[এই লেখাটি সাবেক সচিব পি এ নাজির এর স্মৃতিচারণ মূলক বই থেকে নেয়া। তিনি পাকিস্তান আমলে এসডিও হিসেবে সরকারী চাকুরীতে জয়েন করে নাটোরে পোস্টিং পান। তাঁর অভিজ্ঞতায় উঠে আসে শিক্ষিত হিন্দুদের দেশত্যাগের চিত্র। ঘটনা ১৯৫৬ সালের শেষ ভাগ।] ''মহকুমার কার্যভার গ্রহণ করার পর সরকারী কাজের বাইরে প্রথম যে কাজ করব ঠিক করলাম তা হলো মহকুমা শহরের সবকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন। আছেই মাত্র তিনটি হাইস্কুল। একটি অতি সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে- জিন্নাহ স্কুল। দ্বিতীয়টি মহারাজা স্কুল এবং তৃতীয়টি বালিকা স্কুল। জিন্নাহ স্কুল কাছারির কাছেই। একদিন গেলাম সেখানে। প্রধান শিক্ষক বেশ মার্জিত শিক্ষাবিদ। স্কুলের পরিবেশ দেখে মনে হলো শিক্ষকমন্ডলী দায়িত্ব-সচেতন। পরদিন গেলাম মহারাজা স্কুলে। প্রধান শিক্ষক বেশ ভারিক্কি কিসিমের লোক, একটু যেন লা-পরওয়া গোছেরও। ক্লাস রুমগুলো ঘুরে ঘুরে দেখলাম। ছেলেদের দু’একটা প্রশ্নও করলাম। খুব মামুলি ধরনের যেমন- নাম কি, বাড়ী কোথায়, বাপ কী করেন? ইত্যাদি। দেখলাম শিক্ষকদের মধ্যে একমাত্র আরবী শিক্ষকই মুসলমান, বাকী সবাই হিন্দু। সবিস্ময়ে একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, সামনে বেঞ্চ খালি থাকা সত্ত্বেও সেখানে মুসলমান ছাত্রদের বসতে দেয়া হয়নি। যে গুটিকয়েক মুসলমান ছাত্র স্কুলে আছে তাদের স্থান চতুর্থ ও পঞ্চম সারিতে। প্রতিটি ক্লাসে একই অবস্থা।
বৃথা সময় নষ্ট করতে চাইলাম না। ক্লাস রুম থেকে সরাসরি চলে এলাম শিক্ষকদের কমন রুমে। কয়েকটি বইয়ের আলমারী। আলমারীগুলোর মাথার উপর দেওয়ালে টাঙ্গান রয়েছে বেশ কতগুলো লাইফ-সাইজ রঙিন ছবি। এতে ছিলো রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, গান্ধী, সুভাস এবং মহারাজা। হেড মাস্টার সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কায়েদে আজমের ছবি কোথায়? জবাব পেলাম, ‘ওটা আমাদের স্কুলে নেই।’ শুধু মাথাটায় নয়, সত্যি বলতে কি, সারা শরীরে উষ্ণ রক্ত বহু আগে থেকেই সঞ্চালিত হচ্ছিল অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। কিন্তু সর্বশেষ প্রশ্নের জবাব শুনে রক্তের সে গতি আরো বহু গুণ বেড়ে গেল। বুঝতে পারলাম আর এখানে থাকা নিরাপদ হবে না। কি থেকে কি ঘটে যায় কে জানে! চলে এলাম।
কিন্তু আসার সময় হেড মাস্টার সাহেবকে সংযত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে আমলাতান্ত্রিক কায়দায় বললাম, ‘আমি পরশু আবার আপনার স্কুলে আসব। বাবায়ে কওমের অর্থাৎ আমাদের সবার বাবার ছবিটা এই রুমে দেখতে চাই এবং কাল থেকে কওমী ঝান্ডা সমবেত জাতীয় সঙ্গীতের সাথে উত্তোলন করতে হবে।পরদিন আমাকে একটু অবাক করে দিয়েই মহারাজা স্কুলের হেড মাস্টার সাহেব আমার বাংলোয় এলেন। কাল তাকে বলে এসেছিলাম যে, পরশু আমি তার স্কুলে যাবো। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে আমাকে সেই দাওয়াত দিতে এসেছেন। তার এই আচরণ আমার খুব ভালো লাগলো।
