আশির দশকে সাধারণ মানুষের প্রতি শান্তিবাহিনীর নির্মমতার কারণে বিভিন্ন সময়ে বিপুল সংখ্যক পাহাড়ী-বাঙ্গালী নিজ ভূমি থেকে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছিলো। পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্বে ও পরে বিভিন্ন সময়ে সাধারণ উপজাতি ও বাঙ্গালীরা তাদের শরণার্থী জীবন ছেড়ে সরকারের দেয়া সুবিধাদি নিয়ে স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবনের পথ বেছে নিয়েছিলো। শরণার্থীদের জন্য সরকার ঘোষিত বিশেষ সুবিধাদির প্রতি আকর্ষিত হয়ে এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক রাজনীতির সমীকরণে শরণার্থীদের মধ্যেই সংখ্যা বিভেদ ইস্যু ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করে। যদিও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সুদূরপ্রসারী এই সমস্যার কথা বিবেচনা করে একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেছিলেন, যা “ পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও পূনর্বাসন এবং আভ্যন্তরীন উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পূনর্বাসন সংক্রান্ত টাস্কফোর্স” নামে পরিচিত। বিশেষ এই সংস্থাটির দীর্ঘ নাম দেখলেই বোঝা যায় সরকার সুচিন্তিতভাবেই শরণার্থী সংক্রান্ত সম্ভাব্য সকল সমস্যা অনুধাবন করতে পেরে প্রতিটি বিষয় অন্তর্ভূক্ত করে এই টাস্কফোর্স গঠন করেছিলো।
এই টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান হিসেবে প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় একজন উপজাতি ব্যক্তি দায়িত্ব পালন করেন। চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার পদাধিকার বলে এই টাস্কফোর্সের সদস্য সচিব হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া অন্যান্য সদস্যবৃন্দ যেমন, আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান অথবা তার প্রতিনিধি, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক, বান্দরবান জেলা প্রশাসক, বান্দরবান জেলা পরিষদের একজন সদস্য, রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক, একজন বাঙ্গালী প্রতিনিধি (বর্তমানে জনাব এসএম শফি), ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ওয়েলফেয়ার কমিটির সচিব (বর্তমানে সন্তোষিত চাকমা বকুল) এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ হতে একজন প্রতিনিধি এই টাস্কফোর্সের নীতি-নির্ধারনী সভায় অংশ গ্রহণ করে থাকেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পরবর্তী সময়ে বিশেষ এই টাস্কফোর্স গঠনের পর দীর্ঘ বিরতিতে নিয়োগকৃত কমিটি অধিকাংশ সময়ে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারের কর্তৃক আয়োজিত স্থানে আলোচনা সভা করে থাকেন। বিভিন্ন পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এই কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত হবার পরেও পার্বত্য চট্টগ্রামের শরণার্থী বিষয়ক সংখ্যাভিত্তিক সঠিকতার ক্ষেত্রে কেন এই বিভ্রান্তি?
এই টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান হিসেবে প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় একজন উপজাতি ব্যক্তি দায়িত্ব পালন করেন। চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার পদাধিকার বলে এই টাস্কফোর্সের সদস্য সচিব হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া অন্যান্য সদস্যবৃন্দ যেমন, আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান অথবা তার প্রতিনিধি, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক, বান্দরবান জেলা প্রশাসক, বান্দরবান জেলা পরিষদের একজন সদস্য, রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক, একজন বাঙ্গালী প্রতিনিধি (বর্তমানে জনাব এসএম শফি), ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ওয়েলফেয়ার কমিটির সচিব (বর্তমানে সন্তোষিত চাকমা বকুল) এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ হতে একজন প্রতিনিধি এই টাস্কফোর্সের নীতি-নির্ধারনী সভায় অংশ গ্রহণ করে থাকেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পরবর্তী সময়ে বিশেষ এই টাস্কফোর্স গঠনের পর দীর্ঘ বিরতিতে নিয়োগকৃত কমিটি অধিকাংশ সময়ে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারের কর্তৃক আয়োজিত স্থানে আলোচনা সভা করে থাকেন। বিভিন্ন পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এই কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত হবার পরেও পার্বত্য চট্টগ্রামের শরণার্থী বিষয়ক সংখ্যাভিত্তিক সঠিকতার ক্ষেত্রে কেন এই বিভ্রান্তি?
