পার্বত্য এলাকাকে বিচ্ছিন্ন করতে শান্তিবাহিনীকে ভারতের সামরিক সহায়তা ছিল ওপেনসিক্রেট বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকাকে বিচ্ছিন্ন করে পৃথক ভূখন্ডের রূপ দিতে শান্তিবাহিনীকে প্রায় প্রকাশ্যে সমর্থন জুগিয়েছে ভারত। শান্তিবাহিনীর সামরিক তথা যুদ্ধ তৎপরতায় ভারতের ইন্ধন শুধু নয়, অস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং অন্যান্য রসদ সরবরাহের বিষয়টি ছিল ওপেনসিক্রেট। এ বিষয়ে অনেক তথ্যই পরবর্তীকালে প্রকাশ হয়ে পড়ে। এসব তথ্য থেকে জানা যায়, পার্বত্য এলাকাকে বিচ্ছিন্ন করে একটি কমিউনিষ্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বর্তমান সন্তু লারমার ভাই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি ১৯৭৩-৭৫ সালের মধ্যে প্রথমে বার্মার সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিন্তু নব প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক করতে চায়নি বলে বার্মা তাতে রাজি হয়নি। তারা কমিউনিষ্ট পরিচয় গোপন রেখে ভারতের সঙ্গেও যোগাযোগ করে।
ভারত অপেক্ষার নীতি গ্রহণ করে। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হবার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হলে জনসংহতি সমিতির প্রস্তাব সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করতে শুরু করে ভারত। তারা জনসংহতি সমিতির কমিউনিষ্ট নেতৃত্ব পরিবর্তন সাপেক্ষে একাধিক লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে এই প্রকল্প গ্রহণ করতে সম্মত হয় এবং খুব দ্রুতই কার্যক্রম শুরু করে। এই লক্ষ্যের সর্বশেষ অংশে ছিল, সুযোগমত পার্বত্য এলাকাকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে প্রথমে ‘প্রটেক্ট রেইট স্টেট' এবং পরে সিকিমের মতো ভারতভুক্ত করে নেয়া। কিন্তু বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর দুর্দমনীয় মনোভাব ও নিরবচ্ছিন্ন তৎপরতার ফলে এই উদ্যোগ ভেস্তে যায়।
এ বিষয়ে ১৯৮৯ সালের ১১ জুন নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রতিবেদক সঞ্জয় হাজারিকার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘এক দশকের বেশী সময় ধরে ভারত গোপনে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সীমান্তের উপজাতীয় বিদ্রোহীদের বাংলাদেশের মতো একটি স্বাধীন দেশের বিরুদ্ধে সংঘর্ষ চালিয়ে যাবার জন্য সহায়তা করছে। একজন জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তা এই সহায়তার কথা নিশ্চিত করেছেন এবং বলেছেন, অনির্ধারিতসংখ্যক কিছু বিদ্রোহী যোদ্ধা ভারতীয় প্যারামিলিটারী বাহিনীর সাথেই সীমান্তের কাছে অবস্থান করে। বিস্তারিত কিছু ব্যাখ্যা না দিয়ে সুত্র আরো জানায়, সরকার তাদেরকে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। বিদ্রোহীদের অধিকাংশই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী যারা বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের চাকমা ও অন্যান্য উপজাতীয়দের সাথে মিশে থাকে। তারা বলছে যে উগ্র বাংলাদেশী বাঙালীরা যারা আগাগোড়া কট্টর মুসলিম তারা তাদেরকে উর্বর জমি থেকে বের করে দিয়ে অন্যত্র ঢুকতে বাধ্য করেছে।'
প্রাপ্ত তথ্য মতে, ভারত এ বিষয়ে জনসংহতি সমিতির সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানী ভূখন্ড থেকে ভারতে আশ্রিত ও নাগরিকত্বপ্রাপ্ত স্নেহ কুমার চাকমাকে কাজে লাগায়। দু'পক্ষের মধ্যে যোগাযোগ ও গোপন বৈঠকের অন্যতম আস্তানা ছিল আগরতলার কেন্দ্রীয় জেলখানার পেছনে অবস্থিত একটি জেলখানা। