বর্তমানের তিন পার্বত্য জেলা, রাঙ্গামাটি, বান্দবান ও খাগড়াছড়িকে নিয়ে ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ শাসনকালে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা’ ঘোষণা করা হয়। জেলা ঘোষণার পূর্বে এ এলাকাটি ‘কার্পাস মহল’ নামে পরিচিত ছিল। ১৮৬১ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য জেলায় যে কয়টি থানা স্থাপিত হয় তার মধ্যে লংগদু অন্যতম। লংগদু শব্দটির অভিধানিক কোনো অর্থ জানা নেই। তবে, বিভিন্ন ইতিহাস সূত্রে ধারণা করা হয়, ব্রিটিশ শাসনকালে এই এলাকায় বসবাসরত ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের দলপতি ‘লেংদু’র নাম অনুসারে ‘লংগদু’ নামকরণ হয়েছে। তবে, এই নামকরণ নিয়েও বিতর্ক আছে। ৩৬৮.৪০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের লংগদু থানাকে ১৯৮২ সালের ৭ নভেম্বর ‘মান উন্নত থানা’ ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে লংগদু উপজেলায় উন্নীত হয়। লংগদু উপজেলা রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা সদর হতে নৌপথে প্রায় ৭৬ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। এই উপজেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৈচিত্র্যময়। এই উপজেলার পশ্চিমে ও পূর্বে দুই সারি পাহাড় লম্বালম্বীভাবে মূল উপজেলা ভূমিকে ঘিরে রেখেছে। উপজেলার মূল ভূমি এলাকাকে মনে হয় যেন পাহাড়ের বেড়ায় সংরক্ষণ করছে। উপজেলার মাঝখানে কাপ্তাই হ্রদের বিশাল স্বচ্ছ জলরাশি থৈ থৈ করে। হ্রদের মধ্য দিয়ে বাঘাইছড়ি হয়ে কাচালং নদী সীমান্তের ওপার হতে নেমে এসেছে। যা ভারতের লুসাই পাহাড় থেকে বরকল হয়ে নেমে আসা কর্ণফুলী নদীর সাথে সুভলংয়ে মিলিত হয়েছে।
লংগদু উপজেলার উত্তরে বাঘাইছড়ি এবং খাগড়াছড়ি জেলার দিঘীনালা অবস্থিত। দক্ষিণে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা সদর, পূর্বে বরকল এবং পশ্চিমে নানিয়ারচর ও খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি অবস্থিত। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এই উপজেলায় ১৮০০ সালের পূর্বে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। পরবর্তীতে চাকমা সম্প্রদায়ের আগমন ঘটে। তবে, ব্রিটিশ শাসন আমল থেকে এই উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় বাঙালি সম্প্রদায়েরও বসবাস ছিল। বাঙালিরা ব্যবসা-বাণিজ্য করে জীবিকা অর্জন করত। এলাকার উৎপাদিত কৃষিজ পণ্য বাজারজাত এবং উপজাতীয়সহ স্থানীয়দের নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্য কাপড়-চোপড়, তেল, লবণ, সাবান, ঔষধ ইত্যাদি এই উপজেলায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে আমদানি করত। তাই, উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও সুসম্পর্ক বজায় ছিল।
স্বাধীনতার পর এই উপজেলার মাইনীমুখ বাজারে বায়তুশ শরফ চট্টগ্রামের শ্রদ্ধেয় পীর সাহেব উপমহাদেশের স্বনামধন্য আলেমে দ্বীন হাদীয়ে জামান শাহ্সূফী হযরত মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার (রহ.) আগমন করেছিলেন। বাঙালি মুসলমান সংখ্যা কম দেখে তিনি মহান আল্লাহ পাকের দরবারে বাঙালি মুসলামান সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য দোয়া করেছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে বাঙালি পুনর্বাসনের কারণে এই উপজেলায় বাঙালির সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে এই উপজেলায় চাকমা, বাঙালি ও পাংখো সম্প্রীতির সাথে সহাবস্থান করছে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এ উপজেলা ৬ ডিসেম্বর শত্রু মুক্ত হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সাহায্যকারী মিজুরামের বিদ্রোহী মিজু বাহিনী এই উপজেলায় পাকিস্তানের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করেছিল। ৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনী যৌথভাবে লংগদু সদর ও মাইনীমুখ বাজারে আগমনের ফলে, পাকিস্তানি দোসর মিজু বাহিনী পালিয়ে যায়। লংগদু সদরের নিহত মিজুদের কয়েকটি সমাধির চিহ্ন দেখা যায়।
লংগদু উপজেলার জনসংখ্যা বর্তমানে ৮১,৫৪৮ জন। পুরুষ ৪২,২২৬ জন এবং মহিলা ৩৯,৩২২ জন। ভোটার সংখ্যা ৫০,৩১৯ জন। এই উপজেলায় মৌজা সংখ্যা বর্তমানে ২৫টি, পূর্বেছিল ২১টি। ইউনিয়ন সংখ্যা ৭টি। স্বাধীনতার পূর্বে ইউনিয়ন ছিল একটি।
লংগদুতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংখ্যা ৪৩টি এবং বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ২১টি। মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংখ্যা ১৪টি। এর মধ্যে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় একটি। নাম লংগদু সরকারি হাই স্কুল। তবে, শিক্ষক-কর্মচারী স্বল্পতার কারণে শিক্ষার্থী সংখ্যা নগণ্য। ফলাফলও আশানুরূপ নয়।
উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে কলেজ দু’টি। রাবেতা মডেল কলেজ এবং গুলশাখালী বর্ডার গার্ড মডেল কলেজ। এছাড়াও লংগদু সদর ইউনিয়নের বারবুনিয়া আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন স্কুল এন্ড কলেজ করার প্রস্তুতি চলছে। উল্লেখ্য যে, লংগদু উপজেলায় এখনও কোন ডিগ্রি কলেজ এবং ফাযিল বা কামিল মাদরাসা নেই।
আলিম পর্যায়ে মাদরাসা একটি, মাইনীমুখ ইসলামিয়া আলিম মাদরাসা। দাখিল মাদরাসার সংখ্যা তিনটি। নুরানী ও ফোরকানিয়া মাদরাসার সংখ্যা ১১টি। মসজিদ ১০৫টি। মন্দির সংখ্যা ৪টি। কেয়াং বা বিহার সংখ্যা ১৫টি। তিনটিলা বন বিহার, দুলুছড়ি যেত বন বিহার অন্যতম। উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু শ্রদ্ধেয় বনভান্তে তিনটিলা বন বিহারে বহু বছর সাধনা করেছিলেন বলে জানা যায়। লংগদু থানায় গির্জা সংখ্যা দু’টি। গুলশাখালী ইউনিয়নের বিয়ার থাং পাংখুপাড়ায় একটি এবং আটারকছড়া ইউনিয়নের বামে আটরকছড়ায় একটি। হাসপাতাল দু’টি। লংগদু সরকারি হেল্থ কমপ্লেক্স হাসপাতাল এবং রাবেতা হাসপাতাল (বেসরকারি)।
লংগদু উপজেলা কৃষিনির্ভর। শতকরা ৯০ জন লোক কৃষি থেকে জীবিকা নির্বাহ করে। শুষ্ক মৌসুমে হ্রদ থেকে জেগে উঠা পলিভরাট কাদামাটিতে বোরো আবাদ, পাহাড়ে জুম চাষ, পাহাড়ের কিনারায় নিচু জমিতে আমন চাষ এবং ডুবা টিলাগুলোতে সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে ধানের চাষ, তরমুজ, শাক-সব্জি চাষাবাদ হয়। আখ, আদা, হলুদ বিভিন্ন রবিশস্যের মধ্যে অন্যতম। উল্লেখ্য যে, লংগদু উপজেলা বেশ কিছু এলাকায় পরিবেশ বিনষ্টকারী তামাক চাষ চলে। এই উপজেলায় দ্বিতীয় আয়ের উৎস হচ্ছে হ্রদ থেকে মাছ আহরণ। এছাড়াও বাঁশ, কাঠ সংগ্রহ, আসবাবপত্র তৈরি ও পারমিটের মাধ্যমে জেলার বাহিরে চালান দেয়া এবং বাহির থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় মালামাল উপজেলায় আমদানি করা।
এই উপজেলায় রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার প্রথম শ্রেণির বাজার মাইনীমুখ বাজার অবস্থিত। এ বাজারকে এক সময় জঙ্গলের শহর বলা হতো। তাছাড়া করল্যাছড়ি বাজার, বৈরাগী বাজার, কাট্টলী বাজার, ভাই-বোনছড়া বাজার ও লংগদু বাজার অন্যতম। এ বাজারগুলো ছাড়াও ছোট বড় আরো ১১টি বাজার আছে। লংগদু থেকে সরাসরি সড়ক পথে ঢাকা ও চট্টগ্রাম যাওয়া যায় এবং নদীপথে জেলা সদরের সাথে লঞ্চ যোগাযোগ রয়েছে।
ঐতিহাসিক স্থানের মধ্যে রয়েছে মাইনীমুখে অবস্থিত ‘বনশ্রী বিশ্রামাগার’ এই বিশ্রামাগারটি স্থাপিত হয় ১৯০০ সালে। এই বিশ্রামাগারে তৎকালীন গভর্নর, প্রেসিডেন্ট ও উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ অবস্থান করেছিলেন বলে জানা যায়। সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান একরাত এই বিশ্রামাগারে অবস্থান করেছিলেন। এসময় তিনি একটি বকুল গাছ রোপণ করেছিলেন। বকুল গাছটি বাংলোর পাশে এখনও বিদ্যমান আছে। এছাড়াও গাঁথাছড়া বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, তিনটিলা বন বিহার, দুলুছড়ি জেত বন বিহার, রাজনগর বিজিবি ব্যাটালিয়ন জামে মসজিদ এবং রাবেতা হাসপাতাল কমপ্লেক্স দর্শনীয় স্থানের মধ্যে পড়ে। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে এবং রাস্তাঘাট উন্নয়ন হলে এই উপজেলা দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের অন্যতম উন্নত উপজেলায় পরিণত হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
এখলাস মিঞা খান: সাংবাদিক, শিক্ষক ও ছড়াকার।
·
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা
· পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক সেনাহত্যার ইতিহাস
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা সমূহ:
·
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা
· পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক সেনাহত্যার ইতিহাস
[লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে? তাহলে দয়াকরে গবেষণামূলক ও ইতিহাস
ভিত্তিক এই সাইটটি চালিয়ে যেতে সাহায্য করুন। পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার বঞ্চিত
বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী সাইটটি পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার কতৃক চরমভাবে অবহেলিত ও
সুবিধা বঞ্চিত, পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ঠ এনজিও সমূহের একচোখা নীতি, সন্তু লারমা ও
প্রসীত খীসাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম
জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) 'এর নিপিড়িত, নির্যাতিত ও বর্বরতম সন্ত্রাসের নির্মম ও অসহায়
শিকার - পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠির সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে
ক্ষুদ্রতম এক প্রয়াস]