মুসলমান আগমনের পূর্বে বঙ্গভাষা কোনো কৃষক রমণীর ন্যায় দীনহীন বেশে পল্লী কুটিরে বাস করিতেছিল৷ এই ভাষাকে এ্যাণ্ডারসন, স্ক্রাইন, কেরী প্রভৃতি সাহেবেরা অতি উচ্চকণ্ঠে প্রশংসা করিয়াছেন৷ কেরী বলিয়াছেন, “এই ভাষার শব্দ সম্পদ ও কথার গাঁথুনি এরূপ অপূর্ব যে, ইহা জগতের সর্বপ্রধান ভাষাগুলির পার্শ্বে দাঁড়াইতে পারে।” যখন কেরী এই মন্তব্য প্রকাশ করেন, তখন বঙ্গীয় গদ্য সাহিত্যের অপোগণ্ডত্ব ঘোচে নাই; সে আজ ১২৫ বৎসর হইল ৷ ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা বলিয়াছেন, এমন কোন ভাব নাই, যাহা অতি সহজে, অতি সুন্দর ভঙ্গিতে বাঙ্গলা ভাষায় প্রকাশ না করা যায় এবং এই গুণেই ইহা জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষাগুলির সমকক্ষ৷স্ক্রাইন বলিয়াছেন, “ইটালী ভাষার কোমলতা এবং জার্মান ভাষার অদ্ভুত ভাব প্রকাশ করিবার শক্তি এই মধুরাক্ষরা এবং স্বচ্ছন্দগতি বাঙ্গলা ভাষায় দৃষ্ট হয়।” এই সকল অপূর্ব গুণ লইয়া বাঙ্গলা ভাষা মুসলমান প্রভাবের পূর্বে অতীব অনাদর ও উপেক্ষায় বঙ্গীয় চাষার গানে কথঞ্চিত আত্মপ্রকাশ করিতেছিল৷পণ্ডিতেরা নস্যাধার হইতে নস্য গ্রহণ করিয়া শিখা দোলাইয়া সংস্কৃত শ্লোকের আবৃত্তি করিতেছিলেন এবং “তৈলাধার পাত্র” কিম্বা “পাত্রাধার তৈল” এই লইয়া ঘোর বিচারে প্রবৃত্ত ছিলেন ৷ তাঁহারা হর্ষচরিত্ত হইতে ‘হারং দেহি মে হরিণি’ প্রভৃতি অনুপ্রাসের দৃষ্টান্ত আবিষ্কার করিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করিতেছিলেন এবং কাদম্বরী, দশকুমারচরিত প্রভৃতি পদ্য-রসাত্মক গদ্যের অপূর্ব সমাসবদ্ধ পদের গৌরবে আত্মহারা হইতেছিলেন৷
রাজসভায় নর্তকী ও মন্দিরে দেবদাসীরা তখন হস্তের অদ্ভুত ভঙ্গী করিয়া এবং কঙ্কণ ঝঙ্কারে অলি গুঞ্জনের ভ্রম জন্মাইয়া “প্রিয়ে, মূঞ্চময়ি মানমনিদানং” কিম্বা “মুখর মধীরম, ত্যজ মঞ্জীরম্” প্রভৃতি জয়দেবের গান গাহিয়া শ্রোতৃবর্গকে মুগ্ধ করিতেছিল৷সেখানে বঙ্গভাষার স্থান কোথায়?
