মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৯

শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন বিতর্কের শেষ নেই, ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষ বেড়েই চলেছে

২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২২তম বর্ষপূর্তি ছিল। প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময়ের সংঘাত তথা রক্তের হোলিখেলা বন্ধে ১৯৯৭ সালের এই দিনে সরকারের সঙ্গে জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি নামে অভিহিত। চুক্তির পর ইনসার্জেন্সি বন্ধ হয়েছে। এরপর কেটে গেছে একুশটি বছর। কিন্তু এ চুক্তি ও এর বাস্তবায়ন নিয়ে বিতর্কের যেমন শেষ হয়নি, তেমনি পাহাড়ী স্থানীয় রাজনৈতিক দলের ব্যানারে ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষ দিনের পর দিন যেন বেড়েই চলেছে। জেএসএস এবং এর বিরোধী ইউপিডিএফ (ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট) এর মধ্যে দু’গ্রুপ করে এখন চার গ্রুপ হয়ে যে সংঘাত বিশেষ করে চাঁদাবাজির ভাগবাটোয়ারা ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে জটিল যে রূপ বর্তমানে দৃশ্যমান তা শান্তিচুক্তির মূল লক্ষ্যকে ভুলুণ্ঠিত করছে। সবুজের পাহাড় প্রায়শ রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে। ঝরে পড়ছে তরতাজা প্রাণ। ঝরে যাওয়া তালিকায় প্রতিনিয়ত স্থান করে নিচ্ছে পাহাড়ী-বাঙালী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সদস্যরা। সর্বশেষ রবিবার রাঙ্গামাটিতে জেএসএসের চাঁদাবাজির চীফ কালেক্টরখ্যাত বিক্রম চাকমা প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীদের গুলিতে নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছে।

শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার পক্ষের বক্তব্য হচ্ছে, চুক্তির অধিকাংশ ধারাই বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকি ধারাগুলোও বাস্তবায়িত হবে। অপরদিকে, জেএসএস’র অভিযোগ, সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের পরিবর্তে তা লংঘন করছে। অপরদিকে, এলাকায় চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে পাহাড়ীদের সশস্ত্র সংগঠনগুলোর লড়াই সংঘাতে প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত হচ্ছে পাহাড় । চুক্তির পর গত ২১ বছরে ৪ পাহাড়ী সশস্ত্র গ্রুপের ভ্রাতৃঘাতী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সংঘাতে বিভিন্ন সময়ে অন্তত সাড়ে ৭ শতাধিক নেতাকর্মী ও সমর্থক প্রাণ হারিয়েছে। এছাড়াও এদের বিরুদ্ধে উন্নয়ন প্রকল্পে চাঁদাবাজিসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অভিযোগ রয়েছে। ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে অসংখ্য মানুষের হতাহতের ঘটনা পাহাড়ে বাড়িয়ে রেখেছে অজানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। সংঘাত সহিংসতা মাঝে-মধ্যে পাহাড়ের সম্প্রীতির ওপরও আঘাত হানছে। ফলে দীর্ঘ ২১ বছর আগে বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হলেও এখনও স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নে দুলছে গোটা পাহাড়। তবে শান্তিচুক্তির ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময়ে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, দাঙ্গা-হাঙ্গামার অবসান ঘটিয়ে শান্তি, উন্নয়ন ও সম্প্রীতির পার্বত্য চট্টগ্রাম গড়ে তুলতে সরকার আপ্রাণ চেষ্টা চালিযে যাচ্ছে। অপরদিকে চুক্তি স্বাক্ষরের অপর পক্ষ জেএসএসের পক্ষে বলা হচ্ছে, চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের ‘ধীরে চলা নীতি’র জন্যই পাহাড়ে এখনও স্থায়ী শান্তি ফিরে আসেনি । ফলে পাহাড়ে আত্মপ্রকাশ ঘটছে নতুন নতুন সশস্ত্র গ্রুপের।

চুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় নানান ঘাত-প্রতিঘাত, চুক্তি নিয়ে বাদ-প্রতিবাদ, চুক্তির পক্ষ-বিপক্ষের সশস্ত্র তৎপরতা, খুন, গুম, অপহরণ, চাঁদাবাজি ইত্যাদি ঘটনায় এখনও মাঝে মাঝে অশান্ত হয়ে ওঠে পার্বত্য চট্টগ্রাম। চুক্তির পক্ষ-বিপক্ষের গ্রুপের মধ্যে সশস্ত্র তৎপরতা, নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গে সন্ত্রাসীদের গুলি বিনিময়, পাহাড়ের প্রত্যন্ত এলাকায় পক্ষ-বিপক্ষের নেতাকর্মীর ওপর হামলা, পাল্টাপাল্টি খুনের ঘটনা ও অপহরণ নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ এখনও দিন কাটাচ্ছে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায়। ফলে পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েই চলেছে।

সমঅধিকার আন্দোলনের বক্তব্য
সমঅধিকার আন্দোলনের সাবেক নেতা মোঃ শাহাজ উদ্দিন বলেন, সংবিধান অনুযায়ী দেশের সকল স্থানের ভূমিতে জনগণের সমান অধিকার রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বংলাদেশের কোন অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়। এখানে স্বায়ত্তশাসনের নামে একদিকে চলছে হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম। অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করছে আরেকটি অংশ। আঞ্চলিক দলগুলোর অত্যাচার নিপীড়নে পার্বত্য এলাকা থেকে দিন দিন বসত ভিটা থেকে উচ্ছেদ হয়ে বাঙালীরা সমতলে গিয়ে মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে। ভূমি সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি বলেন, ইউপিডিএফ ও জেএসএস সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে বাঙালীদের রেকর্ডীয় বসত ভিটা থেকে বিতরিত করছে। সেখানে তারা রাতারাতি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি করে পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (সন্তু লারমা গ্রুপ) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ এবং সঠিক উন্নয়ন অর্জনের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করা হলেও এক্ষেত্রে মৌলিক কোন পরিবর্তন সাধিত হয়নি। বরং পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজনৈতিক উদ্দেশে বসতি স্থাপন, গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণ, বসতি স্থাপনকারীদের পার্বত্য চট্টগ্রামের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তকরণ, জেলা প্রশাসক কর্তৃক স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র প্রদান, চাকরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দান, ভূমি দখল, বন্দোবস্ত-ইজারা প্রদান ইত্যাদি কার্যক্রম জোরদার হয়েছে। ফলে জুম জনগণের জাতীয় ও আবাসভূমির অস্তিত্ব চরম হুমকির মুখোমুখি। এছাড়া সরকার পক্ষের সদিচ্ছার অভাবে পরিষদের সংশ্লিষ্ট বিধি ও প্রবিধান প্রণীত না হওয়ায় আঞ্চলিক পরিষদ সংশ্লিষ্ট কার্যাদি সম্পাদনে নানান প্রতিকূলতার নিত্য মুখোমুখি হচ্ছে।

