সোমবার, ৬ জানুয়ারী, ২০২০

পাহাড়ে গাঁজা চাষ, নেপথ্যে আঞ্চলিক সশস্ত্র দলগুলোর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা!

২২ ডিসেম্বর আগুন লাগিয়ে অবৈধ গাঁজা ক্ষেত ধ্বংসের দৃশ্য

সম্প্রতি দুই দফায় খাগড়াছড়ির মহালছড়ি ও মাটিরাঙ্গা উপজেলার দুটি দুর্গম স্থানে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমান অবৈধ ও নিষিদ্ধ গাঁজার ক্ষেত ধ্বংস করেছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। দুটি অভিযানই পরিচালনা করেছে খাগড়াছড়ি রিজিয়ন অধিনস্ত মহালছড়ি জোন। গত ২২ ডিসেম্বর রবিবার মহালছড়ি উপজেলার প্রত্যন্ত কলাবুনিয়া এলাকায় সেনাবাহিনীর মহালছড়ি জোনের অভিযানে ৭ বিঘা জমির গাঁজার ক্ষেত ধ্বংস করা হয়েছে, যার বাজার মুল্য আনুমানিক প্রায় ৪ কোটি টাকা। এ ঘটনায় গাঁজা চাষের সাথে জড়িত দুই সহোদর, অমর বিকাশ চাকমা (৩৫) ও টুলু চাকমাকে আলামতসহ সেসময় পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে। একইদিন মহালছড়ির বিজিতলা সাবজোন কমান্ডার মেজর আসিফ ইকবাল জানান, প্রত্যন্ত ঐ এলাকায় আঞ্চলিক সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অবস্থানের খবর পেয়ে তল্লাসীকালে বিশাল এ গাঁজার ক্ষেতটির সন্ধান পায় সেনাবাহিনী। তিনি আরো জানান, পাহাড়ের আঞ্চলিক একটি সশস্ত্র দল তাদের সংগঠনের অর্থের যোগান দিতে দুই পাহাড়ের মাঝে উর্বর জমিতে ঘেরাও দিয়ে সুকৌশলে এবং বিশেষ নিরাপত্তায় এ গাঁজার চাষ করেছে। পরে পুলিশ ও গণমাধ্যম কর্মীদের উপস্থিতিতে গাঁজার গাছগুলো উপড়িয়ে স্তুপ করে আগুন জ্বালিয়ে ধ্বংস করা হয়।

গাঁজা চাষ করার অপরাধে আটক দুই সহোদর
এদিকে এ ঘটনার মাত্র কয়েক দিনের মাথায় আবার মাটিরাঙ্গা উপজেলায় দুর্গম একটি এলাকা থেকে ফের ২০০ বিঘা জমিতে চাষ করা গাঁজা ক্ষেত ধ্বংস করেছে মহালছড়ি জোনের সেনা সদস্যরা। গত ২রা জানুয়ারি (বৃহস্পতিবার) দুপুর দেড়টার দিকে সনাক্তকৃত গাঁজা ক্ষেত ধ্বংস করা হয়। খাগড়াছড়ি সেনা রিজিয়নের আওতাধীন মহালছড়ি জোনের বিজিতলা সাবজোন কমান্ডার মেজর আসিফ ইকবালের নেতৃত্বে ধল্যাছড়া পাড়ায় অভিযান চালায় সেনাবাহিনী। এসময় টহল দলটি ৩৫-৪০টি গাজা ক্ষেত সনাক্ত করে, যার প্রতিটিতে ৩-৪ বিঘা জমিতে গাঁজা চাষ করা ছিল।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিরাপত্তাবাহিনী এসব মাদক ব্যবসায়ী ও দৃষ্কৃতিকারীদের আটক করার জন্য অভিযান অব্যাহত রেখেছে। গহীন অরণ্য ও দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় যেখানে জনবসতি তুলনামূলক কম, এমন স্থানকে সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের নিরাপদ এলাকা হিসেবে বেছে নেয়। আর এই ধরনের মাদক ব্যবসা থেকে আয় করা অর্থ ব্যয় হয় আঞ্চলিক দলগুলোর সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা, অস্ত্র ক্রয় ও তাদের বেতন ভাতাসহ অন্যান্য প্রশাসনিক কাজে। এছাড়া সাধারণ মানুষ এবং বিশিষ্ট নাগরিক সমাজের ধারণা, বিতর্কিত ভূমি কমিশন আইনের ফলে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো পাহাড়ে ভূমির অবাধ ব্যবহার করে মাদকের স্বর্গরাজ্য তৈরীর সুযোগ পাচ্ছে। স্থানীয়রা জানান, নিরাপত্তাবাহিনী কর্তৃক এই ধরনের অভিযান অব্যাহত রাখায় জনমনে স্বস্তি ফিরে এসেছে।