ইতরের ভাষা বলিয়া বঙ্গভাষাকে পণ্ডিতমণ্ডলী ‘দূর দূৱ’ করিয়া তাড়াইয়া দিতেন, হাড়ি-ডোমের স্পর্শ হইতে ব্রাহ্মণেরা যেরূপ দূরে থাকেন বঙ্গভাষা তেমনই সুধী সমাজের অপাংক্তেয় ছিল-তেমনি ঘৃণা, অনাদর ও উপেক্ষার পাত্র ছিল৷
কিন্তু হীরা কয়লার খনির মধ্যে থাকিয়া যেমন জহুরীর আগমনের প্রতীক্ষা করে, শুক্তির ভিতর মুক্তা লুকাইয়া থাকিয়া যেরূপ ডুবুরীর অপেক্ষা করিয়া থাকে, বঙ্গভাষা তেমনই কোন শুভদিন, শুভক্ষণের জন্য প্রতীক্ষা করিতেছিল।
মুসলমান বিজয় বাঙ্গলা ভাষার সেই শুভদিন, শুভক্ষণের সুযোগ আনয়ন করিল৷গৌড়দেশ মূসলমানগণের অধিকৃত হইয়া গেল৷ তাঁহারা ইরান-তুরান যে দেশ হইতেই আসুন না কেন, বঙ্গদেশ বিজয় করিয়া বাঙ্গালী সাজিলেন। আজ হিন্দুর নিকট বাঙ্গলাদেশ যেমন মাতৃভৃমি, সেদিন হইতে মুসলমানের নিকট বাঙ্গলাদেশ তেমনই মাতৃভুমি হইল৷তাঁহারা এদেশে আসিয়া দস্তুরমত এদেশবাসী হইয়া পড়িলেন৷হিন্দুর নিকট বাঙ্গলা ভাষা যেমন আপনার, মুসলমানদের নিকট উহা তদপেক্ষা বেশী আপনার হইয়া পড়িল৷
বঙ্গভাষা অবশ্য বহু পূর্ব হইতে এদেশে প্রচলিত ছিল, বুদ্ধদেবের সময়ও ইহা ছিল, আমরা ললিত বিস্তরে তাহার প্রমাণ পাইতেছি। কিন্তু বঙ্গ-সাহিত্যকে একরূপ মুসলমানের সৃষ্টি বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না। তাহা আমরা পরে দেখাইব ৷
চারিদিকে হিন্দু প্রজা, চারিদিকে শঙ্খ ঘন্টার রোল, আরতির পঞ্চপ্রদীপ, ধূপ, ধূনা, অগুরুর ধৌয়া-চারিদিকে রামায়ণ মহাভারতের কথা, এবং ঐ সকল বিষয়ক গান। প্রজাবৎসল মুসলমান সম্রাট স্বভাবতই জানিতে চাহিলেন, “এগুলি কি?” পণ্ডিত ডাকিলেন,-তিনি তিলক পরিয়া, শিলা দোলাইয়া, নামাবলী গায়ে দিয়া হুজুরে হাজির হইয়া বলিলেন,
“এগুলি কি জানিতে চাহিলে আমাদের ধর্মশাস্ত্র জানা চাই। দ্বাদশ বর্ষাকাল ব্যাকরণ পাঠ করিয়া ইহার মধ্যে প্রবেশাধিকার হইতে পারে।” এই ঝুনো নারিকেল না ভাঙ্গিয়া ভিতরের শাঁস খাইবার উপায় নাই ৷ বাদশাহ ক্রুদ্ধ হইলেন, “আমি ব্যাকরণ বুঝি না, রাজ-কাজ ফেলিয়া আমি ব্যাকরণ শিখিতে যাইব, তাহাও বামুন আমাকে পড়াইবে না,-ও সকল হইবে না। দেশী ভাষায় এই রামায়ণ-মহাভারত রচনা কর।”
গৌড়েশ্বর দেশী ভাষা শিখিয়াছিলেন, না হইলে প্রজা শাসন করিবেন কিরূপে? তিনি পুরোদস্তর বাঙ্গালী সাজিয়াছিলেন-সে কথা পূর্বেই লিখিয়াছি। দেশী ভাষায় ধর্মগ্রন্থ রচনা করিতে হইবে, এই আদেশ শুনিয়া পণ্ডিতের মুখ শুকাইয়া গেল, ইতরের ভাষায় পবিত্র দেব-ভাষা রচনা করিতে হইবে, চণ্ডালকে ব্রাহ্মণের সঙ্গে এক পংক্তিতে স্থান দিতে হইবে। কিন্তু শত শত কলুক ভট্ট, রঘুনন্দন, শত শত স্মৃতি লিখিয়া শত শত বৎসরে যাহা না করিতে পারেন, শাহানশাহ বাদশাহের একদিনের হুকুমে তাহা হয়-রাজশক্তি এমনই অনিবার্য ৷ অগত্যা প্রাণের দায়ে ব্রাহ্মণকে তাহাই করিতে হইল ৷