জেএসএস নেতৃবৃন্দের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ সংশোধন, ভোটার তালিকা অধ্যাদেশ ও ভোটার তালিকা বিধিমালা ১৯৮২, সামাজিক বনায়ন বিধিমালা ২০০১ পার্বত্য চট্টগ্রামের এনজিও নীতিমালা সংশোধনের জন্য সরকারের নিকট প্রস্তাব পেশ করা হলেও পালনীয় দায়িত্ব অনুযায়ী আইন বিধানকারী রীতিসমূহ প্রণয়ন, পরিবর্তন, সংশোধন ও সংযোজনের ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধিত হয়নি। অ-উপজাতীয় স্থায়ী বাসিন্দা নির্ধারণ প্রশ্নে চুক্তির শর্ত উপেক্ষা করে বৈধ জায়গা জমি না থাকা সত্ত্বেও পার্বত্য জেলার জেলা প্রশাসকগণ অ-উপজাতীয়দের স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র প্রদান করে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সার্কেল চীফগণের এখতিয়ারকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ভোটার তালিকা বিধিমালা প্রণয়নপূর্বক স্থায়ী অধিবাসীদের নিয়ে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় বিরাজ করছে অচলাবস্থা। পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহে কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োগ, উন্নয়ন প্রকল্প এবং উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ তদারকি ও স্থানীয় আইন শৃঙ্খলার উন্নয়নকল্পে পার্বত্য জেলা পুলিশ বাহিনী গঠনের ক্ষেত্রে তেমন কোন কার্যকর পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতাদের অভিযোগ, চুক্তি মোতাবেক ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনার বিষয়টি পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তরের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। পার্বত্য জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণাধীন ও আওতাধীন কোন প্রকারের জমি, পাহাড় ও বনাঞ্চল পরিষদের সঙ্গে আলোচনা ও সম্মতি ব্যতিরেকে সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণ ও হস্তান্তর করার ক্ষেত্রে কঠোর বিধান থাকলেও এ আইন অনুসরণ করা হচ্ছে না।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার ও জেএসএসের মধ্যে চলছে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য। সরকার বলছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। পনেরোটির আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে। সরকারী উদ্যোগগুলোর মধ্যে পৃথক মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন কমিটি, কমিশন ও টাস্কফোর্স গঠন, আইন প্রণয়ন, কিছুসংখ্যক সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার, ভারত প্রত্যাগত পরিবার এবং শান্তিবাহিনীর সদস্যদের পুনর্বাসন এবং চলমান আলোচনা উল্লেখযোগ্য। কিন্তু জেএসএস বলছে, ৭২ ধারার মধ্যে মাত্র ২৫ ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। এ দেশের সিভিল ব্যুরোক্রেসি পার্বত্য শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন চায় না। ফলে নীতি নির্ধারকরা পদক্ষেপ নিতে পারে না। দীর্ঘ সময় গতিহীন থাকায় সরকারী উদ্যোগগুলোর ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে পাহাড়ীরা। বর্তমান সরকারের আমলে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোন মৌলিক অগ্রগতি হয়নি। চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়টি বর্তমান সরকারের আমলে একের পর এক কেবল প্রতিশ্রুতি প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নে আর কালক্ষেপণ মেনে নেয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছে জেএসএস।

এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২ দশক ২২তম বর্ষপূর্তি উদযাপন হচ্ছে আজ সোমবার। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে দৃঢ় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে সরকার। সরকার পক্ষ দাবি করে যাচ্ছে, শান্তিচুক্তির অধিকাংশ ধারাই ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। চুক্তির বাকি ধারা বাস্তবায়ন করতে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন গঠন করা হয়েছে। পার্বত্যাঞ্চলের লোক সরকারী চাকরি পেতে পারেÑ এ ক্ষেত্রে তাদের জন্য বিভিন্ন নীতি ও আইন শিথিল করা হয়েছে। ইউএনডিপি, ইউনিসেফ, এডিবি, ড্যানিডা, ইইউ, সিডা ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীর সহায়তায় পার্বত্য অঞ্চলের জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং পরিবেশ সংরক্ষণ, জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় ইতোমধ্যে বিভিন্ন মেয়াদী উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের সময় পার্বত্য অঞ্চলে সড়ক, সেতু ও কালভার্ট নির্মাণের মধ্য দিয়ে ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। শান্তি ও উন্নয়নের পথ কখনই মসৃণ নয়। সব প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।

সরকার পক্ষে বার বার বলা হচ্ছে, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ছিলেন বলেই পার্বত্য শান্তি চুক্তি হয়েছে। এটা যেন কেউ ভুলে না যান। আওয়ামী লীগ সরকারই শান্তিচুক্তি করেছে। বিএনপি বা অন্য কোন কেউ করেনি। সুতরাং চুক্তি যারা করেছে, বাস্তবায়নও করবে তারাই। অনেকে তো আছে, ‘মায়ের চেয়ে মাসির’ দরদ বেশি দেখায়। কিন্তু বাস্তবে তারা কিছুই করে না। পাহাড়ে শান্তিচুক্তির শান্তির পায়রা উড়িয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তার আগের সরকারগুলো পাহাড়ে শান্তির নামে বারবার ধোঁকা দিয়ে প্রতারণা করেছিল। যা করেছে সব লোক দেখানো। তাদের আন্তরিকতা থাকলে অনেক আগে এখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা হতো। শেখ হাসিনার আন্তরিকতা, সদিচ্ছা ছিল বলেই এই পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়েছে।