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সন্তু লারমা জনসংহতি সমিতির কাজের সঙ্গে ভারতীয় সংশ্লিষ্টতার অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিলসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। বাংলাদেশের গোয়েন্দারা বিভিন্ন সময়ে যে সকল তথ্য উদ্ধার করে তাতে অনেক চাঞ্চল্যকর বিষয় উঘাটিত হয়। এতে দেখা যায়, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ও জনসংহতি সমিতির গোপন চুক্তি অনুযায়ী ১৯৭৫ সালের শেষের দিকে ১৮/২০ সদস্যের একটি দল ভারতের উত্তর প্রদেশের দেরাদুন সামরিক প্রশিক্ষণ একাডেমিতে প্রশিক্ষণে যায়। তথ্য মতে, ১৯৭৬ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেরাদুন সামরিক প্রশিক্ষণ একাডেমিতে শান্তিবাহিনীর ২৬ জন অফিসার সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। তাদের অস্ত্র চালনা, বেতার যোগাযোগ ও গেরিলা তৎপরতার ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এসব অফিসার শান্তিবাহিনীর মধ্যে সামরিক বিভিন্ন রাংক-এও পরিচিত হয়।
প্রশিক্ষণ পর্বের এ পর্যায়ে শুরু হয় অস্ত্রের চালান আসা। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ১৯৭৬ সালের মাঝামাঝিতে ভারত থেকে অস্ত্রের প্রথম চালানটি আসে। শান্তিবাহিনীর প্রশিক্ষক নলিনী রঞ্জন চাকমা ওরফে মেজর অফুরন্ত শান্তিবাহিনীর ৫০ জন সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে রাত ১২টায় বাংলাদেশের পানছড়ির বিপরীতে ভারতের খড়ভূগ বাজারে এই চালান গ্রহণ করে। এসময় চালানের সত্যায়ন করতে মেজর অফুরন্তকে মানবেন্দ্র লারমা তার কালো আংটি প্রেরণ করেন। এই চালানে ছিল ৩শ' টি ভারতীয় থ্রি নট থ্রি রাইফেল, ৫০ হাজার রাউন্ড গুলী ও ১৫০টি গ্রেনেড। এসময় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার ৫/৬ জন অফিসারও উপস্থিত ছিলেন। এর প্রায় এক মাস পর মেজর অফুরন্ত দেড়শ' সঙ্গীসহ ভারতের ইজারা নামক স্থানে বৈরাগীর দোকানের কাছ থেকে দ্বিতীয় চালান গ্রহণ করে। এ সময় দেয়া হয়, ৭.৬২ মিলিমিটার এলএমজি ১০/১২টি, থ্রি নট থ্রি রাইফেল ১শ' টি এবং ২০ হাজার রাউন্ড গুলী। এভাবে ১৯৭৭ সালের শেষ দিক পর্যন্ত বেশ কয়েকটি চালান আসে। অস্ত্রের সঙ্গে আরো যুক্ত হয় এসএমসি (কার্বাইন), সেমি অটো রাইফেল, ওয়ারলেস সেট প্রভৃতি। এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ সব সময় গভীর রাতে ভারতীয় কেন্দ্রীয় রিজার্ভ ফোর্সের ব্যবহৃত তিন টন ট্রাকে করে আনা হতো। সাথে থাকতো গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন। অস্ত্রবাহী গাড়ি আসার সঙ্গে সঙ্গে অপেক্ষমান শান্তিবাহিনীর মিলিশিয়াদের খবর দেয়া হতো এবং এক ঘন্টার মধ্যেই মালামাল সরিয়ে শান্তিবাহিনীর ট্রানজিট ক্যাম্পে রাখা হতো। পরে অবস্থা বুঝে সেক্টর ওয়াইজ অস্ত্র বন্টন করা হতো। ভারত অস্ত্রের পাশাপাশি আনুমানিক ৩০/৪০ হাজার ট্রাক শুকনো রেশনও শান্তিবাহিনীর জন্য সরবরাহ করে।
ভারত তার নিরাপদ এলাকায় শান্তিবাহিনীকে ক্যাম্প গড়ে তোলার ব্যবস্থা করে দেয় বলেও জানা যায়। ভারতীয় এলাকায় এরকম অন্ততঃ ১১টি ক্যাম্পের তথ্য পাওয়া যায়। এগুলো হলো, জয়চন্দ্রপাড়া বিএসএফ ক্যাম্প থেকে দেড় মাইল দক্ষিণ-পূর্বে শান্তিবাহিনীর মিশন একাডেমি, এসকে পাড়া বিএসএফ ক্যাম্প থেকে দু'মাইল পশ্চিমে শান্তিবাহিনীর সদর দফতর, এসকে পাড়া বিএসএফ ক্যাম্প থেকে তিন মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে মাইনি মিশন জুম ক্যাম্প, এসকে পাড়া বিএসএফ ক্যাম্প থেকে দু'মাইল দক্ষিণে উলুছড়ি ক্যাম্প, বোয়ালখালি বিএসএফ ক্যাম্পের তিন মাইল দক্ষিণ-পূর্বে জিরানী ক্যাম্প, বোয়ালখালি বিএসএফ ক্যাম্পের দেড় মাইল পূর্বে জারুলছড়ি ক্যাম্প, বোয়ালখালি বিএসএফ ক্যাম্পের দু'মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে দাতমুড়া ক্যাম্প, ভগবানটিলা বিএসএফ ক্যাম্পের দু'মাইল পশ্চিমে নাকচাতালি ক্যাম্প, নারায়ণবাড়ি বিএসএফ ক্যাম্পের দেড় মাইল পূর্বে কড়াইছড়ি ক্যাম্প, মন্ত্রীপাড়া বিএসএফ ক্যাম্পের দেড় মাইল উত্তর-পশ্চিমে ইজারা ক্যাম্প এবং জয়চন্দ্রবাড়ি বিএসএফ ক্যাম্পের দেড় মাইল উত্তর-পশ্চিমে পাতিছড়া ক্যাম্প।
