুলেশনের সংশোধন-নিরোধ সংক্রান্ত বিধি রাখা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি অনুপ্রবেশ বন্ধ করা।
মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে যে চার দফা দাবী উত্থাপন করেছিলেন তার একটিও পূরন না করে তিনি পাহাড়িদের বাঙালী হয়ে যাবার কথা বলায় পাহাড়িরা মারমুখী হয়ে উঠে। মূলত এ কারনেই সংসদ সদস্য হওয়া সত্ত্বেও ১৯৭২ সালে দেশে যে প্রথম সংবিধান প্রণীত হয় মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা তাতে সই করেননি।
মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার দাবিকে একদিকে শেখ মুজিব উপেক্ষা করেন; অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়কে পাকিস্তান থেকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য ত্রিদিব রায়ের মা বিনীতা রায়কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠান। ত্রিদিব রায় তখন পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু রাজা ত্রিদিব রায় বাংলাদেশে ফিরে আসতে অস্বীকার করেন। ১৯৭৩ সালে রাঙ্গামাটির এক নির্বাচনী জনসভায় চাকমা রাজার বিরুদ্ধে স্বাধীনতা বিরোধী তৎপরতার কথা উল্লেখ করে শেখ মুজিবুর রহমান পাহাড়িদের বাঙালি হয়ে যাবার পরামর্শ দেন। এ জনসভায় বলেছিলেন, From this day
onward the tribals are being promoted into Bengalis.
শেখ মুজিবুর রহমান উপজাতীয়দের চার দফা দাবি প্রত্যাখ্যান করার পর উপজাতীয়রা উপলব্ধি করলো যে বিপ্লবী সংগঠন তৈরি করা ছাড়া তাঁদের উদ্দেশ্য সফল হবে না। এর ফলে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের ১৫ মে গঠিত হয় রাঙ্গামাটি কমিউনিস্ট পার্টি। ১৬ মে গঠিত হয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশ্য সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জে এস এস)। রাঙ্গামাটি কমিউনিস্ট পার্টি ও জনসংহতি সমিতি-এ দুটি সংগঠনের কোনোটিই মার্কসবাদী আদর্শ দ্বারা পরিচালিত হয়নি। সংগঠন দু’টি ছিল মার্কসবাদী ও জাতীয়তাবাদী আদর্শে সংমিশ্রিত সংগঠন। পার্বত্য চট্টগ্রামের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে জনসংহতি সমিতি সামন্তবাদকে প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে, প্রলম্বিত গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের কথা বলে। উল্লেখ্য জনসংহতি সমিতির চার দফা কর্মসূচী পাহাড়িদের নিকট ম্যাগনাকার্টা হিসেবে চিহ্নিত হলেও এ দফাগুলোতে শ্রমিক-কৃষকের দাবি তুলে ধরা হয়নি। চার দফা দাবি আদায় ও আওয়ামীলীগ সরকারের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শেখ মুজিবের আওয়ামী শাসনামলেও আন্ডার গ্রাউন্ডে গিয়ে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি ৭ই জানুয়ারী ১৯৭৩ সালে সেনা উইং সশস্ত্র শান্তিবাহিনী গঠন করেন। ১৯৭৩ সালে গঠিত হলেও এর কার্যকলাপ ১৯৭৫ সালের অগাস্ট মাসের পর অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পায়। শান্তিবাহিনীর কার্যকলাপ এ সময়ে বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ ছিল প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের চাকমা গেরিলাদের সহযোগিতা। ১৯৭৬ সালের জুনে বিলাইছড়ি আর্মড পুলিশ ক্যাম্প এবং বেতছড়িতে শান্তিবাহিনী প্রথম হামলা করে। ওই বছর জিয়াউর রহমান পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ড গঠন করেন। রাজা ত্রিদিব রায়ের মা বিনীতা রায়কে এই বোর্ডের উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়। ১৯৭৭ সালের ৪ জুলাই জিয়াউর রহমান গঠন করেন ট্রাইবাল কনভেনশন। ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে এম এন লারমা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। তবে জাসদ প্রার্থী উপেন্দ্র লাল চাকমা (২৯৯ পার্বত্য চট্টগ্রাম-১), স্বতন্ত্র প্রার্থী অংশ প্রু চৌধুরী (৩০০ পার্বত্য চট্টগ্রাম-২) সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র উইং শান্তিবাহিনীর অন্যতম নেতা সন্তু লারমা ও চবরি মারমা ১৯৭৬ সালের কোন এক সময় সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তাদেরকে বন্দি করে রাখা হয়। এ সময় শান্তি বাহিনীর নেতৃত্বে আসেন প্রীতিকুমার চাকমা। ১৯৮১ সালে শান্তি বাহিনীর সাথে সরকারের আলোচনার শর্ত হিসেবে সন্তু লারমা ও চবরি মারমা মুক্তি পেয়ে পাহাড়ে ফিরে আসেন।
জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র সংগঠন শান্তিবাহিনী ১৯৭৮ সালে আদর্শিক কারণে সাংগঠনিক বিপর্যয়ে পতিত হয়। এ সময়ে প্রীতিকুমার চাকমার নেতৃত্বে একটি গ্রুপ জাতীয়তাবাদী আদর্শের মাধ্যমে অল্প সময়ের মধ্যে পাহাড়িদের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার আদায় করতে চায়। অন্যদিকে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা প্রলম্বিত যুদ্ধের মাধ্যমে পাহাড়িদের অধিকার আদায় করতে আগ্রহী। এ আদর্শিক সংঘাতের ফলে দু’গ্রুপে হানাহানি শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের ১৪ জুন সন্তু লারমার অধীনস্থ শান্তিবাহিনীর সদস্যরা প্রীতি গ্রুপের প্রভাবশালী কমান্ডার অমৃতলাল চাকমা ওরফে বলি ওস্তাদসহ অনেককে হত্যা করে এবং প্রতিশোধ হিসেবে মানবেন্দ্র লারমা প্রীতি গ্রুপের একটি সুইসাইড স্কোয়াডের হাতে ১০ নভেম্বর ১৯৮৩ নিহত হন। ১৯৮৩ সালের নভেম্বর মাসের ১০ তারিখের ঘটনা ১৯৮৭ সালের ভারতীয় পত্রিকায় নিম্নলিখিতভাবে বর্ণিত হয়েছে :
"Priti Kumar and his protagonists in
the organisation called for 'decisive war' to end in the seccssion of the CHT
from Bangladesh and its subsequent merger with India... Manobendra Larma, who
viewed India as an expansionist bourgeois state advocated long protracted form
of armed struggle to achieve autonomy within Bangladesh, not to secede from it.
Manobendra saw the Chakma struggle "as part of the struggle of the toiling
masses of Bangladesh." In fact, the cause of immediate differences between
the two groups was Manobendra's decision to stop the raids on the non-tribal
settlements created by Bangladesh authorities to resettle large members of
Muslim peasants and landless labourers in the hill tracts. Priti Kumar felt
that time was runnig out for the Chakma. "Now or Never" was his
call...
এই মৃত্যু এবং পার্টির ভাঙন সম্পর্কে ৩১ ডিসেম্বর সন্তু লারমা একটি ছাপানো বিবৃতি প্রচার করেন। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘‘গত ১০ নভেম্বর বৃহস্পতিবার ১৯৮৩ ইংরেজী তারিখ জুম্ম জাতির জাতীয় ইতিহাসে সবচেয়ে ঘৃণিত ও কলঙ্কিত কালো দিবস। এই দিনে জুম্ম জাতির কুলাঙ্গার চক্রান্তকারী, ক্ষমতালোভী ও বিভেদপন্থী গিরি (ভবতোষ দেওয়ান), প্রকাশ (প্রীতি কুমার চাকমা), দেবেন (দেব জ্যোতি চাকমা), পলাশ (ত্রিভঙ্গিল দেওয়ান) চক্র এক বিশ্বাসঘাতকতামূলক আক্রমণ চালিয়ে জুম্ম জাতির চেতনা ও জাগরণের অগ্রনায়ক, মহান দেশপ্রেমিক, নিপীড়িত জাতি ও জনগণের অগ্রনায়ক, নিপীড়িত জাতি ও জনগণের একনিষ্ঠ বিপ্লবী বন্ধু, কঠোর সংগ্রামী, ত্যাগী, ক্ষমতাশীল ও দূরদর্শী মহান জাতীয় নেতা, জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে তাঁর ৮ (আট) জন সহকারী (পরিমল বিকাশ চাকমা, মনিময় দেওয়ান, কল্যাণময় খীসা, সৌমিত্র চাকমা ও অর্জুন ত্রিপুরা প্রমুখ) সহ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। .. .. .. সহকর্মীদের কয়েকজনের মরদেহের ওপরও ব্রাশ ফায়ার করে মরদেহ ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে তারা তাদের ঘৃণিত চরিত্র উন্মোচন করে গেছে।