সূত্রে আরো জানা যায়, এসব গাঁজা ক্ষেতের প্রত্যেক্ষ ও পরোক্ষ চাষ এবং মদতদাতা পাহাড়ের আঞ্চলিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো। সম্প্রতি নিরাপত্তাবাহিনীর বিভিন্ন সফল অপারেশনের ফলে অনেকটা কোনঠাসা এসব সংগঠন এবার নিজেদের শেষ অস্তিত্ব টিকেয়ে রাখতে পাহাড়ে ভিন্ন এক অপরাজনীতিতে লিপ্ত হয়েছে। নিরাপত্তাবাহিনীর অভিযানের ফলে সচরাচর স্থানে চাঁদাবাজিতে ভাটা ও স্থানীয়দের সচেতনতায় বর্তমানে চাঁদাবাজি কমে যাওয়ায় নিজেদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে বাঁধাগ্রস্ত হওয়া এসব আঞ্চলিক সন্ত্রাসীরা নিজেদের প্রশাসনিক কাজে স্থিতিশীলতা আনয়ন, সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা, অস্ত্র ক্রয় ও কর্মীদের বেতন-ভাতা জোগাড় করার লক্ষ্যেই পাহাড়ের দুর্গম ও সরকারী খাস জায়গাগুলো দখল করে এসব অবৈধ ও নিষিদ্ধ গাঁজা চাষ করছে। অভিযোগ রয়েছে, সাধারণ পাহাড়ীদের অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে সন্ত্রাসীরা এসব গাঁজা চাষে বাধ্য করছে। যার ফলে নিজেদের লাঙ্গল-জোয়াল ফেলে সাধারণ চাষীরাও সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের কাছে জিম্মি হয়ে গাঁজা চাষের দিকে ঝুঁকছে।

২রা জানুয়ারি গাঁজা গাছ আগুনে পোড়ানোর দৃশ্য
 সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জনমানব শূন্য, নির্জন ও দুর্গম এলাকাগুলোকে চিহ্নিত করেই পাহাড়ের চিহ্নিত আঞ্চলিক সশস্ত্র দলগুলো মাদকের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছিল, যা সেনাবাহিনীর দক্ষ ভূমিকায় ভেস্তে গেছে। তাদের মতে, পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী পাহাড়ের ভূমি সমস্যার সমাধান করতে সরকারের প্রয়াসে গঠন করা পার্বত্য ভূমি কমিশনের সুবিধা লুটে এসব সন্ত্রাসীরা পাহাড়ের আনাছে-কানাছে থাকা সরকারী খাস ভূমি, বিভিন্ন সময়ে পরিত্যক্ত সেনাবাহিনীর ক্যাম্পের ভূমি সমূহ ও বাঙ্গালীদের বেদখল হওয়া ভূমি ব্যবহার করেই তারা নতুন করে তাদের মাদকের সাম্রাজ্য গড়ে তুলে নিজেদের অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী করার চেষ্টা ও অস্ত্র ক্রয় করে তা সরকারের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করার চক্রান্ত করছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পাশ্ববর্তী মিয়ানমারের বিভিন্ন সরকার বিরোধী/বিদ্রোহী গোষ্ঠী যেমন তাদের অর্থের যোগান দিতে বিভিন্ন মাদক চাষ করে তা অন্য দেশের কাছে বিক্রি করছে, ঠিক তেমনি পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনগুলোও নিজেদের আর্থিক যোগান মেটাতেই মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী গুলোকে অনুসরণ করছে। যার ফলে, নিজেরা সাবলম্বী, স্থানীয় ও পাহাড়ে আগত হাজার-হাজার ভ্রমনপিপাসু পর্যটকের মাধ্যমে তা সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়ে দেশের যুব সমাজকে মাদকের ছোবলে গ্রাস করার পাঁয়তারা করছে সংগঠনগুলো। এ বিষয়ে সরকারের কঠোর নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন বলেও মনে করছেন তারা। পার্ব্ত্য চট্টগ্রামে মাদকের বিরুদ্ধে অবস্থান করা বেশ কয়েকটি মাদকবিরোধী সংগঠনের নেতারা বলেছেন, শুধুমাত্র নিজেদের আর্থিকভাবে লাভের আশায় এসব সন্ত্রাসীরা পাহাড়ে মাদকের সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে চাইছে, সেনাবাহিনীর এমন উদ্যেগকে তারা সাধুবাদ জানিয়েছেন।

পরিচয় গোপন রেখে একটি সূত্র জানিয়েছে, শুধুমাত্র মহালছড়ি কিংবা মাটিরাঙ্গাতেই নয়, পাহাড়ের আরো বেশ কিছু দুর্গম স্থানে সরকারী খাস ভূমি দখল করে প্রশাসনের চোখের আড়ালে নিজেদের অস্ত্রের জোরে সাধারণ পাহাড়ীদের দিয়ে এসব গাঁজার চাষ করাচ্ছে সন্ত্রাসীরা। সাম্প্রতিক সময়ে আঞ্চলিক রাজনীতিতে অনেকটা কোনঠাসা সংগঠনগুলো বর্তমানে নিজেদের অনেকটা আড়ালে রেখেই সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এসব সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে লিপ্ত হচ্ছে। এসব মাদকের আখড়া থেকে তারা লক্ষ-লক্ষ টাকা আয় করছে যা, তাদের কর্মীদের বেতন-ভাতা, অস্ত্র ক্রয়, প্রশাসনিক কাজে ব্যয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লবিং ও তাদের পক্ষের দেশীয় রাজনৈতিক এজেন্টদের পেছনে ব্যয় করছে। এছাড়া সম্প্রতি তাদের যেসব নেতা-কর্মী অস্ত্র, হত্যা, অপহরণসহ নানা মামলায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়ে বর্তমানে জেল হাজতে আছেন, তাদের জামিনে বের করতেও এসব অর্থ ব্যয় করছে সংগঠনগুলো।