পরদিন নির্দিষ্ট সময়ে স্কুলে গেলাম। স্কুল মাঠে ১৯৪৭ সালের পর এই প্রথমবারের মতো জাতীয় পতাকা উড়ছে। আমাকে ছেলেরা অভ্যর্থনা করল ‘ব্রতচারী’ গান শুনিয়ে। শিক্ষক কমন রুমে এলাম। দেখলাম, কায়েদে আজমের ছোট্ট মানের ছবির ফ্রেমটা খুব উচুতে স্থাপন করে একটা রুমাল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে এবং একটা রশি লাগিয়ে রুমালটা টানার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাকে পর্দা উন্মোচন করার জন্য অনুরোধ করা হলো। আমি রুশি টানলাম। সবাই করতালিতে কামরাটা মুখর করে তুললো। ফ্রেমের মধ্যে ছবিটা পোস্ট কার্ড সাইজের।
এবার বক্তৃতার পালা। কিছু বলতে হবে। বললাম, ‘যে গতিতে আপনারা অগ্রযাত্রা শুরু করেছেন। তাতে আমি খুব খুশী হয়েছি। মনে হলো তারাও খুব বেশী খুশি হয়েছে এসডিওকে খুশী দেখে। কিন্তু তারা এটা মোটেও আঁচ করতে পারেনি যে, এই ব্যাটা এসডিও কাল আবার স্কুল বসার সময় সশরীরে এসে হাজির হবেন।
পরদিন সকাল ঠিক দশটায় গিয়ে মহারাজা স্কুলে উপস্থিত হলাম। স্কুলের ত্রি-সীমানার কোথাও জাতীয় পতাকার নাম নিশানা পাওয়া গেল না। এতে অবশ্য আমি অবাক হলাম না। শিক্ষকদের কমন রুমে গিয়ে ঢুকলাম। ‘কায়েদে আজম’ উধাও। এটাও অপ্রত্যাশিত ছিল না আমার কাছে। জিজ্ঞেস করলাম হেড মাস্টার সাহেবকে, ‘ছবিটা কোথায় গেল? কোন উত্তর পেলাম না। কারো মুখে রা নেই। সবাই হতচকিত ও বিহবল হয়ে পড়েছে। এরকম একটা ঘটনা বাস্তবে ঘটতে পারে এটা যেন তারা কল্পনাও করতে পারেননি।
এই নীরবতা ভঙ্গ করে আমার এক নতুন আর্দালী এক পানের দোকানদারের হাত ধরে প্রায় টেনে হেঁচড়ে আমার সামনে হাজির করল। ব্যাপার কি? জানতে চাইলাম। সে যা বলল তা হলো কাল যে ছবিটা এখানে টাঙ্গানো হয়েছিল সে ছবিটা এই ব্যাটা দোকানদার ওর দোকানে টাঙ্গিয়ে রেখেছে আজ। কত বড় সাহস! পান দোকানদার কাচুমাচু হয়ে যা বলল তা হলো, এতে ওর কোন অপরাধ নেই। এই ছবিটার প্রকৃত মালিক সেই। স্কুল কর্তৃপক্ষ কাল কিছুক্ষণের জন্য এই ছবিটা তার কাছ থেকে ভাড়া করেছিলো। কাজ শেষে কালই আবার তারা ছবিটা তাকে ফেরত দিয়েছে। এমনভাবে এদের হাটে হাঁড়ি ভাংবে এরা ভাবতেও পারেননি।
একজন শিক্ষক (হেডমাস্টার নন) বিনীত কণ্ঠে বললেন, ‘স্যার’ যদি অভয় দেন তো একটা কথা বলবো। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, নির্ভয়ে বলুন। তিনি বললেন, স্যার আপনি যা চাচ্ছেন তার সাথে যদি আমরা একমত না হই তবে কি আমরা বিনা ঝামেলায় পদত্যাগ করতে পারবো?