পরাগলী মহাভারতে উল্লিখিত আছে;
“শ্রীযুত নায়ক যে সে নসরত খান,
রচাইল পাঞ্চালী যে গুণের নিধান।”
এতদ্বারা প্রমাণিত হইতেছে, হুসেন শাহের পুত্র নসরত শাহ মহাভারতের বঙ্গানুবাদ করাইয়াছিলেন। পাঞ্চালী (পাঁচালী) অর্থ মহাভারত । নসরতের আদেশে রচিত মহাভারতের উল্লেখ আমরা পাইয়াছি, কিন্তু পুস্তকখানি এখনও আবিষ্কৃত হয় নাই । এই গ্রন্থ অনুমান ১8৯৮ খৃষ্টাব্দে রচিত হইয়াছিল। তখনও নসরত সম্রাট হন নাই-তাহাকে শুধু ‘নায়ক’ বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে।
হুসেন শাহের সেনাপতি পরাগল খাঁ চট্টগ্রাম বিজয়ের জন্য পূর্বাঞ্চলে প্রেরিত হন, তাহার বংশধরগণ ফেনী নদীর তীরস্থ পরাগলপুরে (নোয়াখালী জেলার) এখনও বাস করিতেছেন, এখনও তাহারা তথাকার ভূম্যাধিকারী। এক সময়ে পরাগল খাঁ ও তৎপুত্র ছুটি খাঁর প্রতাপ এই প্রদেশে পরিব্যপ্ত ছিল, ছুটি খাঁর সম্বন্ধে কবি শ্রী করণ নন্দী লিখিয়াছেন,
“ত্রিপুরা নৃপতি যার ভয়ে এড়ে দেশ
পর্বত গহবরে গিয়া করিল প্রবেশ।”
তখন ত্রিপুরার রাজা ছিলেন মহারাজ ধর্মমাণিক্য । তাঁহার মত এত বড় পরাক্রমশালী রাজা ত্রিপুরার ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি দেখা যায়না ৷ তাহার প্রধানমন্তী ছিলেন চাণক্যতুল্য রাজনীতি-বিশারদ রায়চান। এহেন সম্রাটও ছুটি খাঁর ভয়ে উদয়পুরের পার্বত্য দুর্গের নিভৃত কোণে আশ্রয় লইয়াছিলেন বলিয়া শ্রীকরণ নন্দী আমাদিগকে জানাইয়াছেন।
হুসেন শাহের সেনাপতি পরাগল খাঁ কবীন্দ্র পরমেশ্বর নামক জনৈক সুপণ্ডিত কবিকে মহাভারতের অনুবাদ রচনা করিতে নিযুক্ত করেন।কবীন্দ্র পরমেশ্বর বহু স্থানে পরাগল খাঁর প্রশংসা করিয়াছেন, ‘শ্রীযুক্ত পরাগল খান পদ্মিনী ভাস্কর তিনি।’ ‘রস বোদ্ধা’, ‘গুণগ্ৰাহী’ ইত্যাদি বিশেষণ তাঁর প্রতি সর্বদা প্রযুক্ত হইয়াছে ৷ কবীন্দ্র পরমেশ্বর ও শ্রী করণ নন্দী উভয়েই মহাভারত অনুবাদের একটা সংক্ষিপ্ত ইতিহাস দিয়াছেন ৷ কবীন্দ্র লিখিয়াছেন,
“নৃপতি হুসেন শাহ গৌড়ের ঈশ্বর
তান হক্ সেনাপতি হওন্ত লস্কর ৷
লস্কর পরাগল খান মহামতি
পঞ্চম গৌড়েতে যার পরম সুখ্যাতি।
সুবর্ণ বসন পাইল অশ্ব বায়ুগতি।
লস্করী বিষয় পাই আইবন্ত চাহিয়া
চাটিগ্রামে চলি গেল হরষিত হৈয়া।
পুত্র পৌত্রে রাজ্য করে খান মহামতি
পুরাণন শুনস্ত নিত্য হরষিত মতি।।”
কবীন্দ্র পরমেশ্বর সংস্কৃতে বিশেষ ব্যুৎপন্ন ছিলেন এবং তিনি মহাভারতের স্ত্রী-পর্ব পর্যন্ত অনুবাদ রচনা করেন। পরাগলের বিজয়দৃপ্ত সুযোগ্য পুত্র ছুটি খাঁ শ্রী করণ নন্দীর দ্বারা মহাভারতের অশ্বমেধ পর্বের অনুবাদ সংকলন করাইয়াছিলেন৷ শ্রী করণ নন্দী তাহার গ্রন্থের ভূমিকায় ঐতিহাসিক অনেক কথাই লিখিয়াছেন ৷ পরাগল খাঁর আদেশে বিরচিত মহাভারতের এক জায়গায় কবীন্দ্র পরাগল-তনয় ছুটি খাঁর উল্লেখ করিয়াছেনঃ
“তনয় ছুটি খাঁ পরগ উজ্জ্বল