সর্বোপরি অনেকেই বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ের বহুল বিতর্কিত পার্বত্য ভূমি কমিশন নিয়ে সরকারের পদক্ষেপগুলো স্থানীয় বাঙ্গালীদের ক্ষতি ও সংবিধান বিরোধী হলেও মূলত লাভের সিংহ ভাগই ঘরে তুলবে পাহাড়ের আঞ্চলিক এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো। ধারা অনুযায়ী ভূমি কমিশনের সংবিধান বিরোধী ধারাগুলো বাস্তবায়ন হলে এসব রায়ের বিরুদ্ধে কেউ আপিলও করতে পারবে না। এই সুযোগে নিজেদের সৃষ্ট স্বাক্ষীর মাধ্যমে দুর্গম এলাকার ভূমিগুলো সরকারের গঠন করা কমিশনের রায়ে নিজেদের কব্জায় নিয়ে সেসব জমিতে এরকম হাজারো মাদকের বিচরণ ভূমি বা প্রজননে ক্ষেত্র তৈরী করবে পাহাড়ে অস্থিরতা সৃষ্টিকারী এসব সশস্ত্র সংগঠনগুলো। আর তা হবে সরকারের সুবিধা লুটে সরকারেরই আলোচিত ঘোষনা “ চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে” স্লোগানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সরকারের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষনার শামিল।

২৪ জানুয়ারি বান্দরবানে শনাক্তকৃত পপি ক্ষেত
প্রসঙ্গত, গতবছরের ২৪ জানুয়ারি মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন বান্দরবানের থানছি ও রুমা এলাকায় নিষিদ্ধ পপি বাগানের সন্ধান পেয়েছিলো সেনাবাহিনী। থানছি উপজেলার তিন্দু ইউনিয়নের মুরুক্ষ্যং ঝিরি এলাকায় সেসময় প্রায় ৫’শ বর্গফুটের নিষিদ্ধ পপি ক্ষেতটি ধ্বংসও করা হয়েছিল। বিভিন্ন গনমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গিয়েছিলো, বান্দরবানের মিয়ানমার সীমান্তবর্তী রিজার্ভ ফরেষ্টের অত্যন্ত দূর্গম ও জনমানবহীন নিরবিচ্ছিন্ন পাহাড়ী এলাকায় পাহাড়ীরা প্রতিবছর থানছির দূর্গম এলাকাগুলোতে নিষিদ্ধ পপি চাষ করে আসছিলো। প্রতিবছরই বিজিবি সদস্যরা উক্ত দুর্গম পাহাড়ী এলাকাগুলোতে অভিযান পরিচালনা করে নিষিদ্ধ পপি বাগান ধ্বংস করে আসলেও দুর্গম ও পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় প্রতিবারই অভিযানের সময় পালিয়ে যেতো চাষিরা, যার ফলে সেখানে পপি চাষ বন্ধ করা যায়নি। এছাড়া সেবছরই থানছির বড় মদক এলাকার উপরে সীমান্তবর্তী দুর্গম এলাকাগুলোতে বেশ কয়েকটি নিষিদ্ধ পপি বাগান ধ্বংস করেছিল নিরাপত্তাবাহিনী।

জানা যায়, বান্দরবানের এসব দুর্গম এলাকায় উৎপাদিত পপির সবচেয়ে বড় ক্রেতা মিয়ানমার। মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী বান্দরবানের সাঙ্গু রিজার্ভ ফরেস্টের দুর্গম ও জনমানবহীন পাহাড়ি এলাকায় আঞ্চলিক সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা প্রতিবছর লাভজনক নিষিদ্ধ পপি চাষ করতো।

লেখক : মোঃ সাইফুল ইসলাম

পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা সমূহ:

·      পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা

·     পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক সেনাহত্যার ইতিহাস


[লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে? তাহলে দয়াকরে গবেষণামূলক ও ইতিহাস ভিত্তিক এই সাইটটি চালিয়ে যেতে সাহায্য করুন। পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার বঞ্চিত বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী সাইটটি পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার কতৃক চরমভাবে অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত, পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ঠ এনজিও সমূহের একচোখা নীতি, সন্তু লারমা ও প্রসীত খীসাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) 'এর নিপিড়িত, নির্যাতিত ও বর্বরতম সন্ত্রাসের নির্মম ও অসহায় শিকার - পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠির সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ক্ষুদ্রতম এক প্রয়াস]