বুঝতে হবে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে দেশী-বিদেশী অনেক চক্রান্ত আছে। এটাকে অশান্ত করে একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে চায় বিশেষ কুচক্রী গোষ্ঠী। তারা বরাবরই পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল রাখতে নানা উস্কানি দিয়ে চলেছে। এসব উস্কানিকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। প্রশ্রয় দিলে অশান্তি থাকবে। জনগণ কষ্ট পাবে। পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর গত ২১ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে কি হয়েছে এবং তার আগে কি ছিল তা মিলিয়ে দেখলেই বুঝা যাবে শান্তি চুক্তির সুফল। পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেটি সকলকে উপলব্ধি করতে হবে। চুক্তির বাস্তবায়ন সংখ্যা দিয়ে মাপা ঠিক নয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ নেতাদের অভিযোগ
উপজাতীয় আইন ও সামাজিক বিচার আঞ্চলিক পরিষদের আওতাভুক্ত থাকার কথা থাকলেও তা এখনও কার্যকর হয়নি। তারা আরও অভিযোগ করেন- পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভারি শিল্পের লাইসেন্স প্রদানের এখতিয়ার আঞ্চলিক পরিষদের নিকট ন্যস্ত করা হলেও সরকারীভাবে তা অনুসরণ করা হচ্ছে না। অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন ও ভূমিহীনদের ভূমি বন্দোবস্ত প্রদানের এখনও কোন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়নি। চাকরি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোটা ব্যবস্থা বহাল রাখা ও উপজাতীয় ছাত্র ছাত্রীদের অধিকসংখ্যক বৃত্তি প্রদান করার কথা থাকলেও তা কার্যকর হচ্ছে না।

জেএসএস সংস্কারপন্থী নেতাদের বক্তব্য
জেএসএস সংস্কারপন্থী নেতা সুধাকর ত্রিপুরার মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানে একমাত্র পথ হচ্ছে ভূমি সমস্যার সমাধান করা। কিন্তু শান্তিচুক্তির প্রায় ২ দশক অতিক্রান্ত হলেও সরকারের আন্তরিকতার অভাবে তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। ফলে পার্বত্য জনগণ হতাশায় ভুগছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনও অঘোষিত অভিবাসন কার্যক্রম চলছে। ভূমির জটিলতা আগের তুলনায় বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তা রোধ করা না হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভবিষ্যত অন্ধকার।

ইউপিডিএফ কেন্দ্রীয় নেতার বক্তব্য
ইউপিডিএফ’র কেন্দ্রীয় নেতা উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমার মতে, দীর্ঘ ২১ বছরেও সরকার পক্ষ চুক্তি বাস্তবায়ন না করায় এ ব্যাপারে তাদের যে কোন সদিচ্ছা নেই। সেটা আজ প্রমাণিত সত্য। চুক্তি সম্পর্কে কিছু মানুষের মনে প্রথম দিকে আশার সঞ্চার হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটা প্রায় হতাশায় রূপ নিয়েছে। উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমা আরও জানান, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সন্তু লারমা ও তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি যদি এতদাঞ্চলে শান্তি স্থাপনের উদ্দেশে হয়ে থাকে, তাহলে এ সরকারের আমলে এখনও কেন প্রতিনিয়ত পাহাড়ীদের ভূমি বেদখল করা হচ্ছে, জনগণের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, লোকজনকে বিনা কারণে গুলি করে মেরে ফেলা হচ্ছে, গণতান্ত্রিক কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে, কেন ‘অপারেশন উত্তরণ’ জারি রয়েছে অর্থাৎ এক কথায় পাহাড়ীদের ওপর সকল ধরনের নির্যাতন জারি রাখা হয়েছে, সে সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেন। ইউপিডিএফ নেতা উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমা আরও জানান, পার্বত্য অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করা ও পাহাড়ীদের প্রথাগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান, অপারেশন উত্তরণ বন্ধসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার ও সেটলারদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনক পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। তিনি দাবি করেন, পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ। ভূমি সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি বলেন, দিন যতই যাচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির উপর পাহাড়ীদের অধিকার খর্ব হচ্ছে। উন্নয়নের নামে পাহাড়ীদের ভূমি বেদখল করা হচ্ছে। অবৈধ অভিভাসন প্রক্রিয়া বন্ধ করা না হলে এ সমস্য দিনদিন আরও প্রকট আকার ধারণ করবে।