কবীন্দ্র পরমেশ্বর রচিল সকল ৷”
সেই স্বভাবের নিভৃত পরম সুন্দর নিকেতন চন্দ্রশেখর পর্বতের ক্রোড়া দেশে, শ্যামল বনস্পতি সচল মুক্তার পংক্তির ন্যায় নির্ঝরধারা অধ্যুষিত পরম রমণীয় রাজধানীতে বসিয়া প্রজারঞ্জক বা মহাবীর মুসলমান সেনাপতিরা হিন্দু পণ্ডিতের দ্বারা রামায়ণ ও মহাভারতের অনুবাদ করাইয়াছিলেন । তাহাদের কীর্তি জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত হউক-এই ছিল হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা।
সে কামনা চরিতার্থ হইয়াছে । আজ ৪৫০ বৎসর পরে তাহাদের মাতৃভাষার গৌরবের সঙ্গে প্রজারঞ্জক এই রাজাদের কাহিনী দেশবিশ্রুত হইয়াছে । পরাগল খাঁর পিতা রাস্তি খানের সমাধি এখনও পরাগলপুরে বিরাজিত । ঐ পল্লীতে বিশাল পরাগলী দীঘি এখনও সেই মহামান্য লস্কর খানের স্মৃতি বহন করিয়া তরঙ্গায়িত হইতেছে ৷
হুসেন শাহ এবং অপরাপর মুসলমান সম্রাটেরা দেশীয় ভাষায় কতটা অনূরাগী ছিলেন, তাহার প্রমাণ প্রাচীন বঙ্গ-সাহিত্যের অনেক স্থানেই পাওয়া যায় । কবি বিদ্যাপতি লিখিয়াছেন,
“সে যে নসিরা শাহজাদা যারে হানিল মদন বানে
চিরঞ্জীবী রহ প্রভু গৌড়েশ্বর; করি বিদ্যাপতি ভনে ।”
অন্যত্র, “প্রভু গায়েশ উদ্দীন সুলতান।”
পঞ্চদশ শতাব্দীতে যখন কবি বিজয় গুপ্ত তাহার মনসাদেবীর ভাষান গান রচনা করেন, তখন গৌড়ের তখতে হুসেন শাহ সমাসীন ছিলেন । কবি অতি সশ্রদ্ধভাবে তাহার উল্লেখ করিয়াছেন, “সনাতন হুসেন শাহ নৃপতি তিলক।” কবি যশোরজ খান হুসেন শাহ সম্বন্ধে লিখিয়াছেন,
“শাহ হুসেন, জগত ভুষণ, সেই রস জানে
গৌড়েশ্বর, ভোগ পুরন্দর যশোরাজ খানে ।”
কৃত্তিবাস রামায়ণের আদি অনুবাদ সংকলন কর্তা।তিনিও কোন গৌড়েশ্বরের আদেশে রামায়ণের বঙ্গানুবাদ রচনায় হস্তক্ষেপ করেন । দুঃখের বিষয়, কবি যদিও রাজসভার একটি আলেখ্য দিয়াছেন, অনেক সচিব ও মন্ত্রীর নাম করিয়াছেন, তথাপি গৌড়েশ্বরের নামটি দেন নাই। ইহা কিছু আশ্চর্যের কথা নহে ৷ যেহেতু এখন কোন সভাসমিতি বা রাজকার্য উপলক্ষে উপস্থিত রাজপুরুষগণের নাম দেওয়া হয়, কিন্তু বড়লাট অথবা ছোটলাটকে কেবল ভাইসরয় কি গবর্ণর নামে উল্লেখ করিবার পদ্ধতি দৃষ্ট হইয়া থাকে । তখন যিনি সর্বজন পরিচিত ছিলেন, এখন তাহার পরিচয়ের দরকার হইয়াছে ৷ সেই সভা মুসলমান প্রভাবান্বিত ছিল-কেদার খাঁ প্রভৃতি নামের পশ্চাতে খাঁ উপাধি দৃষ্টে তাহাই প্রমাণিত হইয়াছে ৷
বঙ্গের ইতিহাসে সেই যুগে একমাত্র রাজা গণেশ ক্ষণকের বিদ্যুৎচমকের ন্যায় হিন্দুশক্তির স্ফূরণ দেখাইয়াছিলেন এবং তারপর মুসলমানগণের হস্তে পুনরায় রাজদণ্ড আসিয়া পড়িয়াছিল । গণেশের পুত্র যদু জালালউদ্দিন নাম গ্রহণ করিয়া মুসলমান ধর্ম অবলম্বনপূর্বক হিন্দু সিংহাসনে তাহার দাবী রক্ষা করিয়াছিলেন ৷