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার মৃত্যুর পর শান্তিবাহিনী লারমা গ্রুপের নেতৃত্ব ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর সন্ত লারমা গ্রহণ করে। এ সময়ে ১৯৮৩ সন্ত লারমার শারীরিক অসুস্থতার কারণে রূপায়ণ কুমার চাকমা পার্টির নেতৃত্ব দান করেন। ১৯৮৫ সালে আদর্শিক কারণে লারমা গ্রুপ দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। উষাতনের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ এবং রূপায়ণ দেওয়ানের নেতৃত্বে অপর গ্রুপ পার্বত্য চট্টগ্রামে নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়ে যেতে থাকে। অপরদিকে দেবেন পলাশের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ প্রীতির নেতৃত্ব থেকে বেরিয়ে ভিন্নভাবে কাজ করতে থাকে।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর বেগম খালেদা জিয়া পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিকভাবে সমাধান করার লক্ষ্যে জনসংহতি সমিতির সাথে পুনরায় সংলাপের ব্যবস্থা করেন। জনসংহতি সমিতি এ সময়ে তাদের পূর্বের পাঁচ দফা দাবি সংশোধিত করে পুনরায় সরকারের নিকট পেশ করে। জনসংহতি সমিতির পাঁচ দফা প্রকৃতপক্ষে পূর্বের পাঁচ দফা দাবির অনুরূপ। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে জনসংহতি সমিতির সঙ্গে মতৈক্যের ভিত্তিতে একটি চুক্তি সম্পাদন করে। এই চুক্তি ‘‘শান্তি চুক্তি’’ নামে পরিচিত হয়। তবে চুক্তি সইয়ের পরপরই উপজাতি জনগণের একটি অংশ পার্বত্য চুক্তিকে ‘আপসের চুক্তি’ বলে আখ্যায়িত করে চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে। পাহাড়ি গণপরিষদ (পিজিপি), গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম (ডিওয়াইএফ)- কেন্দ্রীয় আহবায়ক মিঠুন চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)- বর্তমান সভাপতি অংগ্য চাকমা , হিল উইমেন্স ফেডারেশন (এইচ ডব্লিও এফ) - কেন্দ্রীয় সভানেত্রী সোনালী চাকমা , এ চুক্তির বিরোধিতা করে। চুক্তি বিরোধীদের দাবী জনসংহতি সমিতি সরকারের সাথে যে চুক্তি করেছে তার মাধ্যমে উপজাতিদের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়নি। উপজাতীয়রা পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের যে দাবি জানিয়ে আসছিল সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমে তা অর্জিত হয়নি। তাই উপজাতীয় পাহাড়ী জনগণের স্বার্থরক্ষা ও পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন তারা। এরই মধ্যে হিল উইমেন্স ফেডারেশন দু’ভাগ হয়ে যায়। এক ভাগ থাকে চুক্তির বিপক্ষে অন্য ভাগ চলে যায় চুক্তির পক্ষে। পরে চুক্তি বিরোধী কয়েকটি সমমনা গোষ্ঠীকে নিয়ে প্রসীত খীসার নেতৃত্বে ১৯৯৭ সালের ২৬শে ডিসেম্বর ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউ.পি.ডি.এফ) গঠিত হয়। তিনি সে সময় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতা ছিলেন। পরে তার একক নেতৃত্বে দলটি গড়ে উঠে। এখন এ দলটি পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্বশাসন দাবী করে আন্দোলন করছে। তদের সশস্ত্র বাহিনী আছে এটিও তারা স্বীকার করেন না। তবে পার্বত্য তিন জিলায় ইউপিডিএফ’র কয়েক হাজার সশস্ত্র ক্যাডার রয়েছে। পার্বত্য রাজনীতিতে ইউ.পি.ডি.এফ এখন একটি বড় শক্তি। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান- তিন পার্বত্য জিলাতেই এদের সাংগঠনিক তৎপরতা রয়েছে। পার্বত্য এলাকার অন্যতম প্রধান সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সংগে ইউ.পি.ডি.এফের বিরোধ গোড়া থেকেই। চুক্তি বিরোধী ইউ. পি.ডি.এফের দাবী পার্বত্য অঞ্চলের পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন। এ সংগঠনের সভাপতি হিসেবে নেতৃত্বে রয়েছেন প্রসীত বিকাশ খীসা, (পিতা- অনন্ত বিহারী খীসা), সাধারণ সম্পাদক রবি শংকর চাকমা, অন্যান্য নেতাদের মধ্যে রয়েছেন প্রদিপন খীসা, চন্দন চাকমা প্রমুখ। এই ফ্রন্ট মনে করে স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তারা মনে করে এই চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সৈন্য প্রত্যাহার ও পাহাড়িদের ভূমি সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান হবে না। ইউ.পি.ডি.এফ. সৈন্য প্রত্যাহার ও জাতিসত্তাগুলোর সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধানের গুরুত্ব প্রদান করে। এভাবে দেখা যায় যে পার্বত্য শান্তি চুক্তি নিয়ে পাহাড়ের মানুষ দ্বিধা বিভক্ত। জনসংহতি সমিতির বিকল্প হিসেবে জুম্ম ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (Jumma Naitonal