জবাবে শান্ত কণ্ঠে বললাম, নিশ্চয়ই পারবেন, খুশী মনে পারবেন। কোন ঝামেলাও হবে না। এবার হেড মাস্টার মরিয়া হয়ে মুখ খুললেন, স্যার, এই স্কুলের গভর্নিং বডির প্রেসিডেন্ট কলকাতাবাসী মহারাজা, এসডিও নন। বললাম, সে আমি খুব ভাল করেই জানি। এসডিও হিসেবে আমি জানি আমাকে কি করতে হবে এবং আমি আমার দায়িত্ব সম্পর্কে খুবই সচেতন।
হেড মাস্টার সাহেব আর কিছু বললো না। আমি পায়চারি করতে করতে হেড মাস্টার সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এ স্কুলটির এ্যাফিলিয়েশন কি কলকাতার সঙ্গে না ঢাকার সঙ্গে?’ উত্তর পেলাম না। হেড মাস্টার সাহেবের চেহারা আরো গম্ভীর হলো।হঠাৎ কাচের আলমারীর ভিতর একটা বইয়ের উপর নজর পড়ল। The Calcutta University Calender 1956 বইটা দেখতে চাইলাম। একজন শিক্ষক নীরবে বইটা আমার হাতে তুলে দিলেন। পাতা উল্টাতে উল্টাতে কাঙ্খিত জায়গা পেয়ে গেলাম। নাটোর মহারাজা হাইস্কুল কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাফিলিয়েশন প্রাপ্ত। আগের বছর এই স্কুলের কত জন ছাত্র পাস করেছে তারো একটা হিসাব এতে আছে।
আমার মনে নানা ধরনের সন্দেহ উঁকি ঝুঁকি দিলেও সত্য বলতে কি, আমি এতোটা ভাবতে পারিনি। ইট ইজ টু মাচ! এই স্কুল সম্পর্কে যা সিদ্ধান্ত নেবার তা নিয়ে ফেলেছি তৎক্ষণাৎ, নিজের অজান্তেই। চুপচাপ চলে এলাম নিজের বাংলোয়। সরকারী স্কুলের একজন অবসরপ্রাপ্ত হেড মাস্টার নাটোরের কানাইখালিতে থাকতেন। তাকে রেক্টর নিয়োগ করে মহারাজা স্কুলে পাঠালাম পরদিন।
এদিকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাজশাহী থেকে আমার কাছে এক বার্তা পাঠালেন। তাতে তিনি জানালেন যে, কলকাতায় বসবাসকারী মহারাজা প্রাদেশিক গভর্নর এ কে ফজলুল হক সাহেবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মহারাজা অভিযোগ করেছেন, এক ছোকরা এসডিও তার স্কুলটাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। সুতরাং হক সাহেব যেন ত্বরিত ব্যবস্থা নেন।
ওই দিন বিকেলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্বয়ং নাটোরে তাশরিফ আনলেন। সোজা নিয়ে গেলাম তাকে মহারাজা স্কুলে।... জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তার সদর দফতরে ফিরে গিয়ে মহারাজা স্কুল সম্পর্কে কি রিপোর্ট দিয়েছিলেন জানি না। তবে সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে তিনি আমাকে সবিস্ময়ে বলেছিলেন, ‘এটা কি করে সম্ভব হলো- যে স্কুলটি এই দেশে অবস্থিত, স্কুলের পাঠ্য বইগুলো এখানকার টেক্সট বুক বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত অথচ ছেলেরা পরীক্ষা দেয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সিলেবাস অনুসারে। তাকে এ তথ্যও দিয়েছিলাম যে, কটি মুসলমান ছেলে দশম শ্রেণীর পর্যন্ত পড়ে তারা হয় প্রাইভেটে পরীক্ষা দেয় নতুবা পাশের দিঘাপতিয়া স্কুলের ছাত্র হিসেবে ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষায় অংশ নেয়। এ স্কুল থেকে যারা মেট্রিক পরীক্ষা দেয় তারা সবাই হিন্দু ছাত্র এবং পরীক্ষা দেয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সিলেবাস অনুসারে।
যা হোক, মহারাজা স্কুলের কীর্তিমান হেড মাস্টার এবং তার চার জন সহকর্মী শিক্ষক হঠাৎ এক দিন লাপাত্তা হয়ে গেলেন। খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেল, তারা সীমান্তের ওপারে চলে গেছেন।''
(উৎসঃ পি এ নাজির,স্মৃতির পাতা থেকে, নতুন সফর প্রকাশনী, ১৯৯৩ পৃষ্ঠা ১০-১৫)
প্রাসঙ্গিক আগের পর্বঃ
পর্ব ১ঃ পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা কেন দেশ ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়েছিল?
পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা কেন দেশ ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়েছিল?-পর্ব ২,
পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা কেন দেশ ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়েছিল?-৩
https://www.facebook.com/muldharabd/posts/1668035573259759:0
· পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা
· পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক সেনাহত্যার ইতিহাস
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা সমূহ:
· পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা
· পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক সেনাহত্যার ইতিহাস
[লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে? তাহলে দয়াকরে গবেষণামূলক ও ইতিহাস ভিত্তিক এই সাইটটি চালিয়ে যেতে সাহায্য করুন। পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার বঞ্চিত বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী সাইটটি পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার কতৃক চরমভাবে অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত, পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ঠ এনজিও সমূহের একচোখা নীতি, সন্তু লারমা ও প্রসীত খীসাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) 'এর নিপিড়িত, নির্যাতিত ও বর্বরতম সন্ত্রাসের নির্মম ও অসহায় শিকার - পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠির সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ক্ষুদ্রতম এক প্রয়াস]