রাজা গণেশ স্বয়ং হিন্দু হইলেও তাহার উপর মুসলমান প্রভাব এত বেশী হইয়াছিল যে, তিনি মুসলমানদিগের বিশেষ সাহায্য পাইয়া রাজতখত অধিকার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন ।
সন-তারিখের সূক্ষ আলোচনা করিলে মনে হয়, এই গণেশ রাজাই কৃত্তিবাসকে রামায়ণের অনুবাদ সংকলনের আদেশ প্রদান করিয়াছিলেন ৷
তৎপূর্ববর্তী গৌড়ের মুসলমান সম্রাটগণ হয়ত হিন্দু পণ্ডিত দ্বারা সংস্কৃত পুরাণের বঙ্গানুবাদ সংকলনের প্রথা প্রচলন করিয়াছিলেন মাত্র; তাহার একটি প্রমাণ এই যে, গৌড়ের শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ ১৩১৫ শকাব্দে (১৩৭৩ খৃ.) মালাধর বসুকে “গুণরাজ খাঁ” উপাধি দিয়া তাহার দ্বারা ভাগবতের দশম ও একাদশ স্কন্দের অনুবাদ করিয়াছিলেন । মালাধর বসু কুলীন গ্ৰামবাসী বিখ্যাত বসুবংশীয় এবং কৃত্তিবাসের প্রায় সমসাময়িক করি । পরপর অনেক মুসলমান সম্রাটের সঙ্গে বঙ্গীয় পুরাণানুবাদকের নাম গ্রথিত দেখা যায় । সুতরাং আমাদের নিঃসন্দেহভাবে এই ধারণা বদ্ধমূল হইয়াছে যে, গৌড়েশ্বরগণের সহায়তা না পাইলে বঙ্গভাষা মাথা উঁচু করিয়া সুধী সমাজে দাঁড়াইতে পারিত না, মাথা হেঁট করিয়া পল্লীর এক কোণে চির উপেক্ষিতা হইয়া পড়িয়া থাকিত।
এই সকল পুস্তক যে বাঙ্গলা ভাষায় বিরচিত হইতেছিল, ব্রাহ্মণগণ উহা কিরূপ চক্ষে দেখিতেন, তাহা তাহাদের রচিত কয়েকটি সংস্কৃত শ্লোক ও বাঙ্গলা প্রবাদ বাক্য হইতে পরিষ্কারভাবে জানা যায় । “অষ্টাদশ পুরাণমণি রামস্য চরিতানিচ ৷ ভাষায়াং মানবং শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ” অর্থাৎ অষ্টাদশ পুরাণ ও রামায়ণ যাহারা বাঙ্গলা ভাষায় শ্রবণ করিবে, তাহারা রৌরব নামক নরকে গমন করিবে ।
ব্যক্তিগতভাবে কৃত্তিবাস ও কালীদাস এই কুকার্য করিয়াছিলেন বলিয়া তাহারা ব্রাহ্মণের ক্রোধবহ্নি হইতে নিষ্কৃতি পান নাই । আশ্চর্যের বিষয় এই যে, কায়স্থকুলোদ্ভব কাশীদাস তাহার মহাভারতের প্রতি পত্রে ব্রাহ্মণদের এত স্তব-স্তৃতি করিয়াও তাহাদের অভিশাপ হইতে অব্যাহতি পান নাই । তিনি তো ভনিতায় “মস্তকে রাখিয়া ব্রাহ্মণের পদরাজ্য:” প্রতি পৃষ্ঠায় লিখিয়া তাহাদের মনস্তুষ্টি করিতে চেষ্টা পাইয়াছিলেন । কিন্তু তথাপি ব্রাহ্মণ রচিত এই প্রবাদ বাক্য-“কৃত্তিবেশে কাশীদেশে আর বামুন ঘেঁষে এই তিন সর্বনেশে” (কৃত্তিবাস, কাশীদাস এবং যাহারা বামুনদের সঙ্গে ঘেঁষিয়া সমান হইতে চায়- এই তিন সর্বনেশে) এখনও স্মরণীয় হইয়া আছে ।
এহেন প্রতিকূল ব্রাহ্মণ সমাজ কি হিন্দু রাজত্ব থাকিলে বাঙ্গলা ভাষাকে রাজসভার সদর দরজায় ঢুকিতে দিতেন? সুতরাং এ কথা মুক্তকঠে বলা যাইতে পারে যে, মুসলমান সম্রাটেরা বাঙ্গলা ভাষাকে রাজ দরবারে স্থান দিয়া ইহাকে ভদ্র সাহিত্যের উপযোগী করিয়া নূতনভাবে সৃষ্টি করিয়াছিলেন ।