Democratic Front) গঠিত হয়েছে বলেও পত্রিকায় খবর পাওয়া যায়। শান্তি বাহিনীর বিকল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে ‘জুম্ম ন্যাশনাল আর্মি’ (Jumma National
Army)। অন্যান্য সংগঠন হচ্ছে নয়া সেতু (সভাপতি নিত্যানন্দ পাল)। পার্বত্য চুক্তির প্রধান অঙ্গীকার মুতাবিক পাহাড়ের সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা, বেআইনী অস্ত্রের বন্দুকযুদ্ধ, সন্ত্রাস, খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, মুক্তিপন, অবৈধ আধিপত্য বিস্তার, গুপ্তহত্যা আজো বন্ধ হয়নি। পার্বত্য শান্তি চুক্তির ১৩ বছর পূর্ণ হলেও আজও পাহাড়ে শান্তি ফেরেনি। কমেনি খুন, অপহরণ, সন্ত্রাস আর চাঁদাবাজি। শান্তি চুক্তির আগে শুধু শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাস চললেও চুক্তির পর দ্বিমুখী এবং বর্তমানে ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব, সন্ত্রাস আর চাঁদাবাজিতে অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম। শান্তি চুক্তির নামে পার্বত্য এলাকায় বসবাসকারী বাঙালিদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে। তিন পার্বত্য জিলাতেই চাঁদাবাজি ভয়াবহ আকার ধারন করেছে। চুক্তিবিরোধী ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), চুক্তি পক্ষের জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এবং নানা মতবিরোধের কারণে এই দুই গ্রুপ থেকে বের হয়ে নতুন জন্ম নেয়া ‘চিটাগাং হিল ট্রাক্টস ন্যাশনাল ফোরাম (সিএইচটি এনএফ) এর ব্যানারে চাঁদাবাজি চলছে। রাঙ্গামাটিতে জেএসএস সমর্থকরা ‘সন্তোষ’ এবং ইউপিডিএফ সমর্থকরা ‘গুন্ডুস’ বাহিনী হিসেবে পরিচিত। খাগড়াছড়িতে জেএসএস সমর্থকরা ‘সদক’ এবং ইউপিডিএফ সরাসরি নিজেদের পরিচয় ব্যবহার করে চাঁদাবাজি করে। অন্যদিকে বান্দরবানে নতুন জন্ম নেয়া এনএইচটিএফ সদস্যরা ‘বোরখা পার্টি’ হিসেবে পরিচিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে এহেন অপরাধ নেই যা হয়নি। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে সন্তু লারমার শান্তি বাহিনী। আবারো সশস্ত্র যুদ্ধের হুমকি দিয়েছেন সন্তু লারমা। অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। বেশ কিছু বড় ধরনের অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনাও ঘটেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা মুক্ত, পরিস্থিতি শান্ত এমনটি বলার অবকাশ নেই। পাহাড়ি বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগোষ্ঠী নানাভাবে নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। পাহাড়ে বসবাসকারী বাঙ্গালীরা প্রতিনিয়ত এদের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। এমনকি বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা নতুন মাত্রা পেয়েছে। মনে রাখতে হবে বিদেশী সাহায্যপুষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদ সহজে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। বিগত ৩৫ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে শান্তিবাহিনী ও অন্যান্য সশস্ত্র উপজাতীয়দের হামলায় প্রায় ৮৫ হাজার সৈন্য, বিদ্রোহী ও বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আজও রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত, অরক্ষিত। সেখানকার পাহাড়ে, অরণ্যে, চরাচরে আজ মুসলিম বাংলাভাষী জনতার হাহাকার, আহাজারি আর আর্তনাদে বাতাস ভারী হয়ে আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে প্রায়শই খুন-অপহরণ হচ্ছে