সাধারণ জনগণের বক্তব্য
খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার কমলছড়ি গ্রামের নিরঞ্জন চাকমা বলেন, আমরা হানাহানি চাইনা। আমাদের জবর দখলকৃত ভূমি আমরা ফেরত চাই। সকলে মিলেমিশে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করতে চাই। পাহাড়ীদের নিয়ে অনেকে রাজনীতি করে। কেউ আমাদের মূল সমস্যা নিয়ে কথা না বলে নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।

খাগড়াছড়ি পৌর শহরের স্কুল শিক্ষিকা চম্পা চাকমা জানান, পাহাড়ে শান্তির নামে এ পর্যন্ত বিভিন্ন সরকার বড়বড় কথা বললেও মূলত তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যই কাজ করে। প্রকৃত শান্তির জন্য কেউ কাজ করছেন না। সাধারণ পাহাড়ীদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। পাহাড়ীরা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। মাস্টারপাড়া এলাকার ব্যবসায়ী মোঃ আকবর হোসেন জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধান করে প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারগুলোকে আরও আন্তরিক হতে হবে। বিগত দিনে যা করা হয়েছে তাতে বাঙালী-পাহাড়ী কারই স্বার্থের সঠিক প্রতিফল ঘটেনি। বরং হানাহানি, সাম্প্রদায়িকতা, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে এক গ্রুপকে চাঁদা দিতে হলেও এখন দিতে হয় ৪ গ্রুপকে।

স্থানীয় সংসদ সদস্যের বক্তব্য
প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদাপ্রাপ্ত উপজাতীয় শরণার্থী বিষয় টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান কুজেন্দ্র্র লাল ত্রিপুরা এমপি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃত সমস্যা সমাধান করতে পারে এক মাত্র আওয়ামী লীগ সরকার। এ সরকারই পার্বত্য শান্তি চুক্তি করে পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে এনেছে। এখন পার্বত্য এলাকায় শান্তির সুবাতাস বইছে। পাহাড়ী-বাঙালী সকল সম্প্রদায়ের লোকজন সাম্প্রদায়িকতা ভুলে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বসবাস করছে। পার্বত্য চুক্তির বেশিরভাগ শর্তই বাস্তবায়ন হয়েছে। বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলেই বাকিগুলো বাস্তুবায়ন করা হবে। ইতোমধ্যে ভূমি কমিশন কমিশনের মাধ্যমে পার্বত্য এলাকার ভূমি সমস্যা সমাধানের কাজ চলছে। শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্সের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুসহ শরণার্থীদের পুনর্বাসনের কার্যক্রম সহসাই শুরু হচ্ছে। তিনি পার্বত্য জনগণকে হতাশাগ্রস্ত না হয়ে ধৈর্য্য ধারণ করতে আহ্বান জানান এবং আশান্বিত করেন জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রামকে দেশের একটি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসাবে গড়ে তুলবে।

এদিকে শান্তিচুক্তির ২২ বছর পূর্তি উপলক্ষে সরকারী এবং জেএসএসের উদ্যোগে বিভিন্ন স্থানে পৃথক পৃথক কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। রবিবার থেকে খাগড়াছড়িতে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। রাঙ্গামাটিতে পৃথক কর্মসূচী পালিত হবে।

লেখক : মোয়াজ্জেমুল হক, জীতেন বড়ুয়া

পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা সমূহ:

·      পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা

·     পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক সেনাহত্যার ইতিহাস


[লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে? তাহলে দয়াকরে গবেষণামূলক ও ইতিহাস ভিত্তিক এই সাইটটি চালিয়ে যেতে সাহায্য করুন। পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার বঞ্চিত বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী সাইটটি পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার কতৃক চরমভাবে অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত, পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ঠ এনজিও সমূহের একচোখা নীতি, সন্তু লারমা ও প্রসীত খীসাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) 'এর নিপিড়িত, নির্যাতিত ও বর্বরতম সন্ত্রাসের নির্মম ও অসহায় শিকার - পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠির সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ক্ষুদ্রতম এক প্রয়াস]