[আগের দুই পর্বে উল্লেখিত (১)] ''..কাহিনীগুলি একটি বিষয় পরিষ্কার করে দেয় যে এই সময়ে যারা পুর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে আসছিল তারা মানসিক নিপীড়ন হেতুই চলে আসছে। পাকিস্তান হবার পর সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হেতু এখন তাদের সেখানে মান-সম্ভ্রম ইজ্জৎ নিয়ে বাস করা সম্ভব নয়, এই তাদের ধারণা হয়েছে। পূর্বের পরিবেশে সমাজে যে সম্মান পেতে তারা অভ্যন্ত তা এখন পাওয়া যায় না। বরং পাওয়া যায় উদ্ধত ব্যবহার এবং পদে পদে যেখানে অন্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে স্বার্থের সংঘাত সেখানে অন্যায় অত্যাচার। মেয়েদের ইজ্জৎ রাখা সেখানে দুষ্কর। নিজের ভিটেমাটি কেউ সহজে ত্যাগ করে না। এরা যে করেছে, তা বাধ্য হয়েই করেছে। এরা ভদ্রশ্রেণীর উন্নত রুচির মানুষ। এদের অপমানবোধ তীক্ষ্ণ। তাই অত্যাচার চরমে ওঠবার আগেই, যখন তা মানসিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ তখনি তারা চলে এসেছে। ওপরে [আগের দুই পর্বে উল্লেখিত] যাদের কথা বলা হয়েছে তারা যেমন মানসিক নিপীড়নের ফলে চলে এসেছিল তেমন আর এক শ্রেণীর মানুষ ছিল যারা নিপীড়নের জন্যও অপেক্ষা করে নি, দেশ বিভাগ হবার পরেই, সোজা পুর্ববঙ্গ ত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিল। আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে এ আচরণের অর্থ হয় না, কিন্তু একটু বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে যে তাদের এ বিষয় একটি পৃথক দৃষ্টিকোণ ছিল এবং তাও যুক্তি দ্বারা সমর্থিত।
দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যেমন পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সক্রিয়ভাবে রীতিমত যোগ দিয়েছিল, তেমন পুর্ববঙ্গের হিন্দুও দিয়েছিল। ঠিক বলতে, পুর্ববঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্বেও হিন্দুরাই প্ৰধানত স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে এসেছে। এই প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ব্যাপকভাবে মাষ্টারদার নেতৃত্বে স্বাধীনতার জন্য প্ৰত্যক্ষ সংঘর্ষের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এই ভাবে হক বা অহিংসভাবে হক স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে প্ৰধানত শিক্ষিত হিন্দুদের নেতৃত্বে। জাতীয়তা বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে, স্বাধীনতালাভের জন্য সংগ্রাম করে তারা নিজেদের রাজনৈতিক অধিকার সম্বন্ধে বিশেষ সচেতন হয়ে উঠেছিল। দীর্ঘকাল ধরে আন্দোলন এবং সংগ্রামের পর কিন্তু যখন স্বাধীনতা লাভ সম্ভব হয়ে উঠল তখন নানা বিরোধী স্বার্থের সংঘাত ও কুটনৈতিক প্রক্রিয়ার ফলে নিজ মাতৃভূমিতে স্বাধীনতার যে রূপটি ফুটে উঠল তা তাদের কাছে বিভীষিকা হয়ে দাঁড়াল।
যারা স্বাধীনতা লাভ করবার জন্য আন্দোলন করল, মরণপণ যুদ্ধ করল, প্ৰাণ দিল, তারা দেখল পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে বলে ইংরেজ ভারতত্যাগ করলেও তারা প্ৰকৃত স্বাধীনতা পেল না। কারণ ভারত হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বতন্ত্র রাষ্ট্ররূপে পাকিস্তানের সৃষ্টি হবার ফলে সেখানে হিন্দুর প্রকৃত স্বাধীনতা ভোগের সম্ভাবনা রইল না। পাকিস্তানের উদ্দেশ্য হল ইসলামিক আদর্শে রাষ্ট্র গঠন করা। সেখানে যে ইসলাম-ধৰ্মী সেই নাগরিকের পুর্ণ মর্যাদা পাবে, যে অন্য ধর্মের মানুষ সে বাধ্য হবে নিকৃষ্ট নাগরিকরূপে বাস করতে। সুতরাং এক হিসাবে দেখতে গেলে হিন্দুর অবস্থা ইংরেজের শাসনে পরাধীনতার যুগে যেমন ছিল এক দিক হতে তার থেকেও নিকৃষ্ট হবে। নিকৃষ্ট নাগরিকত্বের মৰ্যাদা নিয়ে তীক্ষ্ম রাজনৈতিক সচেতনতা হেতু এরা তাই নিজ জন্মভূমিতে বাস করতে চাইল না। বহুপ্ৰতীক্ষিত স্বাধীনতালাভের পর তারা এমন জায়গায় বাস করতে চাইল না, যেখানে স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিকত্বের পুর্ণ আস্বাদ গ্ৰহণ করা সম্ভব হবে না। তাই তারা আপাতদৃষ্টিতে বিনা কারণেই দেশ বিভাগ হবার সঙ্গে সঙ্গে দেশত্যাগী হল।''(২)
ওপারে চলে যাওয়া উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের উত্তরাধিকারদের অনেকেই হয়ত ভুলে গেছেন যে প্রায় ২০০ বছরের পরাধীনতার সময়ে তাঁদের প্রভাবশালী একটা অংশ শাসক ইংরেজের সহযোগী ছিলেন শুরু থেকে। পূর্ববঙ্গের মানুষের (নমঃশুদ্র এবং মুসলিম) ওপর জমিদারির মাধ্যমে যে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার, নিপীড়ন ও বেইজ্জতি তাঁরা চালিয়েছেন সেটার সম্মিলিত ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হয়ে জমা হয়ে ছিল তখন। সেসবের রিপারক্রুসান যে বিভিন্ন ফরমে হতে পারে সেটা যারা উপলব্ধি করেছেন, বুঝেছেন তাঁরাও যে নিজ দায়িত্বে দেশান্তরী হয়েছেন সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
নোটঃ
(১) পর্ব ১ঃ পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা কেন দেশ ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়েছিল?
পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা কেন দেশ ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়েছিল?-পর্ব ২,
(২) শ্রী হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, উদ্বাস্তু, সাহিত্য সংসদ, ১৯৬০, পৃ.১৬-১৮
· পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা
· পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক সেনাহত্যার ইতিহাস
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা সমূহ:
· পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা
· পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক সেনাহত্যার ইতিহাস
[লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে? তাহলে দয়াকরে গবেষণামূলক ও ইতিহাস ভিত্তিক এই সাইটটি চালিয়ে যেতে সাহায্য করুন। পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার বঞ্চিত বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী সাইটটি পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার কতৃক চরমভাবে অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত, পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ঠ এনজিও সমূহের একচোখা নীতি, সন্তু লারমা ও প্রসীত খীসাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) 'এর নিপিড়িত, নির্যাতিত ও বর্বরতম সন্ত্রাসের নির্মম ও অসহায় শিকার - পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠির সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ক্ষুদ্রতম এক প্রয়াস]