এই বিষয়টি সঠিকভাবে বিশ্লেষন করার জন্য শরণার্থীদের শ্রেণীভেদ সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। শান্তিবাহিনীর তৎকালীন নির্মমতা ও নৃশংসতার কারণে সাধারণ উপজাতি ও বাঙ্গালীদের অনেকেই কয়েকভাবে শরণার্থী হয়েছিলেন। এই শ্রেণীভেদকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। (ক) ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী (খ) আভ্যন্তরীন উদ্বাস্তু। ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী তারাই যারা গত শতাব্দির আশির দশকে শান্তিবাহিনীর অত্যাচারে নিজ এলাকায় টিকতে না পেরে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলো। তবে সাধারণ উপজাতিদের এই স্থানান্তর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তৎকালীন শান্তিবাহিনীর নেতারা মনে প্রাণে চাইছিলো। অনেক সাধারণ উপজাতি ব্যক্তিবর্গ ঐ সময় শান্তিবাহিনীর শত অত্যাচারের মাঝেও নিজ ভূমি ত্যাগ করতে চান নি। তাদেরকেও শান্তিবাহিনীর সদস্যরা জোর করে সীমান্ত অতিক্রম করতে বাধ্য করেছিলো। শান্তিবাহিনী সম্ভবত বহিঃবিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য এমনটি করেছিলো। সেসময় খাগড়াছড়ি জেলায় শান্তিবাহিনীর দৌরাত্ন সবচেয়ে বেশী ছিলো। এছাড়া এই জেলার সাথে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের দীর্ঘ সীমান্ত অঞ্চলও শান্তিবাহিনীকে বড় সংখ্যক শরণার্থী সৃষ্টিতে সহযোগীতা করেছিলো। সাধারণত ভূক্তভোগী উপজাতিরা খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার বাবুছড়া-জারুলছড়ি-ধনপতি-নাড়াইছড়ি হয়ে সীমান্ত অতিক্রম করতো। এছাড়া পানছড়ির দুদকছড়া ও তাইন্দং সীমান্ত দিয়েও অনেক ভূক্তভোগী উপজাতি সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিলো। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে এই শরণার্থী ক্যাম্পগুলোর অবস্থান ছিলো; পঞ্চকানন শিবির, তাকুমবাড়ি, কর্ব, সাবরুম, ভগবান টিলা, লেকাছড়া প্রভৃতি স্থানের শিবির গুলো ছিলো অন্যতম। ভারত সরকার এই শরণার্থী পরিবারগুলোর জন্য জনসংখ্যা ভিত্তিক আটা, রেশন, লাকড়ি ও মাসিক এক হাজার টাকা ভাতাও প্রদান করতো বলে জানা যায়।
আভ্যন্তরীন উদ্বাস্তু তারাই যারা শান্তিবাহিনীর অত্যাচারে বাধ্য হয়ে নিজ ভূমি ত্যাগ করে একস্থান থেকে অন্যস্থানে অবস্থান নিয়েছিলো। তাদের মধ্যে বাঙ্গালীদের সংখ্যাই সর্বাধিক। গত শতাব্দির সত্তর ও আশির দশকে তৎকালীন সরকার বাংলাদেশের অন্যান্য স্থান থেকে যে সমস্ত বাঙ্গালীদের পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে এসেছিলো, তাদের প্রত্যেক পরিবারকে কবুলিয়তের মাধ্যমে ৫ একর করে জমি বরাদ্দ দিয়েছিলো। আশির দশকের মাঝামাঝি শান্তিবাহিনীর নির্মমতা ও অত্যাচার যখন অসহনীয় হয়ে উঠেছিলো তখন নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে তৎকালীন সরকার বাঙ্গালীদের জন্য কয়েকটি স্থানে গুচ্ছগ্রাম তৈরী করে সেখানে বসবাস করার সুযোগ সৃষ্টি করেছিলো। এই গুচ্ছগ্রাম গুলো সাধারণত নিরাপত্তাবাহিনীর ক্যাম্প গুলোর কাছাকাছি করা হয়েছিলো। গুচ্ছগ্রামে অবস্থানকালীন সময়ে সরকার এই বিপুল সংখ্যক জনগনের জন্য প্রয়োজনীয় রেশনের ব্যবস্থাও করেছিলো, যা বর্তমানেও অব্যাহত আছে। গুচ্ছগ্রামে চলে আসার পর অনেক বাঙ্গালীই তাদের জন্য সরকারের দেয়া কবুলিয়তের ঐ ৫ একর জমিতে আর ফিরতে পারেনি। তৎকালীন শান্তিবাহিনীর প্ররোচনায় এবং পরবর্তীতে আঞ্চলিক উপজাতি দলগুলোর দৌরাত্বে ঐ জমিগুলোর দখল বাঙ্গালীদের হাতছাড়া হয়ে পড়ে। অনেক বাঙ্গালী তাদের জমিতে যে গাছ-গাছালি সৃজন করেছিলো তা থেকেও তারা কোন সুফল নিতে পারেন নি। অপরদিকে উপজাতিদের মধ্যে স্বল্প সংখ্যার হলেও আভ্যন্তরীন উদ্বাস্তু শরণার্থী ছিলো।