মুসলিম বাংলাভাষীরা। বড় বড় নৃশংস হত্যাকান্ড-লংগদু হত্যাকান্ড, কাউখালী হত্যাকান্ড, বরকলের ভূষণ ছড়া হত্যাকান্ড, পানছড়ি হত্যাকান্ড, বাঘাইছড়ি থানার নব খাগড়াছড়িতে ৭ জন সৈনিক হত্যাকান্ড, রামগড় থানার ঝগড়াবিল বাজার হত্যাকান্ড, খাগড়াছড়ির লোগাং হত্যাকান্ড, নানিয়ারচর হত্যাকান্ড, খাগড়াছড়ির মহাজন পাড়ার হত্যাকান্ড, বাঘাইছড়ি থানার হত্যাকান্ড, বাঘাইছড়ি থানার গুলশাখালী, গাঘছড়া, মাইনী, বড় মহিল্লা ও কালাপাকজ্জার ৩৪ বাঙালী কাঠুরের হত্যাকান্ড, খাগড়াছড়ির কুমিল্লা টিলার হত্যাকান্ড, নাইক্ষ্যাংছড়ি পাড়া ও বলিপাড়ার হত্যাকান্ড ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বসবাসরত উপজাতিদের ধর্মকর্ম, সংস্কৃতি ও জীবন যাত্রার ধরনও পরস্পর থেকে ভিন্ন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে চাকমারা একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে আছে। চাকমারা মূলত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ভুক্ত হলেও এখন তাদের একটা বড় অংশ খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে খ্রিস্টান ধর্মীয় মিশনগুলো খুব তৎপর এবং উপজাতিদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। উপজাতীয়দের বেশ ব্যাপকহারে ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়টি মনে হয় পার্বত্য সমস্যার নতুন উপাদান যোগ করেছে। জনসংখ্যার দিক থেকে চাকমাদের পরই অর্থ্যাৎ দ্বিতীয় স্থানে বাঙালিদের অবস্থান। বাঙালিদের আবার সবাই মুসলমান। এ মুহূর্তে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার তিনটি কারণ প্রধান বলে মনে হয়। প্রথমত. সেনাবাহিনী প্রত্যাহার, দ্বিতীয়ত. বাঙালী বসবাসকারীদের প্রত্যাহার, তৃতীয়ত. পুঞ্জীভূত ভূমি সমস্যা- ভূমি জরিপ ও বন্টন। তবে তাৎক্ষনিক কারন হিসেবে মনে হয় সেনাবাহিনী ও বাঙালি বসবাসকারীদের প্রত্যাহারের দাবির বিষয়টিই প্রধান। চাকমা উপজাতিদের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফ’র দাবি তাই। এরা এসব দাবি সংবলিত স্মারকলিপিও স্থানীয় জিলা প্রশাসনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করেছে। পাল্টা স্মারকলিপি পেশ করেছে বাঙালিদের রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ।
লেখক-পরিচিতি : জনাব মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম- বিশিষ্ট ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ এবং প্রাবন্ধিক।
লেখা-পরিচিতি : প্রবন্ধটি ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১০ তারিখে বাংলাদেশ ইসলামিক সেনটার কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে উপস্থাপিত হয়।
পরের
পর্ব: পর্ব-৪ পর্ব-৫ পর্ব-৬ পর্ব-৭ পর্ব-৮ পর্ব-৯
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক
বাঙ্গালী গণহত্যা
সমূহ:
·
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা
· পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক সেনাহত্যার ইতিহাস
[লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে? তাহলে দয়াকরে
গবেষণামূলক ও ইতিহাস ভিত্তিক এই সাইটটি চালিয়ে যেতে সাহায্য করুন। পার্বত্য
চট্টগ্রামে অধিকার বঞ্চিত বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী সাইটটি পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার
কতৃক চরমভাবে অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত, পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ঠ এনজিও সমূহের একচোখা
নীতি, সন্তু লারমা ও প্রসীত খীসাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস
ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) 'এর নিপিড়িত, নির্যাতিত ও বর্বরতম
সন্ত্রাসের নির্মম ও অসহায় শিকার - পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠির
সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ক্ষুদ্রতম এক প্রয়াস]