আরাকান রাজের প্রধান সচিব মুসলমানধর্মী ছিলেন, কিন্তু তাহার নাম ছিল মাগন ঠাকুর । ১৬২৬-২৭ খৃ: অব্দে মাগন ঠাকুর সৈয়দ আলওয়াল নামক কবিকে মালিক মোহাম্মদ রচিত পদ্মাবৎ নামক হিন্দী কাব্যের বাঙ্গলা তরজমা করিতে নিযুক্ত করেন । বাঙ্গলা পদ্মবৎ গ্রন্থের উল্লেখ আমরা পুনরায় করিব ৷ দৌলত কাজী নামক এক করি “লোর চন্দ্রানি” নামক কাব্য রাজানুগ্রহে রচনা করেন ।
মুসলমান রাজ-রাজারা যে রীতি প্রবর্তন করেন, তাহা ব্রাহ্মণগণের নিষেধ-বিধি ও উপেক্ষা অগ্রাহ্য করিয়া প্রচলিত হইয়াছিল; শাহানশাহ বাদশাহগণ যাহা করিলেন, ছোট ছোট হিন্দু রাজন্যবর্গ তাহার অনুকরণ করিতে লাগিলেন ৷ এইভাবে বঙ্গভাষা ক্ষুদ্র-বৃহত রাজসভায় প্রতিষ্ঠা পাইয়া বিজয়ী হইল ৷ ব্রাহ্মণগণই স্বয়ং রৌরব নরকের ভয় অতিক্রম করিয়া শাস্ত্রগ্রন্থের বঙ্গানুবাদ প্রণয়নে তৎপর হইলেন।আমরা ষোড়শ শতাব্দীর কবি ষষ্ঠিবরকে জগদানন্দ নামক মুরুব্বীর আদেশে মহাভারতের অংশবিশেষের অনুবাদ করিতে দেখিতে পাই ৷ এই ব্যক্তি সম্ভবতঃ কোন জমিদার বা প্রসিদ্ধ ব্যক্তি ছিলেন ।
লেখক শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯) একজন শিক্ষাবিদ, গবেষক, লোক-সাহিত্যবিশারদ, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার।
[সংগৃহীতঃ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলিম অবদান, মোশাররফ হোসেন খান (সম্পাদিত),বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা, ১৯৯৮, পৃষ্ঠাঃ ১৮-২২]
·
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা
· পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক সেনাহত্যার ইতিহাস
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা সমূহ:
·
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঙ্গালী গণহত্যা
· পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক সেনাহত্যার ইতিহাস
[লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে? তাহলে দয়াকরে গবেষণামূলক ও ইতিহাস
ভিত্তিক এই সাইটটি চালিয়ে যেতে সাহায্য করুন। পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার বঞ্চিত
বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী সাইটটি পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার কতৃক চরমভাবে অবহেলিত ও
সুবিধা বঞ্চিত, পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ঠ এনজিও সমূহের একচোখা নীতি, সন্তু লারমা ও
প্রসীত খীসাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম
জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) 'এর নিপিড়িত, নির্যাতিত ও বর্বরতম সন্ত্রাসের নির্মম ও অসহায়
শিকার - পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠির সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে
ক্ষুদ্রতম এক প্রয়াস]