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে বাংলাদেশী উপজাতি জনগণের দীর্ঘকালীন অবস্থান উক্ত পরিবার গুলোর জন্য বড় এক ধরণের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছিলো। তাছাড়া ত্রিপুরা রাজ্যের উক্ত শরণার্থী শিবিরগুলোতে সবার জন্যই সমরুপ ব্যবস্থাপনা ছিলো। অর্থাৎ অনেক উপজাতি পরিবার, যারা বাংলাদেশে অবস্থানকালে স্বচ্ছল ছিলেন এবং সুশিক্ষিত হয়ে তাদের সন্তানদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছিলেন, তাদের জন্য ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উক্ত শরণার্থী জীবন কোন ভাবেই গ্রহনযোগ্য ছিলো না। কিন্তু একবার শরণার্থী শিবিরে নাম লেখানোর পর দেশে ফিরে আসাটাও সহজে সম্ভব ছিলো না। এছাড়া সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন স্থানে শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র সদস্যদের বাঁধাতো ছিলই। তারপরেও বাংলাদেশ সরকারের ঐকান্তিক ইচ্ছা আর আহবানে সাড়া নিয়ে বিভিন্ন উদ্ভাবনী উপায়ে এবং ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের শরণার্থী শিবিরগুলোর কর্তাব্যক্তিদের অনুমতি নিয়ে স্বেচ্ছায় অনেক সাধারণ উপজাতি সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন স্থান দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিলো। ঐ সময়ে শরণার্থীদের দেশে ফেরাতে ত্রিপুরা উন্নয়ন জন সিমিতি (টিইউজেস)’র ভূমিকা ছিলো প্রসংশনীয়। সেসময় উল্লেখযোগ্য অন্যান্য নেতৃবৃন্দ যেমন, মঙ্গল কিশোর ত্রিপুরা, শ্যামা চরণ ত্রিপুরা প্রমুখ ব্যক্তিত্বগণ ভারতে অবস্থানরত শরণার্থীদের দেশে ফেরানোর জন্য ব্যাপক কাজ করেছিলেন। এমনকি মঙ্গল কিশোর ত্রিপুরা রইশ্যাবাড়ি ক্যাম্পের নিকটবর্তী সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশী শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে আনতে স্বশরীরে অংশ নিয়েছিলেন। এছাড়া তৎকালীন সময়ে ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য গঠিত কমিটির প্রথম সভাপতি উপেন্দ্র লাল চাকমাও শরণার্থীদের দেশে ফেরাতে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রেখেছিলেন। বাংলাদেশ সরকার ঐ সময় টেলিভিশন, রেডিও ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে প্রচারণার ব্যবস্থা করেছিলো যাতে ভারতে অবস্থানরত উপজাতি শরণার্থীরা স্বেচ্ছায় দেশে ফিরে আসেন। নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে ঐ সময় শরণার্থীরা যখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতো, তাদের প্রথমে নিকটবর্তী কোন নিরাপত্তাবাহিনীর ক্যাম্পে রিপোর্ট করতে হতো। ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ তখন ঐ উপজাতি শরণার্থীদের কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য নিয়ে সংশ্লিষ্ট হেডম্যান-কার্বারী ও মেম্বার-চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে তথ্যের সঠিকতা যাচাই করতো। এরপর উক্ত শরণার্থীদের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে নিয়ে গিয়ে উপজেলা ভিত্তিক প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন অফিসে (পিআইও) প্রয়োজনীয় তথ্য লিপিবদ্ধকরণ শেষে তাদের জন্য সরকার প্রদত্ত নির্ধারিত নিরাপদ স্থানে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হতো। তবে এই সকল শরণার্থী পরিবারের মধ্যে যেসব পরিবার তাদের নিজ ভূমিতে নিজেদের নিরাপদ মনে করতো এবং সংশ্লিষ্ট হেডম্যান-কার্বারী ও মেম্বার-চেয়ারম্যানগণ একমত পোষন করলে তখন তাদের নিজভূমিতে গমনের অনুমতি দেয়া হতো। সরকার স্বেচ্ছায় ফিরে আসা এসব উপজাতি শরণার্থীদের জন্য কয়েকটি স্থানে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে বসবাসের ব্যবস্থা করেছিলো। ত্রিপুরা ও মারমা সম্প্রদায়ের শরণার্থী পরিবারগুলোর জন্য যেসকল বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো সেসকল স্থান সমূহ “বড়গ্রাম” নামে পরিচিত ছিলো। চাকমা সম্প্রদায়ের শরণার্থীদের যেসকল স্থানে বসবাসের ব্যবস্থা করা হতো সেসকল স্থান “শান্তিগ্রাম” নামে পরিচতি ছিলো। এই “বড়গ্রাম” এবং “শান্তিগ্রাম”এ বসবাসরত উপজাতি শরণার্থীদের জন্য সরকার প্রয়োজনীয় রেশন ও পরিবার প্রতি মাসিক ১ হাজার টাকা করে ভাতার ব্যবস্থা করেছিল। তবে অনেকের অভিযোগ রয়েছে প্রথম ছয়মাস রেশন প্রাপ্তির পর একটি বড় সংখ্যক পরিবারের রেশন প্রদান প্রক্রিয়া চলমান থাকেনি তবে এটাও ঠিক, বর্তমানেও উক্ত শ্রেণীভুক্ত পরিবারগুলোর কেউ কেউ রেশন পাচ্ছেন।
শান্তিচুক্তির পূর্বে সরকারের আহবানে সাড়া দিয়ে যে সকল পরিবার স্বেচ্ছায় দেশে ফিরে এসেছিলো তাদের সংখ্যা নিয়ে প্রাথমিকভাবে মত পার্থক্য ছিলো। কারণ অনেক শরণার্থী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর নিরাপত্তাবাহিনী এবং উপজেলা প্রশাসনের কাছে নাম লিখিয়ে কিছুদিন দেশে অবস্থানের করে পরিস্থিতি অনিরাপদ মনে হওয়ায় পুনরায় তারা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের শরণার্থী শিবিরে ফিরে গিয়েছিল। এরপর পরিস্থিতি শান্ত হবার খবর শুনে ফেরত যাওয়া উক্ত পরিবারগুলোর মধ্যে অনেক পরিবার আবার সীমান্তের বিভিন্ন স্থান দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিলো। ফলশ্রুতিতে একই পরিবার সম্পর্কে কয়েকবার তথ্য সন্নিবেশিত হওয়ায় স্বেচ্ছায় ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদের পরিবার ও জনসংখ্যার তারতম্য হয়েছিলো। ২০১৫ সালে “স্বেচ্ছায় ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী কল্যাণ সমিতি”র নেতৃবৃন্দ প্রাথমিক ভাবে যাচাই বাছাইয়ের পর খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় ১৩ হাজার ৪ শত ১৫টি পরিবারের ৫১ হাজার ৯ শত ৩২ জন এবং রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় ১ হাজার ৫২ টি পরিবারের ৪ হাজার ৯ শত ২২ জন, সর্বমোট দুই জেলায় ১৪ হাজার ৪ শত ৬৭ পরিবারের ৫৬ হাজার ৮ শত ৫৪ জন শরণার্থী স্বেচ্ছায় দেশে ফিরেছিলেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা দেন। তবে এই সংগঠনের বর্তমান সভাপতি খগেশ্বর ত্রিপুরার মতে স্বেচ্ছায় ফিরে আসা শরণার্থীদের সংখ্যা আরো অনেক কম হবে। তবে ঐ সময়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের শরণার্থী শিবিরগুলোতে যারা ছিলেন তাদের কয়েকজনের ভাষ্যমতে, তৎকালীন স্বেচ্ছায় ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পরে ফিরে আসা শরণার্থীদের মোট সংখ্যা ৮০-৯০ হাজারের বেশী হবে না। এই সংখ্যা নিয়ে সংশয় থাকার কোন অবকাশ নেই বলে অনুমেয়। কারণ ঐ সময় শরণার্থী শিবিরগুলোতে যে সকল উপজাতি পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল তাদের নাম শিবির পরিচালনাকারী কর্মকর্তাদের কাছে লিপিবদ্ধ করা ছিল। তাদের নিয়মিত যেহেতু রেশন দেয়া হতো , সঠিক শরণার্থী পরিবারের সংখ্যা সম্পর্কে তথ্য উদঘাটন করা কঠিন কিছু নয় বলে অনুমেয়।
পার্বত্য চুক্তির পূর্বে সরকার প্রদত্ত বিশেষ সুবিধাদি কয়েক শ্রেণীর উপজাতি ও বাঙ্গালী জনগন ভোগ করা শুরু করেছিলো, অর্থাৎ বড়গ্রাম, শান্তিগ্রাম সমূহের উপজাতি জনগোষ্ঠী আর গুচ্ছগ্রাম সমূহের অবস্থানরত বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী। শান্তিবাহিনীর আত্নসমর্পনকৃত সদস্যগণ, ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীগণ এবং গুচ্ছগ্রামে অবস্থানরত বাঙ্গালীদের সরকার প্রদত্ত রেশন স্ব স্ব এলাকার প্রজেক্ট চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে বন্টন করা হয়ে থাকে যেখানে ব্যপক দূর্ণীতির অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে আত্নসমর্পনকৃত শান্তিবাহিনী সদস্যদের এবং ভারত প্রত্যাগত উপজাতি শরণার্থীদের রেশন বন্টন প্রক্রিয়ায় আঞ্চলিক উপজাতি দলগুলো অনৈতিক সুযোগ গ্রহণ করে থাকে, এমন অভিযোগও রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অংশ হিসেবে সরকার চুক্তিকালীন সময়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে অবস্থানরত শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে এনে আকর্ষণীয় সুবিধা সম্বলিত ২০ দফা প্রনোদনা প্যাকেজ ঘোষনা করেছিল। এই প্যাকেজের মধ্যে পরিবার প্রতি নগদ অর্থ, বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় রেশন, গৃহ নির্মানের প্রয়োজনীয় সামগ্রী, যাদের চাষাবাদের জমি ছিলো তাদের চাষের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ, কৃষি ঋণ মওকুফ, বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণ অবলোপনের বিষয়ে সহানুভূতির সাথে বিবেচনার আশ্বাস, ৩০ শে জুন ১৯৯৪ পর্যন্ত ইন্সারজেন্সি সংক্রান্ত মামলার ক্ষেত্রে সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা, যারা শরণার্থী হওয়ার পূর্বে চাকরিরত ছিলেন তারা যাতে উক্ত চাকরি ফিরে পেতে পারেন তা সহানুভূতির সাথে বিবেচনার আশ্বাস, শরণার্থীদের সন্তানদের শিক্ষার বিষয়টি চলমান রাখার জন্য ত্রিপুরা রাজ্যে শরণার্থী শিবিরে অবস্থানকালীন সময়ের শিক্ষা সনদপত্র সমূহ আমলে নিয়ে বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমে “বিশেষ পরীক্ষা” গ্রহণের ব্যবস্থাকরণ ইত্যাদি ছাড়াও অন্যান্য বেশ কিছু সুবিধাদি প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহন করার করা হয়েছিলো। ঐ সময়ে সরকার এমনও ঘোষনা দিয়েছিলো যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পরবর্তী সময়ে যে সকল শরণার্থী দেশে ফিরে এসে উপরোল্লেখিত প্রনোদনা প্যাকেজ সুবিধাদি পাবেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্বে স্বেচ্ছায় এবং