সূত্র মতে, জনসংহতি সমিতির প্রধান নেতা মানবেন্দ্র লারমা তার কাংখিত লক্ষ্য অর্জনে সন্দিহান হয়ে এক পর্যায়ে তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আলোচনা করার একটা উদ্যোগ নেন। বিষয়টি জানতে পেরে ভারত তড়িঘড়ি ১৯৭৬ সালের প্রথম দিকেই এ্যাকশনে যাবার জন্য চাপ দেয়। তাদের প্রথম দিকের কার্যক্রম ছিল থানা আক্রমণ, সরকারী সম্পত্তির ক্ষতিসাধন এবং প্রয়োজনে সামরিক বাহিনীর উপর ঝটিকা আক্রমণ। পরে তা সম্প্রসারিত হয়। এ পর্যায়ে জলে-স্থলে নিরাপত্তা বাহিনীর উপর ঝটিকা আক্রমণ, বাঙ্গালী গ্রামসমূহে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্পসমূহে আক্রমণ ও আগুন দেয়া, বাঙ্গালীদের হত্যা এবং শান্তিবাহিনী বিরোধী উপজাতীয়দের হত্যা, মুক্তিপণ আদায়ের লক্ষ্যে সরকারী কর্মকর্তা ও গুরুত্বপূর্ণ উপজাতীয় নাগরিকদের অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়, বিভিন্ন সরকারী স্থাপনা ও অবকাঠামো ধ্বংস করা, সাপ্রদায়িক দাঙ্গায় উস্কানি দিয়ে উপজাতীয়দের ভারতে শরণার্থী হতে বাধ্য করা প্রভৃতি কার্যক্রমও বাস্তবায়ন করা হয়।
এসব কর্মকান্ড একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পরিচালিত হলেও এব্যাপারে ভারত কোন বাখ্যা দেয়নি। এ থেকে তারা ভবিষ্যতে বিরত থাকার ব্যাপারেও কিছু বলেনি। ফলে ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তির আশংকা থেকেই যাচ্ছে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন (সূত্র: দৈনিক সংগ্রাম, ১৬ জুলাই ২০১১)।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধি দল ত্রিপুরা এলাকায় বাংলাদেশ-ত্রিপুরা দুর্গম সীমান্ত পরিদর্শনে যেয়ে ভয়াবহ তথ্য জানতে পারে। পরবর্তীতে সেখান থেকে ফিরে বিষয়টি লিখিতভাবে ভূমি মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছিল। ওই লিখিত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছিল-বাংলাদেশ ও ত্রিপুরা শূন্য রেখা থেকে একটু ভেতরেই শত শত শান্তি বাহিনী অবস্থান করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে অশান্ত করে তোলার পরিকল্পনায় অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া এসব শান্তি বাহিনীকে ভারত শুধু নিয়ন্ত্রণই করেনা, আশ্রয়-প্রশ্রয়ও দিয়ে যাচ্ছে। ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে এসব বিচ্ছিন্নতা বাদীদের খাবার সরবরাহও করা হয় এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী এখনও প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে। এই প্রতিনিধি দলের সরেজমিন প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছিল-সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরিয়ে আনতে শান্তি বাহিনীর সাথে শান্তি চুক্তিতে উপনীত হলেও তারা এখনও এই চুক্তি মেনে চলছে না।
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা সমূহ:
·
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা
· পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক সেনাহত্যার ইতিহাস
[লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে? তাহলে দয়াকরে
গবেষণামূলক ও ইতিহাস ভিত্তিক এই সাইটটি চালিয়ে যেতে সাহায্য করুন। পার্বত্য
চট্টগ্রামে অধিকার বঞ্চিত বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী সাইটটি পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার
কতৃক চরমভাবে অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত, পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ঠ এনজিও সমূহের একচোখা
নীতি, সন্তু লারমা ও প্রসীত খীসাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস
ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) 'এর নিপিড়িত, নির্যাতিত ও বর্বরতম
সন্ত্রাসের নির্মম ও অসহায় শিকার - পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠির
সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ক্ষুদ্রতম এক প্রয়াস]