তৎকালীন সরকারের আহবানে সাড়া দিয়ে যারা দেশে ফিরেছিলেন, উভয় ধরণের শরণার্থীগণই সরকার ঘোষিত সকল সুযোগ সুবিধা পাবেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্বে স্বেচ্ছায় ভারত প্রত্যাগত উপজাতি শরণার্থীদের বিষয়ে পরবর্তীতে আগমনকৃত শরণার্থীদের এক প্রকার অসন্তুষ্টি ছিলো কারণ, তারা মূলত তৎকালীন শান্তিবাহিনীর সদস্যদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। এই দলের নেতৃবৃন্দ নব্বইয়ের দশকের শুরুর বিভিন্ন সময়ে যারা সরকারের আহবানে সাড়া দিয়ে অথবা স্বেচ্ছায় দেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন তাদেরকে তারা পছন্দ করতো না। তৎকালীন শান্তিবাহিনী প্রভাবিত এই নেতৃবৃন্দ মনে করতো, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্বে স্বেচ্ছায় ফিরে আসা এ সকল শরণার্থী সরকার তথা নিরাপত্তাবাহিনীর বিশেষ সমর্থক ছিলো। ফলশ্রুতিতে সরকারের ঘোষনা থাকা সত্ত্বেও স্বেচ্ছায় ফিরে আসা উপজাতি শরণার্থীরা প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল। পরিস্থিতি বিবেচনা করে এই সকল শরণার্থীরা একটি বিশেষ সংগঠন গড়ে তোলেন, যা “স্বেচ্ছায় ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী বঞ্চিত কল্যাণ সমিতি” নামে পরিচিত। এই সংগঠনের সভাপতি হিসেবে বর্তমানে খগেশ্বর ত্রিপুরা ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সুপ্রিয় চাকমা দায়িত্ব পালন করছেন। নিজেদের প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা আদায়ে সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি জেলার কয়েকটি উপজেলাতে বর্তমানে এই সংগঠনের কমিটি রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর সরকার কর্তৃক গঠিত বিশেষ টাস্কফোর্স “পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও পূনর্বাসন এবং আভ্যন্তরীন উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পূনর্বাসন সংক্রান্ত টাস্কফোর্স” গঠিত হবার পর উক্ত টাস্কফোর্সের নীতি নির্ধারনী কমিটি বিভিন্ন সময়ে একাধিক সভা করেও শরণার্থীদের সংখ্যা নিয়ে ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেন নি। এখানে দুটি গুরুত্বপূর্ন বিতর্কিত বিষয় কাজ করছে। প্রথমত, স্বেচ্ছায় প্রত্যাগত শরণার্থীদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রাট এবং দ্বিতীয়ত, আভ্যন্তরীন উদ্বাস্তু হিসেবে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীকে মেনে না নেওয়ার অপচেষ্টা। ২০১৪ সালে এ সংক্রান্ত একটি সভায় সন্তু লারমা আভ্যন্তরীন উদ্বাস্তুদের মধ্যে বাঙ্গালীদের সংযুক্তকরণের বিষয়ে আপত্তি তোলেন। এছাড়া ২০১৭ সালে বর্তমান টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান জনাব কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা হঠাৎ করেই ৮২ হাজার নতুন শরণার্থী পরিবারের তালিকা সংযুক্তকরণ প্রক্রিয়ার একটি ইঙ্গিত দেন। এই উভয় বিষয়েই পার্বত্য চট্টগ্রামের সচেতন মহলের মধ্যে আলোচনা ও সমালোচনার সৃষ্টি করেছে। নতুন ভাবে দাবিকৃত ৮২ হাজার শরণার্থী পরিবারের মধ্যে পরিবার প্রতি ৬ জন হিসাব করলে প্রায় ৫ লক্ষ প্রত্যাগত শরণার্থীর জন্য সরকারকে বিশেষ প্রনোদনা প্যাকেজের সুবিধাদি দিতে হবে। এই বিষয়ে সরকারী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে এর অপব্যবহারেরও যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। অনেক সুযোগ সন্ধানী উপজাতি ব্যক্তিবর্গ আঞ্চলিক দলের নেতাদের সহায়তায় নতুনভাবে শরণার্থীদের তালিকায় নাম লিখিয়ে সরকারের সুযোগ-সুবিধাদি গ্রহণ করে তা বিক্রয় করে দিয়ে এই অর্থ সুযোগ সন্ধানী আঞ্চলিক উপজাতি দলসমূহের প্রয়োজনে অব্যবহার করার যথেষ্ট সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। এই সুযোগ সন্ধানী ব্যক্তিবর্গ ব্যক্তিগত পরিচিতি অথবা আত্নীয়তার সুযোগ নিয়ে হয়তো সরকার ঘোষিত সুবিধাদির সদব্যবহার করে পুনরায় তার নিজ এলাকা ত্রিপুরায় ফিরে যাবে। এই একই ব্যক্তিবর্গ দ্বৈত নাগরিকত্ব লাভের অপচেষ্টাও চালাতে পারবে। সেক্ষেত্রে বিপুল সংখ্যক এই জনগোষ্ঠী আঞ্চলিক উপজাতি সংগঠন সমূহের নেতাদের ভোট ব্যাংক হিসেবে কাজ করতে পারবে। এছাড়া এই নতুন ভাবে সৃষ্টি হওয়া শরণার্থীগণ ভারত-বাংলাদেশের দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ নিয়ে অবাধে দুদেশে যাতায়াত করতে পারবে এবং বিভিন্ন প্রকার সন্ত্রাসী দলকে সহায়তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করার অপচেষ্টা করতে পারবে। অন্যদিকে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীকে আভ্যন্তরীন উদ্বাস্তু তালিকা থেকে বাদ দেওয়া অপচেষ্টা করা হলে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী যৌক্তিক প্রাপ্যতা সত্ত্বেও বঞ্চিত হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ব এবং পরবর্তীকালীন সৃষ্ট অবস্থার পরিস্থিতি বিবেচনায় শরণার্থীদের সংখ্যাভিত্তিক যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, এ বিষয়ে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। অন্যথায় স্বার্থান্বেষী মহল তাদের দলীয় ও ব্যক্তিগত সুবিধাদি চরিতার্থ করার জন্য দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতেও কুন্ঠাবোধ করবে না। বিষয়টি নিশ্চয়ই সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবেন।
লেখক: পারভেজ হায়দার, পার্বত্য গবেষক।
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি
সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা সমূহ:
·
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা
· পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক সেনাহত্যার ইতিহাস
[লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে? তাহলে দয়াকরে গবেষণামূলক ও ইতিহাস
ভিত্তিক এই সাইটটি চালিয়ে যেতে সাহায্য করুন। পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার বঞ্চিত
বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী সাইটটি পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার কতৃক চরমভাবে অবহেলিত ও
সুবিধা বঞ্চিত, পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ঠ এনজিও সমূহের একচোখা নীতি, সন্তু লারমা ও
প্রসীত খীসাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম
জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) 'এর নিপিড়িত, নির্যাতিত ও বর্বরতম সন্ত্রাসের নির্মম ও অসহায়
শিকার - পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠির সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে
ক্ষুদ্রতম এক প্রয়াস]